সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:১০+১১

0
619

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

১০.
নিজেদের দুর্নাম পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর যে দেখা দিবে মায়ের চিরুনি পাওয়া যাচ্ছে না, সুপারি চেঁছোনি পাওয়া যাচ্ছে না, পানদানি পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি মায়ের বাথরুমের ছেড়া জুতা টা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না তখন কি করবে? রুবেল বেশ চিন্তিত হয়ে উনাদের সামনে বসলেন। নির্মলা বেগম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হালকা হাসলেন। এরপর নানারকম কথা বলতে লাগলেন যে কেনো ফিরা করতে পারেন নি। রুবেল সাহেব ও বিনীত ভঙ্গিতে সেসব শুনে নিলেন। নির্মলার খুবই খারাপ লাগছিলো মিথ্যা কথাগুলো বলতে। সে মনে মনে ঠিক করেছে, যতগুলো মিথ্যা বলেছে ততগুলো মিথ্যার বদলে ফকিরদের একবেলা খাইয়ে দিবেন।

খাবার টেবিলে সবার আগে বসেছেন রুপসী বানু। অথচ এখনো প্লেট, জগ-মগ ও আনা হয় নি। তবুও তিনি হাত পা মেলে খেতে বসেছেন। রিপার মা হোসেনআরা ধীরে ধীরে সব নিয়ে আসতে লাগলো। রুপসী বানু বলে,

‘ শরীর টা একটু নাড়াও বউ। আর কতক্ষণ তাগোরে বসিয়ে রাখবে? এমনে নি মেয়ের বাড়ীর লোকদের দাওয়াত করায়? যাও তাড়াতাড়ি সব নিয়া আসো।’

হোসেনআরা বলে,

‘জ্বি, আম্মা। ইয়ে, গরম করতে সময় গেছিলো।’

রুপসী বানু বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বউ টারে ভালো মনে করতেন, সারাক্ষণ আম্মা আম্মা কইরা জান দিতো। আর এখন দেখো তাকে না জানিয়ে নাতিনের বিয়ে দিয়ে দিলো। রুপসী বানু বিষয়টাতে খুবই ব্যথিত। একমাত্র ছেলের বড় নাতিন বলে কথা। অধিক শোকে তিনি এসব করছেন। হোসেনআরা বা রুবেল কেউ কিছু বলছে না। তারা বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত যে, তখন বাস চলে নাই তাই তাকে আনতে পারে নি। রুপসী বানু সেটা বুঝতে নারাজ,তাই তারা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বয়স হয়েছে, এ সময়ে সবাই এমনই করে। শেষ বয়সে বৃদ্ধরা এক কথা নিয়েই ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান করে।
হোসেনআরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে খাবার নিয়ে আসতে লাগলেন। খাবার দ্রুত রেডি করে সবাইকে ডাকতে চলে গেলো। রুপসি বানু চারপাশে না তাকিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলেন। বউটার গরুর মাংস রান্না বেশ লাগে। কেমন ঝোল ঝোল মাখা মাখা হয়। আবার মুরগি টা অত ভালো পারে না। তিনি বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে খেতে লাগলেন। সবাই আসতে আসতে তার প্লেটের অর্ধেক ভাত শেষ হয়ে গিয়েছে। রুপসি বানুকে খেতে দেখে রুবেল বড়ই লজ্জিত হলো। মা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলে কি হতো? তিনি বিষয়টাকে এড়িয়ে সবাইকে বসার জন্য সম্বোধন করলেন। বসতে যেয়ে দেখা দেয় বিপত্তি। রুপসী বানুর এক পাশে একটা চেয়ার আর অপর পাশে দুইটা চেয়ার খালি রয়েছে।বড়রা সবাই আগেই বসে পড়েছে। শ্যামল তো রুপসী বানুর সাথে বসবেনা, সেটা খুবই ভালোভাবে সে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে। প্রথমে কি কান্ড ঘটিয়েছে,তার কি সেটা মনে নেই? খুবই ভালো করে মনে আছে। পাশে বসলে দেখা যাবে রুপসি বানু গোসল করতে চলে যাবেন। তাই সে ফটাফট রুপসী বানুর দুই পাশের চেয়ার বাদ দিয়ে অবশিষ্টটাতে বসেছে। নুহা ও ফট করে যেয়ে শ্যামলের পাশে বসে পড়লো। সাথে সাথে রুপসী বানু খাবার বন্ধ করে দিলেন। নুহার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকালেন। মনে মনে ভাবলো, এখানে তো নাতিনটার বসার কথা অথচ তার ভাবী বসেছে। তাও নিজেরে অসুস্থ স্বামীরে শাশুড়ির পাশে দিয়া। কিছু একটা গন্ডগোল মনে হচ্ছে।’ ইমনকে নির্মলা বেগম তার সাথে বসিয়েছেন। ছেলেকে খাইয়ে দিতে হয়, সে ঠিক মতো খেতে পারে না। রিপা এখন খাবে না বলে বসতে চাইলো না, কিন্তু তার মা মানলো না। জোর করে তাকেও বসিয়ে দিলো রুপসী বানুর অপর পাশে। রিপা বসতেই রুপসি বানু তার প্লেটে ভাত দিতে লাগলেন। খুবই চাপা আওয়াজে বললেন,

