সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -১২+১৩

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১২

ঘরে ঢুকে মেজো চাচিকে দেখে,এবার ভেতরে চাপিয়ে রাখা আমার কষ্টটা যেন কয়েক গুন বেড়ে গেলো। আমি চাচিকে কোন রকমে এরিয়ে তোয়ালেটা বেলকনিতে শুকানোর জন্য দিয়ে আসতে গেলাম। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারিনি! তাঁর আগেই চাচি আমার হাত ধরে ফেললেন। বরাবরই যে হাতটা ধরে এবারও সেই হাতটাই ধরলেন। আমার এবার কষ্টে ভরা বুকটা ধক করে উঠলো। আমি কোনমতে মাথা নিচু করে বললাম।

_ হঠাৎ আমার ঘরে কি মনে করে চাচি? আর আমার হাতটা ছেড়ে কথা বলুন।

_ কি শপিং করে এলি আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে, সেটাই দেখতে আসলাম।

_ সব শপিং ব্যাগ আপুর ঘরে সেখানে গিয়ে দেখুন।

_ সে না-হয় দেখলাম,আগে তোকে দেখি।

_ আমাকে দেখার মতো কিছু নেই। না আমার রূপ বেড়ে গেছে, না আমার কমতি দু’টো আঙুল গজিয়েছে।

_ বাহ্ মেয়ের মুখে দেখি বুলি ফুটেছে।

_ আর কতদিন ই বা চুপ থাকবো।

_ তাই নাকি? বাহ্ বাহ্ মেয়ে দেখি আস্তে আস্তে সাহসী হয়ে উঠছে। বেস অসুবিধা নেই! এখন থেকে আমার হাতের জোরটা না-হয় বাড়িয়ে দিবো।

এই কথাটা বলেই চাচি আমার হাতটা মুচড়ে ধরলো। ভেতরে চাপিয়ে রাখা কষ্ট, নিজের সুপ্ত অনুভূতি গুলো মাটি চাপা দেওয়া আর চাচির এমন অত্যাচার আমার যেন আর সহ্য হলো না। আমি জোরে চাচির হাত ঝাকি দিলাম। চাচির হাত থেকে আমার হাত সরিয়ে নিলাম। আঙুল উঁচু করে হিসহিসিয়ে বললাম–

_ ভালো আছি,ভালো থাকতে দিন। খারাপ হতে জোর করবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে।আর একদিনও যদি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন! আমি ভুলে যাবো আপনি আমার সম্পর্কে কি হন? আর হ্যা মনে রাখবেন, আপনার ছেলে আমার পিছনে ঘোরে আমি না। তাই নিজের ছেলেকে সামলান,অন্যের মেয়েকে নয়। চুপ থাকি বলে যে সব সময় চুপ থাকবো এমনও নয়। আমি আপনার ছেলেকে বারন করেছিলাম আমার সাথে যেতে! সে যদি বেহায়ার মতো আমার পিছনে পিছনে যায়! আমি কি করবো। আমার ভেতরে আবার প্রচুর মায়া দয়া, তাই আর আপনার ছেলেকে তাড়িয়ে দেইনি। কারণ তাঁর মা যতোটা খারাপ, সে ততোটাই ভালো। এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে আপনি বেরিয়ে যাবেন। নাহলে আমি আব্বু আর আম্মুকে সবটা বলে দিবো। আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কিন্তু সাক্ষীও আছে। তাই যেচেই নিজের ক্ষতি করবেন না। এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যান।

