সায়াহ্নের প্রণয় পর্ব -০২

#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বিতীয়_পর্ব

৪.
গালে স্পষ্ট হলুদের প্রলেপ লাগানো। গলায়ও বেশ খানিকটা লেগে রয়েছে। আয়নায় নিজের গালের দিকে চোখ যেতেই আতকে উঠে প্রাচী।
– “এগুলো কোত্থেকে আসলো? আমি তো একটু আগেই ফ্রেশ হয়ে আসলাম। কই তখন তো ছিল না এগুলো!”
ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গালে হাত বুলিয়ে নেয় প্রাচী। হলুদের কারণেই ঘুমের ঘোরে থাকা সত্ত্বেও বেশ ঠান্ডা লাগছিল। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও কাউকে খুঁজে পেল না সে।
– “দরজা, ব্যালকনি সবই তো বন্ধ। তাহলে রুমে কেউ আসবে কি করে? আর মাঝরাতে কেই বা এমন উদ্ভট কাজ করতে পারে?”
হিসেব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রাচী। কিন্তু পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে ব্যালকনির দরজা খুলতেই রাতের এক দমকা শীতল বাতাস তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। ব্যালকনিতে এডজাস্ট করা লাইটটা সন্তর্পণে অন করে নেয় সে। বাড়ির সবাই বেশ ব্যস্ত থাকায় এত রাতে কারো জেগে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ব্যালকনি থেকে চারপাশে নিচে চোখ বুলিয়ে নেয় প্রাচী। তবে ঘুটঘুটে অন্ধকার হওয়ায় তেমন কোনো লাভ হয়নি। পেছনে ফিরে রুমের দিকে প্রবেশ করবে এমন সময় কিছু একটা পায়ের স্পর্শ পেতেই থমকে দাঁড়ায় সে। ভ্রু কুঁচকে হাঁটু গেড়ে নিচে বসতেই সিলভার রঙের একটা ছোট্ট রিং চোখে পড়ে প্রাচীর।
সন্দিহান হয়ে রিং টা তুলে নেয় সে। দেখে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে এটা কোনো ছেলের হাতের রিং কেননা এর ডিজাইন টাই একটু অদ্ভুত ধরনের যা সচরাচর কোথাও দেখা যায় না। রিং টা হাতে তুললেও মনে একপ্রকার ভয় জেঁকে বসেছে প্রাচীর।
– “এটা তো নিশ্চিত যে কেউ তো এসেছিল আমার রুমে। কিন্তু কে সে?”

রুমে এসে ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে দেয় প্রাচী। নভেম্বরের শেষের দিকে হওয়ায় এমনিতেই বেশ ঠান্ডা পড়েছে। তাছাড়া একটু আগেই ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে বেশ চিন্তিত করে তুলেছে। মিনিট পাঁচেক বাদে ফজরের আযানের ধ্বনি কর্ণকুহরে‌ পৌঁছাতে নড়েচড়ে বসে প্রাচী। বিয়ে বাড়ির বিশাল আয়োজন আর অন্যদিকে অজানা আগন্তুকের চিন্তায় সে রাতে চোখে আর ঘুম জড়ো হলো না প্রাচীর।
পরদিন সকালে,,
হোসেন বাড়িতে সকাল থেকেই চারপাশে মেহমান দিয়ে গমগম করছে। বিয়ে বাড়ির লোকজনদের মাঝে প্রাচীও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন কাজে। আর একটু পরেই বরপক্ষ রওনা দিবে কনে পক্ষের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সব আয়োজন শেষে রুমে তৈরি হওয়ার জন্য প্রবেশ করে প্রাচী। বাড়িতে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চাদের তৈরি করার দায়িত্ব পড়ে প্রাচীর উপর যার জন্যেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।
ডার্ক ব্লু রঙের শাড়ি, হাতে মুঠো ভর্তি ব্লু রঙের কাঁচের চুড়ি, মুখে ভারী মেকআপের আবরণ, চুলগুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে দেওয়া। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করছিল এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে পা বাড়ায় দরজার দিকে। দরজা খুলতেই অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশের উপর চোখ পড়ে সিরাতের‌।

