সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -১৬+১৭

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৬

রাতের সৌন্দর্যের বিস্তারিত কখনোই মুখে বলে বোঝানো যায় না। শুধু চোখ বুঁজে অনুভব করতে হয়। আর রাতের ওই অন্ধকার আকাশে যদি একটা গোল থালার মতো চাঁদ থাকে,তাহলে তো কোন কথাই নেই। তাহলে সকল সৌন্দর্য ওই রাতের আকাশের কাছে হার মানবে। আমরা সব সময় যাকে এরিয়ে যাই,ঠিক তাঁর সাথেই আমাদের মুখোমুখি হতে হয় বারংবার তাই না নদী। দেখ আমি তোকে কখন কীভাবে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। কিন্তু তুই সবটা জেনেও কেমন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আমাকে এরিয়ে গেছিস সব সময়। আমি কখনোই সুন্দর জিনিসের সৌন্দর্য বিবরণ দিতে পারি না, যেমন তোকে নিয়েও দিতে পারবো না। আসলে কী বল তো? আমি কখনোই তোর প্রেমিক পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমার মনে হয়েছে কারো প্রেমিক পুরুষ হওয়ার থেকে কেয়ারিং স্বামী হওয়া বেশি কঠিন। তাই নিজেকে তৈরি করতে চেয়েছি তোর মনের মতো করে। তারপর তোর সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছি।
নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সরাসরি বড় চাচ্চুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবো এটাই ছিলো আমর মনের ইচ্ছে। কিন্তু হুট করেই চাচ্চু তোর বিয়ে ঠিক করে দিলো। আমি কখনো ভাবতে পারিনি এমন কিছু হতে পারে। কিন্তু হয়ে গেছে। আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন একটা দেখা হয়নি। তুই শেষ কবে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলি তোর মনে আছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার মনে আছে। শেষ আমাদের বাড়িতে যখন গিয়েছিস, তখন তুই ক্লাস নাইনে পড়িস। আর একবারের জন্যও তুই আমাদের বাড়িতে নিজের ছায়া রাখিসনি। কারণটা কখনোই জানতে চাইনি, আজ জানতে চাইছি। কারণটা কি আমি নদী? যদি আমি হয়ে থাকি,তাহলে বলবো– আমি কী খুব খারাপ, যাঁর মুখ দেখলে তোর পাপ হবে? ভালোবাসা প্রকাশিত করে যদি ভালোবাসা আদায় করা যেতো,তাহলে সেই কাজ আমি অনেক আগেই করতাম। শোন নদী আমি তোকে ভালোবাসি। কতটা ভালোবাসি বোঝাতে পারবো না। তুই কী—

_ আমি আপনাকে কখনোই সেই চোখে দেখিনি বর্ণ ভাইয়া।

_ সত্যি।

_ মিথ্যা কেন বলবো?

