সুখতারার খোঁজে পর্ব -১৭

#সূখতারার_খোজে🧚‍♀️
#লেখক:আর আহমেদ
পর্ব ১৭

ছলছল চোখে বধু তারার দিকে তাকিয়ে তূর৷ নয়নাক্ষি তার দাউদাউ করে জ্বলছে। গাঢ় খয়েরি রঙের লেহেঙ্গা পড়া তারাকে আজ কতই না সুন্দর লাগছে,সে তার অর্ধাঙ্গিনি হলে কি খুব খারাপ হতো? হতো হয়তো! সে’ই তো ভেঙেছে প্রথমে। ধরিয়েছে তারা আর অভ্রের সম্পর্কে ফাটল। এই ফাটল আজ তার বুক দীখন্ডিত করতে ভাবছে না। বুক ধু ধু করছে তার। ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্যের। অপরাধ?, তারার জিবনে দাগ দেয়া। হয়তো এটুকু কুকর্ম না করলে আজ তারা তার’ই হতো। ভালোবাসতো তাকে! এই আসরে তার বিয়ে হতো।

তূর কাঠশুকনো গলায় একটি ঠোগ গিললো। গলা শুকিয়ে আসছে। শ্বাস ভার! গলায় দলা পাকাচ্ছে কষ্টগুলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দু বার আড়াল করলো চোখের পানি তূর। জানালা হাতল শক্ত করে খিচে নিলো। বউ সাজানো হচ্ছে তারাকে। লুকিয়ে তা দেখছিলো তূর। কিন্তু তার কর্মফল সম্মুখে বুঝতে পেরে সে নরক যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্হান ত্যাগ করলো তূর।

আশেপাশের মেয়েরা সকলে ঘরে হাসি ঠাট্টায় ব্যাস্ত। ঠেস দিয়ে কথা বলছে তারা। তারা অপলক চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে। আজ তার বিয়ে। পুরো বাড়ি লোকে ভর্তি। নিশ্বাস ছাড়ার জায়গা নেই পর্যন্ত। দু’দিনে এখতেয়ার জাকজমক আয়োজন করেছে। লাল,হলুদ গাধা ফুলে সজ্জিত আজ এখতেয়ারের কুটির। লাল টকটকে চান্দোয়া পুরো উঠোনে টাঙানো। তারার ঘরে ভির নেই। ইলিমা নিজ হাতে সবটার খেয়াল রেখেছে। মেয়েটা গায়ে হলুদের পর থেকে চুপচাপ থাকে,তাই তিনি ভির করতে দেননি ও ঘরে।

ঘরের মেয়েগুলো উচ্চস্বরে হাসছে। কেউ কেউ তারাকে এদিক ওদিক দিয়ে গুতোচ্ছে আর ফাজলামো করছে। প্রতিত্তোরে শুধুই হাসছে তারা।

বিকেল চারটেতে গড়ালো। ইলিমার দম ফেলার সময় নেই। এই এদিকে ছুটছে, তো আরেকদিকে ছুটছে! কাজ যেন তাকেই পেয়েছে। তিনি তারাদের ঘরে গেলেন। তারার সাজা হয়ে গেছে। তিনি শেষ জিজ্ঞেস করলেন,

-তোদের সব হলো?

মেয়েরা একস্বরে আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠলো,

-হয়ে গেছে। দেখ, কেমন সুন্দর লাগছে তারাকে।

ইলিমা এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো তারার কাছে। এঁটো হাত আঁচলের শেষপ্রান্ত দ্বারা মুছে বসলেন তারার পাশে। তারা তাকালো না একবারও। ইলিমা বললেন,

-মন খারাপ?

তারা নিচুস্বরে বললো,

-না।

-সায়নের পরিবার তোকে রানির মতো রাখবে দেখিস। কপালে সুখের বন্যা বইবে। মন খারাপ হয় কি করে তোর? আমি হলে তো মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ জপতাম। বেঁচে গেছি যে! আর তুই?

