সুখের পাখি পর্ব -২৩+২৪

#সুখের_পাখি

২৩
ইহান মনে মনে তনুর উপর খুশি হলো। ওর বন্ধুরা আসার পর থেকে তনু একবারও ঘর থেকে বেরোয় নি। যাক বাবা, তনু ওদের চোখে না পরলেই হলো। ইহান তো জানে ওর বন্ধু তিনটা কোন লেভেলের লুচ্চা। সুন্দর মেয়ে দেখলেই লাইন মারতে ইচ্ছে করে। তনুকে দেখলে তিন গাধাই তনুর পেছনে আদাজল খেয়ে পড়ে যাবে। সবথেকে হাড়বজ্জাত আরাফাত শালাটা। এর থেকে বিশেষ করে তনুকে লুকিয়ে রাখতে হবে। আরাফাতের চোখে কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে আর সে তাকে পটাতে পারেনি, এমনটা কখনও হয়নি। আর ভবিষ্যতেও মনে হয় না হবে। মেয়ে পটানো আরাফাতের একটা গুন বলা যায়।
ইহান ট্রিট দেবার নাম করে ওদেরকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ সে বাড়িতে ছিল তার বুকটা ঢিপঢিপ করেছে। এই বুঝি তনু ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। এই বুঝি তনু গাধা তিনটার চোখে পড়বে।
আরাফাত মহা বিরক্ত হয়ে বলল,

–‘দূর! তোর বাড়িতে গেলাম। ভাবলাম খালাম্মা রান্নাটান্না করবে, কব্জি ডুবিয়ে খাব। তা না, তুই রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিতে নিয়ে এলি।’

–‘বাড়ির খাবার তো রোজ খাস।’

নাফিজ ইহানের সাথে একমত হয়ে বলল,

–‘ইহান ঠিকই বলেছে।’

সৌরভের আবার খাওয়ার ব্যাপারে এতটা আগ্রহ নেই। ও না খেয়েও যে এত মোটা কীভাবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। হাওয়া খেলেও মনে হয় সৌরভ মোটা হয়। দিনদিন পেটটা বেশ বড় হচ্ছে। শরীরের আগে পেট চলে।

–‘রাতে কিন্তু তোর বাড়ি ফেরা চলবে না। খালাম্মাকে কল করে জানিয়ে দিস। নইলে টেনশন করবে।’

ইহান কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল,

–‘ফিরতে পারব না কেন?’

আরাফাত খেঁকিয়ে উঠল,

–‘আহ ন্যাকা! যেন কিছুই বুঝো না তুমি। বার্থডে বয় বলে কথা। তোমার জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদেশি মাল ভাই। যা চিকনি কোমর। মাঝ থেকে ভেঙে পড়ে যাবার দশা। এই কোমরেই যা ছন্দ তুলে না, মাইরি…

–‘চুপ গাধা। জীবনে কখনও ওসব চোখে দেখেছিস? বড় বড় বুলি ছাড়ছিস। আশপাশ থেকে যেকেউ শুনলে বলবে লম্পট দলের তালিকায় এক,দুই,তিন,চার নম্বরে আছি আমরা।’

ইহানের খিস্তি শুনে আরাফাত হোহো করে হাসতে লাগল।

–‘মাঝে মাঝে গুড বয় তকমা ছেড়ে ব্যাড বয় হতে ইচ্ছে করে। ওদের জীবনটা একটিবার হলেও উপভোগ করতে চাই।’

আরাফাতের কথা শুনে নাফিজ হাসছে। ইহান বিরক্ত। সৌরভের কোন ভাবান্তর নেই। সে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

–‘ব্যাড বয় হতে গেলে মদ,গাঁজা, সিগারেট, হেরোইন, বাবা, চাচা, মামা, দাদা আরও কত কিছু খেতে হবে। তুই তো সিগারেটই খেতে পারিস না। মদ খেলে তোর পুলিশ বাপ তোকে জেলের বাইরে রাখবে?’

