#সুখের_পাখি
২১
দুপুরে খেয়ে তনু ঘরে এসে শুয়েছিল। এখন প্রতিদিনই নিয়ম করে দিনের এই সময়টা ঘুমিয়ে কাটায় তনু। পরীক্ষা শেষ। এখন শান্তি আর শান্তি। কোনো পড়ার চাপ নেই। কোন কাজ টাজ নেই তার। দিন কাটতে চায় না। প্রথম কয়েকটা দিন ভালোই কেটে গিয়েছিল। এখন আর সময় পার হতে চায় না। রেজাল্ট এর অপেক্ষা করে আছে তনু। বাবার স্বপ্ন যেভাবেই হোক পূরণ করতে হবে ওকে। জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বাবা তো নেই, নিজের জন্য আর ফুপুর জন্যই কিছু করে দেখাবে সে। তনুর ঘুম ভাঙলে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে এপাশ ফিরেই দেখে ফুপু আম্মা তার পায়ের কাছে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। হাতে মনে হয় কিছু আছে। জিনিসটা পেছনে লুকিয়ে রেখেছে। তনু চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। সাবিনা তনুর দিকে একটু এগিয়ে এসে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
–‘তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে রে তনু। তখন থেকে তোর ঘরে এসে বসে আছি। তোর ঘুমই ভাঙছিল না।’
–‘আমাকে ডাকলে না কেন তুমি?’
–‘এত আরাম করে ঘুমাচ্ছিলি। ডাকতে ইচ্ছে করল না।’
তনু মনে মনে ভাবে, তার মা বেঁচে থাকলে মা’ও কি তাকে ফুপু আম্মার মতোই ভালোবাসতো? নাকি আরও বেশি? উঁহু, ফুপু আম্মার থেকে বেশি তাকে কেউ ভালোবাসতে পারতো না।
–‘কী সারপ্রাইজ দিবে?’
–‘গিফট! চিন্তা করে বল তো কী গিফট দেব তোকে? বল দেখি মিলে যায় কি-না।’
–‘শাড়ি টাড়ি কিছু?’
–‘না।’
–‘গয়না?’
–‘উঁহু।’
–‘তাহলে?’
–‘তুই বল।’
–‘আইসক্রিম। ফুচকা নয়তো চকলেট। আমি শিওর।’
–‘না রে। হলো না।’
–‘আহ ফুপু আম্মা! পেটের ভেতর কাতুকুতু লাগছে। বলে দাও তো জিনিসটা কী। আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।’
সাবিনা পেছন থেকে হাত সামনে নিয়ে এলো। তনুর সামনে নতুন ফোনসেট রেখে বলল,
–‘তোর জন্য নতুন মোবাইল ফোন।’
তনু খুশি হয়ে গেল। সাথে কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
–‘সত্যি! আমার জন্য এনেছ! হায়, আমার সব বন্ধুদের ফোন আছে। শুধু আমারই ছিল না। কখন এনেছ এটা?’
সাবিনা তনুর থেকে দ্বিগুণ খুশি ও উৎসাহ নিয়ে বলল,
–‘আমি কিনি নি। ইহান কিনে এনেছে। এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, তনুর জন্য এটা। তুমি ওকে দিয়ে দিও। আমার তো মা ওসব কথা মনেই ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে মেয়ে। এবার তো বড় হয়ে গেছে। ওর যে নিজের ফোন নেই বন্ধুদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবে! ইহানের সবদিকে খেয়াল আছে। এখন দেখ তোর পছন্দ হলো কি-না।’
ইহান এনেছে শুনে তনু ফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দিল। ইহান ভাইয়ের দয়া তার লাগবে না। তনু মানছে তাদের বাড়িতে তাদের দয়াতেই আছে। কিন্তু সে এখন ফুপুর দায়িত্ব। বলা যায় ফুপুর ঘাড়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে আছে। তাই বলে অন্য কারো দয়া, করুণা সহ্য করবে না তনু। সে কি ইহান ভাইকে বলেছিল, আমার মোবাইল ফোন লাগবে? তাহলে ইহান ভাই কেন তাকে ফোন কিনে দিতে গেল।