-আমিতো বলিনি আমার মন খারাপ।

-চাচী হই তোর। এটুকু বুঝবো না? জানিস? তোর মা লতিফা বেঁচে থাকাকালীন যখন প্রথম তোর চাচার বাড়িতে পা ফেললাম। বেশ ঝগড়া হতো আমাদের মাঝে। তোর দাদী কাজে কম বেশি করাতেন। কোনদিন আমি খুব কাজ করতাম আর কোনদিন তোর মা। এতে অবশ্য লতিফার কোন মাথাব্যথা ছিলো না। ছিলো আমার, যেদিন খুব বেশি কাজ আমার ভাগ্যে পড়তো সেদিন খুব খাটুনি হতো,কমরে ব্যথা ধরতো। তাই ঝগড়া হতো। তোর মা কখনোই বলেনি আমার ব্যাথা হয় কাজ করলে। আমি তো প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম,আপা তোর ব্যাথা করে না? সে তো খিলখিল করে হাসতো। বলতো,-না কেন রে? আমি কোন কথা না বলে চলে আসতাম। যেদিন তোর দাদী মারা গেলো,সেদিনের পর থেকে একের পর এক অশান্তি সৃষ্টি করতেন তোর চাচা। কথায় কথায় খালি বলতেন,জমি ভাগ চাই। ভাগ করে দাও। তোর বাবা এমন কুশ্রী প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। একদিন তর্কাতর্কিতে লেগে গেলো তুমুল ঝগড়া। মেয়ে মানুষ,স্বামির সাথে তাল না দিয়ে পারিনি! তোর বাবার সাথে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেছিলাম। লতু আপা আমায় আর তোর বাবা কে আটকাতে চেয়ে ঘাই গুতা খেয়ে ফিরেছে। ভালো মানুষ ছিলেন উনি!

তারা মায়ের নাম শুনতেই ইলিমার দিকে তাকিয়ে সবটা শুনলো। মুখ দিয়ে একাএকাই বেড়োলো তারার,

-তারপর?

-তারপর? আচ্ছা কেন বলতো তোকে শেষে বললাম উনি ভালো মানুষ ছিলেন?

তারা অস্ফুটস্বরে বললো,

-কেন?

-কারন,একটা মানুষের কতটা সহ্যশক্তি থাকতে পারে আমি সেদিনই বুঝেছি। সত্যি বলতে তোর মায়ের বিয়ের পর থেকেই রোগ ছিলো। তুই পেটে থাকাকালীন সময়েও রোগ পিছু ছাড়েনি লতুর। মূল কথায় ফিরি, সেদিন ঝগড়ার এক পর্যায় বসার পিড়ে আমি ছুড়ে মাড়ি লতু আফার মুখে। তা সরাসরি ঠোঁটে লাগে। সে কি রক্ত! ঝগড়া থেমে যায়, অথচ রক্ত বন্ধ হয় না। পরদিন সে ঠোঁট ফুলে ডোল হয়। পানি এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে খেতো আপা। জানিস? এ ব্যাথা পুরো একমাস সহ্য করেছে। খেতে পারতো না,ঘুমোতে পারতো না। সবসময় শুধু চোখে পানি টইটই করতো লতু আফার। জেনে অবাকই হবি আমায় একটা গালিগালাজ করেনি তোর মা। অথচ আমি তাকে কতই না বেদনা দিয়েছিলাম। সংসার আলাদা হলো। আমরা এখানে ঘর তুললাম। যেদিনই ভালো কিছু রান্না করতো সবার আগে এক বাটি এ বাড়িতে দিয়ে যেত আপা। তুই পেটে থাকতেই তখন তূরের চারবছর বয়স কিংবা তার কম। সবসময় তোদের বাড়িতে সে ছেলে থাকতো। আমি দুঃখে,আর নিজের প্রতি ঘৃনা ছুড়ে আর যায়নি কখনো। কিন্তু আমার মন খালি তোর মায়ের কথা ভাবাতো। লজ্জায় আর সম্মুখে দাড়াতে পারিনি আমি।

তারার চোখ চিকচিক করে ওঠে। এই বুঝি টুপ করে পানি গড়ায় এমন অবস্থা। তারার হেঁচকি উঠছে খানিক পর পর।

-২০২০ সাল মর্মান্তিক একটি সাল! করোনার আক্রোশে আক্রান্ত হলেন তোর বাবা। একমাসে এতটা কাবু হলেন যে মৃত্যুই হলো ওনার। তুই দেখলাম ঠিক তোর মায়ের মতন! নিজের কাজ নিজে করতে শিখে গেলি বড্ড তাড়াতাড়ি। আরও ঘৃনা বাড়লো নিজের প্রতি। কিন্তু যখন তোর মায়ের আগ মুহুর্তে আগত তখন ছুটে গেলাম ও বাড়িতে আমি। পারিনি নিজেকে আটকাতে। অনেকবার করে লতুআফার কাছে মাফ চাইলাম। উনি কোন সারাই দিলো না। ভাবলাম একটু শাস্তি পাওয়া দরকার আমার। আমিই তূরকে বলে কয়ে ঝগড়ায় মাতালাম যাতে তোকে নিয়ে না যায় তোর বন্ধবী।হ্য া রে। আমিই তূরকে ঝগড়া করতে বলেছিলাম!কাছে রেখে একটু আদর করতে পারি যেন তোকে। তার আগেই কয়েক বিষাক্ত ছোবল তোকে কেটেছে।এটাতো আজানাই ছিলো আমার। যখন জানলাম তখন আমিই তূরকে তোর অযোগ্য ভাবতে লাগলাম। একজন ভাঙ্গক নিষ্চই তুই কামনা করিস না? আজ সায়নের সাথে তোর বিয়ে হলে ভাববো তুই তোর সুখের সামনে গিয়েছিস। এখন হাতে পেলেই তুই ভালো থাকবি রে! ভালো থাকিবি।

