সাঁঝক বাতি পর্ব -১৩+১৪

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৩]

আজ দুইদিন হলো শিফার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাবার বাসাতেও যায় নি। আত্মীয়-স্বজন,
এবং বন্ধুরাও তার খোঁজ জানে না। মেয়েটা হুট করেই উধাও! কোথায় গেল? কেন গেল? শিফার চিন্তায় সবার নাওয়া- খাওয়াও বন্ধ। দিগন্ত দায় এড়াতে শশুড়বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়েছিল।সে খোঁজার চেষ্টা না করলেও; দেখাচ্ছে আর কি।
এমন ভাব যেন শিফাকে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে। আজ হসপিটালে দিগন্তের জরুরি কাজ আছে। সে দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
হসপিটালে পৌঁছে ওর কেবিনে চলে গেল। দ্রুত দরজা আটকে গোপন দরজা দিয়ে পাতাল ঘরে
চলে গেল। পাতালঘরে দশজন পেশেন্টের বডি আছে। সাফার মতো এদের পরিবারের থেকেও
সাইন নেওয়া হয়েছিল। এদের শরীরের দরকারী
পার্টস জমা দিতে হবে। না দিলে, আইনী ব্যবস্থা নিবে।পরিবারের লোক ঝামেলা করলে বোঝায়, এগুলো বিনামূল্যে অন্য পেশেন্টদের দিয়ে প্রাণ বাঁচানো হয়। মৃত ব্যাক্তির জিনিসে অন্যরা বেঁচে থাকছে। অর্থাৎ সেই ব্যাক্তিরও সাওয়াব হচ্ছে।

অথচ একথাটা সম্পূর্ন মিথ্যে। চোখ ও কিডনি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব পার্টসগুলো চড়া দামে বিক্রয় করা হয়। কয়েক বছর থেকে সে এই কাজগুলোই করে আসছে। এই হসপিটালটা বিলাশবহুল। এখানে ধনীরা বেশি আসে। তারা শিক্ষিত মানুষ। বন্ড পেপার সম্পূর্ণ পড়েই সাইন করে। তাই দিগন্তের ব্যবসা লাটে ওঠার সম্ভবণাও বেশি। এজন্য রয়েল হসপিটালের পাশেই একটা চারতলা বিশিষ্ট হসপিটাল করে দিয়েছে।সেখানে
নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা আসে। আর এদের বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। নয়তো ইংলিশ বোঝে না। অথচ বন্ড পেপারের এমন শর্তগুলো ইংলিশে লিখা। যদিও এটাও একটা টোপ।যাতে
কার্যসিদ্ধি হয়। মানুষগুলো যখন ইংলিশ বোঝে না, তখন রিসিপশানে থাকা কেউ এগিয়ে যায়।
তারা পুরো পেপারে নাম ঠিকানা লিখে, দেখিয়ে দেয় কোথায় সাইন করতে হবে! বিপদের সময়ে আগে-পিছে না ভেবে পেশেন্টের বাড়ির লোকও সাইন করে দেয়। ওই লোকগুলোকে এই কাজেই রাখা হয়েছে। তাদের এই দায়িত্বেই নিয়োজিত।
পরে, অসহায় মানুষগুলো জানতে পেরে, হাইহাই করে। তখন আর কিছু করারও থাকে না। শুধু আফসোস করা ছাড়া! এই পর্যায়ে এসে, সেখানে আরেকদলকে লোকের আগমন ঘটে। যারা সেই
পেশেন্টের বাড়ির লোকদের বুঝিয়ে ব্রেণ ওয়াশও করে ফেলে। তারা বোঝায়; চোখ ও কিডনি দান করা পূণ্যের কাজ।