বাবার কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় আরাফাতের চেহারা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। বাবাকে ও যমের মতো ভয় পায়। তার পুলিশ বাপ এখনও তাকে শিশু শ্রেণীর বাচ্চা মনে করে। বাবার কথার একটু এদিক-সেদিক হলেই হয়েছে, গালাগাল একটাও মাটিতে পড়বে না।
বাকি তিনজন আরাফাতের মুখের ভাব দেখে মনের কথা বুঝে নিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগল।

ইহান চার বছর ধরে জন্মদিন পালন করে না। বছরের বাকি দিনগুলোর মতই এই দিনটাও সে বাড়িতে শুয়ে বসেই কাটিয়ে দেয়। মা এই দিন টায় তার পছন্দের খাবার রান্না করে ঠিকই। কিন্তু কেক কেটে ইহানকে নিয়ে জন্মদিন পালন করার সাহস পায় না। এসবে ইহান প্রচুর রেগে যায়৷ যা তা কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলে। তাই মা’ও বেশি জোরজবরদস্তি করে না।
বন্ধুদের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে দেয় ইহান। অনেকদিন পর বন্ধুদের সঙ্গ পেয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যায় ও।
ওদিকে বাড়িতে তনুর ছটফট করে সময় কাটাচ্ছে। ঘরজুড়ে পায়চারি করতে করতে ওড়নার এক কোনা কামড়াতে কামড়াতে খেয়েই ফেলেছে সে।

–‘আজ ইহান ভাইয়ের জন্মদিন। আমি উনাকে কিছু দেব না! কী দেব আমি? আগে তো জানতাম না। কোন গিফট তো কেনা হয়নি। কী দেব তাহলে? আজকের দিনটা মানুষটার জীবনে স্পেশাল একটা দিন। উফ, আল্লাহ! আমি এত গাধা কেন? একটু কি খোঁজ খবর নেওয়া যেত না!’

তনু কয়েকবার বাইরে এসে ফুলির আপার থেকে জেনে গেছে, ইহান ফিরেছে কিনা। রাত কয়টা বাজে? এখনও ফিরছে না! কেমন মানুষ হ্যাঁ।

–‘অনেক রাত হয়েছে। এবার আমাদের বাড়ি ফেরা উচিত।’

ইহানের কথায় আরাফাত খেঁকিয়ে উঠল,

–‘বাড়িতে বউ রেখে এসেছিস নাকি শালা! এত যাই যাই করছিস কেন? তখন থেকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছিস। ওই জেলখানায় আমার ফিরতে ইচ্ছে করে না। যতক্ষণ বাইরে থাকি আমার নিজেকে মুক্ত মনে হয়। আমার বাপের ওই খাঁচার ভেতর ঢুকতে চাই না আমি।’

–‘তাহলে আমার সাথে আমার বাড়ি চল। নিজের বাড়ি ছেড়ে আয়।’

শান্ত গলায় বলল ইহান। তার সাথে সাথে নাফিজও বলল,

–‘তোর বাপটা একটা হিটলার। গাব্বার সিং। ওর মুখের উপর বলে আয়, হে হিটলার বাপ তোমাকে ত্যাগ করছি আমি। আমার উপর তোমার আর কোন অধিকার নেই। চৌধুরী সাহেব, জোর করে তুমি আমার দেহ পাবে কিন্তু মন পাবে না।’

সৌরভ তিক্ত গলায় ধমক দিয়ে উঠল,

–‘সামান্য বিয়ার খেয়েও মাতালের মতো মাতলামি করছিস। মদ খেলে তোদের কী অবস্থা হবে গড নোজ!’