‘ স্বামীর পাশে না বইসা এদিক দি বইলি ক্যান,গাধী? আবার তার সাথে ধলা মাইয়া বসাইছোস। তোর কি কান্ড জ্ঞান নাই? জানোস না, পুরুষ আর বিড়াল এই দুই জাতরে বিশ্বাস করতে নেই, এরা যেখানে সেখানে মুখ দেয়।’

রিপা ফিসফিস করে বলে,

‘ আমি বসাইছি নাকি? ভাবী প্রথমে বসে গিয়েছিলেন। এখন আমি উনাকে কীভাবে উঠতে বলি?’

‘মুখ দিয়া কইবি। ক্যান তোর মুখে কি ঠাডা পড়ছে? শুন, এখনই পাশে বইবি। আচ্ছা দাড়া, আমি ব্যবস্থা করতেছি।’

‘আরে দাদী শুনো তো,,,,,’

রুপসী বানু শুনলেন না। তিনি সোজা হয়ে বসে গেলেন। রিপাও চুপ করে গেলো। কেউ দেখলে খুবই খারাপ বলবে। মজলিসে ফিসফিস করে কথা বলা ঠিক নয়। শুধু যে অনুচিত তা নয় এটা বড় অপরাধও বটে। এমনটা রিপার বাবা বলে। রুবেল সাহেব এসব একদম পছন্দ করেন না। রুপসী বানু মাংসের বাটি টা নিয়ে নিজের পাতে আবারো নিলেন। বাটি টা টেবিলে না রেখে তিনি নুহাকে সাধলেন। নুহা একটু হেসে না বললো। রুপসী বানু দমলেন না। জোরপূর্বক তার প্লেটে দিতে দিতে বললেন,

‘আরে না বললে হইবো? মেহমান মানুষ কিছুই লইতেছো না। নাও নাও এটা খাও। এটা খুবই মজা।’

রুবেল বলে,

‘আহা, আম্মা। ও যখন নিতে চাইছে না তাহলে জোর করছো কেনো?’

‘তুই চুপ কর। মেহমনারা তো না করবেই তাই বলে,,,,,

‘আউউ,, কি করলেন? আমার এত দামী জামা…..’

রুপসী বানু শরমিন্দা হলেন। অপরাধী স্বরে বলেন,

‘ দুঃখিত, দুঃখিত মা। একদম চৌখে দেখি নাই। বয়স হইছে তো, এই জন্য চোখে কম দেখি। পোলাডারে কতবার কইলাম চশমা কিনে দিতে, ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে এরা শুনে কই। আমি তো বু….’

