সিঙ্গেল মাদার পর্ব ৮

#সিঙ্গেল_মাদার
#ফাবিহা_ফারিন_প্রিয়ন্তী
পর্ব:০৮

ইরিনের মুখে আর কোনো কথা নেই চুপচাপ মেঝেতে বসে কান্না করছে , আর ইপ্সিতা পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ।
ইরিনের মা কান্না থামিয়ে জিগ্যেস করল

– “ইরিন কেন এমন টা করলি আমাদের না জানিয়ে” ? আমাদের উপর ভরসা করতে পারলি না” ?

– আমি ভুল করে ফেলেছিলাম মা বিশ্বাস করো আমি এমন করতে চাই নি !

-শাহানা বেগম রেগে বললো তবে তুই কেমন করতে চেয়েছিলি , বাচ্চা বড় করে আমাদের সামনে আসবি ?

-ইরিন আর কিছু বলতে পারছে না সে কিভাবে বলবে সৌমিকের পাগলামী কে সাই দিতে গিয়ে আজ এমন‌টা হয়েছে ।

– “ভুল বুঝছো মা আমরা জানিয়ে দিতাম শুধু সৌমিকের চাকরির জন্য অপেক্ষা করছিলাম” ।
– “তোর তো নিজেরই পড়া লেখা শেষ হয় নি আর এর মধ্যে এতো কান্ড ঘটিয়ে ফেললি , বিয়ে করতে হলে আমাকে বললি না কেন আমি করিয়ে দিতাম ভালো কোনো ছেলের সাথে ।
ছিঃ তুই তো মেয়ে নামের কলঙ্ক আমাদের সব মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলি” ।

এবার ইরিনের বাবা চুপ থেকে কথা বলে উঠলো

– থামো শাহানা যা হওয়ার হয়ে গেছে ওকে বলতে দাও এবার , তুই বল ছেলের পরিচয় , কি করে কোথায় থাকে ??

– আজ তোমার লাই পেয়ে মেয়েটার এই সর্বনাশ হয়েছে আমরা কি লেখা পড়া করি নাই , আমাদের বাবা মা তো আমাদের এতো স্বাধীনতা দেয় নি , আর কতো চুপ করে থাকবো আমি , শুধু যে বিয়ে করে এসেছে তা তো নয় আর কিছু দিন পর ওর শরীরের গঠন চেঞ্জ হবে তখন লোকে কি বলবে আমরা কি বলে সবাইকে থামাবো ?

– আমি ভুল বুঝেছিলাম শাহানা আমার রাজকন্যা টা অনেক বড় হয়ে গেছে সে তাকে আগলে রাখার জন্য আর এই বাবাটার কথা ভাবে না ।
যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ ছেলের সাথে তার বাবা মা কে ডেকে এনে আবার বিয়ে দিয়ে দিতে হবে ।

যাই হোক ইরিন তুই বল –

– বাবা ওর নাম সৌমিক আহসান , বাড়ি বরিশাল আমাদের ভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্সে পড়ছে ।

– সৌমিক কে সাথে করে কেন আসলি না এখানে আমাদের কাছে ??

– বাবা ও আসতে চেয়েছিল টিকিট ও কেটেছিল শেষ পর্যন্ত আসতে পারে নি , আমি ওর ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না ।

শাহানা বেগম চুপ থেকে বলে উঠলো
– তোকে তো বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে ভাবতাম ইরিন আর শেষ পর্যন্ত কি না একটা ফর্ড ছেলের হাতে পড়লি ?

– মা সৌমিক খারাপ ছেলে না ।

– তুই চুপ কর , ভালো মন্দ না‌ বুঝে নিজের সবটুকু তো খুইয়ে এসেছিস এখন ছাফায় গাইতে এসেছিস !