– “কি ব্যাপার আকাশ, তুই এখানে? কিছু লাগবে?”
স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে প্রাচী।

– “না তেমন কিছু না, রেডি হয়ে ভাবলাম তোকে ডেকে নেই। একসাথে যাওয়া যাবে, আর এমনিতেই লেট হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চল।”
আকাশ তাড়া দিতেই প্রাচী গিয়ে টেবিলের উপর ফোনটা নিতে যাবে তখনই চোখ পড়ে টেবিলের উপর থাকা আংটি টার উপর। একপলক তাকিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয় সে। অতঃপর পা বাড়ায় বাইরের দিকে।

৫.
বাসার সামনেই পরপর চারটে গাড়ি দাঁড় করানো। জেবা বেগম, আনোয়ার হোসেন সহ বাড়ির বড় সদস্যরা এক গাড়িতে বসেছেন, বাকি দুই গাড়িতে পর্যায়ক্রমে বর ওরফে ইশরাক আর বাড়ির মাঝবয়সী বাচ্চারা বসেছে। আর একটা মাত্রই গাড়ি ফাঁকা রয়েছে। প্রাচী তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে ফাঁকা সিট খুঁজতেই সামনে থাকা গাড়ি থেকে আনোয়ার সাহেবের কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
– “কি ব্যাপার প্রাচী, দাঁড়িয়ে আছো কেন? শীঘ্রই সমুদ্রের সাথে গিয়ে পেছনের গাড়িতে বসে পড়। বাড়ির বড়রাও সবাই যার যার মতো বসে পড়েছে। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আনোয়ার সাহেবের কথা শুনে হাসিমাখা মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল প্রাচীর। একপ্রকার বাধ্য হয়ে গোমড়া মুখে গুটি গুটি পায়ে গাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাড়াতেই ভেতরে এক কোণে বসে থাকা সমুদ্রের উপর নজর পড়ে প্রাচীর।
– “যতই বলি এই লোকটার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকব কিন্তু না। কোনো না কোনো ভাবে ঘুরে ফিরে এই লোকটার সাথেই দেখা হয়ে যায়। একেই বলে রে নসিব প্রাচী। তোর নসিবে মনে হয় এই বিরক্তিকর লোকটার সাথেই বার বার দেখা হবে। ভালো লাগে না আর।”
মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে প্রাচী।

– “এক্সকিউজ মি, গাড়ির সামনে এভাবে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসো। এমনিতেই তোমার জন্য প্রচুর লেট হয়ে গিয়েছে। নাহলে পড়ে দেখা যাবে তোমার জন্য তোমার ভাইয়ের বিয়েটাই না দেরি হয়ে যায়। ইডিয়ট একটা।”
ফোনের স্ক্রিনের উপর চোখ রেখেই গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে সমুদ্র। এদিকে সমুদ্রের বলা প্রতিটা কথা যেন শরীরে সুচের মতো বিঁধে প্রাচীর। রাগে ক্ষোভে শাড়ির আঁচল গুটিয়ে নিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে সে। কিছুক্ষণ পর আকাশ এসে গাড়ির দরজা খুলে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়তেই গাড়ি চলা শুরু করে তার নিজস্ব গতিতে।
অনেকটা দূর হওয়ায় বেশ খানিকটা সময় কেটে যায়। গাড়ির অপর প্রান্তের সিটে বসে থাকা সমুদ্রের দিকে মাঝে মধ্যে আড়চোখে তাকায় প্রাচী। তবে এ কয়েক বছরে সে এটা ভালো করেই বুঝেছে অন্য সবার সামনে হাসিখুশি থাকলেও তার সামনে মুখে যেন রাজ্যের গাম্ভীর্যতা‌ নেমে আসে। প্রাচী যখন সমুদ্রকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত সমুদ্রের দৃষ্টি তখন ফোনের স্ক্রিনে স্থির।
– “নিশ্চয়ই সো কল্ড‌ গার্লফ্রেন্ডের‌ সাথে চ্যাটিং করছে। অথচ এদিকে আমি কোনো দোষ না করলেও ননস্টপ বকবকানি শুনতে হয় তার কাছ থেকে। কেন যে আবারো দেখা হতে হলো এই লোকটার সাথে। চারটা বছর তো খুব ভালো ভাবেই কেটেছিল। এখন যে কয়েকদিন বিডিতে থাকবে ততদিনই কোনো না কোনো ভাবে উনার সামনে পড়তে হবে।”
বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বিড়বিড় করে প্রাচী।