_ হয়তো কোন কারণ আছে।

_ না নেই

_ তুই যেদিন জন্ম নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছিলি,তখন আমার দশ বছর বয়স। তোকে নিয়ে ফুপি আর চাচ্চুর মাঝে একটা ঝামেলা হয়েছিল। অন্য কেউ কিছু বলার সাহস করতে পারেনি,শুধুমাত্র বড় ফুপি ছাড়া৷ আমি তেমন কিছু বুঝতে পারছিলাম না,কেন তোকে নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে, বাবা বলেন– তোকে নাকি অনেক কষ্ট সহ্য করে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে। তোর কিছু কমতির জন্য তোকে রোজ কথা শুনতে হবে। আমি কি মনে করেই হুট করে চাচির কাছে চলে যা-ই। চাচির কাছে আবদার করি তোকে কোলে নেওয়ার। চাচি আমার আবদার পূরণ করেন। আমি তোর গালটা টেনে দিয়ে চাচিকে বললাম– চাচি ওকে নাকি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে। চাচি আমার কথায় আঁচলে চোখ মুছলেন। আমি চাচিকে বললাম। আমার স্কুলের ম্যাম বলেছেন,নদীর বুকে নাকি অনেক কষ্ট। তাঁকে সবাই ব্যবহার করে,অথচ তাকেই সব থেকে বেশি অবহেলা করে। কিন্তু নদী অনেক ধৈর্যশীল,সে তাঁর নিজের জায়গায় অটল থাকে। আমাদের উচিত নদীর যত্ন নেওয়া। নদীর মতো ধীর গতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়া। তাই আজ থেকে আমরা ওকে নদী বলেই ডাকবো। ওকে যাঁরা কষ্ট দিবে,তাঁরাই ওকে একদিন যত্ন করবে। ও ঠিক বয়ে যাওয়া নদীর মতো ধীর গতিতে সামনে এগিয়ে যাবে। কি চাচি যাবে না। চাচি আমার কথা শুনে আমার কপালে চুমু খেলেন। আর বললেন– তোর কথাই যেন সত্যি হয় বাবা। আস্তে আস্তে আমি বড় হলাম। নদী নামের মর্মতা বুঝতে শিখলাম। কিন্তু কে জানতো সেই কঠিন নদী আমার বেলাতেই সব থেকে বেশি কঠোর হবে। জানলে ঠিক কোন নরম ফুলের নামে নাম রাখতাম। তাতে যদি আমার প্রতি তাঁর দয়া হতো। ভালোবাসা জোর করে আদায় করার বস্তু নয়,যদি হতো তাহলে আমি আদায় করে নিতাম। আমি জানি না, আদোও তুই আমাকে পছন্দ করিস কিনা,বা অন্য কোন কারণে করতে চাচ্ছিস না। যদি অন্য কোন কারণ হয়ে থাকে,তাহলে বলবো সব কারণকে আমি ভেঙে দিয়ে তোকে আপন করতে রাজি,শুধু তুই একবার হ্যা বলে দেখ। কিছুদিন আগেও আমার ভয় ছিলো! কীভাবে তোকে নিজের মনের কথা বলবো। আজ সব বলতে পেরেছি,কিন্তু একবুক হাহাকার আমাকে পেতে হলো তোর থেকে। আমি তোর থেকে এমন কিছু পাবো ভাবিনি। অবশ্য আমরা যা ভাবি,তাঁর উল্টো কিছুই হয় আমাদের সাথে। তাই তোর আমাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু তুই মনে রাখিস,আমি কখনোই চাই না,তুই আমার জীবনের একটা বিশালতা জায়গা জুড়ে শূন্যস্থান হয়ে থাকিস। না পাওয়ার জায়গা জুড়ে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা থাকিস “সে ফুটেছে তবে আমার হয়ে নয়। সে নদী বয়ে গেছে তবে,মিলবার তরে নয়। সে পাখি গেয়েছিলো গান ভাঙা সুরে,তবে শোনা হয়নি মোর। সে শহর জুড়ে বৃষ্টি হয়ে ঝড়েছে তবে, ভিন্ন ছিলো তাঁর বুক। আমি সেই প্রেমিক পুরুষ নই যে পাওনাকড়ির মাঝে শূন্যতা নিয়ে বেঁচে আছে”।

টুপ করেই রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলো এক ফোঁটা চোখের জল। দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো বর্ণ। এক পলক নদীর মুখপানে তাকিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। যতক্ষন বর্ণের ছায়া বিলুপ্ত হলো না,ততো সময় নদী নিরবে বসে রইলো। বর্ণের ছায়া বিলীন হতেই নদী নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলো। তাঁর যে আর নিজেকে সামলে রাখা হলো না। সে মুখের মধ্যে ডানহাতের তালু ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করতে রইলো। কিন্তু সেই চিৎকারে কোন আওয়াজ এলো না,যা এলো তা শুধুই গোঙানির আওয়াজ। ধারালো দাঁতের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো ডান হাতের তালু,কিন্তু সেদিকে কোন খেয়াল নেই নদীর। সে শুধু ভাবতে রইলো বর্ণের বলে যাওয়া প্রতিটা কথার মানে। সে শুধু উপলব্ধি করতে রইলো বর্ণের কষ্ট। নদী চাইলেও বর্ণকে নিজের করে পেতে পারে না। কারণটা সবার জানা। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে সে-ও নিচে নেমে এলো। কোনোদিকে না ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। আর বের হলো না সে। অবশেষে বের হলো মান্নান সাহেবের ডাকে। তা-ও রাতের খাবার খাওয়ার সময়। খাবারে হাত দিতেই হাতটা জ্বলতে শুরু করলো। খেয়াল হলো তখন নিজের কষ্ট সামলে নিতে হাতে কামড় বসিয়েছিলো সেখানেই তরকারির ঝোল লাগতেই জ্বালাপোড়া অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু বাড়ির সকলে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করতে পারে। তাই চুপচাপ সব যন্ত্রণা হজম করে নিলো। হঠাৎ নদী খেয়াল করলো,টেবিলে সকলে থাকলেও বর্ণ নেই। তাহলে কি সে চলে গেছে? কিন্তু আগ বারিয়ে কোন কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারলো না সে। নদীর মনের প্রশ্নটা তাঁর বাবা করলেন।