–‘ খুলে দেখ। পছন্দ না হলে বদলে আনতে বলব।’
–‘আমার এখন মোবাইল ফোন লাগবে না ফুপু আম্মা।’
সাবিনা চোখ কপালে তুলল। বিস্মিত গলায় বলল,
–‘সেকি রে! একটু আগে না বলছিলি তোর সব বন্ধুদের ফোন আছে, শুধু তোর নেই। এখন ফোন পেয়েও বলছিস লাগবে না! তুই এমন কেন রে তনু? তোকে আমি বুঝতে পারি না। ইহান এনেছে, না রাখলে যে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলবে এটা তো জানিসই। কেন শুধু শুধু বাদুড়টাকে একটা ঝামেলা বাঁধানোর অজুহাত তৈরি করে দিচ্ছিস! রেখে দে। ফেসবুক টেসবুক চালাবি। বন্ধুদের সাথে কথা বলবি।’
–‘আমার লাগবে না ফুপু আম্মা। তুমি এটা নিয়ে যাও।’
–‘আমি কিছু জানি না। তোর না লাগলে তুই ইহানকে গিয়ে দিয়ে আয়৷ ওর জিনিস ও নিয়ে যাক।’
ফুপু আম্মা মাঝে মাঝে এতটা অবুঝ কেন হয়ে যায়! তনু নাকি জেদি, ফুপু আম্মা তো তাহলে আরও বেশি জেদি। নিজের ছেলের থেকেও বেশি। এই বাড়ির সব ক’টা মানুষ ঘাড় ত্যাড়া।
তনু শেষমেশ আর মানুষ পেল না। ফুলি আপাকে ধরল সে।
–‘ও ফুলি আপা, যাও না গো। দিয়ে আসো না এটা তোমার ভাইজানকে।’
ফুলি দুই হাত কাঁধের কাছে তুলে প্রচণ্ড বেগে নাড়াতে লাগল।
–‘না, না। আমি পারমু না তনু। তুমি যাও। কেমন মানুষ গো তুমি! গিফটের জিনিস ফেরত দিতে চাও! এমুন গিফট পাইলে আমি গিফট দেওনের ওই মানুষরে দিনে দুপুরে পায়ে হাত দিয়া সালাম করতাম। পারলে চব্বিশ ঘন্টা ওর পা ধইরা ঝুইলা থাকতাম। পায়ের কাছে বইসা থাইকা কইতাম, হুজুর আপনার এই দাসী কী সেবা করতে পারবে বলেন? আপনি খালি মুখ ফুইটা কন একবার, হুজুর।’
দুঃখের মাঝেও ফুলি আপার কথা শুনে তনুর হাসি পাচ্ছে। ফুলি গম্ভীর মুখে বলল,
–‘ না,না। গিফট ফেরত দেওয়া অপমান হইব।’
তনু জানে ফুলি আপাকে জোর করেও কোন কাজ হবে না। ফুলি আপা তার ভাইজান বলতে জীবন দেয়। তনুই দ্বিধান্বিত পায়ে ছাদের দিকে হাঁটে। ইহানের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার বুক ভরে দম নেয় আর ফেলে। চোখ বন্ধ করে সাহস জুগিয়ে দরজায় টুকা দেয়।
–‘কে?’
–‘আমি তনু।’
ইহান ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে। আজ কতদিন পর তনু তার ঘরে এসেছে? দুই মাসের উপর হবে। ইহান আলনা থেকে গেঞ্জিটা টেনে নেয়।
–‘এসো তনু।’
তনু ভেতরে আসে। তনুর হাতে ফোনসেটটা দেখে ইহান মৃদু হাসল। বলল,
–‘পছন্দ হয়নি, নাকি চালাতে জানো না? এসো আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।’
তনু ইতস্তত ভাব কাটিয়ে বলে ফেলল,
–‘আমার মোবাইল ফোন লাগবে না।’
ইহানের হাসি হাসি মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে তনুর আচরণে বিস্মিত হচ্ছে। মেয়েটা এমন রোবট হয়ে গেছে কেন আজকাল?
–‘লাগবে না কেন?’
–‘এমনি।’
–‘এমনি! এমনি লাগবে না? এটা কেমন কথা!’
তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ইহান। তনু ভয় পেয়ে গেলেও চেহারায় প্রকাশ করল না। ইহান উঠে তনুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
–‘আমি দিয়েছি বলেই তো নিতে চাচ্ছ না, তাই না?’