– “কি ব্যাপার রে প্রাচী, মুখটাকে ওভাবে পেঁচার মত করে বাইরে তাকিয়ে আছিস কেন? তোর একমাত্র বড় ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা, একটু তো হাসিখুশি থাক।”
আকাশ পেছনের দিকে ফিরে কথাটা বলতেই বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল প্রাচী। চোখ গরম করে তাকাতেই আকাশ জিভ কেটে সামনে তাকায় আকাশ। এদিকে সবটাই সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করে নেয় সমুদ্র। চোখে চশমা থাকা সত্ত্বেও তার আড়ালে চোখ দুটোতে লুকিয়ে আছে কিছু অজানা, কিছুটা রহস্য।

৬.
লাল টুকটুকে রঙে বধূ বেশে সেজেছে ফিহা। আজ এতটা বছর, এতটা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর তার ভালোবাসার মানুষটি ওরফে ইশরাক কে নিজের করে পেতে চলেছে সে। ফিহা। পুরো নাম প্রিয়াশা‌ আহমেদ ফিহা‌। বাবা মা আর ছোট বোনকে নিয়েই তার পরিবার। আর ইশরাক? সে তো তার কল্পনাময় পৃথিবী। দু পরিবারের মতামতেই আজ তার প্রিয় ব্যক্তিটির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে ফিহা‌।
কাজী সাহেবের সামনেই মাথা নতজানু করে বসে আছে ফিহা‌। তার ঠিক অপর পাশেই বর বেশে বসে আছে ইশরাক‌।
– “বলুন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
প্রথমে নিজের মাঝে হালকা জড়তা কাজ করলেও পরক্ষণেই বড়দের কথায় মাথা নতজানু অবস্থায় ই ফিহা বলে উঠে, কবুল।
অতঃপর দুজন ভালোবাসার মানুষ বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছে। সারাদিনের ধকলে শরীর বেশ ক্লান্ত হয়ে এসেছে প্রাচীর। রুমের সব ডেকোরেশন চেক করে বের হতে সামনে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রের উপর নজর পড়ে তার। সাদা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পরনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে সমুদ্র। সমুদ্রের দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা শুরু করে প্রাচী। এদিকে সমুদ্র বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত।
অন্ধকার আকাশের মাঝে অজস্র তারা মিটমিট করে জ্বলছে। তার মাঝে পূর্ণ থালার মতো চাঁদ ও ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল প্রাচী। চোখে ক্লান্তি আর ঘুমের ছাপ। হুট করে কাঁচ ভাঙার আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে প্রাচী। ভীত চোখে তড়িঘড়ি করে পাশের সুইচ অন করে লাইট জ্বালিয়ে দিতেই মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরোর উপর নজর পড়ে তার। ব্যালকনির কাঁচের দরজা নিচ থেকে খানিকটা গোল হয়ে ভেঙে গিয়েছে। কে করতে পারে এমনটা আর কিসের জন্যেই বা এতকিছু ভেবে অতি সন্তর্পণে খাট থেকে নিচে নেমে পড়ে প্রাচী। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিতেই টেবিলের কোণায় মোড়ানো কাগজ দেখতেই ভ্রু কুঁচকে নেয় সে। ধীর পায়ে এগিয়ে কাগজটা হাতে নিতেই ভেতরে একটা মাঝারি আকারের পাথর দেখতে পায় সে।
সন্দিহান চোখে কাগজটায় তাকায় প্রাচী। কাগজে কালো রঙের কালি দিয়ে লেখা রয়েছে কিছু। ভালো করে লেখাগুলো পড়তেই পুরো শরীর হিম হয়ে আসে প্রাচীর। বিস্ফোরিত চোখে কাগজটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ব্যালকনির দিকে তাকায় প্রাচী।…………….

#চলবে 🍂

হ্যাপি রিডিং 🌼

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here