_ সবাইকে আছে দেখছি, কিন্তু বর্ণ কোথায়?

_ হঠাৎ বললো,কোন একটা দরকারি কাজ পড়েছে! এখনি যেতে হবে। এতটুকু বলেই চলে গেলো। ছেলেটাকে বিচলিত লাগছিলো। আর মুখটায় যেন আঁধার নেমেছে। আল্লাহ জানে কী এমন হলো যে ওভাবে চলে গেছে? দুপুরে তো বললো থাকবে,সন্ধ্যা হতেই কি হলো কি জানি।

স্বামীর প্লেটে তরকারি দিতে দিতে মিনা বেগম উত্তর দিলেন। স্ত্রীর কথায় আর কিছু বললেন না মান্নান সাহেব। খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন তিনি। কিন্তু অন্যদিকে গলায় যেন খাবার আঁটকে গেলো নদীর। মানুষটাকে কোথাও কি বেশি কষ্ট দেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু নদী তো তেমন কিছুই বলেনি। শুধু মোহ সরিয়ে বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছে। তাতে যদি সে বেশি কষ্ট পেয়ে থাকে,তাহলে কি এখানে নদীর অন্যায়। সম্পর্কে শুরু হয়ে যদি শেষ হতো,তখন তো এর থেকেও বেশি কষ্ট পেতো। এখন না-হয় এতোটুকু কষ্ট নিয়েই ভুলে থাকুক তাঁকে।

_ মামনী কি হয়েছে খাচ্ছো না কেন?

হঠাৎ বাবা-র কথায় চমকে উঠলো নদী। মাথাটা এদিক ওদিকে দুলিয়ে কিছু না বোঝালো। কিন্তু মান্নান সাহেব হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছেন,তাই মেয়েকে নিজের কাছে ডাকলেন। নিজের চেয়ার ছেড়ে বাবা-র পাশের চেয়ারে বসলো নদী। যত্ন সহকারে মেয়েকে খাইয়ে দিলেন মান্নান সাহেব। নদীও চুপচাপ খেয়ে গেলো বাবা-র হাতে। এই হাতে কতটা তৃপ্তি আছে,তা শুধু প্রতিটা বাবা-র মেয়েরা জানে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই বাবা-র নিকট প্রশ্ন তুললো।

_ বাবা

_ হুম

_ আমি অন্যায় করেছি,সেটা যদি কখনো জানতে পারো তখন কি তুমি আমায় খুব ঘৃণা করবে।

_ এটা কেমন কথা মা? তুমি আমার সন্তান। সব থেকে আদরের সন্তান। তুমি ভুল করবে,আমাদের উচিত সেই ভুল শুধরে দিয়ে তোমায় ক্ষমা করে দেওয়া,ঘৃণা করা নয়। তুমি যতো বড়োই অন্যায় করো না কেন? শুধু বাবা-র কাছে স্বীকার করো,দেখবে সেই সকল অন্যায় বাবা ম্যাজিক দিয়ে ঠিক করে দিবো।

_ তুমি এতো কেন ভালোবাসো আমায়? এতো বোঝ কেন ?