নাফিজ, আরাফাত ওদের কথা জড়িয়ে আসছে। পা টলছে। এদের নিয়ে ক্লাবে যাওয়াই ভুল হয়েছে। ভুল করে মদ টদ মেশানো কিছু খেয়ে ফেলেছে নাকি? নইলে সে আর ইহান তো ঠিকই আছে। ওরা কেন মাতলামি করছে?
আরাফাত আকাশের দিকে দুই হাত তুলে ধরে চেঁচিয়ে বলল,

–‘শান্তি নাই। আমার জীবনের ডিকশনারিতে শান্তি নামক শব্দটা নাই। আমার ভিলেন বাপ ওই শব্দটা ইরেজার দিয়ে ঘষে মুছে দিয়েছে।’

‘শান্তি!’ হ্যাঁ, শান্তি। সৌরভ চট করে একবার ইহানকে দেখে নিল। আরাফাতকে থামানোর জন্য ও গলা উঁচু করে ফেলল।

–‘আহ! হচ্ছেটা কী হ্যাঁ? কী হচ্ছে আরাফাত! মাতালের মতো আচরণ করছিস কেন তুই? নিজের বাড়ি না গেলে আমার বাড়ি চল। তবুও চুপ কর।’

ইহানের কোনো ভাবান্তর হলো না। শান্ত স্বাভাবিক ভাবে সে বলল,

–‘ওকে তুই বরং তোর বাড়িতেই নিয়ে যা। নাফিজ একা একা বাড়ি ফিরতে পারবি? আচ্ছা, তাহলে আমি যাই। মা হয়তো এখনও আমার অপেক্ষায় বসে আছে।’

ইহান আর কিছু না বলে বা ওদের কোন কথা না শুনে, বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরল।
বাড়ি ফিরে ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি ক’টা টপকে ছাদে চলে এলো। অন্ধকার রাত। আকাশে এতবড় একটা চাঁদ আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। বড় এক খণ্ড মেঘ চাঁদটাকে তার পেছনে লুকিয়ে রেখেছে।
ঘরের দরজা খুলতে গিয়ে ছাদের ওইপাশে কিছু একটা দেখতে পেল ইহান। স্পষ্ট না। অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটাকে ঠিক ভাবে দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না আসলেই ওখানে কেউ আছে নাকি মনের ভুল।

–‘কে? কে ওখানে?’

তনুর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে পেছন দিকে ফিরল সে। ইহানের উপস্থিতি সে টের পায়নি। হঠাৎ কারো গলা শুনে ভয়ে অজ্ঞান হবার দশা হয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে কন্ঠটা চিনতে পেরে ভয় কেটে গেল। তবুও শরীরের কাঁপুনিটা কমলো না। ঘরে ঘুম আসছিল না বলে তনু ছাদে চলে এসেছিল। ইহানের ঘরে অনেকক্ষণ বসে থেকে, ওর জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে, বিছানায় গড়াগড়ি করে উঠে এসেছে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে চাঁদটাকে দেখছিল সে। ঠান্ডা শিরশিরে বাতাসে ভালোই লাগছিল। ইহান কখন এসেছে খেয়ালই করেনি তনু।

–‘কে ওখানে?’

–‘আমি।’

তনু উত্তর দেওয়ার আগেই ইহান ফোনের ফ্ল্যাশলাইট তনুর মুখের উপর ফেলে। তনু চোখের সামনে হাত তুলে আনে। ইহান তনুকে দেখে আলো সরিয়ে নেয়।

–‘তুমি এখানে। এত রাতে। ঘুমাওনি?’

তনু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ইহান ভাই কি তাকে বকবে? এত রাতে ছাদে আসায় ধমকাবে?

–‘ঘুম আসছিল না।’

সত্য কথাই বলেছে তনু। ইহান ফোন পকেটে ভরে নিল। অন্ধকারে একজন আরেকজনের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। মুখ দেখছে না বলে অস্বস্তিটাও কমে গেছে।

–‘ভূতে ভয় পাও না তুমি?’

–‘ভূত! ভূত বলতে কিছু হয় নাকি? আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?’