তনু কিছু বলল না। জড়োসড়ো হয়ে ইহানের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। ইহান আবার হুংকার ছাড়ল।
–‘কেন নিতে চাইছ না বলো। সমস্যা কী তোমার? আমাকে রাগাতে তোমার ভালো লাগে? তাই এসব করো! ইচ্ছে করে আমার কথার অবাধ্য হও।’
–‘নিতে চাইছি না কারণ, আমি আপনার রাগ সহ্য করতে পারি। কিন্তু আপনার করুণা আমার সহ্য হচ্ছে না।’
–‘করুণা!’
ইহান হতভম্ব। তনুর মনে হচ্ছে ইহান ওকে করুণা করছে! আর তাই ফোন কিনে দিয়েছে।
–‘আমি তোমাকে করুণা করছি! এমনটাই মনে হচ্ছে তোমার?’
–‘তা নয়তো কি? আপনি তো আগে কখনও আমার জন্য এতটা ভাবেননি। সব সময় আমাকে ধমকের উপর রাখতেন। চোখ গরম করা ছাড়া দু’টা কথা বলতেন না। অপমান করে আপনার ঘর থেকে বের করে দিতেন। তাহলে হঠাৎ আপনি পাল্টে গেলেন কেন? আমার এত খেয়াল রাখতে শুরু করলেন কেন? মা বাবা হারা আশ্রয়হীন এতিম একটা মেয়ে, আপনাদের বাড়িতে থাকছে। যাবার কোন জায়গা নেই। আপন বলতে কেউ নেই। ওর উপর একটু দয়া দেখাই। এই সুযোগে দান-খয়রাত করে একটু সোয়াব কামাই করে নিই। আমার কারো দয়া বা সহানুভূতি লাগবে না। আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও আমি কিছু মনে করব না। বরং আপনার এই ভালো ব্যবহারই আমি নিতে পারছি না। কী করব বলুন? মানুষ অভ্যাসের দাস। আমিও আপনার ওরকম ব্যবহারেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’
তনুর মনের এসব ভাবনা সম্পর্কে ইহানের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ইহান তাকে দয়া, করুণা বা সহানুভূতি দেখাচ্ছে না। তনু তাকে ভালোবাসে এটা জেনেই ইহান তনুর থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ওরকম ব্যবহার করতো। তনুর বাবা মারা যাবার পর মেয়েটা একা হয়ে গেছে। ওর মনের অবস্থা বুঝেই ইহান তনুর প্রতি তার রুক্ষ আচরণকে নরম করেছিল। কিন্তু এই মেয়ে তো এক লাইন বেশিই বুঝে সব সময়। কথায় আছে না, কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না। তনুরও তার ভালোমানুষি হজম হচ্ছে না।
ইহান ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিল। ছুড়ে ফেলেই দিতে যাচ্ছিল। হাত মাথায় উপরে চলে গেছে। তনু বাধা দিয়ে উঠল,
–‘এটাকে আবার ভাঙছেন কেন? এর কী দোষ? ভেঙে ফেললে টাকাটা তো আপনারই যাবে।’
–‘টাকা আমার পকেট থেকে যাবে তাতে তোমার কোন সমস্যা? তোমার জন্য এনেছিলাম, তুমি নিতে না করে দিয়েছ। এখন এটার সাথে আমার যা ইচ্ছা তা করতে পারব। তুমি কথা বলার কে?’
–‘কেউ না। তবুও ভাঙবেন না।’
–‘তোমার কথা শুনতে হবে আমাকে!’
ইহানের গলায় তাচ্ছিল্য।
–‘না। শুনতে বলেছি আমি? দিন ওটা আমাকে।’
–‘কেন দেব?’