সাফার সঙ্গে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। সাফারও কিডনী, লিভার, ফুসফুস, ও চোখ বাধ্য হয়ে’ই দিতে হয়েছিল। সেদিন থেকে শিফার অঘোষিত লড়াইও শুরু হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ওর সাজ্জাদ বাবার হসপিটালটা দিগন্ত নিজের করে নিয়েছে। সে হসপিটালের মান খুবই ভালো
দেখায়। আর সবার আড়ালে অসহায় মানুষদের ফাঁসিয়ে দেয়। স্ব-ইচ্ছায় দান করা একথা। আর বাধ্য হয়ে দেওয়া ভিন্ন কথা। বিগত কয়েক বছর
ধরে সে এসব করছে। আর এভাবে কোটি কোটি টাকাও উপার্জন করছে। শিফা চেষ্টা করেছে, এই তথ্যগুলো খোঁজার। কিন্তু সম্ভব হয় নি। বরং সে খুঁজতে খুঁজতে পাতালঘর অবধি পৌঁছেও গেছে। আর সেদিনই দিগন্তের কাছে ধরা খেয়েছে। আর ততদিনে দিগন্তও শিফার কথা জেনে গিয়েছিল। শিফা কে? কেন খোঁজ নিচ্ছে। তার উদ্দেশ্যেই বা কী? সেদিনই সে গুপ্তচরের মাধ্যমে শিফার দূর্বল পয়েন্টের কথাও জেনেছিল। মেয়ে বলে ওয়ানিং দিয়েছিল। শিফা তবুও থামছিল না বরং মরিয়া হয়ে উঠেছিল। পরে দিগন্তই শিফার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল,

-‘কি চায়?’
-‘আপনাকে।’
-‘কেন?’
-‘বিয়ে করব।’
-‘ইচ্ছুক নই!’
-‘আমি কোন দিকে থেকে কম?’
-‘উহুম, কম নয়। বরং একটু বেশিই হট।’
-‘তাহলে রাজি?’
-‘না।’
-‘ওকে।’

এরপরেই শিফা দিগন্তকে বিয়ে করার জেদ করে।
লজ্জা ভুলে বাসায় দিগন্তের কথা জানায়। কেউ রাজি না হলে আত্মহত্যার হুমকিও দেয়। শিফার বাবা মেয়ের জেদের কাছে হার মানে। উনি নিজে দিগন্তের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। আর
শিফা দিগন্তকে বিরক্ত করতে থাকে। দিগন্ত রেগে ওকে বলেছিল,

-‘যদি পারো, বিয়ে না করে আমার কাজে বাঁধা দিয়ে দেখাও।’

-‘কাপুরুষের মতো ভয় পাচ্ছেন? আহারে, ভীতু ছেলেটা।’

কেউ ইচ্ছে করে মরতে চাইলে সুযোগ দিতে হয়ে।
এটা দিগন্তের উক্তি। তাই সে কিছু না বলে রাজি হয়েছিল। দূর থেকে নজর রেখে শিফারও কাজ হচ্ছিল না। এজন্য বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধও হয়েছিল। বিয়ে না করলে বাসায় ঢুকতেও পারবে না। আর তথ্যও সংগ্রহ করতে পারবে না। যেটা ওর জন্য খুব জরুরি। দিগন্তের বাসায় যাওয়ার পর, শিফা তথ্য সংগ্রহের যথেষ্ট চেষ্টাও করেছে।
কিন্তু তেমন কিছু পায় নি। বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে চুপিচুপি সে সাজ্জাদ বাবার বাসায় যেতো।
সেই স্থানটা ছিল ওর জন্য নিরাপদ। সাজ্জাদের সহকারী হাসিব বর্তমানে শিফাও সহকারী। আর মাক্স পড়া সেই মেয়েটা ছিল, তমা। তনয়ের মা।
খোঁজ দিয়ে দিগন্ত তমাকেও চিনে ফেলেছিল। সে প্রথমবার ওয়ানিং দিয়েছিল। তমা ওর বারণ না শুনাতে, তনয়কে অপহরণ করেছিল। তিনদিন আটকে রেখেছিল। তারপর তনয়ের হাত কাটার পর, দিগন্ত হসপিটালে দেখতেও এসেছিল। ছোট্ট তনয় দিগন্তের কোলে উঠে কেঁদে বলেছিল,

-‘আঙ্কেল! আঙ্কেল! হাত। আমার হাতটা ঠিক করে দাও। ফুপি পঁচা! প্লিজ হাত ঠিক করে দাও। আমি আর দুষ্টু হবো না, প্রমিস।

তনয়ের কথা শুনে দিগন্ত ওর চোখ মুছিয়ে শিফা আর তমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলেছিল,

-‘বড়দের কর্মফল ছোটদেরকে ভোগ করতে হয়।
যাতে বড়রা আফসোসে পুড়ে মরে। তাছাড়া, কে
বা চায় নিজেকে নিঃশেষ হতে দেখতে!’