জামাল সাহেব এবার একটু গম্ভীর কন্ঠে বললো-
” দেখ ইরিন তোকে বিশ্বাস করেছিলাম সেটা ভেঙ্গে দিয়েছিস , বাকিটা সম্মান যেটুকু আছে সেটা আমি নষ্ট করতে চাই না ‌। তোকে আমি এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি তার মধ্যে তুই সৌমিক কে আমাদের সামনে আনবি নয়তো তোর এই বেবি ক্যারি করতে পারবি না যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কিছু করার চেষ্টা কর নয়তো‌ আমার হাতে আর কোনো অপশন খোলা থাকবে না” ।

বাচ্চা ক্যারি করতে না দেওয়ার কথা শুনে ইরিন চমকে উঠলো , এতোবড় কথা ও তো ভাবেই নি ।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো “আচ্ছা” ।
বলেই রুমে চলে গেল ।
ইরিন রুমে আসার পরেই ফোন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল , ইপ্সিতা অনেকক্ষণ ধরে ভাবছে রুমে যাবে কি যাবে না শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো “আপু আসবো” ??
– হুম আয় , কিছু বলবি ??
– আপু তোমার বিয়ে হয়ে গেছে ? তোমার বাবু হবে ?
ইরিন অবাক হয়ে দেখছে ছোট্ট একটা মেয়ের চোখেও নিজেকে নিয়ে প্রশ্নের সমাহার , তবে আমি সত্যি ভালো বোন আর আদর্শ মেয়ে হতে পারলাম না ।
– “আপু বলো‌” !
– ইপ্সিতার কথায় ইরিনের মনোযোগ ভাঙলো, ইপ্সিতার হাত টেনে ইরিন পেটের উপর রেখে বললো “তুই খালামনি হবি ইপু” ।
ইপ্সিতার চোখে মুখে আনন্দের ঝলক দেখা গেল
– “সত্যি আপু বাবু হবে , আমরা কতো মজা করবো বাবুর জন্য দোলনা কেনা লাগবে , ঝুনঝুনি কেনা লাগবে ” ।
– ইরিনের মলিন মুখেই এক টুকরো হাসির রেখা দেখা গেল ।
ফোনে ট্রাই করেও কিছুতেই পাচ্ছে না সৌমিককে, আগের মতোই ফোন অফ আবার ও মিথি কে ফোন দিল ।
একবার কল কেটে যাওয়ার পর মিথি ফোন উঠালো ।
– হ্যালো কে ?
– মিথি আমি-
– ইরিন বল ,
– বলছি সৌমিকের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল ??
– ইরিন তুই ও তো পাগল হয়ে যাচ্ছিস, খোঁজ পেলে কি তোকে জানাতাম না ??

মিথির এই বিরক্তি ভাবে কথা বলা তে ইরিনের একটু খারাপ লাগলো , ও ভাবলো আসলেই তো অনেক জ্বালাচ্ছে সবাই কে ও শুধু একটা খোঁজ নেওয়ার জন্য ।
মিথি বিষয়টা বুঝতে পারলো তার কথায় হয়তো ইরিনের খারাপ লেগেছে তাই আবার বললো –

– ইরিন আসলে তুই এতো টেনশন করিস না এই মুহূর্তে তোর এতো টেনশন কি ভালো হবে বলে তো ?? এখন তো তুই একা না আর আমারা সব সময় খবর নিচ্ছি খোঁজ পেলেই তোকে জানাবো ।

ইরিন ও আর কথা বাড়ালো না ফোনটা রেখে দিল ।

এভাবে কেটে গেল আরো চারটি দিন ইরিন আর স্থির থাকতে পারছে না , সবাই কে ফোনে অতিষ্ঠ করে তুলেছে সে ।
পরিবার থেকে চাপ দিচ্ছে , পরিবারের সবাই ধরেই নিয়েছে সৌমিক আর ফিরবে না ও ধোঁকা দিয়েছে ইরিন কে তাই আর সময় দিতে চাই না ।
– শুনছো ইরিনের বাবা আরো সময় পেরিয়ে গেলে ইরিনের ক্ষতি হয়ে যাবে, কিছু একটা করার দরকার ।
– আমিও ভয় পাচ্ছি শাহানা আমাদের আর সময় দেওয়া যাবে না ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌।
– কিন্তু মেয়ে তো রাজি হবে না !
– রাজি না হলে কৌশলে সবটা করতে হবে , আমরা তো সব রকম সুযোগই দিলাম কিন্তু ছেলে তো আসলো না ।
– আমি আগেই বলেছিলাম একটা ফর্ড ছেলের পাল্লায় পড়েছে আমাদের মেয়েটা ।
বলেই কান্না শুরু করলো শাহানা বেগম ।