–‘আজব তো! আমার জন্য না এনেছেন।’
–‘তোমার তো লাগবে না।’
–‘লাগবে। দিন আপনি।’
–‘না। এখন আর আমার দেওয়ার ইচ্ছা নেই।’
–‘ইহান ভাই দিন প্লিজ।’
–‘উঁহু। এটাকে ভেঙে ফেলে তবেই আমার মন শান্ত হবে।’
–‘এত রাগ কোত্থেকে আসে আপনার? নাকের ডগায় রাগ। দিন তো। দিন।’
তনু ইহানের হাত থেকে প্রায় কেড়েকুড়ে ফোনটা নিয়ে গেল। ইহান কত লম্বা! তার উপর আবার হাত মাথার উপরে তুলে রেখেছে। ওটাকে ধরতে তনুর লাফাতে হলো। লাফিয়েও কাজ হলো না। শেষমেশ ইহানের হাতে ঝুলে পড়লে হাত নামিয়ে নিল ইহান।
একটানা কলিংবেল চেপে ধরে রেখেছে কেউ। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভেঙে ফেলতে চাইছে। ফুলি রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে বেড়িয়ে এসেছে। কেউ
এভাবে কলিংবেল বাজালে ফুলি সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়। যেখান থেকেই এসেছিল ভাই, ধৈর্য ধরে আর দুইটা মিনিট দরজার সামনে দাঁড়া। মানুষ তো আর দরজা খোলার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা রেডি হয়ে বসে থাকে না। কাজটাজও তো আছে বাড়িতে নাকি?
–‘কোন হারামজাদা রে হ্যাঁ! সকাল দুপুরে কার মরি লাগছে রে? আইতাছি খাড়া। খাড়া রে হারামজাদার দলেরা। তগোর বদমাইশি ছুটাইয়া দিমু আজ।’
ফুলি দরজা খুলে দিয়ে কিছু বলার আগেই তিনজন হাড্ডা গাড্ডা ছেলে ফুলিকে ঠেলে ভেতরে চলে এলো। বাইরে থেকেই ওরা গলা ছেড়ে দিয়েছে।
–‘ওই ইহান! ইহান!’
–‘ওই ভীতুর বাচ্চা বাইর হ তুই। কই লুকাই আছিস বাইর হ কইতাছি।’
–‘আজ খালি সামনে পাই তোরে। বাইর হ হালা। ওই ইহান।’
ভয়ে ফুলি আর মুখ দিয়ে কোন কথা উচ্চারণ করতে পারছে না। হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে ওর।
–‘এই গুণ্ডা গুলা ভাইজানরে এমন কইরা ডাকতেছে কেন? এদের হাবভাব তো ভালা মনে হইতাছে না। ভাইজানের লগে কোন গণ্ডগোল আছে নাকি? এরা কি বাড়ি বইয়া ভাইজানরে মারতে আইছে! এখন কী করমু আমি? আম্মাজান কই গেল? ভাইজানের কত বড় বিপদ! তনু কই? বড় সাব তো দেশে নাই। উনারে ফোন কইরা জানাইব কে? ও আল্লাহ! মাবুদ তুমি ভাইজানরে বাঁচাও। ভাইজানের এই বিপদ কাটলে আমি দশ শুক্কুরবার রোজা রাখমু আল্লাহ।’
ফুলি বিড়বিড় করে দোয়াদরুদ পড়তে শুরু করে দিয়েছে।
–‘লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুনতু মিনায য-লিমীন। লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহা-নাকা ইন্নী কুনতু…
#সুখের_পাখি
২২
বাইরে চেঁচামেচি শুনে তনুও এতক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কারা এরা? বাড়িতে এসে এভাবে ইহান ভাইকে ডাকছে কেন? তনু ফুলির পাশে এসে দাঁড়াল। লক্ষ করল ফুলি আপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।
–‘ফুলি আপা, এরা কারা?’
–‘জানি না তনু। আল্লাহরে ডাকো৷ আমার মনে হয় এরা গুণ্ডা। ভাইজানরে মারতে আইছে। আম্মাজান যে কই গেল!’
–‘ইহান, ওই দুলাভাই বাইর হইয়া আয়। কই তুই? ওই ভীতুর ডিম লুকাইয়া আছোস ক্যান?’