ছোট্ট তনয় সেদিন এত কঠিন কথার মানে বুঝে নি। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। তখন শিফা নিজেকে দমিয়ে নেওয়া অভিনয়ও করেছিল। যাতে দিগন্ত বুঝে, শিফা কিছুটা ভয় পেয়েছে। শিফা নিশ্চুপই ছিল কয়েকদিন। তবে খোঁজ চালানো বন্ধ করে নি। হঠাৎ কিছু পেয়েও গিয়েছিল। দিগন্তের বেড রুমের ভেতরে আরেকটা রুম আছে। সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে পাতালঘর পাওয়া গেছে। বাসাতেও পাতাল ঘর! সে ভাবতেও নি। তবে পাতালঘরে তালা থাকায় ঢুকতে পারে নি। পরে পাতালঘরের চাবিটাও পেয়েছিল, দিগন্তের এ্যাকুরিয়ামের ভেতরে।আর চাবি ছিল প্লাস্টিকের মাছের মধ্যে। শিফা একদিন ভাবনায় মগ্ন হয়ে এ্যাকুরিয়ামের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ খেয়াল করে; সব মাছ নড়লেও সাদা মাছটা নড়ছে না।
ওর মনে মনে সন্দেহ হয়। উঠে মাছটা মরা নাকি
দেখতে গিয়ে চাবি পেয়েছিল। আর সুযোগ বুঝে
চাবিটা নিয়ে পাতালঘরেও গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে এসিডের গভীর কূপ এবং অসংখ্য কঙ্কাল দেখেছিল। প্রতিটা দেওয়ালে; কঙ্কাল ঝুলিয়ে নিচে নাম ও তারিখ দেওয়াছিল। শিফা সাজ্জাদ হোসাইনের কঙ্কাল পায় নি। সময়ও কম থাকায় খুঁজতেও পারে নি। দুইদিন পর গিয়ে দেখে চাবি কাজ করছে না। অর্থাৎ তালাটা কেউ বদলেছে।
রুমের কোথায় আর নতুন চাবি খুঁজে পায় নি।
খোঁজার মতো কিছু পায়ও নি। কারণ দিগন্তের রুমের প্রতিটা জিনিসে ওর ফিঙ্গার পিন দেওয়া। এমনকি আলমারিতেও।

দিগন্ত পাতালঘরে ডুকে নিজে পরখ করল। গত পরশু ডিল সাইন করেছে। সাত কোটির টাকার!
চোখ ও লিভারের ব্যবস্থা করতে হবে। আপাতত
একসপ্তাহের মধ্যে দশজোড়া চোখ পাঠাতে হবে।
এজন্য ঢোপও ফেলতে হবে। দিগন্ত সুখু নামের ছেলেটাকে বলল,

-‘তোর প্রেমিকার কি খবর?’
-‘হেহে, হের চক্ষূ দুইখান আগেই তুইল্লা নিছি। এহন কেডনীও তুলুম ছ্যার।’

দিগন্ত ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

-‘কষ্ট হচ্ছে না তোর?’
-‘না তো। হেতীর ট্যামক শেষ কইরা দিছি।
-‘তোর ভাবির কি খবর?
-‘ভাবির খুঁজ এহনও পায় নাইক্বা।পাইলে তহনই
জানামু।’

দিগন্ত আর কথা বাড়াল না। ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৪]