‘ জ্বি,জ্বি বুঝতে পেরেছি।’ বলেই নুহা টিস্যু দিয়ে মুছতে লাগলো। সে খুবই বিরক্ত। দাত চেপে রাগ সংবরণ করছে। একে তো জামা নষ্ট করে ফেলেছে আবার পকপক শুরু করেছে। না থামালে দেখা যেতো আরো কত হাবিজাবি বলা শুরু করেছেন।

রুপসী বানু বলেন,

‘ এমনে মুছলে যাইবো না, তুমি পানি দিয়া ধুইয়া নাও। বউমা এদিকে আসো তো, মাইয়াডারে একটু ওই কি বিসিন না ভাসিন দেখাইয়া দাও।’

নুহা লাগবেনা বলে যেতে চাইলো না। রুপসী বানু মানলেন না। জোর পূর্বক হোসেনআরার সাথে ভেসিনে পাঠিয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটা নির্বাক হয়ে দেখছে রিপা। দাদীর কান্ডতে সে মোটেও অবাক হয় নি। তার ধারনা দাদী পারে না এমন কিছু নাই। শুধু পাশে বসেছে দেখে তাকে উঠিয়ে দিয়েছে এবং আর খেতে দিবে না যে এও সে জানে। তার চিন্তা হচ্ছে যদি খুনাক্ষরেও টের পান নুহা মেয়েটা তার স্বামীর পেছনে লাইন মারে তখন যে কি করবে কে জানে? রুপসী বানু ইশারায় তাকে শ্যামলের পাশে আসতে বললেন। রিপা চারপাশের মানুষজন দেখিয়ে না বললো। রুপসি বানু রেগে গেলেন। মনে মনে রিপাকে খুবই কঠিন গালি দিলেন। রিপা আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলো। রুপসী বানু আবারো বাটি হাতে নিয়ে রিপা কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘ ও মা গো, নাতিন জামাই দেখি কিছুই নিতেছে না। কি রে রুপা তুই নিজে নিজে সব গিলতাছোস? স্বামীর দিকে তো তাকাইতেছোস না। এই নে জামাইরে দে। আমি দিতে গেলে পইড়া যায়। নে তুই দে।’

সবাই খাওয়া বন্ধ করে রিপার দিকে তাকালো। রিপা হে হে করে মেকি হাসলো। দাদীর দিকে দাঁত চেপে তাকিয়ে উঠে যেয়ে শ্যামলের পাশে বসলো। দাদীর হাত থেকে বাটি নিয়ে একসাথে তিন চার চামচ তরকারী দিতে লাগলো।

শ্যামল বলে, ‘ আর দিও না, এতগুলা খেতে পারবো না।’

রিপা ফিসফিস করে বলে,
‘কেনো? নটিবেটি পাশে নেই বলে? ঢলাঢলি না করলে শান্তি লাগে না,তাই না? চুপচাপ খান বলছি।’

শ্যামল অসহায় দৃষ্টিতে খাবারের দিকে তাকিয়ে রইলো। মন বড্ড কু গাইছে। কেনো জানি মনে হচ্ছে নুহার পাশে বসার অপরাধে আজ তার সাথে কিছু ঘটতে চলেছে। খাওয়া বাদ দিয়ে একবার রিপার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার প্লেটের দিকে তাকাচ্ছে। ধরে নিয়েছে, আজ দুদিক থেকেই বদ-হজম হবে।

নুহা জামা ঝারতে ঝারতে এসেই দেখলো রিপা তার স্থানে বসে শ্যামলকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। অটোমেটিক সে দাড়িয়ে পড়লো। রুপসী বানু তাকে দেখে উঠে গেলেন।

‘আরে মা এসেছো। আমারে মাফ কইরা দিও, চোখে দেখি না তো। আচ্ছা তুমি তো আর খাইবা না, তাই না? চলো,চলো তোমারে আমি একটা জিনিস দেখাইমু। ওইটা দেখলে তোমার মন একদম খুশি হইয়া যাইবো।’

নিপা বলে,

‘দাদী, ভাবী তো খাইবে না বলে নাই। আপনি…’

‘তুই চুপ কর। বেশি জানোস নি? এমন সুন্দর চিকন মাইয়ারা কম খায়। দেখোস নাই খাইতে বসেও কত অল্প খাইছে। বেশি খাইলে মোটা হই যায় বুচ্ছোস। কি গো মা তুমি তো আর খাইবা না,তাই না?’