একদমে কথাগুলো শেষ করলাম। তোয়ালেটা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলাম। বেলকনির এককোনায় বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। চাচি কেন আমায় অপছন্দ করে? আমি তাঁর কি ক্ষতি করেছি? কেন সবাই আমায় ভালোবাসে না? আমার মাঝে খারাপ কি এমন আছে? ওরা সবাই কেন এতো অবহেলা করে আমায়। এতো অবহেলা যে আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।হঠাৎ প্রচন্ড বুকে ব্যথা শুরু হলো,আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো! আমি মুখ হা করে শ্বাস নিতে রইলাম। না কাজ হলো না,আস্তে আস্তে আমার দম যেন ক্রমশ বন্ধ হয়ে এলো। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে! হ্যা, আল্লাহ ইনহেলার, সেটা তো ঘরে এবার। আমার যে শক্তিও নেই ঘরে গিয়ে ইনহেলার নিয়ে মুখে স্প্রে করার। আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম,কারণ প্যানিক করা শুরু করলে মস্তিষ্ক এমার্জেন্সি জারি করে দেয়। তখন আরও বাড়তে থাকবে আমার শ্বাসকষ্ট।
আমি যথাক্রমে শান্ত থাকার চেষ্টা চালালাম। বেলকনিতে থাকা ফুলদানিতে লাথি দিলাম,যেন সেটা ভাঙার শব্দে কেউ আমার ঘরে আসে। কিন্তু সেই শক্তিটুকুও আমি সঞ্চয় করতে পারলাম না। আমি দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, উঁহু কাজ হলো না। আমি পড়ে গেলাম।
অবশেষে আমি ওখানেই নেতিয়ে পড়লাম। আমি কষ্টের জন্য চোখখুলে তাকাতে পারছিলাম না,কিন্তু আমার সেন্স ছিলো কিছুটা। হঠাৎ আমার ঘরে কারো উপস্থিত টের পেলাম। কেউ আমাকে ডাকছে, কিন্তু কে ডাকছে সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমি নিজের সকল শক্তি দিয়ে ফুলদানিতে লাথি দিলাম,কিন্তু এবারও কাজ হলো না। আমি আবারও চেষ্টা করলাম,কিন্তু ফলাফল শূন্য। খুব অসহায় লাগছিলো নিজেকে! অবশেষে আমি আবারও নেতিয়ে পড়লাম। হঠাৎ চোখ বুজতে বুজতে দেখলাম, আমার দিকে কেউ ছুটে আসছে! কিন্তু কে জানি না,সবটাই আমার কাছে ঝাপসা। অবশেষে ঝাপসা চোখটা অন্ধকারে পরিনত হলো।৷

_ নদী, নদী, এই নদী কথা বল। কি হয়েছে তোর। কথা বল,দেখ আমি বর্ণ। আমি–। কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোর। আল্লাহ আমি কি করবো এবার। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না। কথা বল। জান আমার কথা বল। ও আল্লাহ আমি কি করবো। আমার নদী। নদী কি হয়েছে তোর। নদী, নদী, নদী এই নদী। কথা বল প্লিজ। দেখ আমি,আমি তোর সামনে৷ আর রাগ করবো না,তবুও তুই কথা বল। নদী

দিশেহারা হয়ে কোলে তুলে নিলো বর্ণ নদীকে। আর নেতিয়ে কোলের মাঝে পড়ে আছে নদী। ড্রইংরুমে বসে সবাই মিমের জন্য আনা পোষাক দেখছিলো। হঠাৎ করেই বর্ণের কোলে নদীকে নিয়ে ওভাবে ছুটে আসতে দেখে সবার মুখে ভয় স্পষ্ট। সবাই ছুটে এলো বর্ণের দিকে। মেয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে মান্নান সাহেব যেন পাগল হয়ে গেলেন।

_ বর্ণ কি হয়েছে আমার মেয়ের,নদী ও মা নদী কি হয়েছে তোর। সোনা মা আমার, কি হয়ে তোর, ওরে সাগর ডাক্তারকে ফোন কর। আমার মেয়ে, আমার জান পাখিটার কি হলো। ঝর্ণা ইনহেলার নিয়ে আয়। ওর শ্বাসকষ্ট উঠেছে। তাড়াতাড়ি যা। বর্ণ ওকে এখানে শুয়ে দাও। জিভ, নখ বা আঙুল নীল হয়ে আসছে কিনা দেখো তো তাড়াতাড়ি।

