সুখতারার খোঁজে পর্ব -১৬

#সূখতারার_খোজে🧚‍♀️
#লেখক:আর আহমেদ
পর্ব ১৬ ও সীমিত আকারে বোনাস

গ্রিষ্মের তাপদাহ পেড়িয়ে শান্তিময় বর্ষার প্লাবন! উষ্ণ গরমের শহর যেন প্রান পেলো বর্ষার বৃষ্টিতে। পুরো শহর জুড়ে খুব জোড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। স্হির সায়ন! বিছানার একপ্রন্তে সে আর অন্যপ্রান্তে নিবিড় নীরবতা পালন করছে তারা।সায়ন কিছু বলতে গিয়েও থেমে হেলো। সায়ন ভেবেই পাচ্ছে না মেয়েটার জন্য সে কত কি করছে অথচ সে তার বিরুদ্ধে! চাকরির ভয় নেই সায়নের। ধন্যাট্ট পরিবার ছেলে হওয়ায় সে কখনই এ চাকরি হারাবার ভয় পায় না। কিন্তু তার থেকেও দ্বীগুন ভয়ে আছে তারা। সায়ন মনে মনে ক্রুদ্ধ তারার প্রতি! নীরবতার মাঝে সা সা করে চলা বৃষ্টির শব্দ শিউরে তুলছে। সাথে বইছে মৃদু শিতল বাতাস। তারার বেবি হেয়ারগুলো দুলিয়ে ছুটছে। সায়ন উঠে জানালার ধারে দাড়ালো। ঝুম বৃষ্টি নামছে। অনেকদিন পর এমন বৃষ্টি দেখলো সায়ন। এদিকে তারা একপলক তাকালো সায়নের দিকে। ফুল ব্লাক সায়নের পড়নে। তারা চোখ নামিয়ে নিলো। সায়ন জানালার দিকে তাকিয়েই বললো,

-তাহলে তুমি যাচ্ছো?

নতজানু হয়ে বললো তারা,

-হুম।

-ভাবিনি এতটা অবাধ্য হবে তুমি। ভয় শব্দটা তো আমি সেদিনের স্টারের চোখে,মুখে দেখিনি? সেই রিসিপশনে এতো মানুষের ভীরেও অভ্রকে মেরেছিলে, মনে আছে?

তারা মাথা নিচু করে আস্তে করে বললো,

-হুম।

-আর সে রাতের জান ছুটিয়ে গোঙানি? চিৎকার?

-আছে মনে।

তারার দিকে তাকিয়ে কর্কষ কন্ঠে বললো সায়ন,

-তাহলে আজ কিসের ভয় পাচ্ছো তুমি? চাওনা কিডন্যপার সাজা পাক? একটু বোঝো তারা!

ভয় পেলো তারা। বুক ধরফর করছে তার। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। ক্রমশ শীতলতা বাড়ছে। চারতারা ফ্লাটের দো’তলার রুমটায় চুপ করে বসে রইলো তারা। সায়নের রাগ যেন বেড়ে আকাশচুম্বী হলো। দু হাত কোমরে গুজে বললো,

-তুমি এখনো তোমার সিদ্ধান্তে অনড়?

তারা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

-হ্যা।

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই শক্তহাতে তারার হাত খিচে নিলো সায়ন। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তারা। সায়ন চেয়াল খিচে হাত টানতে লাগলো। তারা উঠে পড়লো বিছানা থেকে। সায়ন টানতে টানতে ফ্লাটের নিচে নামালো তারাকে। হাত ব্যাথায় ছিড়ে আসছিলো যেন তারার৷ বলার পর’ও সায়ন নিজের রাগ দমাতে পারলো না। টানতে টানতে কঠিন বেগে হওয়া বৃষ্টির মাঝে নেমে রাস্তায় পা রাখলো সায়ন। মুহুর্তেই ভিজে উঠলো তারার পুরো শরীর। ভিজলো সায়ন’ও। তারা থমকে গেলো। হাত আরও খিচে নিয়ে তারাকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটতে লাগলো সায়ন। কিছুটা এগোতেই এক রিকশা চালক ছুটে এলো তাদের কাছে। মাথায় পলিথিন তার। তিনি বললেন,

-আফা জাবেন কই? রিকশায় ওঠেন। যেখানেই যাবেন নিয়ে যাবো। আজ বৃষ্টির কারনে একটা ও ভারা মারতে পারি নাই আপা। যাবেন?