– আহ্ শাহানা থামো, এখন কান্নার সময় না । কাল ইরিন কে বুঝিয়ে শুনিয়ে চেকআপের নাম করে ওকে রুমানার ক্লিনিকে নিয়ে এসো বাকিটা আমি ম্যানেজ করে রাখবো ।
– আচ্ছা তবে তাই করবো ।

বলেই দুজনে শুয়ে পড়লো আর ইরিন রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো ।
মনে হলো যেন আকাশ ভেঙ্গে ওর মাথায় পড়লো। চিরচেনা লোকগুলো অচেনা রূপ ধারণ করলো ।
ইরিন ছুটে রুমে চলে গেল
মাথায় এখন একটাই কথা কিছু একটা করতে হবে , সৌমিক যদি চিট ও করে এই বাচ্চা কে সে কিছুতেই কিছু হতে দেবে না । ফোন হাতড়ে সময় দেখলো ১০:৩০ টা বাজে , ওদের বাড়িতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে ।

ইরিন ব্যাগ থেকে টিকিট বের করলো কাউন্টারে ফোন দিয়ে জানতে পারলো রাত ১২:৩০ টাই কুষ্টিয়া- চট্টগ্রাম আগত একটা বাস ঢাকা ক্রস করবে , সিট করে দেওয়া যাবে ।
আর এক মুহূর্ত ও লেট করলো না ব্যাগ গুছিয়ে রেডী হয়ে নিল , ইপ্সিতা আলাদা রুমে থাকে ওর রুমে এখন কেউ আসার কোনো রকম ভয় নেই । একটা চিরকুট লিখে ড্রেসিনটেবিলের আয়নায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিল ।
ফোন থেকে একটা ক্যাব বুকিং করে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের ঠিকানা দিল সব কিছু রেডি হয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় পেটে হাত রেখে বললো-
“পুচকু তোর জন্য আমি সব করতে পারবো , আজ তোর মাম্মাম নিজের বাড়ি ছাড়লো তোর জন্য” ।
বলেই দুফোঁটা জল হাতের উপর গড়িয়ে পড়লো ।
আর দেরি না করে ইরিন বেরিয়ে পড়লো , চুপচাপ বেরিয়ে এলো বাসা থেকে ।
৪৫ মিনিট মতো সময় লাগলো বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে ।
ইরিন একটা টিকিট নিয়ে বসলো , টেনশনে এতোটাই মগ্ন ছিল যে আশেপাশে খেয়াল পর্যন্ত করে নি ।
হঠাৎ ইরিনের নাকে সিগারেটের গন্ধ এলো পাশে তাকাতেই দেখতে পেল কতো গুলো বখাটে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে ।
ওদের মধ্যে থেকে একজন ইরিনের দিকে তাকিয়ে টিজ করে উঠলো “ভাই লোগ আজ তো রাত হি বান গেয়ি” ।
ইরিন যেন একটু ভয় পেয়ে গেল , এতো রাতে বাস স্ট্যান্ডে শুধু ও একা মেয়ে মানুষ আর কেউ নেই ।
ভালো ভদ্র কেউই নেই ।
ইরিনের ভয়টা মুখের প্রতিচ্ছবির মধ্যেও ফুটে উঠলো ।
আরেকজন বলে উঠলো “কি আপুমনি কোথায় যাচ্ছেন” ??
ইরিন বিরক্তি মুখে জবাব দিলো – “চট্টগ্রাম ” ।
– আমরাও যাচ্ছি চট্টগ্রামে কোথায় যাবেন ?
ইরিন আর কোনো জবাব দিলো না ।
– “আপুমনি কি রাগ করলেন ” বলেই বিশ্রী ভাবে সবাই হেসে উঠলো ।
ইরিন এতো সাহসী হয়েও আজ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে , মনে মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে ।
আজ ইরিন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে “মেয়ে মানুষের পায়ে পায়ে বিপদ” ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here