_ তুমি এখনো বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করো তাই তোমায় এতো বুঝতে হয় আমায়। আমি আর তোমার মা যদি তোমায় না বুঝি,তাহলে কী করে হবে। আর তুমি খুব আদরের সন্তান আমার,তাই তোমায় এতো ভালোবাসি। আর কিছু।

_ উঁহু

বাবাকে জড়িয়ে ধরলো নদী। এই শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলে,পৃথিবীর সকল কষ্ট নিরাময় হবে নিশ্চিত। তাই তো একটু আগের সকল কষ্ট ভুলে নদী পরম শান্তিতে চোখের পাতা বুজলো।

————–

সূর্যের তেজি রশ্মি চোখেমুখে পড়তেই চোখ খুলে তাকালো বর্ণ। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আবারও চোখ বুজলো সে। ভাবতে রইলো কীভাবে নদী তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাস্তবতার দোহাই দিয়ে কীভাবে নিজেকে আড়াল করে নিলো। আচ্ছা নদী কী এটা বুঝলো না! একটা অচেনা অজানা ছেলে যদি সব জেনে ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়,তাহলে ছোট থেকে বর্ণ ওকে চিনেছে জেনেছে ও কেন নদীকে বিয়ে করতে পারবে না। ওই ছেলের বেলায় যদি কোন বাস্তবতা না থেকে থাকে,তাহলে তাঁর বেলায় কেন বাস্তবতা এলো। নাকি বাস্তবতা একটা পর্দা, সত্যিটা হচ্ছে বাস্তবতা একটা অজুহাত। তাহলে কী এখানে কোন গোপনীয়তা আছে, বাস্তবতা কি শুধুমাত্র একটা অজুহাত। যদি সত্যি কোন গোপনীয়তা থেকে থাকে,তাহলে সেটা বর্ণকেই খুঁজে বের করতে হবে। নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পেতে বর্ণকে যতোদূর যেতে হয় যাবে। তবুও যদি কিছু থেকে থাকে,তাহলে তাঁর শেষ দেখবে।
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৭

বর্তমানে দেখছি কখন বাড়ি থেকে বের হও বা কখন আসো বোঝাই যাচ্ছে না। আজকাল কি নিজেকে বাড়ির কর্তা ভাবছো নাকি? কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছো না। আমার বাড়ির কিছু নিয়ম আছে তা হয়তো তুমি ভুলে গেছো। আমার বাড়িতে কিন্তু এসব হবে না। আমি সাবধান করে দিলাম। আর কাল সারাদিন কোথায় ছিলে? আর কোথা থেকেই বা ওতো রাতে বাড়ি ফিরলে?

বিছানা গুছিয়ে নিতে নিতেই কথাগুলো বললো পারভীন। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের চুলগুলো ঠিক করে নিলো বর্ণ। মায়ের কথা তাঁর কান অবধি পৌঁছালেও উত্তর দেওয়ার মতো ইচ্ছে তাঁর বিন্দুমাত্র নেই। এমনই তাঁর মেজাজ তেতে আছে,তারউপর মায়ের এই অহেতুক কথার উত্তর দিয়ে আর মেজাজ বিগড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে কথা এরিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো—-

_ আয়শা স্কুলে গেছে?

ছেলের উত্তরে সন্তুষ্ট নন পারভীন। তাই আবারও প্রশ্ন করলো।

_ আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয়।

মায়ের এমন কঠিন রূপে বর্ণের তেতে যাওয়া মেজাজটা আরো তেতে উঠলো। তাই রাগের বসেই বললো–

_ আমি ক্লাস ট্রু-থ্রি-র বাচ্চা নই,যে তুমি যেটা প্রশ্ন করবে,সেটারি উত্তর দিতে হবে। এমনই আমার মন ভালো না,তারউপর তুমি আজেবাজে প্রশ্ন করে যাচ্ছো। কোথায় গেছি কেন গেছি! আরে বাবা মরতে তো যাইনি। মরতে গেলে নিশ্চয়ই ফিরে আসতাম না।

হঠাৎ ছেলের এমন অগ্নিগিরি হয়ে যাওয়ার বিষেস কোন কারণ খুঁজে পেলো না পারভীন,কিন্তু কিছু একটা পেলো।তাই তিনি ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

_ এতোটা পরিবর্তন তোমার মাঝে,বাহ্ আমি তো নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না। তা এই পরিবর্তনের জন্য কে দায়ী! কার জন্য তুমি তোমার মায়ের মুখে মুখে কথা বলছো?