‘সাঁঝক বাতি’ গল্পের নামকরণের গভীরতা বেশ অদ্ভুত। গভীরভাবে ভাবলে এর মর্মার্থ বোঝাটা
সম্ভব। রৌদ্রজ্জ্বল এক দিনের শেষে ঘনিয়ে আসে
, সন্ধ্যা! সন্ধ্যার আঁধারে ধীরে ধীরে ডুবে যায় এ ধরণী। দিন ছুটি নেয়। বুঝিয়েও দেয়, তার আয়ূ শেষ। আর সাঁঝ থেকে শুরু হয় ;রাতের রাজত্ব। সাঁঝক অর্থাৎ সন্ধ্যা। আর বাতি মানে প্রদীপ, লাইট অথবা আলো। এই শব্দার্থও নিদারুণ।
সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসা আঁধার কাটাতে একমাত্র অবলম্বন; বাতি। বাতিই পারে অাঁধার কাটাতে।
মিটিমিটি আলো ছড়াতে নিজেকে পুড়াতে থাকে, তাও অন্যের স্বার্থে। যাতে অন্যকে আলোকিত করতে পারে। যতক্ষণ পুড়ে সে নিংশেষ না হবে, ততক্ষণ নিস্তারও নেই। নিঃস্বার্থভাবে বাতি তার আলো বিলাতে থাকে। যেন আঁধার সবটা ঘ্রাস করতে না পারে। এর কারণ বেঁচে থাকার অর্থ; লড়াই, যুদ্ধ। হোক সেটা বাতির কিংবা মানুষের ক্ষেত্রে। আলো ও আঁধারি সৃষ্টির এক অন্যবদ্য খেলা। রাতের জন্য দিনের তাৎপর্য’টা সু-স্পষ্ট। প্রকৃতিও বুঝিয়ে দেয়, সবকিছুর সীমা, মূল্য এবং মর্ম আছে। তেমনি এর সূচনা এবং সমাপ্ত পার্ট আছে। দিন যেমন অফুরন্ত নয়; তেমনি রাতও।
মানুষ ও কষ্ট একে অন্যের সঙ্গে নিবিড় জড়িত।
বাঁচতে হলে জীবনে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, এবং
রাগ- জেদ, আদর-অনাদর সবকিছুই আসে।
না আসলে এসবের মর্ম বোঝাও সম্ভব হতো না।

আর শিফার জীবন ঠিক সাঁঝক বাতিরই মতো।
যতক্ষণ বাঁচবে নিজেকে পুড়িয়ে লড়াইও করবে।
শুধুমাত্র সুমিষ্ট এক সমাপ্তের আশায়। যাতে সে রাত পেরিয়ে নতুন দিনের সন্ধান পায়। অন্যয়ের
পাহাড়কে চূর্ণ করে সত্যের সূর্যকে উদিত করতে পারে। ঠিক এই কারণেই ওর জীবনীর নামকরণ করা হয়েছে; সাঁঝক বাতি।
_________________________________

শিহাব হসপিটালে এসেছে সাফার আম্মুর খোঁজ নিতে। কিন্তু এসে মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। সাফার আম্মু নেই! উনাকে কেউ নিয়ে গেছে। নার্সের বক্তব্যে অনুযায়ী, সুদর্শন একটা ছেলে এসেছিল নিতে। পেশেন্টকে নার্স একবার জিজ্ঞাসা করেছিল,

-‘উনি কি আপনি পূর্ব পরিচিত?’

সাফার আম্মু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক
মাথা নাড়িয়েছেন। অর্থাৎ চিনে। এজন্য নার্সও আর বাঁধা দেয় নি। ওইদিকে স্বপ্নীল আর শিফা নিঁখোজ। এদিকে সাফার আম্মুও! কি হচ্ছে সব? শিহাব আর উপায়ান্তর না পেয়ে দিগন্তকে ফোন দিলো। তবে দিগন্ত রিসিভ করল না। খুব ব্যস্ত বোধহয়! শিহাব দ্রুত বাসায় ব্যাপারটা জানাল।
সবার হতবাক। পুলিশও বাহাত্তর ঘন্টার আগে নিঁখোজের কেস নিবে না। কি করবে কেউ বুঝতে পারছে না। চিন্তাতে শিফার মায়ের প্রেসার বেড়ে গেছে। উনি হাই প্রেসারের রোগী। উনাকে নিয়ে
বাসাতে হুলস্থুল কান্ড। বিপদে বিপদ এসে হানা দিচ্ছে। চিন্তাতে কারো মস্তিষ্কও কাজ করছে না। তমা হাসিবকে ফোন করেও কিছু জানতে পারল না। শিফা কই? আর সাফার আম্মু? দিগন্তকেও ফোনে পাচ্ছে না। সবাই গোলক ধাঁধায় আটকে পড়েছে। না পারছে বের হতে; আর না সমাধান করতে।

দিগন্তের বাবা-মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে।
দিগন্ত এত টাকার ডিল সাইন করেও ভাগ দিচ্ছে নি। অথচ শর্ত এমন ছিল না। এজন্য দিগন্তের মা খুবই ক্ষিপ্ত। এমন বেয়াদব ছেলে পূর্বে দেখেন নি। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও বলে না। এমন ভাব যেন শুনতে পায় না। দিগন্তের বাবাও ছেলেটাকে কিছু বলেন না। বেহায়া একটা। গতরাতেই উনি বলেছিলেন,