ইহান নিঃশব্দে হাসল। সত্যিই সাঙ্ঘাতিক মেয়ে। ভূতেও ভয় পায় না। ছেলেদেরও ভয় পায় না। মেরে ফেলে রেখে চলে আসে। এই মেয়ে এমন কেন? বাকি সবার থেকে আলাদা। তনু উত্তরের অপেক্ষায় আছে ভেবে ইহান বলল,

–‘থাকলে অবশ্যই বিশ্বাস করতাম।’

রাত এখন একটার উপরে। গভীর রাতে একটা মেয়েকে তার ঘরে আসতে বলা উচিত হবে? যতই মেয়েটা তাকে বিশ্বাস করুক। যতই তার মনে খারাপ কোন উদেশ্য না থাকুক। কিন্তু সমাজ এই বিষয়টাকে নিশ্চয় সহজ ভাবে নিবে না। এই কথা জানাজানি হলে বরং তনুর বদনাম হবে। তাই ইহান তনুকে আর ওর ঘরে এসে বসতে বলল না।

–‘তনু, অনেক রাত হয়েছে। ঘরে যাও। এত রাতজাগা ভালো না। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

–‘হুম।’

মুখে হুম বললেও তনুর যাবার কোন লক্ষণ দেখল না ইহান। আস্তে আস্তে ভয় হচ্ছে ওর। তনু মেয়েটা পাগলা টাইপ। তার উপর বয়স কম। বিচারবুদ্ধিও কাঁচা। তাকে নাকি আবার ভালোবাসে। এমনটাই দাবি করে তনু। এই মুহূর্তে তনুর মনে কী চলছে? ইহান ওর মুখ দেখতে পারছে না। তাই ওর মন পড়া সম্ভব হচ্ছে না। ইহান শুধু দেখছে অন্ধকারে একটা মূর্তি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। তনু হঠাৎ দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে না ধরলেই হলো। আবেগের বশে কোন ভুল না করে ফেলে মেয়েটা। তনু কোন ভুল করুক ইহান এটা চায় না। বড় হয়ে একদিন তনু ঠিকই বুঝতে পারবে। তখন হয়তো পস্তাবে। কিন্তু এখন সে ঠিক ভুল বুঝতে পারছে না। ইহান গলার স্বর কঠিন করল।

–‘যাও তনু।’

ধমক খেয়েও মিনমিনে গলায় তনু বলল,

–‘ইহান ভাই, আজ তো আপনার জন্মদিন ছিল।’

তনুকে কথা শেষ করতে দিল না ইহান। একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

–‘এখন একটা বাজে তনু। বারোটার পর জন্মদিন বাসি হয়ে গেছে। গতকাল জন্মদিন চলে গেছে।’

ইহান থামল। তনু কিছু বলছে না। ইহান আবার বলল,

–‘তুমি আমাকে উইশ করতে চাও? গিফট টিফট দেবে নাকি? গিফট যদি দিতেই চাও তাহলে একটা কথা দাও। তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তোমার আপনজনেরা তোমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে এরকম কিছু হয়ে দেখাবে। বাকিসব কিছু ভুলে গিয়ে ডান-বামে না তাকিয়ে তোমার সম্পূর্ণ মনোযোগ পড়াশোনার উপর দিবে। আমার কথা তুমি রাখবে, তুমি যদি এমনটা কথা দিতে পারো, তাহলে এটাই আমার সবথেকে বড় গিফট হবে।’

তনু কিছুই বুঝল না। হাঁ করে অন্ধকারে চেয়েই থাকল। এইসব কিছু তো ইহান ভাই তাকে তার নিজের জন্যই করতে বলছে। তাহলে এটা কীভাবে উনার গিফট হয়! তনু প্রতিষ্ঠিত হলে তার লাভটা কী?
#সুখের_পাখি