মায়ের এবারের কথায় বর্ণ যেন আরো রেগে গেলো! মায়ের এই দোষটা কখনোই যাবার নয়,কোন কিছু হলেই অন্য কারো দোষ খোঁজে। আরে দোষ তো আমি করেছি,অন্য কেউ এখানে এলো কোথা থেকে। হাতের ঘড়ি ঠিক করতে করতে মায়ের উদ্দেশ্যে আবারও বললো–

_ অন্যের দোষ খোঁজা এবার একটু বন্ধ করো, বয়স তো কম হলো না?

_ তুমি তোমার বড় চাচ্চুদের বাড়ি গিয়েছিলে বর্ণ?

নিজের কথার পিঠে তার মা এমন একটা কথা বলতে পারে,সেটা বর্ণ ভাবতেও পারেনি। আর তাঁর সাথে তর্ক করার মাঝে বড় চাচ্চুরা কোথা থেকে এলো এটা সে বুঝলো না। তাই মায়ের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে পারভীন কিছু একটা ভেবে নিজের রুমে চলে গেলো। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে বড়-জায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ ফোন বাজতেই ফোন ধরলেন মিনা বেগম।

_ কিরে কি খবর তোর পারভীন? ভালো আছিস।

_ হুম আপা ভালো আছি। তা আপনাদের কি খবর?

_ এই তো আলহামদুলিল্লাহ। শাহাজাহান, আয়শা ভালো আছে ওরা।

_ হুম ভালো আছে। তোমাদের ওইদিকের কি খবর?

_ এই তো সবাই ভালো আছে।

_ আপা,কাল কী বর্ণ তোমাদের ওখানে গিয়েছিলো?

_ হ্যা,দুপুরের দিকে এলো বললো রাতে থাকবে। কিন্তু হঠাৎ সন্ধ্যায় বললো কাজ আছে। এই কথা বলেই চলে গেলো। কেন বাড়িতে যায়নি?

_ এসেছে, ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় ছিলি, বললো না। মা তো তাই টেনশন হয়েছে। এখন নিশ্চিন্ত।

_ আচ্ছা, তা বল কেমন যাচ্ছে দিনকাল।

_ আপা আমার একটু কাজ আছে,পরে কথা বলি।

_ আচ্ছা ঠিক আছে।

পারভীন বেগমের হঠাৎ ফোন দেওয়া আর এসব জিজ্ঞেস করেই ফোন কেটে দেওয়ার তেমন কোন মানে খুঁজে পেলো না মিনা বেগম। তিনি কিছুক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে বসে বসে ভাবতে রইলো! কোন অসুবিধা হয়নি তো ওদের? আর এদিকে তো বাড়ি মাথায় তুলে নিলেন পারভীন বেগম। তাঁর ছেলে তাঁকে না বলে নদীদের বাড়িতে গেছে। ছেলে কি তাহলে তাঁর কন্ট্রোলের বাহিরে চলে যাচ্ছে। রান্না ঘরের কিছু আসবাবপত্র ভাংচুর করলেন তিনি। প্রথমে মায়ের রাগের কারণ খুঁজে পেলো না আয়শা। সে তাঁর মায়ের কান্ড দেখে গেলো শুধু। মা’কে একবার আঁটকাতে নিলেই পারভীন বেগম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।

_ একদম ছুবি না আমায়। তোরা সব বেঈমানের দল। তোর বাবা একজন, যে কিনা সারাজীবন ভাই আর ভাবি করেই জীবন শেষ করে দিলো। এখন ভাইজির প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে নিজের নামের সম্পত্তি তাঁর নামে লিখে দিচ্ছে। তোর ভাই আজকাল না জানিয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে ঘাঁটি মারছে। আর এখানে এসে রাগ দেখাচ্ছে। তোদের চাকর আমি যে সব সময় তোদের কথামতো চলবো। দুই পয়সার দাম তো তোরা কেউ আমাকে দিস না। মাঝে মাঝে আমি ভাবি আসলে আমি এই বাড়ির কর্তী নাকি চাকর।