এই কথা বলেই সোফায় বসে পড়লো মান্নান। মান্নান সাহেবের কোলে নদীর মাথাটা দিয়ে সোফায় শুয়ে দিলো বর্ণ। নদীর জিভ,নখ,আঙুল চেক করলো। না এখনো নিল হয়ে পারেনি। তার মানে এখনি কিছু করতে হবে। ঝর্ণা ছুটে গিয়ে ইনহেলার নিয়ে এলো। বর্ণ ঝর্ণার হাত থেকে কেঁড়ে নিয়ে নদীর মুখে স্প্রে করলো! কিন্তু নদীর কোন রেসপন্স পাওয়া গেলো না। সাগর ডাক্তারকে ফোন করে পেলো না। সবার চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। মেয়েকে বারকয়েক ঝাকালো মান্নান সাহেব। কিন্তু মেয়ের কোন স্বাড়া পাওয়া গেলো না। চঞ্চল মেয়েটা এমন ভাবে নেতিয়ে আছে,যে কারোরই মাথা ঠিক নেই। হঠাৎ মোহন বললো।

_ আব্বু মোড়ের ফার্মেসী থেকে নরুল আঙ্কেল কে নিয়ে আসবো?

_ যাবি কখন, আমার মেয়েটা মরে গেলে। ওরে তোরা কিছু কর। ওরে আমার মেয়ে।

কথাটা বলেই মান্নান সাহেব নিজেই যেন ঢলে পড়ছেন,মান্নান সাহেবকে সরিয়ে বর্ণ নদীর মাথাটা নিজের কোলের উপর নিলো। মান্নান সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লো,মেয়ের অবস্থা দেখে। বাড়ির সবারি মাথা কাজ করছে না। কি থেকে কি করবে তাঁরা যেন বুঝতেই পারছে না। কথায় আছে বিপদের সময় সবার মাথায় কাজ করে না। প্রায় দশমিনিট পর মোহন ছুটতে ছুটতে এলো নরুল সাহেবকে নিয়ে। তিনি নদীকে দেখে, একটা ঘুমের ইনজেকশন পুস করলেন। তারপর বললো।

_ ওকে ঘরে নিয়ে যান,আল্লাহর রহমতে একটু পরেই ওর জ্ঞান ফিরে আসবে। আল্লাহ চাইলে আর কোন সমস্যা হবে না। আপনার মেয়ে অনেক স্ট্রং। দেখে মনে হচ্ছে নিজেকে অনেক শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে। যদি প্যানিক শুরু করতো,তাহলে খারাপ কিছু হতে সময় নিতো না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আমি গেলাম মান্নান ভাই।

নুরুল সাহেব চলে গেলেন। বর্ণ নদীকে কোলে করে আবারও নদীর ঘরে ফিরে গেলো। বর্ণর পিছনে পিছনে, ঝর্ণা,মোহন,নয়ন,সাগর, মিম,রোকেয়া বেগমও গেলেন। সেলিনা বেগম পারভীন আর নদীর মা থেকে গেলেন মান্নান সাহেবের কাছে। তিনও মেয়ের করুন অবস্থা দেখে নাজেহাল অবস্থায় পরে রইলেন। তাঁকে ধরে নিয়ে গেলেন ঘরে। ওদিকে নদীকে বর্ণ বিছানায় শুয়ে দিতেই, ওর গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিলো ঝর্ণা। সবার চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। ঝর্ণা খুব ভয় পেয়েছে, এরকম অবস্থা আরো একবার হয়েছিল! তখন নদী মাত্র পাঁচ বছরের বাচ্চা ছিলো। আরো ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল তখন নদীর। এতোটা খারাপ অবস্থা হয়েছিলো যে,ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিলো। হঠাৎ ঝর্ণা ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঝর্ণার কান্নার শব্দে সবাই ওর দিকে তাকালো। মিম জড়িয়ে নিলো ঝর্ণাকে। মোহনও প্রায় কেঁদে দিবে দিবে অবস্থা। মোহনকে সাগর আর নয়ন ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