২৪
আজ সকাল সকালই তনু টিভি খুলে বসেছে। ফুলি আপা রান্নাঘরে। এখনও কারো ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। ফুপু আম্মাও ফুলি আপার সাথেই আছেন। তনু ওদের সাহায্য করতে গেলে দু’জনই চোখ পাকিয়ে তনুকে রান্নাঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কোন কাজকর্ম নেই তাই বাধ্য হয়ে তনু অনাগ্রহে টিভির সামনে বসে আছে। কবে যে রেজাল্ট বের হবে! আর কবে সে কলেজে যাবে! বাড়িতে তো সময় কাটতেই চায় না। সারাটা দিন বোর লাগে। কতক্ষণ আর ফুলি আপার সাথে আড্ডা দিয়ে কাটানো যায়?
কলিংবেলে বাজছে। প্রথমবার শুনেও শুনল না তনু। হয়তো মনের ভুল। দ্বিতীয় বার আরও তীক্ষ্ণ শব্দে আবার বাজল। উঠে বসল তনু। বিরক্ত হলো। কপাল সামান্য কুঁচকে উঠেছে। এই সাতসকালে কে এসেছে আবার? এখন গিয়ে দরজা খুলতে হবে নাকি ছাতা!

–‘তনু, মা রে দরজাটা খোল তো। আমার হাত বদ্ধ।’

রান্নাঘর থেকে সাবিনার গলা শুনে তনু টিভি অফ করে উঠে দাঁড়াল। তাড়া নেই এমন ভঙ্গিতে গুনে গুনে পা ফেলে দরজার কাছে চলে এলো। দরজা খুলে দিতেই পাহাড়ের মতো উঁচু, আলুর বস্তার মতো মোটা এক মহিলা তনুকে ঠেলে ঝড়ের বেগে ভেতরে চলে এলো। তনু হতবুদ্ধি হয়ে মহিলার দিকে চেয়ে রইল। এভাবে অনুমতি ছাড়াই কেউ কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ে! আজব মহিলা!
মহিলাটা দেখতে যেমন হাতি তার গলা স্বরও বজ্রপাতের শব্দের থেকে কম না। তনু প্রায় ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল।

–‘উফ কী গরম! উফ কী গরম!’

বলতে বলতে দু’হাতে মুখের সামনে পাখার মতো বাতাস করতে করতে মহিলা গিয়ে সোফায় বসে পড়ল। এতক্ষণ যেন তনুকে লক্ষই করেনি। এবার তনুর দিকে চোখ পড়তে বলল,

–‘এই মেয়ে, ফ্যানটা ছাড়ো তো। উফ, বড় গরম।’

তনু ভদ্র মেয়ের মতো ফ্যান চালিয়ে দিল। মহিলা হাঁপাচ্ছে। অবাক চোখে তনু উনাকে কতক্ষণ দেখল। তনু দরজা লাগিয়ে দিতে গেলে তিনি বললেন,

–‘বাইরে থেকে আমার ব্যাগ গুলো নিয়ে এসো।’

তনু ব্যাগ গুলো দেখেই নি। অবাক হয়ে তাকাল তনু। এত ব্যাগপত্র! কে এই মহিলা? সারাজীবনের জন্য এই বাড়িতে চলে এসেছে নাকি! আজব তো!

–‘কী হলো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখছ কেন হু? ব্যাগ গুলো ভেতরে এনে রাখো।’

এত ওজন! বাপরে বাপ! একটা ব্যাগ ওঠাতেই তনুর দম বেরিয়ে যাচ্ছে। কী আছে ব্যাগের ভেতর? খুলে দেখা উচিত। পরক্ষণে তনু ভাবল, না থাক। এটা অভদ্রতা হবে। এই মহিলা হয়তো ফুপু আম্মার চেনা কেউ। এর সাথে উল্টাপাল্টা ব্যবহার করলে ফুপু আম্মার বদনাম হবে। তিনটা ব্যাগ তনু ভীষণ কষ্টে তিন বারে ভেতরে এনে রাখল। হাঁপাচ্ছে ও। বাবারে বাবা! অচেনা একটা মহিলা বাড়িতে ঢুকে এসেছে। আর এসেই তনুর উপর হুকুম করছে। এটা ফুপু আম্মাকে জানাতে হবে। তনু ধীর পায়ে মহিলার সামনে থেকে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে উনি ডেকে উঠলেন। অগত্যা তনুকে দাঁড়াতে হলো।