কথা শেষ করেই আরো একটি প্লেট ছুঁড়ে মারলো পারভীন। আয়শা আসল কারণটা বুঝতে পেরে তাঁর মায়ের এমন কান্ডে এবার আর অবাক হলো না। কারণ তাঁর মা প্রায়শই এমন কাজ করে থাকে। সে বুঝতে পারে না,তাঁর মায়ের এতো রাগ কেন তাঁর ওই সহজ সরল চাচ্চুর পরিবারের উপর। একটু বুঝ হওয়ার পর থেকেই সে দেখছে তাঁর চাচি আর চাচ্চু সবার জন্য কতোটা নিজেদের বিলিয়ে দেয়। না তাঁদের ভালোবাসায় কোন খাদ আছে না কোন স্বার্থ। তবুও তাঁর মায়ের এতো অভিযোগ কেন তাঁদের প্রতি? চাচা চাচির রাগ যে মাঝে মাঝে তার মা নদীর উপরেও ঝাড়ে,সেটাও আয়শা জানে। কিন্তু চেয়েও কাউকে কখনো বলতে পারেনি। যতোই হোক মা তো। কিন্তু দিনকে দিন মা যদি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে না জানি ওই সহজ সরল পরিবারের কতো বড় ক্ষতি করে বসে। আর নদী আপুটাও হয়েছে আরেক নিরবচ্ছিন্ন মানুষ। কারো প্রতি তাঁর কোন অভিযোগ নেই! যা আছে শুধু নিজের উপর। আজ মায়ের এমন রূপ যেন আর ভালো লাগছে না আয়শার,তাই দ্বিতীয়বার আর মা’কে শান্ত করতে এগিয়ে গেলো না। নিজের স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সময় হলে নিজেই ঠান্ডা হয়ে যাবে। আজ বেচারা আমার বাবা-র অবস্থা খারাপ হবে এটা ভেবেই খারাপ লাগছে।

মেয়ে তাঁকে শান্ত করার বদলে চলে যাচ্ছে দেখে,পারভীনের রাগ আরো বেড়ে গেলো। সে এবার চাকু ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। কিন্তু একটু অসাবধানতার জন্য নিজের হাতটাই কেটে গেলো। রাগ আর ব্যথা থেকে সে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। আর সে রূপ হলো নিরব। নিরবতা যে বড়োই ভয়াবহ।

—————

_ আমার অনুমতি ছাড়া এভাবে হুটহাট আর কখনোই ভিডিও কল করবেন না শাওন। আমার ভালো লাগে না,এটা আপনি ভালো করেই জানেন।

_ সেটা না-হয় করবো না। কিন্তু তোমার কি মন খারাপ?

_ কেন?

_ না মনে হচ্ছে।

_ হুম সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, কিছুই পড়া হয়নি। তাই একটু টেনশন করছি।

_ চিন্তা করো না,ফেল করলেও আমি তোমায় বিয়ে করবো।

_ সেটা জানি।

_ কি জানো?

_ এই যে আপনি আমায় বিয়ে করবেন।

_ আমার কোর্স প্রায় কমপ্লিট। খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবো। তোমায় নিয়ে কিছুদিন ঘোরাঘুরি, তারপর সোজা বিয়ে।

_ ভালো

_ ততোদিনে তোমায় কিছুটা চেনাজানাও হবে কি বলো?

_ কাউকে চিনতে হলে তাঁর সাথে ঘোরাঘুরির প্রয়োজন নেই।

_ হ্যা সেটা ঠিক। তবুও বিয়ের আগে একটু জেনে-বুঝে নিলে ক্ষতি কী?আচ্ছা তুমি তোমাদের ওখানের কিছু জায়গার নাম বলো তো যেখানে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে পারবো। হুট করে তোমায় সেখানে নিয়ে যাবো না জানিয়ে, তুমি খুশি হবে।

_ আমার তেমন কোন পছন্দের জায়গার নাম জানা নেই।

_ এটা কেমন কথা। নিজেদের খুলনা সমোন্ধে কিছু জানো না। তুমি কী জানো তোমাদের ওখানে একজন কবির বাড়ি আছে।

_ আপনার কী মনে হয়?

_ মনে হচ্ছে জানো না।

_ এখন কি আমাকে প্রমাণ করতে হবে আমি জানি কিনা?