_ মিম ঝর্ণাকে নিয়ে বাহিরে যা,নদীর জ্ঞান ফিরলে আমি ডাকবো। এখন এখানে শব্দ করার দরকার নেই। আমি আর বড় ফুপি আছি।

বর্ণের কথা মতো ওরা বেরিয়ে গেলো। ঘরে এখন রোকেয়া বেগম আর বর্ণ। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর, রোকেয়া বেগম বর্ণকে বললো–

_ তুই বসে থাকিস একটু ওর পাশে,আমি শুকরিয়ার দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আসি। কতোবড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেলো মেয়েটা।

_ আচ্ছা ফুপি

রোকেয়া বেগম চলে গেলেন। বর্ণ একা রইলো ঘরে। নদীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে রইলো বর্ণ। বাম হাতটা নিজের হাতের মুষ্টির মধ্যে নিলো। একটা শুকনো, দুঃখ মাখা চুমু খেলো সেই হাতে।

_ এভাবে ভয় দেখালি কেন? আর একটু হলে তো আমি নিজেই মরে যেতাম। একটু রাগ করার ফলাফল যদি এভাবে তোকে হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হয়! তাহলে সেই রাগের গুল্লি**মারি। তোকে আমি কখনোই হারাতে পারবো না। খুব তাড়াতাড়ি আমার মনে কথা তোকে বলে দিবো। তোকে রাজি করানোর পরই পরিবারের সবাইকে আমার মনের কথা বলে দিবো। তোকে হারালে যে আমি নিশ্ব হয়ে যাবো,তাই এই কয়েক মুহূর্তে বুঝে গেছি। শুধু তুই একবার বল,তুই আমার! তাহলে দেখ পুরো পৃথিবীর সাথে আমি যুদ্ধ করতে রাজি। শুধু তুই আমার হবি,শুধুই আমার। তোকে যে আমার গল্পের সমাপ্তিতে নয়, শুরু থেকে সমাপ্তিতে চাই। তুই একবার বল শুধু। দেখ সবাইকে পেছনে ফেলে আমি শুধু তোকে নিয়েই ভাববো।

কথা শেষ করেই খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বর্ণ। তাঁকে যে মনের সবটা বলতেই হবে নদীকে। অনেক দেরি হ’য়ে গেছে, আর দেরি করলে চলবে না। এবার তাঁর আমানত তাঁকে বুঝে নিতে হবে।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,

কিছু তো বলে যান। সবাই নেক্সট লিখে ক্লান্ত হয় না,কিন্তু আমি দেখে দেখে ক্লান্ত।#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৩

বুকটা খুব ভারি লাগছে। চোখের পাতাটা কোন মতেই খুলতে পারছি না। চোখ বন্ধ অবস্থায় আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে করলাম। মনে পড়তেই বুকটা আরো ভার হয়ে এলো। পিটপিট করে চোখের পাতাটা খুলে চারিদিকে তাকালাম। সময় নিয়ে বুঝতে পারলাম আমি আমার ঘরে আছি। চোখ ঘুরিয়ে আমার বাম পাশে তাকাতেই দেখলাম বর্ণ ভাইয়া আমায় দেখছে। তাঁর চোখের পাতা নড়ছেই না। সে আমায় দেখতে এতোটাই মগ্ন যে আমি চোখ খুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি সেটা সে খেয়ালই করেনি। আমার বাম হাতটা তাঁর মুষ্টিতে আঁটকে আছে। আমি হাতটা টান দিতেই তাঁর খেয়াল ফিরলো। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই পাগলের মতো আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।

_ আল্লাহর অশেষ রহমতে তোর জ্ঞান ফিরেছে তবে। আল্লাহর কাছে লক্ষ লক্ষ শুকরিয়া। তুই তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিস। এই পিচ্চি এভাবে কাউকে ভয় দেখায়। একটু হলে তো আমার জান যায় যায় অবস্থা। তুই জানিস তোকে ওভাবে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে আমার কি হয়েছিলো! মনে হয়েছে আমারও জান পাখিটা হাতে চলে এসেছে, যখন তখন ফুঁসস।