তারা বিমুঢ় চোখে তাকালো সায়নের দিকে। সায়ন এখনো সামনেই তাকিয়ে। কোথথেকে চালক ছুটে এসেছে জানা নেই,কিন্তু এইটুকুতে ভিজে গেলো সেও। সায়ন ওভাবেই বললো,

-আপনার রিকশা কই?

চালক বুঝতে না পেরে এ্যা জাতিও কিছু বললো। তার পরপরই সায়ন ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,

-আপনি কি কাঁধে করে নিয়ে যাবেন? রিকশা কই আপনার?

-ওওও আপনারা যাবেন? খাড়ান আমি নিয়ে আসছি।

চালক ছুটে কোথাও চলে গেলো। তারা হাত ছাড়াতে চাইলে আরও শক্ত করে ধরে নিলো সায়ন। প্রতি বৃষ্টির ফোঁটা কাটার মতো বিঁধছে শরীরে। বড় বড় টোপে মাটি ভাসাচ্ছে বৃষ্টি। তারা শুকনো ঢোগ গিললো। সায়নের মুখই বলে দেয় সে কতটা রাগি। তারার কথা বলতে ভয় হচ্ছে। কিছুটা সময় পর বলেই ফেললো,

-ক..ই যাচ্ছি আ..আমরা?

তখনি আগমন রিকশাচালকের। সায়ন তারার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। চালক এসেই তাড়া দিয়ে বললেন,

-উঠেন উঠেন আপা। ভিজে গেলেন একদম!

সায়ন তখনো হাত ছাড়লো না তারার। দুজনেই বসে পড়লো রিকসায়। রিকশার সাটার নামালো না সায়ন। কিছু বললো না তারাও। কিছুটা এগোতেই রিকশাওয়ালা চাচা বললেন,

-সাটারটা নামান। ঠান্ডা লাগবে। এমনি..

-আপনারও তো ঠান্ডা লাগবে। কই মাথায় তো পলিথিন ছাড়া কিছুই নেই।

বললো সায়ন। প্রতিত্তোরে শব্দ করে হাসলো চালক। বললো,

-আমাদের ঠান্ডা লাগার চিন্তা করলে হবে স্যার? বাড়িতে বউ বাচ্চা না খায়া আছে। দরজায় খাড়াই এই আশায় আছে, এই বুঝি চাল ডাল আনলাম কিছু।

-অখুশি?আপনি?

কথার পরপরই তারা আবাক চোখে তাকালো। মুখ দিয়ে স্রোতের মতো পানি গড়িয়ে পড়ছে তারার। লোকটা কম কথা বলে। অথচ তার অল্প কথার সারমর্ম টুকু বুঝতে পেরে তারা অবাক হলো। কারো পেশার খুশি জানতে চাইলেন সায়ন? সায়ন এবারে তাকালো তারার দিকে। রিকশা ক্রমশ দুলছে। রিকশাওয়ালা বললেন,

-আলহামদুলিল্লাহ। ভালোই আছি। পাইলে খাই আর না পাইলে নাই। তবুও অভিযোগ নাই,রাত্রের শান্তিতে ঘুমাতে পাইলেই আলহামদুলিল্লাহ!

তারার ভুলটুকু সায়ন ধরিয়ে দিয়েই চোখ সড়িয়ে নিলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ তারা।

________

বৃষ্টি থামেনি এখনো। রিকশা এখতেয়ারের বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। তারা মুখ কাচুমাচু করে তাকালো সায়নের দিকে। এতটা তারাতাড়ি সায়ন তাকে সবার সামনে আনবে ভাবতেই পারেনি তারা। সায়ন রিকশা থেকে নেমেই পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো। পাঁচশত টাকার একটা ভেজা নোট ধরিয়ে দিলো চালকের হাতে। চালক মৃদু হাসলেন। বললেন,

-কইলাম না স্যার? আজ এক টাকাও রোজগার হয় নাই। টাকা পয়সা নাই স্যার। ভাংতি দেন।

সায়ন ভ্রুযুগল কুঁচকে বললো,

-ভাংতি আছে,কিন্তু দিবো না।

-স্যার এসব বলেন কি? টাকা ভাংতি আমি পাবো কোথায়?