সবার একদৃষ্টিতে তাকানো দেখে নুহা বেকায়দায় পড়ে গেলো। এত মানুষের সামনে নিশ্চই বলা যায় না, আমি খাবো। ভদ্রতার খাতিরে দাত চেপে হেসে বলে,

‘ হ্যা,হ্যা। আর খাবো না। আমি এত অয়েলি ফুড খাই না। ‘

রুপসি বানু এক গাল হেসে বলে, ‘দেখছোস? আমি কইছি না? আইচ্ছা মা,চলো চলো।’

নুহাকে জোর করে রুপসি বানু নিয়ে গেলেন। তার দেখানো মতো কিছুই নেই তবুও তিনি আলমারি থেকে এটা সেটা দেখাচ্ছেন। আর ইতিহাস বলছেন। নুহা ভদ্রতার খাতিরে সব সহ্য করছে নাহলে এতক্ষণে বানুর রফাদফা করে দিতো। রুপসি বানু কথায় কথায় একটা চামচ বের করলেন। চামচ টা দেখতেই খুবই সুন্দর। তবে সেটা একটা আর নেই। নির্মলা বেগম নুহাকে ডাক দিতেই সে বেরিয়ে এলো। ইমনকে ঔষধ খাওয়াতে হবে। রুপসি বানুও তার পেছন পেছন এলেন। সবার খাওয়া শেষ। ময়নার মা প্লেট বাটি কিচেনে নিয়ে যাচ্ছে। হোসেনআরা ও তার সঙ্গে সব কাজ করছেন। নিপা,শিপা শ্যামল আর রিপাকে নিয়ে ছাদের দিকে গিয়েছে। রুপসি বানু অন্যদিকে না যেয়ে ডাইনিং এ দাড়িয়ে দাড়িয়ে ময়নার মাকে দেখতে লাগলেন। সে কয়টা নিচ্ছে কি কি নিচ্ছে আড় চোখে সব পরখ করছেন। হোসেনআরাকে ইশারায় কাছে ডেকে বলেন,

‘ বউ দেখো তো সব ঠিক আছে কি না।’

‘আহা, আম্মা। ময়নার মা খুবই ভালো মানুষ। আপনি শুধু শুধু তাকে সন্দেহ করতেছেন।’

রুপসি বানু বিরক্তির সুরে বলেন,

‘ ভালো মানুষরাই আজকাল চুরি করে। ভালো ভালো বইলা তার সামনে সব খোলা রাখলে শয়তানে তখন তারে খোঁচায়। বলে, নিয়ে নে,নিয়ে নে, ওরা জানে তুই ভালো এসব তুই চুরি করবি না। তখন সেও নিয়ে নেয়।’

হোসেনআরা বলেন,

‘কি বলেন মা। এমনও হয়?’

রুপসি বানু বলে,

‘হয় হয়। এই দেখো চামচ টা। এটা কার জানো? এটা হইলো আমার বাল্যকালের সখীর। মেলাদিন আগে একবার তার বাড়ীতো গেছিলাম। তখন এই চামচ টা খুবই পছন্দ হইছিলো। আশেপাশেও কেউ ছিলো না। শয়তানে তখন আমারে খোঁচায় বলে, নিয়ে নে নিয়ে নে কেউ দেখবে না। আমি নিতে চাইছিলাম না, শয়তানে অনেক জোর করছে দেখে আর না করতে পারি নাই। টুপ করে নিয়ে আঁচলের নিচে লুকাই ফেলছি।’

‘তাই বলে আম্মা, চামচ!’