যতোটা বুঝলাম,তখন আমার ঘরে বর্ণ ভাইয়া এসেছিলো। তিনি আমায় আঁকড়ে রেখেছে বুকের ভেতরে। আমার হার্টবিট বাজনা বাজাচ্ছে তাঁর ওই জড়িয়ে নেওয়ার ফলে। মনে হচ্ছে আমার আবারও দম বন্ধ হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। এভাবে বর্ণ ভাইয়া আমায় কখনোই জড়িয়ে ধরেনি। তাঁর হাত ধরা অব্ধি সীমাবদ্ধতা ছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁর সিমা তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। তাঁর মানে সে নিজের মনের কথা আমায় যখন তখন বলে দিতে পারে।
তাঁকে যদি আমি এখনই না সামলে রাখি তাহলে হিতে বিপরীত কিছু হতে পারে। আমি জানি অনেকেই ভাববে আমি নেকামি করে তাঁকে সরিয়ে রাখছি। কিন্তু যে সম্পর্ক সামনে কোন ভবিষ্যত এনে দিতে পারবে না,তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। মায়া বারানোর কি দরকার মরীচিকা নামের সম্পর্কের সাথে। কারণ বিয়ে বা ভালোবাসার সম্পর্কে শুধু দু’টো মানুষ জড়িয়ে থাকে না ! তাঁদের সাথে দু’টো পরিবারও জড়িয়ে থাকে। আমার জন্য সেই দু’টো পরিবারের মাঝে কোন ভাঙনের সৃষ্টি হোক তা আমি চাই না। আর আমি তো নিজের অনুভূতি লুকাতে শিখে গেছি। সেখানে আমি ভুল করা মানে, নিজের সাথে সাথে পরিবারের ক্ষতি করা। তাই আমি বর্ণ ভাইয়াকে বললাম–

_ আমার কষ্ট হচ্ছে বর্ণ ভাই আমাকে ছারুন।

আমার কথায় বর্ণ ভাইয়ের হুঁশ এলো। সে বুঝতে পারলেন আসলে কি করছিলেন এতোক্ষণ তিনি। আমি সেদিকে পাত্তা দিলাম না।

_ বাড়ির বাকিরা কোথায়,আপনি কেন আমার রুমে?

আমার কথাট হয়তো বর্ণ ভাই প্রথমে বুঝতে পারেননি। তাই কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যখন বুঝলেন তখন উত্তর দিলেন।

_ চাচ্চুর প্রেশার বেড়ে গেছে, ডাক্তার এসেছে তাকে দেখতে! সবাই সেখানেই। অবশ্য ডাক্তার তোকেও দেখে গেছে।

_ আব্বু অসুস্থ আর আপনি আমায় এখন বলছেন।

আমি দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতেই বর্ণ ভাই আমার হাত আঁকড়ে ধরলো।

_ কি করছেন,আমার হাত ছারুন।

_ তুই পড়ে যেতে পারিস। শরীর অনেক দুর্বল তোর,হুট করে মাথা ঘুরে যেতে পারে। চল আমি নিয়ে যাচ্ছি।

_ কোন দরকার নেই,আমি যেতে পারবো। আমি গল্পের নাইকা নই,যে একটু হাঁটতে নিলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবো,আর আপনি ধরে নিবেন।

_ এভাবে বলছিস কেন?

_ কেন ভালোভাবে বলে ফেলেছি,আমার কি আরো একটু খারাপ ভাবে বলা উচিত?