–‘এই মেয়ে, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো তো। যাও তাড়াতাড়ি যাও।’

যাক, তনু পানি আনতে যাবার নাম করে ফুপু আম্মাকে ডেকে আনবে। ফুপু আম্মা তো রান্নাঘরেই আছে। রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়েই তনু চাপা গলায় ডাকল,

–‘ফুপু আম্মা, মোটাসোটা এক পাহাড় মহিলা বাড়িতে ঢুকে এসেছে।’

কে এসেছে বুঝতে বাকি রইল না সাবিনার।

–‘এখন কোথায় উনি?’

–‘বসার ঘরে বসে আছে।’

তনু আরও কিছু জিজ্ঞেস করত, কিন্তু তার আগেই সাবিনা হাতের কাজ ফেলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সোফায় বসা মহিলাকে দেখেই হাসি হাসি মুখ করে আন্তরিক গলায় বলে উঠল,

–‘আপা! চলে এসেছেন। আমি আরও তখন থেকে ভাবছি এত দেরি হচ্ছে কেন?’

শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ও গলার ঘাম মুছতে মুছতে রাশেদা বিরক্তি মাখা গলায় বলল,

–‘তোমাদের এই বাড়ি গাড়ি টাকাপয়সা কে খাবে শুনি? কার জন্য এসব করছ? বাড়িতে গাড়ি আছে। অথচ গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভার নেই।’

সাবিনার মুখ কালো হয়ে গেল। কৈফিয়তের সুরে বলল,

–‘ছিল তো আপা। গতমাসেই ইহান ছাড়িয়ে দিয়েছে।’

–‘কেন?’

–‘শুধু শুধু কাজটাজ না করে বেতন নিচ্ছে। আমি বাড়ি থেকে তেমন বের হই না। গাড়ির দরকার পড়ে না। ইহানও গাড়ি ব্যবহার করে না। তাই…

–‘হয়েছে, হয়েছে। ড্রাইভার ছিল না। ইহানকে তো গাড়ি নিয়ে পাঠাতে পারতে? সাতসকালে একটা মানুষ পাই না। শেষমেশ দ্বিগুণ টাকা নিয়ে এক ছোকরা ব্যাগগুলো মাথায় করে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছে। ট্যাক্সি ওয়ালাও সেয়ানা বদের বদ…

রাশেদার কথা বলা শেষ হবে না। এখন যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত সাবিনাকে কথা শুনাতে থাকবে। ইহানের বড় ফুপু উনি। ইহানের বাবারা চার বোন, এক ভাই। চারটা বোনের একটা ভাই। সেই সুবাদে সাবিনা দায়িত্ব অনেকটা বেশি। বাবা, মা মারা যাবার পর চার বোনই এক ভাইয়ের বাড়িতেই বেড়াতে আসে। এতে সাবিনার আপত্তি নেই। তিনি বরং খুশিই হোন। কিন্তু ইহানের চার ফুপুর থেকে ওর বড় ফুপুই একটু বেশি খুঁতখুঁতে। সবার সব কাজে উনার খুঁত ধরা চায়। নইলে যেন পেটের ভাত হজম হয়না।

–‘ফুলি আপ, হাতিনীটা কে গো?’

ভ্রু কুঁচকে ফুলি তনুর দিকে তাকাল। তনু কার কথা বলছে বুঝতে পারল না ফুলি।

–‘কী কইলা?’

–‘আরে বুঝলে না? হাতিনী। হাতির ফিমেল ভার্সন। ওই আলুর বস্তা পাহাড়টার কথা বলছি। কে গো উনি?’