হোসেনআরা বিস্মিত চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালেন। রুপসি বানুকে দেখতে খুবই নিষ্পাপ লাগছে। কে বলবে এই মহিলা চামচ চুরি করেছে।

#চলবে…
®সোনালী আহমেদ

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

১১.
হোসেনআরা বিস্মিত চোখে শাশুড়ির দিকে তাকালেন। রুপসি বানুকে দেখতে খুবই নিষ্পাপ লাগছে। কে বলবে এই মহিলা চামচ চুরি করেছে। রুপসি বানু বউয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে চুপচাপ চলে গেলেন। এভাবে বলা ঠিক হয় নাই। অন্যভাবে বললে হতো। থাক বলে ফেলেছি, তো কি হইছে? আমি কি নিতে চাইছি, শয়তানে জোর করছিলো দেইখা ই না নিছি। রুপসি বানু আপনমনে বিরবির করতে করতে চলে গেলেন। যেতে যেতে ঠাস করে ধাক্কা খেলেন নুহার সাথে। নুহা হড়বড় করে কই যাচ্ছে।

‘ও মা গো, কোমড় শেষ রে। খাড়াও মাইয়া, কই যাইতাছো? বড় ছোট মানো না, ধাক্কাধাক্কি করে ফালাই দাও।’

‘সরি, সরি দাদী। আমি দেখি নি। ‘

‘ রাখো তোমার সারি। সারি কইলে আমার ব্যাথা চইলা যাইবো নি?’

নুহা দাত চেপে তাকিয়ে রইলো। এখন তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। দ্রুত যেতে হবে নাহলে রিপা আর শ্যামল তার চোখের সামনে থেকে চলে যাবে। সে বিনয়ের সাথে মাথা নত করে রইলো। রুপসি বানু দমলেন না, তিনি বকে যেতে লাগলেন। উপায়ন্তর না দেখে নুহা চুপ করে দৌড় দিলো। রুপসি বানু পেছন থেকে তাকে চেঁচাতে লাগলেন। সেসব কর্নগোচর করলো না সে। দরজার বাহিরে এসে কোথাও রিপা আর শ্যামলের চিহ্ন দেখলো না সে। অনেক্ষণ খুঁজেও কোনো দিশা না দেখে ঘরে ফিরতে হলো তাকে। গোমড়া মুখে নির্মলা বেগমের পাশে বসলো। নির্মলা বেগম রুবেলের সাথে কথা বলছে। ইমন নিপার সাথে ছাদে গিয়েছে। রুবেল কিছু জরুরী কথা বলছিলো নির্মলার সাথে, তখন ইমনের জন্য বলা হয়ে উঠছিলো না। সে কথার মাঝখানে সমস্যা করছিলো তাই নিপাকে ডেকে তার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে রুবেল সাহেব।

-নিস্তব্ধ ছাদে একা একা হাটছে নিপা। এই ভর দুপুরে মানুষের ভীড় হবার ও কথা নয়। মৃদু বাতাসের ফলে ছাদের দড়িতে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো এদিকে-সেদিকে দুলছে। ইমন বারবংবার সেই কাপড়গুলোর পেছন লুকোচুরি খেলছে। নিপা ব্যস্ত গলায় বলে,

‘ইমন ভাই, দাড়ান। ছাদের রেলিং নেই, আপনি পড়ে যাবেন তো।’

ইমন বোধ হয় শুনলো না। আপনমনে সে হাসছে আর খেলছে। হঠাৎ বেখেয়ালি ভাবে খেলতে যেয়ে পিছলে যায়। সাথে সাথে নিপা ধরে ফেললো। ইমন ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো। তাকে সোজা দাড় করিয়ে রাগান্বিত স্বরে বকা শুরু করলো নিপা। বেশ জোর কন্ঠে বলে,