_ হুম করো প্রমাণ, দেখি তুমি তোমার খুলনা সমোন্ধে কতোটা জানো। শুধু কবির নামটা বলো,বাকিটা নাহয় আমি বলবো।

_ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার সেনহাটি ইউনিয়নের সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত স্থান এবং ব্যবহার্য জিনিস পত্র নিয়ে তৈরি করা হয়েছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ইনস্টিটিউট জাদুঘর।

কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৪ সালে বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ের প্রধান পন্ডিতপদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ঢাকার নর্মাল স্কুলে যোগদান করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিনি মডেল স্কুলে (১৮৬০) যোগ দেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন স্কুলে দীর্ঘ উনিশ বছর শিক্ষকতা করেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন খুবই নিষ্ঠাবান। অনেক কীর্তিমান ব্যক্তি তাঁর ছাত্র ছিলেন।

কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সদ্ভাবশতক’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। তাই পরিণত বয়সে তিনি ‘রামের ইতিবৃত্ত’ (১৮৬৮) নামে একটি আত্মচরিত রচনা করেন। মহাভারতের ‘বাসব-নহুষ-সংবাদ’ অবলম্বনে রচিত তাঁর অপর গ্রন্থ হলো ‘মোহভোগ’ (১৮৭১) কৈবল্যতত্ত্ব (১৮৮৩) তাঁর একটি দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তাঁর নাটক ‘রাবণবধ’। এ ছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো। তাঁর রচনা প্রসাদগুণসম্পন্ন এবং তাঁর কবিতার অনেক পঙ্তি প্রবাদ বাক্যস্বরূপ, যেমন: ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে’, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে’, ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন হে’ ইত্যাদি। এ পঙ্তিধারী কবিতাটি এক সময় স্কুলপাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কৃষ্ণচন্দ্র সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনোরঞ্জিকা, কবিতা কুসুমাবলী ও দ্বৈভাষিকী। শেষ জীবনে কৃষ্ণচন্দ্র সেনহাটিতে বসবাস করেন এবং বিবিধ রকমের সঙ্গীত রচনা করে অবসর জীবন কাটান। ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। আর কিছু জানার আছে।

_ না ভাই। শুধু কবির নাম শুনতে চেয়েছি। তুমি তো পুরো কবির A two Z বলে দিলে।

_ ওই যে বললেন আমি কিছু জানি না।

_ তুমিই তো বললে–

_ আমি বলেছি আমার পছন্দের কোন জায়গা নেই।

_ আচ্ছা, ধীরে সুস্থে আমার সাথে ঘুরতে ঘুরতে পছন্দ হয়ে যাবে।

_ হুম,এখন রাখছি।

_ এতো তাড়াতাড়ি

_ পনেরো মিনিট কথা হয়েছে, তাড়াতাড়ি কোথায়?

_ আচ্ছা

শাওন ফোন কেটে দিতেই নদী জানালার কাছে এগিয়ে গেলো। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে রইলো,তার অনেক পছন্দের জায়গা আছে। কিন্তু সেটা কখনোই শাওনকে সে বলবে না। কারণ পছন্দের জায়গায়,শুধু মাত্র প্রিয়জনকে নিয়ে যাওয়া যায়। শাওন কখনোই তাঁর প্রিয়জন হতে পারবে না। কারণ নদীর মনের কোণে একজনই প্রিয়জন আছে! আর নদীর প্রিয়জন হচ্ছে বর্ণসুখ। তাঁর জীবনের পুরোটা জুড়ে অতৃপ্তি হয়েও কিছুটা তৃপ্তি।

বৃষ্টি শেষে রঙধনুতে তাকিয়ে ছিলাম আমি। মনে হলো রঙধনুতে হাত বাড়িয়েছো তুমি। ছুঁতে গিয়ে বুঝলাম আমি,তুমি বহুদূর। ইচ্ছে হলেই যায় না ছোঁয়া,কারণ কমতিতে ভেজানো আমার গা।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,
ইনশাআল্লাহ চলবে

এতো কষ্ট করে গল্প লিখে নাইস নেক্সট দেখে,লেখার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here