আমি বর্ণ ভাইকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। সোজা আব্বুর ঘরে চলে গেলাম। আব্বুর ঘরে সবাই বসে আছে। আব্বু চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি সোজাসুজি আব্বুর পাশে গিয়ে আব্বুর বুকে মাথা রাখলাম। সাথে সাথেই আব্বু আমার মাথায় হাত রেখে উঠে বসলেন আমায় নিয়ে।

_ আমার সোনা মায়ের জ্ঞান ফিরেছে তবে।

_ ফিরেছে তো? কিন্তু তোমার সোনা মা’টার তাঁর বাবাকে এভাবে দেখতে একদম পছন্দ করছে না।

_ আমি একদম ঠিক আছি। একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছি আমার সোনা মা’কে ওভাবে দেখে। আমার সোনা মা সুস্থ হয়ে গেছে, আমিও সুস্থ হয়ে গেছি।

_ এটা মিথ্যা কথা। তুমি এভাবে কেন অস্থির হয়ে পড়ো আমি অসুস্থ হলে। যদি আমি কখনো মরে যা-ই তখন।

_ নাহহ, এভাবে বলে না মা। তোদের আগে যেন আমাকে মহান রাব্বুল আলামিন নিয়ে যায়। আমি বেঁচে থাকতে তোদের কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো।

_ আচ্ছা ঠিক আছে,আর বলবো না। এখন বলো শরীর কেমন?

_ আলহামদুলিল্লাহ

_ ভাইজান মেয়ের অসুস্থতা আপনাকে এভাবে ভেঙে দেয়,সেখানে ওতোদূরে মেয়ে বিয়ে দিয়ে থাকবেন কি করে?

আমাদের কথার মাঝেই সেজো চাচ্চু কথাটা আব্বুকে বললেন। আব্বু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছারলো,কিন্তু কিছু বললো না। কিন্তু আব্বুর পাশে বসে বর্ণ ভাইয়া হঠাৎ বলে উঠলো–

_ আব্বু এই জন্যই তো আমি চাচ্চুকে বলেছি,ওই ছেলে বাদ দিয়ে আশেপাশের কোন চেনা-জানা ভালো ছেলের সাথে নদীর বিয়ে দিতে। ঘরের মেয়ে ঘরে থাকবে,যখন তখন দেখাও হবে খবরও পাওয়া হবে।

_ কিন্তু এমন ছেলে কোথায় পাবো,তোর জানামতে কোন ছেলে আছে বর্ণ।

_ বোঝো ঠেলা। আমি জলজ্যান্ত একটা ছেলে সামনে আছি,আর তিনি ছেলে খুঁজছে। কেন আমি কি দেখতে খুব খারাপ, নাকি তাঁর মেয়েকে ভালো রাখতে পারবো না। এই জন্যই বলে ঘরের দুয়ারের ঘাস গরুতে খায় না। হায়রে পোড়া কপাল তোর বর্ণ,নাম তাঁর ভাত,তবুও বলে অন্ন। (মনে মনে)

না চাচা তেমন কেউ নেই,আপনি যদি বলেন খুঁজে দেখতে পারি।

_ কোন দরকার নেই,আমি শাওনের সাথে কথা বলেছি,উনি আর বিদেশে যাবেন না। এখানেই একটা চাকরি খুঁজে নিবে। আমি তো আমার আব্বুকে চিনি। সে আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না,তা ভালো করেই আমি জানি। আমি নিজেও আব্বুকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তাই এই বিষয়ে কারো কোন চিন্তা করার দরকার নেই।

মেয়ের মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন মান্নান সাহেব। আর মুখটা চুপসে মাথা নিচু করলো বর্ণ। কিছুটা কায়দা করে সবাইকে লাইনে এনেছিলো! কিন্তু ঠিক ব্যগরা দিয়ে দিয়েছে নদী। এই জন্য ওর নাম নদী। কখনোই সোজা পথে চলতে পারে না,যতো অলিগলি আর চিপা চাপা আছে ওখানে ওকে ঢুকতেই হবে। কেন রে? না ঢুকলে কী তোর হবু বরের গর্দান যাবে।

_ কিরে বর্ণ তুই আবার কি ভাবতে শুরু করলি?