‘আপনি আস্ত একটা পাগল। এতবার বলেছি শুনেন নি। এখন পড়ে মরে তো শান্তি হতেন।’

ইমন কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

‘ আমি থাকবো না। সবাই আমাকে শুধু বকে আর মারে। আমি চলে যাবো। সরুন আমি চলে যাবো।’

নিপা শান্ত হলো। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো। ইমন তো আসলেই পাগল, একদম উচিত হয় নি এভাবে বলা। মনেমনে বেশ অপরাধবোধ করলো। নিপা সুর পাল্টিয়ে মিষ্টি সুরে বলে,

‘ আপনি যদি আমার কথা শুনতেন তাহলে কি বকতাম? আচ্ছা বাদ দেন। বলেন তো, আপনাকে আর কে কে বকে?’

ইমন হড়বড় করে বলে,

‘সবাই। মা, ভাই, নুহাপু। শুধু বার্বিডল কিছু বলে না। জানো সে আমার কথা শুনে।’

‘বার্বিডল? বার্বিডল কে? আর নুহা আপু তো আপনার বউ আপনি আপু কেনো ডাকছেন?’

ইমন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারছে না। বউ শব্দ টা বোধ হয় সে এর আগে শুনে নি। ইমন গোলাটে কথাবার্তা বললো। যার আগাগোড়া নিপার বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণবাদে কথার দীর্ঘ ইতি টেনে নিচে নেমে আসলো দুজনে।

বিকালের শেষ দিক। রঙিন আকাশ কালো দেখাচ্ছে। সম্ভবত ঝড়-বৃষ্টি হবে। নির্মলা বেগম তৈরী হয়ে গিয়েছেন যাবার উদ্দেশ্যে। রিপাকে রেখে যাবেন। সপ্তাহ-দশদিন পর নিতে আসবেন। রুবেল সাহেব ভারী খুশি হলেন। বিয়ের পর মেয়েরা বাড়ীতে ফিরলে বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি বাবারাই হয়। রিপা রুমের কোণে শুয়ে আছে। তার সাথে রুপসি বানু বসে বসে পান চিবুচ্ছেন। রিপার দিকে একপলক তাকিয়ে মুখ ভেংচিয়ে বলেন,

‘এমন ঢং দেখাইয়া শুইয়া আছোস ক্যান? যা যাইয়া শাশুড়িরে বিদায় দিয়া আয়।’

রিপা নিরুত্তর রইলো। রুপসি বানুর একই কথা বারংবার শুনতে শুনতে বিরক্ত হলো। খানিকবাদে মুখ খুললো,বললো,

‘আচ্ছা দাদী, আমি এখানে থাকলে তো তিনি ওই বাড়ীতে থাকবো। আবার নুহা ভাবীও ওখানে থাকবে।’

‘তো?’

‘ আপনি না বলছিলেন, আপনি বিয়ার পর একদিনও দাদাজানরে ছাড়া কোথাও থাকেন নাই এবং থাকতেও দেন নাই। ‘

‘হু। আর আমি অসুস্থ থাকলে ওইদিন আর তারে বাড়ীর বাইরে পা রাখতে দেই নাই। দেখা যেতো আমি অসুস্থ বইলা কোন চিপায় নটিবেটিদের সাথে চইলা যাইতো। ঠিক করছি না,বল?’

‘একদম।’

রুপসি বানু মিষ্টি হাসলেন। রিপা সুর পাল্টিয়ে বলে,

‘ দাদী, শ্যামল না সারাক্ষণ মৌমাছির মতো নুহা ভাবীর পেছনে ঘুরঘুর করে। এখন আমি যদি না থাকি তাহলে কি হইবো বুঝতে পারতাছো?’