-পুরোটা নিয়ে যান। বেলা তো প্রায় শেষ। আর ইনকাম হবে না। যান এটা দিয়ে চালটা আর ডালটা কিনে নিয়েন।

বৃষ্টির পানির সাথে একফোঁটা পানি কখন গড়িয়ে পড়লো টেরই পেলো না রিকশাওয়ালা। তিনি রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে এসে বললেন,

-আপনারা সুখি হন স্যার। আপনাদের দাম্পত্য জীবন যেন খুব সুখের হয়।

বলেই বাহনের দিকে হাটতে লাগলো চালক৷।পেছন থেকে সায়নে ডেকে উঠলো,

-শুনুন।

চালক থামলো। পেছন ফিরতেই সায়ন বললো,

-আপনি আমাদের ভুল ভাবছেন। আমরা স্বামী স্ত্রী নই!

মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন চাচা,

-আপনাদের ভালোবাসা পূর্নতা পাক।

তারা তন্দা মেরে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে। খুশিতে উনি কি থেকে কি বলবেন বুঝতেই পারছে না নিশ্চই। রিকশাওয়ালা বলেই চলে গেলো। সায়ন এতক্ষনে তারার সাথে কথা বললো। তারাকে বললো,

-ভিতরে যাও।

চোখের কোনে অশ্রু টলটল করছে তারার। নিজেকে শক্ত করে দু’বার মাথা ঝাকালো তারা। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় কয়েকবার টোকা দিলো। সশব্দে বৃষ্টির কারনে আওয়াজ পৌছালো না এখতেয়ারের বাড়ির ভেতরে। তারা উচ্চ আওয়াজে শব্দ করলো এবার। ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো,কেএএ?

এটি তনয়ার আওয়াজ। তারা চুপ রইলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিলো তনয়া। তারাকে দেখেই হাত থেকে লাল ছাতিটি হাত আলগা হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। আবেগি হয়ে তনয়া জড়িয়ে নিলো তারাকে। বাধভাঙা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে উঠলো বোনকে দেখে। তারার চোখের পানি ও মিশলো বৃষ্টির পানির সাথে। আটকানো গলায় বললো,

-পাগলি কাঁদছিস কেন তুই? এইতো আমি!

-কই ছিলে আপু? তোমার জন্য কতই না খারাপ লাগতো। কোথায় গিছিলে তুমি? কেন গেছিলে? জানো? আব্বু চিন্তায় ভাত খায় না। সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। অনেক রাত করে ফেরে তূর ভাই। সে এখন আবার আগের মতো সিগারেট খাওয়া শুরু করছে আপু। আবার গেম খেলা শুরু করছে। সবাই না খেয়ে দিন দিন শুকনা কাঠের মতো শুকাচ্ছে আপু।

বলেই চিৎকার ছেড়ে কাঁদতে লাগলো তনয়া। তারা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের ভেজা শরীরের সাথে। তনয়াও ভিজে উঠলো দু দন্ডে। ইলিমা খক খক করে কাশতে কাশতে চালিতে এসে দাড়ালেন। কড়া নড়ার পর থেকে তনয়ার আর কোন সারা নেই। উনি দেখতে এলেন। কিন্তু দারে তারাকে দেখে তিনি বিভৎস রকমের চিৎকার ছেড়ে বললেন,

-তনয়া!!!

তারা ছেড়ে দিলো তনয়াকে। তনয়া মায়ের দিকে তাকাতেই চালি থেকে বেড়িয়ে এলেন ইলিমা। আসতে আসতে কাশলেন কয়েকবার। চাচীর কাশি শুনে তারা এগোতেই ইলিমা হাত দেখিয়ে থামিয়ে তনয়ার হাত খিচে বললেন,

-তুই এইখানে এসে ভিজছিস? জ্বর বাঁধলে কি হবে তখন? আর এ মেয়ে কে? একজন পতিতা কোন সাহসে এ বাড়িতে পা রাখে?