-‘দিগন্ত শিফাকে মেরে দাও।’
-‘কেন?’
-‘ওকে বাঁচিয়ে নিজের বিপদ ডেকো না।’
-‘জ্ঞান দেওয়া শেষ? এবার যেতে পারেন।’
-‘মায়ের সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলে?’
-‘মা নয়,সৎ মা। আমারই হসপিটালের সামান্য একজন নার্স।’
-‘আমার ভাগটা দাও।’
-‘ দিবো না। ফারদার বকলে আপনার পার্টসও সাপ্লাই করে দিবো।’

দিগন্তের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারেন নি।
লোকসম্মুখে মা মা করে মুখে ফেনা তোলে আর আড়ালে বাঁশ দেয়। কথার সোজাসাপ্টা জবাবও
দেয় না। কথায় কথায় নার্স বলে অপমান করে।
উনি দিগন্তের বাবার সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন। তখন আশেপাশের মানুষজন বিয়ে পড়িয়ে দেয়।যদিও এটা ছিল উনার পরিকল্পনা।
উনি আগেই অন্য নার্সদের হইচই করার টাকাও দিয়েছিলেন। পূর্বপরিকল্পনা নিখুঁতভাবে সফলও
হয়েছিল। আর দিগন্তের মা মারা গেছেন, ব্লাড ক্যান্সারে। প্রশান্ত যখন ওর পড়াশোনা শেষ করে অবসরে ছিল। আর দিগন্ত তখন ভার্সিটি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মায়ের অবর্মানে মানিয়ে নিয়ে দিন
কাল ভালোই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন দিগন্তের বাবার ডায়বেটিস বেড়ে গিয়েছিল। উনাকে দ্রুত রয়েল হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল। দিগন্তের সৎ মা রেবেকা উনার সেবার দায়িত্বেই ছিলেন।
তারপর গল্পের ছল আর সেই সময়ের প্রেক্ষিতে উনারা সম্পর্কে লিপ্ত হোন।মূলত, উনি দিগন্তের
বাবাকে ফাঁসিয়েছিলেন। বড়লোক মানুষ আর কি লাগে! এই ঘটনাটা একরাতের মধ্যেই চাপাও পড়ে গিয়েছিল। হয়তো টাকার জোরে। প্রশান্তও তখন হসপিটালের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। এজন্য তেমন ঝামেলা হয় নি। দিগন্তরাও বাবাকে কিছু বলেছিল না। বলার, প্রয়োজনও মনে করে নি।
প্রত্যেক পুরুষের নারীর সঙ্গের প্রয়োজন। হোক, শারীরিক তৃপ্তি বা মানসিক! তাছাড়া ওরা যুবক!
ব্যাপারটা ওদেরও অজানা নয়। তবে রেবেকাকে দিগন্ত সহ্য’ই করতে পারে না। কথায় কথায় খুব অপমান করে। গালমন্দও করে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে কথা বলে। বাবার জন্য কিছু বলতে পারে না। রেবেকার কষ্ট লাগলেও কিছু বলতে পারেন না। কারণ দিগন্তের মতো পাষাণ হৃদয়ের মানব উনি দু’টো দেখেন নি। যে ছেলে আপন মামার চোখ তুলতে দু’বার ভাবে না। প্রাক্তন প্রেমিকা, বাসার কাজের মেয়ে, অফিসের পার্টনার, নার্স,
এবং বন্ধুকেও ছাড়ে নি। ওদেরও প্রয়োজনীয় সব পার্টসগুলোই নিয়েছে। টাকার বিনিময়ে বিক্রিও
করেছে। এজন্য তাকে ভুলেও স্বাভাবিক মানুষ বলা যাবে না।

দিগন্ত আর শিফা দু’জনে মুখোমুখি বসে আছে। শিফার মুখভর্তি হাসি আর দিগন্তের চোখে মুখে ক্রোধ। শিফা কফির মগে চুমুক দিয়ে আশেপাশে তাকাল। রেস্টুরেন্টটা খুবই সুন্দর। এটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট। শিফা মুখ বের করে বাইরেটা দেখছে।
নদীর ছোট ছোট ঢেউ ভেসে আসছে।তবে ঘোলা পানি। প্রাণজুড়ানো বাতাস। অদূরে নৌকা দেখা যাচ্ছে। দিগন্ত ক্রোধ নিয়ে বলল,