–‘সসস্, যা কইছো, কইছোই। আর কিছু কইয়ো না বইন। উনি ভাইজানের বড় ফুপু। ডেঞ্জারাস মহিলা। এই বেডির মতো চিজ আমি আমার এই জীবনে দেখি নাই। বাড়িতে আইছে তো। খুঁটি গেঁড়ে বসব এক দুই মাসের জন্য। দেখতে পারবা। আম্মাজানরে নাকে দড়ি দিয়া ঘোরায়। বজ্জাত বেডি। ওর সামনে পইড়ো না তুমি।’

ফুলি আপা মিথ্যে বলছে না। বা একটুও বাড়িয়ে বলছে না। এই মহিলাকে দেখেই মনে হয় বদের হাড্ডি।

–‘ অহো, কথায় কথায় ভুলেই গেছি। উনি আমাকে পানি নিয়ে যেতে বলেছিল।’

–‘তাড়াতাড়ি যাও। দেরি হইলে তোমার উপরও রাগারাগি শুরু করবে।’

তনুর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলল রাশেদা। গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

–‘এক গ্লাস পানি আনতে এত সময় লাগে? কী মেয়েদেরকে যে তুমি বাড়িতে রাখো না সাবিনা! তোমাকেও বলে পারি না। এই নতুন মেয়েকে আবার কবে কাজে রাখলে।’

রাশেদা তনুকে কাজের মেয়ে ভাবছে। তনু ঝট করে একবার ফুপু আম্মার দিকে ফিরল। সাবিনার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। চাপা রাগ, অপমান বা অভিমানে মুখের চেহারা লাল দেখাচ্ছে। শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে সাবিনা বলল,

–‘তনু এবাড়ির কাজের মেয়ে না। ও আমার ভাইঝি। আমার ভাইয়ের মেয়ে।’

রাশেদা কপালে ভাঁজ ফেলে তনুকে দেখতে লাগল। বলল,

–‘ভাইঝি! কিন্তু আমি তো জানতাম তোমার কোন ভাই নেই। তাহলে ভাইঝি কোত্থেকে…

–‘তনু আমার ভাইয়ের মেয়ে। এই বাড়িতে আমার নিজের মেয়ের মতো আছে ও। যতদিন থাকবে আমার নিজের ছেলেমেয়ের মতই থাকবে।’

সাবিনাকে এরকম ভাবে কথা বলতে রাশেদা হয়তো আগে কখনও দেখেনি। তাই ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা আর ঘাঁটাল না। এই আলুর বস্তার কথায় তনু একটু কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু ফুপু আম্মা তাকে কতটা ভালোবাসে তা আজ আবারও একবার প্রমাণ হয়ে গেল।
তনু বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, কাল রাতে ইহান ভাই তার থেকে একটা কথা নিয়েছে। সে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। ইহান ভাই কি আগে থেকেই জানত তনু এভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে ফুপুর মতো অনেকেই তনুকে কাজের লোক মনে করে বসবে। ওকে অবহেলার চোখে দেখবে। তনু হেসে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,

–‘উঁহু, আমি ইহান ভাইয়ের বউ হলে তখন আর ফুপু শাশুড়ী আমাকে অবহেলা করতে পারবে না।’

‘বউ’ শব্দটা অনেকক্ষণ তনুর মাথায় বাড়ি খেয়ে খেয়ে ঘুরলো। ইহান ভাইয়ের ঘরে এখন একবার যাবে সে? না বাবা থাক।

–‘ফুপ্পি! তুমি কখন এলে?’

দরজার সামনে রাশেদাকে দেখে ইহানের বিশ্বাস হচ্ছে না। বড় ফুপ্পি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মেজো ফুপ্পি,সেজো ফুপ্পি,ছোট ফুপ্পির চোখে তার দোষ ধরা পড়লেও বড় ফুপ্পির চোখে কখনও তার দোষ ধরা পড়ে না। সে যা করে তা-ই ঠিক। ইহান খুশি মুখে রাশেদাকে জড়িয়ে ধরল। রাশেদা হেসে বলল,

–‘তুই দিনদিন এমন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন রে বাপ! খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করিস না? তোর মা কী করে? একটা ছেলে বাড়িতে আছে। তারও দেখাশোনা করতে পারে না!’