–‘তুই লুকাই থাক মন চায় পাতালে ঢুকে যা৷ তোরে টাইনা বাইর কইরা আনমু।’
–‘ওই শালা ইহান…
ইহানের কানেও ওদের চিৎকার চেঁচামেচি পৌঁছে গেছে। তিনটা কন্ঠই তার ভীষণ চেনা। কারা এসেছে বুঝতে পেরে ছুটে আসতে এক মিনিটও সময় নিল না সে। খালি গায়ে ছিল, ওভাবেই বেরিয়ে এলো। শার্ট পরারও সময় পেল না। সিঁড়ির মাথায় ইহানকে দেখেই ওরা চেঁচাল।
–‘ওই তো ওইযে এসেছে।’
তিনজন একসাথে ছুটে এসে ইহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তনুর বুক কাঁপছে। ইহান ভাই একা একা তিনজন মানুষের সাথে পেরে উঠবে? তনু আর ফুলির ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে ওরা তিনজন ইনাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিলো। দু’জন ওর দুই পায়ে ধরেছে। একজন দুই হাতে। ইহান এখন মাটি থেকে তিন চার হাত উপরে ঝুলে আছে। ইহান ওদের কাণ্ডে হাসছে। ওদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বলছে,
–‘আরে, আরে কী করছিস তোরা? নামা আমাকে।’
–‘উঁহু দুলাভাই। কোন কথা না। আজ আমাদের দিন।’
–‘গুনে গুনে পঁচিশে পা দিয়েছিস শালা। পাছায় আগে পঁচিশটা লাথি পড়বে তারপর তোকে ছাড়া হবে।’
–‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। এক এক করে গুনে পঁচিশটা। দুই তিনটা বেশি হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু কম হওয়া যাবে না।’
‘আল্লাহ’ তনু মাত্র দম ফেলল। এতক্ষণ শ্বাস আটকে ছিল ওর। যাক বাবা, এসব তাহলে সিরিয়াস কোন বিষয় না। আজ ইহান ভাইয়ের জন্মদিন। আর ওরা সবাই তার বন্ধু। ফুলি তনুর কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
–‘বন্ধু না ডাকাইত? আল্লাহ আল্লাহ! গুন্ডাপাণ্ডা পোলাগোর লগে ভাইজান মিলামিশা করে! আমার তো ভয়ে কলিজা শুকাইয়া গেছিল। এইরকম কেউ করে! জন্মদিনে এইডা কেমুন চকম দেওয়া! মানুষরে ভয় পাওনের কামকাজ।’
ফুলি রাগ দেখাতে দেখাতে রান্নাঘরে চলে গেল। তনু এখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ওদের কাণ্ডকাহিনী দেখছে সে। ইহান ভাইকে এতটা হাসতে তনু আগে কখনও দেখেনি। বন্ধুদের সাথে মন খুলে হাসছে। মানুষটার হাসি এতটা সুন্দর কেন? এই হাসিতেই তো সে হাজার বার মরতে পারে। তিনজন সত্যি সত্যিই ওদের বলা কথা অনুযায়ী গুনে গুনে ইহানকে লাথি দিচ্ছে।
–‘নয়, দশ, এগারো, বারো…
–‘তোরা পাগল! ওরে ছাড় না রে। বাড়িতে আরও মানুষ আছে তো।’
ইহানের কথা ওরা কানে নিলে তো! নিজেদের সাধ মিটিয়ে নিচ্ছে ওরা।
–‘শুধু কী লাথি রে দুলাভাইয়ের বাচ্চা! পঁচা ডিম, আটা, ময়দা সব এনেছি। আজ ওসব দিয়ে তোকে জামাই আদর করব রে। আমার জন্মদিনে কী করেছিলি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি চাদু! গোবর জোগাড় করতে পারিনি। নইলে আজ তোকে গো মূত্র আর গো গু দিয়ে স্নান করাতাম। এই জন্মদিন মরার পরেও ভুলতি না।’
তনু ওখান থেকে চলে এলো। ওর সামনে বন্ধুদের ওরকম আচরণে ইহান ভাই বিব্রত হতে পারে। লজ্জাও পাবে হয়তো। তাই তনু নিজের ঘরে চলে এসেছে।
ইহান ওদের তিনজনকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। নিজের ঘর বলতে ওর বেডরুম। ছাদের চিলেকোঠায় না। ফুলি এসে ওদের চা নাস্তা দিয়ে গেছে। সাবিনা বাড়িতে নেই। কার নাকি বাবু হয়েছে, হাসপাতালে দেখতে গেছে। সৌরভ, আরাফাত, নাফিজ আরাম করে ইহানের ঘরটাকে নিজের ঘর মনে করে সোফায়, বেডে শুয়ে বসে আছে। আরাফাত একটার পর একটা মুখে বিস্কিট ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
–‘তখন একটা মেয়েকে দেখলাম। কে রে মেয়েটা?’
–‘ফুলি?’