-‘শিফা কাজটা ঠিক করলে না। এর মূল্য দিতে; প্রস্তুত হও।’

-‘আপনি আসলেই কাপুরুষ। পুরুষত্বের জোর থাকলেই তাকে পুরুষ বলে না। বুকে পাটা থাকা লাগে। যেটা আপনার নেই।’

শিফা কথাটা বলে পুনরায় কফিতে চুমুক দিলো।
আজ ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। দিগন্তের কাজে বাঁধা দিয়েছে! ওর আটকোটি টাকার ডিলে পানি ঢেলে দিয়েছে। দিগন্তের পার্টনারকে আজ জেলে পাঠিয়েছে। সুখু এক্সিডেন্ট করেছে। এই না, না, করানো হয়েছে। শিফা নিজে করিয়েছে। সর্বশেষ
নিহাকে অপহরণ করেছে। আচ্ছা, তনয়ের মতো করলে কেমন হয়? ভালো হয়! এজন্য প্রশান্ত কি
কষ্ট পাবে? হয়তো কাঁদবেও! কিন্ত কি আর করা।
পাল্টা আঘাত না করলে হচ্ছেও না। তা নয়তো
দিগন্তও বুঝবে না। এবার এক ভাইয়ের পাপকর্মে অন্য ভাই কাঁদবে। আহা, চমৎকার সমীকরণ।
সে হসপিটালে লোক লাগিয়ে হাঙ্গামা করিয়েছে। ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়েছে। সঙ্গে, মাখোমাখো ক্যাপশন দিয়েছে। যাকে বলে সোনায় সোহাগা।
এখন লাইক কমেন্টের বন্যা বইছে। এবার মনটা শান্ত হয়েছে। একটু সুখ সুখও লাগছে। এতদিনে
কাজের কাজ হয়েছে। দিগন্ত রাগটা সামলানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে।আজকে সারাদিন সে দৌড়ের উপর ছিল। খাওয়া-দাওয়াও ঠিকঠাক করে নি।
এখন বাজে রাত নয়টা বিশ। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা থাকলেও খেতে পারছে না। সে চিন্তাতে অস্থির।
একটা ঝামেলা সামলাতে গিয়ে আরেক ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। সব হয়েছে, এই বেয়াদব মেয়েটার জন্য। দিগন্ত কিছু বলার আগেই শিফা পেপার
এগিয়ে দিয়ে বলল,

-‘সাইন করুন।’
-‘তুমি কী আমার কিডনী নিবে?’
-‘না, মুক্তি।’
-‘মানে?’
-‘ডিভোর্স।’
-‘পাবে না, আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।’
-‘না দিলেও, আপনার বুকে আমার ছুরি বসাতে আমার হৃদয় কাঁপবে না।’

দিগন্ত হাসল। চুলে হাত বুলিয়ে চেয়ারে আরাম করে বসল। দৃষ্টি উপরের ঘূর্নায়মান সিলিংয়ের দিকে। মেয়েটা পাষাণ। তিতা সত্যিগুলো সহজে বলে ফেলে। যদিও এতে ওর আসবে যাবেও না।
শিফা তখস সময়টা দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,

-‘করবেন কি না?’
-‘না।’
-‘আপনার লজ্জাবোধও কি নেই?’
-‘ছাড়ব না, পারলে ছাড়িয়ে নাও।’
-‘ওকে।’

কথাটা বলে শিফা উঠে চলে গেল। দিগন্ত ঠোঁট উল্টিয়ে হাসল। তারপর দু’জন দু’জনের পথে চলল। দু’জনের মুখে হাসি। তবে তাদের হাসির কারণ ভিন্ন। রাত এখন দুইটা ঊত্রিশ। সুনসান পরিবেশ। শিফা হতবাক হয়ে লেপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর পুরো পৃথিবীটা যেন ঘুরছে।
সাফার সঙ্গে দিগন্ত যে আইডি দিয়ে কথা বলত, সেটা দিগন্তের নয়। এখানে আরেকজন ব্যাক্তি যুক্ত আছে। আর সেই ব্যাক্তির নাম দেখে শিফা আরেকদফা অবাক।

To be continue………!!
(.!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here