–‘এবার থাকবে তো ফুপ্পি?’

–‘হু দেখি, তোর ফুপা পাগল না হয়ে গেলেই হলো। আমাকে ছাড়া তো সে আবার চোখে পথ দেখে না। দুই সপ্তাহ পর সাদাফ আসবে। ততদিন থেকে যাব।’

‘সাদাফ’ রাশেদার একমাত্র ছেলে। প্যারিসে আছে। ইহানের ফুপাতো ভাই। ইহান মনে করতে পারল না লাস্ট কবে সাদাফ ভাইয়ের সাথে তার দেখা হয়েছে।

ইহানের ফুপু বাড়িতে আসার পর থেকে উনি সারাক্ষণ ইহানের আশেপাশেই আছে। তনু কয়েকবার ছাদের সিঁড়ি থেকে ঘুরে গেছে। এই মহিলা তাকে যে বিশেষ পছন্দ করেনি এটা তনু বুঝতে পেরেছে।

–‘হ্যাঁ রে বাপ, তোর মা’র এই ভাই জন্ম নিল কবে? তোর বাপের বিয়ের সময় তো শুনেছিলাম তোর মা একাই তোর নানার ঘরে। তাহলে এই ভাইটা হঠাৎ তার মেয়ে সহ কোত্থেকে এলো? আকাশ থেকে পড়লো নাকি?’

ইহান ফুপুর কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। ফুপু তাকে যতটা ভালোবাসে অন্যদের তেমনই দেখতে পারে না। তনুর সাথে কোন কারণে ফুপুর বনিবনা না হলেই হয়েছে। ফুপু তনুর এই বাড়িতে থাকা মুশকিল করে দিবে।

–‘তনু, তুমি যে আমাকে ভালোবাসো এটা আমাকে কেন বললে না?’

–‘ই-ইহান ভাই। আ-আসলে…

ইহান এক পা, এক পা করে তনুর দিকে এগিয়ে আসছে। তার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। তনু ইহানের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলল। ইহান ভাই তার মনের কথা জেনে গেছে! কিন্তু কীভাবে? ইহান যত এগুচ্ছে তনু ততই পিছিয়ে যাচ্ছে।

–‘ইহান ভাই, আসলে… হুম বলো। পরে কী? তুমি আমাকে ভালোবাসো না?’

–‘ভা-ভা-ভালো… আমি ভা…

–‘এত ভয় পাচ্ছ কেন তনু? বলো। ভালোবাসো তো আমাকে! বিয়ে করবে আমায়?’

তনুর চোখ কপালে উঠে গেল। একবার হেঁচকি তুলে ঢোক গিলে গলা ভেজাল ও।

–‘বি-বিয়ে?’

–‘হুম। বউ হবে না আমার? আমার লাল টুকটুকে বউ।’

–‘তনু! এই তনু!’

ফুলির ডাকে তনু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। বুক ভরে দম নিতে নিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঘরটা দেখে। কই ইহান ভাই? কোথায় গেল? সে কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল? এতক্ষণ যা যা ঘটেছে সব স্বপ্নে! আল্লাহ, আর একটু হলে স্বপ্নেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেত। কী ভয়ংকর স্বপ্ন! ইহান ভাই কিসব বলছিল! বিয়ে,বউ!

–‘ঘামতাছো কেন এমনে? দেখো মেয়ের কারবার! এই অবেলায় ঘুমাইতাছে। তাও ফ্যান না চালিয়ে। গরমটা যা পড়ছে দেখো নাই। ঘেমে গোসল করে ফেলছো। উঠো, উঠো। সাঁঝ সন্ধ্যায় ঘুমাইতে নাই। আম্মাজান তোমারে ডাকে।’

চলবে🍃

#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here