–‘আরে না। অন্য একটা মেয়ে। তোদের বাড়িতে নতুন মনে হলো।’
অন্য মেয়ে বলতে আর কে হতে পারে? অহ, তক্ষুনি মনে পড়ল ইহানের তনুর কথা বলছে ওরা। ইহান বন্ধুদের থেকে তনুর ব্যাপারটা যথেষ্ট এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলল,
–‘কাজিন।’
সৌরভ উৎসুক হয়ে লাফিয়ে উঠে বসল।
–‘কাজিন! তোর কোন কাজিন টাজিন আছে আগে তো বলিস নি, দুলাভাই। আমি আরও মনের কষ্টে তোকে শালা বলতে পারি না। কারণ তোর কোন বোন নেই। তাই তোকে দুলাভাই ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলি।’
নাফিজ উঠে গিয়ে দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বাইরে উঁকিঝুঁকি পারছে।
–‘আমি তো তখন খেয়াল করে দেখিইনি। একবার ডাক তো ইহান। আবার একটু দেখি।’
তনুকে নিয়ে ওদের এমন মজা ইহানের সহ্য হচ্ছে না। ইহান জানে তার বন্ধুরা কেমন চরিত্রের। ওরা জাস্ট ফাজলামি করছে। তবুও ইহানের নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওদের সাথে রিয়্যাক্ট করা যাবে না। এরকম মজা ইহানও কত করেছে ওদের সাথে। তবে তনুর ক্ষেত্রে কেন এসব কথা শুনতে পারছে না সে! সৌরভ তো নিজে থেকেই মজা করে ওকে দুলাভাই ডাকে। অথচ ওর তিন বোনকে ইহান নিজের বোন মনে করে। কাজিনদের নিয়ে একটুআধটু মজা করেছে অবশ্য।
আরাফাত ইহানের ভাবভঙ্গি লক্ষ করে বলল,
–‘কিরে শালা, মুখের চেহারা ফাটা বেলুনের মতো হাওয়া ফুঁস হয়ে গেল কেন?’
ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরাসক্ত গলায় বলতে লাগল,
–‘তনু অন্য সব মেয়েদের মতো না। ভীষণ ডেঞ্জারাস মেয়ে ও। তাই তোদের জন্য চিন্তা হচ্ছে একটু।’
নাফিজ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল,
–‘যেমন?’
–‘তোদের কাছে আর লুকানোর কী আছে? তোরা তো আমার বন্ধু। তাই আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি। এই নিষ্পাপ চেহারার মেয়েকে এক ছেলে রাস্তাঘাটে বিরক্ত করত। ও ছেলেটার এমন জায়গায় লাথি দিয়েছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে ছেলেটা এই জীবনে আর বিয়ে করতে পারেনি।’
সৌরভ চিন্তিত মুখে ডান হাতের তালু দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে বলল,
–‘সাঙ্ঘাতিক ক্যারেক্টার মাইরি!’
আরাফাত ইহানকে সাবধান করে দিয়ে বলল,
–‘তুই আবার এই মেয়ের সাথে ইটুসপিটুস করতে যাস না। কাজিন বলেই যে চান্স নিতে যাবি এরকম চিন্তাভাবনা থাকলে বাদ দে। আমরা তোর ছেলেপুলের চাচা হতে চাই, ভাই।’
ইহান মনে মনে হাসল। গাধা গুলোকে বেকুব বানাতে পেরে মনে মনে স্বর্গীয় সুখ পাচ্ছে সে। বুদ্ধি করে কথাটা সঠিক সময়ে বলে ফেলে ওদের ভয় তো অন্তত দেখানো গেছে! ইহান বন্ধুদের কথায় হাসছে। নিজের উপর গর্ব করে বিড়বিড় করে বলছে,
–‘তোরা তো জানিস না, ওই সাঙ্ঘাতিক ক্যারেক্টারের মেয়েটাই তোদের বন্ধুর উপর লাড্ডু। আমি আশকারা দিলে এতদিনে কাহিনী অনেক দূর এগিয়ে যেত। আমি চাইলেই ওকে বিনা বাধায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে পারতাম। ভালোবাসার মানুষকে নিশ্চয় বাধা দিতো না তনু। অবশ্য বলা যায় না। ওই মেয়ের দ্বারা সবই সম্ভব। হয়তো ওইরকম একটা লাথি আমার কপালেও লেখা থাকত।’