টুপটুপ করে পানি ঝড়তে লাগলো ইলিমার চোখ বেয়ে। তিনি তারার চোখের কোনের পানিটুকু নিজ আঁচলে মুছলেন। মাথায় আদুরে হাত বুলালেন কয়েকবার। তারা পারলো না নিজেকে সংযোত করতে। মাথা হেলিয়ে জাপটে ধরে বাধ ভাঙা নদির মতো কাদঁতে লাগলো । ইলিমার মাথা তুলিয়ে চোখ মুছিয়ে রাগি কন্ঠে বললেন,

-পাগলা মেয়ে, মেকাপটা নষ্ট হচ্ছে তো। কাঁদছিস কেন তুই?

নাক টেনে বললো তারা,

-আজ আমি আরেক মা’কে হারাবো।

-হারাবি মানে? আমি তো আছিই,তুই বল,আরো একটি মা পাবি সাথে পরিবার। সবার সাথে মানিয়ে নিস রে মা। নিজেই কারো চোখের আড়াল হোস না। ভুল বুঝতে সময় লাগে না, তার থেকে ভালো না,তুই ভুল বুঝতেই দিবি না?

-ঠিক আছে চাচী।

ইলিমা সকল কাজ ভুলে নীরব ভাবে বসে রইলো তারার পাশে। ইলিমার কোলে মাথা রেখে বারবার নাক টানছে তারা। নিজেকে যথাসম্ভব চেষ্টায় রেখেছে যেন নোনাজল আর না গড়ায়। দেড় ঘন্টা পর পুরো বাড়ি চিৎকারে ভরে উঠলো। একে একে সকলে উচ্চকন্ঠে সারা দিলো,

-বর এসেছে,বর এসেছে!

ইলিমা আদুরে হাতে মাথা তুলিয়ে একটা গাঢ় চুম্বন করলেন তারার মাথায়। বললেন,

-আসছি।

ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো ইলিমা।সাথে মেয়েগুলোও। বরকে নামানো হলো গাড়ি থেকে। কোলপাজা করে আনার নিয়ম সেখানে। আংটি পড়িয়ে আসরে এনে বসানো হলো তাকে। নেমে এলো সায়নের মা, বাবা আর সায়নের ছোটবোন। আত্নীয় স্বজন ও এসেছে। কাজি এসেছেন বহুত আগে। তার একবার খাওয়াও শেষ। এখতেয়ার খাওয়ার আয়োজন জমজমাট ভাবে করেছে। নিজের সার্থের বাইরে গিয়ে। ডাক পড়লো পত্রীর। ইলিমা নিজে আরও একজনকে নিয়ে তারাকে আনতে গেলেন। সায়ন অনেক্ষন যাবৎ উঁকিঝুকি দিচ্ছে। পাশ থেকে ছোট বোন খোঁচা দিলো,

-ভাইয়ুর তো দেখি বউকে দেখার জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। আমাদের হবু ভাবিকে আজ না’হয় আমাদের কাছেই রেখে দেবো রাত্রিরে।

সায়নের কপালে ভাজ পড়লো। বোনকে কড়া গলায় দমিয়ে দিলো,

-এমন পাকা পাকা কথা ফের শুনলে কানের গোড়ায় মারবো বলে দিলাম।

দমে গেলো সাবিহা। সায়ন একপলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো।পাশ থেকে ছোট মামা লজ্জিত স্বরে বললেন,

-রুমাল দে মুখে।

সয়তানির ছলে বললেও সায়ন ঠিক তাই করলো। হাসলো সায়নের ছোটমামা। এরিমধ্য তারাকে আনা হলো সেখানে। কাজি বিয়ের খুৎবা পড়তে আরম্ভ করলেন। ইলিমা আর তনয়া এক কোনে দাড়িয়ে রইলো আধারের দিকটায়। তারাকে সায়নের সাথে বেশ লাগছে। ভয়ে,লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে বেচারি। এদিকে সায়ন উশখুশ করছে তারাকে কিছু বলার। পারছে না! খুব ফিসফিস করে বললেও যেন শুনে ফেলবে পাশের লোকগুলো। তার বলতে ইচ্ছে হয় ‘সুখতারা’ সম্মোধন করে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here