‘পতিতা’ শব্দটি কর্নকুহরে পৌছাতেই মাথায় বাজ পড়লো তারার। গলায় কোন সূক্ষ কাটার খোঁচা অনুভব করলো তারা। আটকানো গলায় কিছু বলবে তার আগেই তনয়া চেঁচিয়ে বললো,

-মা তুমি তারাকে কি বলছো এসব?তোমার মাথা ঠিক আছে?

ইলিমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে বুক। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,

-খবরে শোনস নাই? কোন কুকিত্তি করছে তোর বোন? আজ এখানে কেন এসেছে ও?

-চা..চাচী!

কম্পিত কষ্টদায়ক কন্ঠে বলে উঠলো তারা। ইলিমা ফের কাশলেন। তারা তনয়াকে উদেশ্য বললো,

-তনয়া তুই চাচীকে চালিতে নিয়ে যা।

-থাক! ওই ছেড়াডা কই? যার সাথে তুই…

তারা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ইলিমা থামলেন। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারা বললো,

-চাচী পুরো কথাটা শোন আগে…

-না!কখনোই না। তনয়া তোর চাচাকে ডাক।

তনয়া আকুতির স্বরে বললো,

-মা তুমি ভুল বুঝতে পারছো আপুকে? এতটুকু বিশ্বাস ছিলো তোমার আপুর প্রতি?

-কানে শুনলে হয়তো ভাবতাম। কিন্তু চোখে দেখাকে মিথ্যে বলি কিভাবে? (কাটকাট কন্ঠে)

-হয়েছে? বলা হয়েছে আপনার? ছিহ্! মানুষ কতটা ঠুঙ্ক বিশ্বাস রাখতে পারে তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। কি বললেন একটু আগে? পতিতা? আরে ও নিজের মেয়ের মতো আপনার। আগে কিছুটা শুনতেন তারপর না হয় বলতেন ও খারাপ নাকি ভালো!

সায়ন এগিয়ে এসেই কথাগুলো কড়া স্বরে বলে উঠলো।ইলিমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। জ্বর আসছে বোধহয় আবারো। তিনি ছবিতে তারার সাথে যে ছেলেটিকে দেখেছিলেন সেই ছেলেটিই তার সামনে দাড়িয়ে। ইলিমা খুব বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগলেন। তার অস্সস্তি হচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিছু বলবেন তার আগেই কাদা মিশ্রিত মাটিতে পড়ে গেলেন!

সন্ধ্যা নেমেছে! ঘন আধারে ঘিরে গেছে চারপাশ। সূর্য অন্যদেশের আকাশে উঠতে ব্যাস্ত! এদিকে এখতেয়ার নিষ্চুপ। ইলিমা চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে। চোখ খুলছেন না উনি। খালি মুখ দিয়ে কি সব প্রলেপ বকছেন। কারেন্ট নেই! হাড়িকেনের আলোয় হলুদ চারপাশ, সাথে মৃদু আবছা অন্ধকার। কাপড় পাল্টিয়েছে তারা, সায়ন। বৃষ্টি থামেনি। তূর আসেনি এখনো অব্দি। সায়ন একে একে পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলেছে এখতেয়ারকে। বলেছে একটু আগের ঘটনাও। তারপর থেকেই নীরবাতা।নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন এখতেয়ার,

-তারা যেটা ভেবেছে, সেটা যেমন ঠিক,তেমনি অন্যায়। তারার উচিত হয়নি সবটা ধামাচাপা দেয়া। সেদিন আমার সামনে ও আসলে কি আমিও ভুল বুঝতাম? নাকি সহায়তা করতাম না ওকে? নাকি…তা হোক! এই ছেলেকে তুমি কিভাবে চেনো তারা? আর এত কিছুর পর’ও ছবিটা আমি মিথ্যে মানতে পারছি না আমি। মহল্লার পুরো মানুষ দেখেছে ছবি। কত কটু কথাই না শুনতে হয়েছে। এতকিছু হওয়ার পরও কি দুজনে বলবে যে সে রাতে তোমাদের মাঝে কিছু ঘটেনি?

এখতেয়ার সরু চোখদুটি নিক্ষেপ করলেন তারা আর সায়নের দিকে। তারা নিঃশব্দে কাঁদছে! হঠাৎ বিছানা থেকে ইলিমা অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,

-দু..টোর বিয়ে দাও। ওদের বিয়ে হলেই কলঙ্ক থ..থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here