তনু ঘরে এসে ভাবনায় পড়ে গেল। গালে হাত দিয়ে টেবিলে বসে বসে সে ভাবছে,
–‘ইহান ভাইয়ের বয়স পঁচিশ। আমার ষোলো। নয় বছর! নয়টা বছর! ইহান ভাই আমার থেকে পুরো নয় বছরের বড়! ইহান ভাই যদি এখন বিয়ে করে ফেলে? হায় হায়! আমার তো এখনও আঠারোই হলো না। আমি তো উনাকে মনের কথা জানাতেই পারব না।’
তনু চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে লাগল।
–‘ আপনি আর দুইটা বছর পরে বিয়ে করুন ইহান ভাই। আমাকে আঠারোতে তো পড়তে দিন। আপনার গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ড থাকলেও এখন বিয়েটা করবেন না। আমি যেদিন আঠারোতে পা দিব, সেদিনই আপনাকে আমার মনের কথা জানিয়ে দিব। তারপর আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিন, বকুন, মারুন যা ইচ্ছে করুন। আমি নিজেকে এটা বলে তো সান্ত্বনা দিতে পারব যে, না আমি সাহস করে আপনাকে জানাতে তো পেরেছি।’
দূর! ইহানের বিয়ের কথা ভাবতে তনুর একটুও ভালো লাগছে না। হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল তনু।
–‘আপনার বিয়েটা কি কোনোভাবেই আমার সাথে হতে পারে না, ইহান ভাই? আমি কি দেখতে এতটাই বাজে? লম্বাতেও তো মোটামুটি আপনার কাঁধ সমান। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়ালেই আপনার কপালে চুমু দিতে পারব। তা-ও যদি না পারি পায়ের নিচে টুল রেখে নেব। আমার গায়ের রঙও তো আপনার থেকে ফর্সা। আমাদের ছেলেমেয়েরাও সুন্দরই হবে। হ্যাঁ আমি আপনার মতো ভালো ছাত্রী না। একবার পরীক্ষায় ফেল করেছি তো কী হয়েছে? আমার মাঝে তো আরও কত গুন আছে। গুন! কী গুন আছে আমার মাঝে?’
তনু নিজেই নিজের গুন সম্পর্কে দ্বিধায় পড়ে গেল। আকাশ পাতাল ভেবেও নিজের কোন গুনই খুঁজে পাচ্ছে না সে।
–‘ গুন! গুন বলতে কী যেন বোঝায়? রান্না পারি? উঁহু। ঘরদোর ঝাঁট দিতে পারি? পারি হয়তো। কখনও তো দিইনি। জানব কীভাবে পারি নাকি পারি না! কাপড় কাচতে পারি? ইহান ভাই যদি আমাকে বিয়ে করে তাহলে আমি উনার জামাপ্যান্ট ধুতে পারব? ঘরের কোন কাজই তো পারি না আমি। গুন বলতে পটরপটর ফটরফটর করে কথা বলতে পারি। ইহান ভাই তো আমার কথা শুনেও বিরক্ত হয়।’
তনু নাকি কান্না করতে লাগল। এসব ভেবে ভেবে মাথার যন্ত্রণা বাড়ছে। তার সাথে কেন এমন হয়? এমন দোটানা নিয়ে কি বাঁচা যায়? মানুষটা তার অনুভূতি একটুও বুঝে না! কেমন মানুষ উনি?
নাকি বুঝেও তাকে কষ্ট দেয়।
–‘আমার তেমন কোন গুন না থাকুক। আমি আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসি এটাই কি আমার সবচেয়ে বড় গুন হতে পারে না? আপনাকে পাওয়ার জন্য আমার ভালোবাসা কি যথেষ্ট না? আমার থেকে বেশি আর কেউ ভালোবাসতে পারবে আপনাকে? উঁহু, জীবনেও পারবে না। আপনি তো জানেন না, তনু আপনার জন্য সব করতে পারে। সব। এমনকি নিজের জীবনও দিয়ে দিতে পারে। তবুও আপনি তনুর ভালোবাসা ফিরিয়ে দিবেন? এত নিষ্ঠুর হতে পারবেন আপনি, ইহান ভাই?’
চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা