সাহেব বিবি গোলাম পর্ব ১০

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১০

,
,
শুভর আপা রাতের খাবার খাওয়ার জন্য যখন আমায় ডাকলেন তখন আমি বারবার কেঁপে কেঁপে উঠলাম।মহিলাটি আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালেন।বললেন,

—কি সমস্যা?

আমি শুকনো হেসে মাথা নাড়লাম।সমস্যা আবার কি?জিবনজুরেই তো আমার সমস্যায় ভরা।
শুভ ডাইনিংয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,

—ওর কোন সমস্যা নেই রে আপা,তুই বোস তো।

মহিলাটি আমার দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টি ফেলে চেয়ার টেনে বসলেন।
সবার প্লেট এ খাবার বেড়ে দিলেন।আমি খাবার আঙুলের ডগা দিয়ে নাড়াচাড়া করলাম খানিকক্ষণ।
আমার মোটেও এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা।খাবার গলা দিয়ে নামবে না আমার।
জিবনটা একটা অদ্ভুত আঁকাবাঁকা পথ মনে হচ্ছে।যে পথ মোটেও মশ্রীন নয়,কাঁটায় পরিপূর্ণ।
কখন কোনদিকে মোড় নেবে তা কেউ জানেনা।জানতে পারেওনা।
তবে অন্যসবার তুলনায় নিজের জিবনের পথটাকে বেশি কন্টকাকীর্ন মনে হচ্ছে।
সবার জীবন কি স্মুথলি এগিয়ে যায়।আর আমার জিবন?এমন টা কেনো?
ভালবাসার মানুষের এতো অভাব কেনো আমার জিবনে?মা আর প্রিতম ছাড়া আর কেউ কেনো নেই আমার পৃথিবীতে?
কিন্তু প্রিতম?সে কি অদৌ আর আমার আছে?আমার জিবনটা যে অন্যকারো জিবনের সাথে জুরে গেছে?এক অনাকাঙ্খিত বন্ধনে বাধা পরেছি যে দুজন।এ বন্ধন কি সহজেই ভাঙা যাবে?
প্রিতম তখনও কি একই ভাবে ভালবাসবে আমায়?মেনে নেবে তো সে?

শুভর আপার কথায় আমার ভাবনার ছেদ ঘটলো।সে জোরে টেবিলে বারি দিয়েছে।
বললেন,

—খাওয়া বাদ দিয়ে গবেষনা হচ্ছে নাকি টেবিলে?
এসব এ বাড়িতে চলবেনা।খাওয়ার সময় চুপচাপ খেয়ে উঠতে হবে,এবং প্লেট পুরো খালি করতে হবে।

শুভকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—শুভ,তোর বউকে বুঝিয়ে দে।

শুভ আমার গা ঘেসে সরে বসলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

—বোঝাবো বউ?

আমি চোখ গরম করে তাকালাম।শুভ সেদিকে কোন পাত্তাই দিলোনা।আবার নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
আমিও খেতে শুরু করলাম।
ভয়েই হোক আর যাই হোক আমি পুরো প্লেটের খাবার খেয়ে তারপর টেবিল ছেড়ে উঠলাম।
শুভর আপা আমার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার সামনে ঠায় বসে রইলেন।
যেনো আমি খাবার না খেয়ে উঠলেই তিনি আমায় খপ করে পাকড়াও করবেন।
,

,

ঘরে ঢুকে আরোও এক বিপদের মুখোমুখি হলাম।আমার সাথে কোন এক্সট্রা জামা নেই।বিয়ের শাড়ি পরে তো আর ঘুমানো যায়না।তাছাড়া সমস্যা একটা না,আরও আছে।
এটা শুভর রুম।শুভ এই রুমেই থাকবে এবং এই বিছানাতেই।
তাহলে আমি কোথায় থাকবো?শুভর সাথে?উহু,কক্ষনো না,মরে গেলেও না।
আমি বারবার মাথা ঝাকালাম।
শুভ এতক্ষন ওয়াশরুমে ছিলো।আমাকে মাথা ঝাকাতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো।বললো,

—কি হলো বউ?পাগল হয়ে গেছো নাকি?
নাকি বাউল হতে মন চাইছে?
কোনটা?

আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম।লোকটা তো বিশ্ব শয়তান!যখনই কথা বলে তখনই কি তার মুখ থেকে এসব আজগুবি কথাই বেরোয় নাকি?
কই আমি তো এইসব বলিনা,কাউকে রাগাইও না।
আমাকে কথা বলতে না দেখে শুভ আবার বললো,

—এবার কি বোবাও হয়ে গেছো?জিহ্বায় কিছু হয়েছে?নাকি গলায়?আচ্ছা মাথার সমস্যা গলায় নামেনি তো?

আমি তেড়ে গেলাম।আঙুল উচিয়ে তার চোখের সামনে নিয়ে বললাম,

—দেখুন!

শুভ একটু সরে দাড়ালো।আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত গাঢ় একটা নজর বুলিয়ে বললো,

—দেখলাম।
আমি অগ্নি দৃষ্টি ফেলতেই সে মাথা নামালো।হেসে বললো,

—আরে রাগ করো কেনো?আরও ভালো করে দেখতে বলছো নাকি?মানে উইথ আউট জামা কাপড়?

আমার রাগ কন্ট্রোল হচ্ছে না কেন যেনো।ভেতরটা ফুসে উঠছে।কি পরিমান বদ ছেলে?কিন্তু এই মুহুর্তে আমি রাগতে চাচ্ছি না।ঝগড়াও করতে চাচ্ছিনা।শুভর বোন এ বাড়িতে আছে।সে আমার দিকে কেমন রাগী রাগী ভাবে তাকায়।আমার খুব ভয় করে।
এখন যদি এসে দেখে প্রথম দিনই আমি তার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছি তখন সে নিশ্চয়ই রেগে যাবে।
আমি সে রিক্স নিতে চাইনা।
রাগ কমানোর জন্য আমি চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম।
নিজেকে শান্ত করে শুভর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলাম।
বললাম,

—সব কথা পরে হবে,আগে স্বামীর দায়িত্ব পালন করুন তো!

শুভ একটু অবাক হলো বোধহয়।বড়বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।তার সাথে আমি এতো ভালো করে কখনো কথা বলেছি কিনা সন্দেহ আছে।
সে আবুলের মতো হেসে বললো,

—বলো বউ,কি করতে হবে?

—শাড়ি বা জামা এনে দিন আমায়।

—আমি?এখন?কিন্তু কেনো?

—কেনো মানে?আমি পরবো না?এই বিয়ের শাড়ি পরে কতক্ষণ থাকবো বলুন তো?

শুভ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে নিজের শার্ট খোলা শুরু করলো।
আমি দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকলাম।
—আরে আরে করছেনটা কি?জামা খুলছেন কেনো?
আমি কি আপনার জামা পরবো নাকি?

শুভ বললো,

—বুদ্ধি সব কোথায় রাখো বলোতো?হাটুর নিচে?

আমি ফট করে চোখ খুলে চোখ কুচকে তাকালাম।

—মানে?

—আমার জামা তোমায় পরতে দেবো এটা তুমি ভাবলে কিকরে?আমি তো বাইরে জামা কিনতে যাবো,তাই শার্টটা বদলাচ্ছিলাম।

একটু থেমে দুষ্টু হেসে বললো,

—কিন্তু তুমি কেনো মুখ ঢেকেছিলে?আমি তো তোমারই স্বামী নাকি?আমায় দেখলে আমি একটুও রাগ করবো না।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

—আপনি কি জানেন,আপনি একজন অসভ্য বদ ছেলে?

শুভ অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,

—কে?আমি?তুমি বলতে পারলে এটা?
একটু ঝুকে এসে বললো,

—কি এমন অসভ্যতামী করেছি তোমার সাথে?বরংচ তুমিই আমার সাথে অসভ্যতামো করেছো?

—আমি?

—হু,ঐযে বাসের মধ্যে?আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমালে?জ্যাকেট টেনে নিয়ে নিলে?আরও কতো কি করলে?
নেহাৎ আমি সহজ-সরল সাধাসিধা মানুষ,নয়তো অন্যকোন ছেলে হলে কি যে হতো!

আমি তেড়ে গিয়ে সামনে দাড়ালাম।
সহ্যের একটা সীমা থাকে।এমন বদ ছেলের উপর রাগ না করে থাকা যায়।
বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলাম।
তবে আমার ভাগ্য খারাপ।বিশাল আকারে খারাপ।
নয়তো এমন মুহুর্তে শুভর বোন এসে সামনে দাড়ায়?
তিনি অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শুভর দিকে তাকালেন।
বললেন,

—ঝগড়া করে মন ভরেনি?এখন তোরা মারামারি করছিস?

আমি মাথা নিচু করে দাড়ালাম।দেখলাম শুভর মুখে শয়তানি হাসি।
মহিলাটি আমার হাত টেনে ধরলেন।

—চলো আমার সাথে।

আচমকা এমন কিছু বলবে শুভ হয়তো আশা করেনি।সে বলে উঠলো,

—ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আপা?

—আমার ঘরে!

—কেনো?

—কারন আজ ও আমার সাথে আমার ঘরে ঘুমোবে।মারামারি করার জন্য আমি এখানে ওকে মোটেও রেখে যাবোনা।

বলেই তিনি আমায় নিয়ে রুম থেকে বাইরে বেরোলেন।আমার হাত ধরে রুম থেকে বেরোনোর আগে আমি একবার শুভর দিকে তাকালাম।
তার হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেছে।
কেমন অসহায়ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
মনে মনে আমার বেশ আনন্দ হলো।বেটা থাক এখন একা একা,কর ঝগড়া নিজের সাথেই।
,

,

চলবে…..

(আজ রাতে আরেকটা পার্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো)
#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#Extra_part
,
,

খাটের এককোনে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে আছি আমি।পাশে শুয়ে আছেন শুভর আপা।
নামটা কি আমি জানিনা।তবে এই মুহুর্তে আমার ঘুম আসছেনা।এতো এতো চিন্তা নিয়ে কারো ঘুম আসেনা।তাছাড়া পাশে শোয়ারত মহিলাটিকে কেনো যেনো আমার ভয় লাগছে।হয়তো শশুড়বাড়ির লোক সম্পর্কে সব মেয়েদের মনেই কিছু ভীতি থাকে।ভয় পেলে কারো ঘুম আসে নাকি?
আমি উশখুশ করতে থাকলাম।
খুব করে মায়ের কথা মনে পরছে আমার।ঘুম না আসলে মা আমায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।যত্ন করে কোলে মাথা রেখে শোয়াতেন।
কি যে ভালো লাগতো আমার!
চোখের কোনে অজান্তেই পানি জমতে শুরু করলো।আমি আলগোছে চোখের পানি মুছলাম।
ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা মহিলাটি বলে উঠলেন,

—তোমার কি ঘুম আসছে না পিহু?

আমি মাথা নাড়লাম।পরক্ষনেই জিভে কামড় দিলাম।কি পরিমান বলদ আমি!এই অন্ধকার ঘরে মাথা নেড়ে উত্তর দেওয়ার কোন মানে আছে?তাছাড়া উনিও তো ওপাশ ফিরে শোয়া।
আমার কথার জবাব না পেয়ে আবার বললেন,

—পিহু?

—হ্যাঁ,জ্বী! জ্বী!
না মানে হ্যাঁ,মানে!

আমাকে আমতাআমতা করতে দেখে উনি উঠে বসলেন।পাশের সেন্টার টেবিলে হাত দিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালেন।
বললেন,

—কি হয়েছে?খারাপ লাগছে তোমার?

—না তো!

উনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন।বললেন,

—তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছো পিহু?

আমি মাথা নিচু করে চুপ থাকলাম।কিছু কথার সরাসরি উত্তর দেওয়া যায়না।মুখপর ওপর তো না ই।

আমার নিরবতায় উনি যা বোঝার বুঝলেন।মাথা নাড়লেন কিছুক্ষণ।
বললেন,

—ঘুম না আসলে আমার কাছে এসো,আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখো ঠিক ঘুম আসবে।

আমি ইতস্তত করতে করতে এগোলাম।কোলে মাথা টেনে নিলেন তিনি।পরম যত্নে হাত বুলালেন।আবেশে আমার চোখ বুজে এলো।
মনে হলো আমি যেনো মায়ের কোলেই আছি।কি মমতামাখা ছোয়া!বড় বোনের মাঝে যে মায়ের ছায়া থাকে তা কি সবাই জানে?
আমি সাহস জুগিয়ে বললাম,

—আমি আপনাকে কি বলে ডাকবো?
আমার কথা শুনে তিনি হাত থামালেন।আমি সেদিকে তাকালাম না।কেনো যেনো হুট করে আমার সাহস বেড়ে গেছে।মহিলাটিকে এখন মোটেও ভয় করছেনা আমার।বরংচ নিজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু কেনো?এভাবে মমতা ভরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন বলে?নাকি ওনার বাইরের খোলসের ভেতরে একটা নরম মনের সন্ধান পেয়েছি বলে?

—আপা বলে ডাকি?

আপা মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলানো পুনরায় শুরু করলেন।
বললেন,

—তাহলে আমিও কিন্তু তুই বলে ডাকবো,তুমি বললে কেমন পর পর লাগেরে।

আমি মুচকি হেসে সায় জানালাম।
আপা বললেন,

—আমার ভাইটা খুব ভালো জানিস পিহু।খুব খুব খুবই ভালো।তুই হয়তো এখন বুঝতে পারছিস না,কিন্তু একসময় ঠিকই বুঝবি।
তোকে ভালোও বাসে।
খুবই ভালবাসে।
প্রথম যেদিন তোকে দেখেছিলো সেদিন এসেই আগে আমার কাছে এসে তোর কথা বলেছিলো জানিস?

আমি চমকে উঠে বসলাম।
কে ভালবাসে?কাকে ভালবাসে?
আমি কি কানে ভুল শুনলাম?কানটা একবার হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে নিলাম আমি।
চোখ বড়বড় করে বললাম,

—কে ভালবাসে?

আপা চোখ গরম করে তাকালেন।বললেন,

—আমার কথ তুই কিচ্ছু শুনিসনি?যাহ আর বলবোই না তোকে!তুই ঘুমো আয়।

আমি কথা বাড়ালাম না।চুপচাপ শুয়ে পরলাম।মনে মনে কথাগুলো বারবার আউড়ালাম,শুভ ভালবাসে আমায়?
কিন্তু? নাহ কিছুতেই না,ভালবাসলে কেউ এমন ব্যবহার করে?এতোটা রাগায়?ভালবাসার মানুষকে কেউ কষ্ট দেয়?
আপা নিশ্চয় ভুল বলেছে।নয়তো ভুল জানে সে।
আমার প্রিতমও তো আমায় ভালবাসে।সে তো কক্ষনো আমায় কষ্ট দেয়না?কক্ষনো রাগায়ও না।
পরক্ষনেই একটা কথা মনে পরলো আমার।আমি শুভর ফোন দিয়ে এখন নিজের আইডিতে ঢুকে প্রিতমের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
মামা তো এখন আর বাধা দিতে পারবেনা।সে তো নেই এখানে।
খুশিতে ডগমগ করতে করতে আমি চোখ বুজলাম।
কাল সকালেই শুভর কাছে তার ফোনটা চাইবো আমি।
সে নিশ্চয় না করবেনা।

,

,

চলবে…..

(আজ আরেকটা পার্ট দেওয়ার কথা দিয়েছিলাম ঠিকই তবুও সময় করে উঠতে পারিনি।তার জন্য স্যরি।
তবে কথা দিয়েছিলাম বলে
তাড়াহুড়ো করে এতোটুকু লিখেছি।
বড় পার্ট দিতে না পারায় ক্ষমা করবেন প্লিজ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here