রুপসি বানু পান চিবুনো বন্ধ কর দিলেন। কল্পনায় শ্যামল আর নুহা কে একসাথে দাড়িয়ে কাছে এগিয়ে আসতে দেখেই তিনি চোখ বড় বড় করে ফেললেন। ‘নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ ‘ বলে বিরবির করে পানের পিক ফেললেন। হড়বড় করে উঠে বসে ছুট লাগালেন ড্রয়িংরুমে। চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখলেন নুহা, শ্যামলের পাশে দাড়িয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ তার চোখের সামনে কল্পনার দৃশ্য ভেসে উঠলো। এক চিৎকার দিয়ে ওদের দুজনের মাঝখানে দাড়িয়ে পড়লেন। সাথে সাথে ছিটকে সরে পড়লো নুহা আর শ্যামল। দুজনেই ভয়ে বুকে থু থু ছিটাতে লাগলো। উপস্থিত সবাই হতভম্ভ হয়ে গেলো! নির্মলা বেগম প্রশ্ন করলো,

‘কি হয়েছে? কি হয়েছে?’

রুপসি বানু নিজেকে সামলিয়ে বলেন,

‘কিছু না।’

রুবেল বলে,

‘তাহলে এমন চিৎকার দিয়েছো কেনো আম্মা?’

‘ খুশিতে চিক্কুর দিছি। আমি ঠিক করেছি,আমিও যাবো নাতিনের শশুড়বাড়ী। বিয়ার সময় তো সব চৌখে দেখি নাই তাই এখন সব দেখবো।’

রুবেল ব্যস্ত গলায় বলে,

‘আম্মা কি বলতাছো? রিপা তো থেকে যাবে তুমি যেয়ে কি করবা?’

রুপসি বানু বলে,

‘ রিপা থাকবো কে বলছে তোরে? রিপা তোর মতো অবুঝ না। শাশুড়ি অসুস্থ, ভাসুর অসুস্থ, স্বামী অসুস্থ। সে কোন আক্কেলে থাকবো।’

শ্যামল চোখ বড় করে বলে,

‘আমি কখন অসুস্থ হলাম?’

রুপসি বানু তাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে,

‘ এখন অসুস্থ! বাগানে যাইয়া রিপা আর শিপারে বলে কইছিলা পেটে গুটুর গুটুর করতাছে। কয়েকবার নাকি বাথরুমে গেছো। সব পাতলা পাতলা যাইতেছে। কিরে শিপা বলে নাই?’

শিপা মাথা নাড়ালো। দাদীর কথার বিপরীতে বলার সাহস নেই। এর পূর্বে দুবার সাহস দেখানোর ফলস্বরপ, ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছিলো। তাই এবার আর সাহস করলো না। রিপাকে এদিকে আসতে দেখে শ্যামল সাথে সাথে মাথা দুলিয়ে সমর্থন করলো। এবং পেট চেপে অসুস্থতার ভান করলো। নির্মলা বেগম বেশ লজ্জিত হলেন। ছেলে টা একদম বোকা হয়ে গেছে। শশুড়বাড়ীতে প্রথম এসেই ডায়রিয়া ছুটিয়েছে। এটা কোনো কথা? রুবেল সাহেব ব্যস্ত হয়ে স্যালাইন নিয়ে আসলেন। এক প্যাকেট গুলিয়ে তাকে জোর করে খাইয়ে দিলেন। শ্যামলকে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা বেশি পাতলা নাকি?’ রুপসি বানুর মাথা দুলানো দেখে শ্যামলও মাথা দুলালো। রুবেল সাহেব সাথে সাথে আরেক প্যাকেট খাইয়ে দিলেন। শ্যামল পেট চেপে ধরলো। এবার সত্যি সত্যি পেট ব্যাথা করছে। গলা ভর্তি খাবার। পেট পাক দিয়ে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ ছুট দিলো বাথরুমে। তার সাথে সাথে বাকিরাও যেয়ে বাথরুমের দরজার সামনে দাড়ালো। কয়েক সেকেন্ড বাদেই রুপসি বানু প্রশ্ন করেন, ‘ এবার ঠিকঠাক হয়েছে?’ ভেতর থেকে তখন কোনোরুপ শব্দ আসে না। রুপসি বানু অস্থির হয়ে উঠলেন। বারংবার একই প্রশ্ন করতে লাগলেন। এসব দেখে লজ্জায় ইতোস্ত করতে লাগলেন নির্মলা বেগম। সেদিকে কেউ নজর করলো না। খানিকবাদে বেরিয়ে আসলো শ্যামল। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখের করুণ দশা।