হঠাৎ বর্ণ ভাই চাচ্চুর কথায় নড়েচড়ে বসলো। বাবা-র উদ্দেশ্যে কিছু না বলে উঠে গেলো ওখান থেকে। একে একে সবাই নিজেদের কাজে চলে গেলো। বসে রইলেন মান্নান সাহেব আর শাহাজাহান। শাহাজাহান ভাইকে বললেন।

_ ভাইয়া ওই বিষয়ে তো তুমি আর কিছু জানালে না?

_ কোন বিষয়ে?

_ নদীর নামে যে আমার ভাগের চার শতাংশ জমি লিখে দিতে চাইলাম সেই বিষয়ে।

_ তোমায় আমি বলেছি,এটা সম্ভব না। আমার যা আছে আমার সন্তানদের জন্য সেটাই যথেষ্ট। তাঁদের বারতি চাচাদের সম্পত্তির দরকান নেই।

_ ভাইজান আমি ভালোবাসে ওকে দিচ্ছি।

_ শাহাজাহান তুমি এখনো বোকা রয়ে গেলে। পৃথিবীটা স্বার্থে চলে। এখানে বিনা পয়সায় তুমি এক গ্লাস পানিও পাবে না। মনে রেখো আজ তুমি যেটা ভালোবেসে নদীকে দিবে,দেখা যাবে তোমার মৃত্যুর পর সেটা নিয়ে তোমার সন্তানেরা খুনোখুনি করছে।

_ আমার বর্ণ এমনটা করবে আপনি কী করে ভাবলেন?

_ আমি ভাবিনি,পরিস্থিতি আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে। তুমি খবরের কাগজ পড়ো না। যেখানে ছেলে হয়ে বাবাকে খুন করে, সেখানে তোমার ছেলে তো কিছুটা হলেও দূর।

_ ভাইজান ওই সম্পত্তিটুকু আমার নামে। আমি কাকে দিবো না দিবো,সেটা কিন্তু একান্তই আমার ব্যপার।

_ তুমি যদি একা থাকতে তাহলে তোমার একান্ত ব্যপার হতো। কিন্তু তোমার বউ-ছেলেমেয়ে আছে,তাই তাঁদের কথাও তোমার চিন্তা করতে হবে।

_ ভাইজান তাঁদের আমি যথেষ্ট পরিমাণ দিয়েছি৷ আপনি আমাদের মানুষ করতে গিয়ে জীবনে তেমন কিছুই করতে পারেননি। জীবনের শেষ সম্বলটুকু দিয়েও আমাদের সবার থাকার জন্য ঘর তৈরি করেছেন। কই আপনার থেকে বাবার সম্পত্তি আমরা কয় ভাইবোন বেশি পেয়েছি,আমরা তো এমনটা করিনি।

_ তোমারা আমার ছোট,তাই করোনি। কিন্তু আমি বড় তোমাদের! আমার ভালোবাসা, দায়িত্ব অনেক বেশি। আমি প্রজাপতি পিছনে না ছুটে ফুলের চাষ করেছি,তাই প্রজাপতি আমার কাছে আসে। আমি ভালোবাসার ফুলবাগান তৈরি করেছি আমার পরিবার দিয়ে। আর তোমাদের আমাকে করা সম্মান,ভয়, ভালোবাসা হচ্ছে প্রজাপতি! যা কিনা আমার সামনে দাঁড়ালে এমনই চলে আসে তোমাদের । আমার আর কী চাই?

_ ভাইজান আজ বুঝলাম, আব্বা আপনাকে কেন বড় মিয়া বলে ডাকতো। আজ সেই কবিতার স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম। আপনারে বড় বলে বড় সে নয়। লোকে জারে বড় বলে বড় সে হয়। কিন্তু আজ হোক বা কাল,আমি ঠিক নদীর নামে ওই জমিটুকু লিখে দিবো। আমি আপনার বারন শুনবো না।

ভাইয়ের কথায় শুধু মুচকি হাসলো মান্নান সাহেব।

ইনশাআল্লাহ চলবে

একটু বেশি বেশি কমেন্ট করুন,লেখার আগ্রহ বারিয়ে দিন। আমার লিখতে ভালো লাগলে, আপনাদের পড়তে ভালো লাগবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here