‘জামাই, এবার কেমন হইছে? পাতলা নাকি ঘন?নাকি ডাক্তার নিয়া আইতে হইবে?’

শ্যামল মাথা দুলালো। ডাক্তার লাগবে না। অথচ তার বলা উচিত লাগবে। খুবই শোচনীয় অবস্থা। সুস্থ মানুষকেও যে কেউ অসুস্থ বানিয়ে দেয় তা এখানে না আসলে শ্যামল জানতো না। কোনোরকম এলোমেলো পা ফেলে ড্রয়িংরুমে আসলো। রিপা মুখ চেপে দাড়িয়ে আছে। দমফাটা হাসি আসছে তার। কিন্তু এখন হাসলে চলবে না। কেউ একজন অসুস্থ, আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি করলে নিশ্চই সবাই তাকে সন্দেহ করবে। রুবেল সাহেব অনুরোধের সুরে বলে,

‘বেয়াইন সাহেব, বাবাজি না হয় আজ থেকে যাক। এ অবস্থায় বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া টা একদম উচিত হবে না। সুস্থ হয়ে গেলে আমি নাহয় রিপাসহ তাকে দিয়ে আসবো।’

নির্মলা বেগম নিশ্চুপ রইলেন। সে না বলতে পারছে হ্যা আর না বলতে পারছে না। তার দেখা দিয়েছে উভয় শংকট। কীভাবে কি করবেন? শেষে সবার জোরাজুরিতে রাজি হলেন। কিন্তু নুহা মানতে চাইলো না, বহু চেষ্টা করলো রেখে না যেতে। সক্ষম হলো না। নির্মলা বেগম শ্যামলকে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় কঠিন কিছু আদেশ দিয়েছেন। শ্যামল চুপচাপ সব শুনলো। সবাই চলে যাওয়ার পর রুপসি বানু পুরো ঘরের খুঁটিনাটি দেখতে লাগলেন। এমনকি নিচু হয়ে মেঝেতেও চোখ বুলিয়েছেন। সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

– শ্যামলকে রিপার রুমে শুতে দেওয়া হয়েছে। রাত নয়টা পর্যন্ত তারপাশে বসে রইলেন রুবেল সাহেব আর হোসেনআরা। মাথায় ভীষণ চিন্তা। হঠাৎ মেয়ের জামাই অসুস্থ কীভাবে হয়ে পড়লো? কত পদের খাবার খাইয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। তারা চলে যাবার বেশ সময় পর রুমে আসলো রিপা। এসেই বিছানায় শ্যামলকে না দেখে এদিকওদিক তাকাতে লাগলো । কই গেলো মানুষটা? রিপা অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেই হুট করে তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো শ্যামল। আচমকা এমন হওয়ায় ভড়কে যায় রিপা। শ্যামল কোথায় ছিলো? কোন দিক দিয়ে আসলো ভেবে পেলো না সে। শ্যামল সেদিকে তোয়াক্কা না করে অন্যহাতে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর দুহাতের মধ্যে বন্দি করে ফেললো রিপাকে। প্রচন্ড স্পীডে হার্টবিট চলাচল করতে লাগলো রিপার। রিপার কম্পনরোগ দেখে মৃদু হাসলো শ্যামল। দেওয়াল থেকে এক হাত সরিয়ে রিপার উন্মুক্ত কোমড়ে রাখলো।

#চলবে….
®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here