#সুখের_পাখি
২৫
রাতে খাবার টেবিলে বিশাল আয়োজন। এত এত রান্না হয়েছে। ডাইনিং টেবিলের কোথাও তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। তনু এসে দেখে অবাকই হয়েছে। এত খাবার কি এই আলুর বস্তা একা খাবে! খেতে পারবে? তনু সবার দিকে একবার তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসল। ফুলি আজ ওদের সাথে খেতে বসল না। পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ইহান ফুপুর সাথে হেসে গল্প করছে। এর মাঝে ইহান ভাই তার দিকে দু’বার তাকিয়েছে। তনু দেখেছে। তনু ফুলিকে বলতে যাচ্ছিল, ফুলি আপা তুমি বসছো না কেন? তার আগেই রাশেদা খিটখিটে গলায় বলল,
–‘তুই এখানে মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দূরে যা। আমাদের খাওয়া শেষ হলে পরে খেয়ে নিস।’
ইহান ভাইয়ের ফুপু ফুলি আপার সাথে এরকম ভাবে কথা বলছে কেন? তনু ফুলির দিকে তাকাল। ফুলির মুখটা কালো হয়ে গেছে। আশ্চর্য! ফুপু আম্মা, ইহান ভাই কেউ কিছু বলছে না! এটা কেমন কথা! ফুলি আপার সাথে কাজের মেয়ের মতো আচরণ কেউ করে না। ফুলি আপা সত্যি সত্যিই চলে গেল। কাছেপিঠে দেখা গেল না। তনুর হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। খেতে পারল না কিছু সে। ভাতের প্লেটে নাড়াচাড়া করতে লাগল। ইহান আড়চোখে তনুকে দেখছে। তনুর মন খারাপের কারণও বেশ বুঝতে পারছে। ফুলির কথা ভেবে তনুর খারাপ লাগছে। কিন্তু ফুপু এমনই। কয়েকদিনের জন্য আসে ফুপু। এই কয়টা দিন ফুপুর মতই সবাইকে চলতে হয়। কিছু বললেই রাগ করে চলে যাবে। এক দুই বছর আর রাগ করে আসবে না।
সাবিনা টেবিলের নিচ দিয়ে তনুর হাত ধরে মৃদু চাপ দিল। চোখে ইশারা করে কিছু বোঝাতে চাইল। ফিসফিস করে বলল,
–‘মন খারাপ করিস না মা। খেয়ে নে।’
–‘কিরে বাপ, মুরগীর বাচ্চার মত ঠুকরে ঠুকরে এতটুকু খেলে হবে নাকি? বেশি করে ভাত তরকারি নিয়ে খা। এভাবে খেয়েই তো এমন রোগা পাতলা হয়েছিস।’
তনু মনে মনে এই শয়তান মুটকি আলুর বস্তার উপর রাগে ফেটে পড়ছে। সব দরদ ভাইয়ের ছেলের জন্য। আর অন্যরা মানুষ না। ফুলি আপার সাথে এভাবে কীভাবে কথা বলতে পারল! মানুষকে কষ্ট দিয়ে শান্তি পায় মুটি।
তনুর চোখ মুখ চেহারার ভাব দেখে হয়তো ইহান তনুর মনের কথা শুনে ফেলেছে। তনুর দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে হেসে ফেলল সে। তনু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। রাশেদা কপাল কুঁচকে বলল,
–‘হাসছিস কেন বাপ? কী হয়েছে?’
ইহান দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।
–‘কিছু না ফুপ্পি। একটা হাসির কথা মনে পড়ে গেল।’
–‘খাওয়ার সময় বাজে কথা মনে করতে হবে না। শান্তিতে খা।’
–‘হুম।’
মিতার সাথে কথা বলছে তনু। অনেকদিন পর মিতা কল করেছে। প্রিয় বান্ধবীর সাথে কথা বলতে বলতে মনটা হালকা হয়ে গেল ওর।
–‘কিরে দিন কাল কেমন কাটছে তোর?’
–‘আমার তো ভালোই। তোর খবর কী?’
–‘কিসের খবর?’
–‘উহহ ন্যাকা। কিছুই বুঝে না সে। অবুঝ শিশু।’
মিতা যে মুখ মুচড়ে উঠেছে তা তনু ফোনের এপাশ থেকেও বুঝতে পারল। মৃদু হাসল সে।
–‘এই লম্বা ছুটির মধ্যে বাড়িতে থেকে কতদূর এগিয়েছিস সেটা বল।’
–‘এক পা-ও এগোতে পারিনি রে।’
–‘কেন?’
–‘কেন আবার কি? ইহান ভাই মনে হয় আমাকে সেভাবে পছন্দ করে না। মানে আমি ওকে যেভাবে পছন্দ করি তেমন না।’
–‘ঢঙ! পছন্দ করে না বললেই হলো নাকি? খুব তো দেখলাম পরীক্ষার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বাইকের পেছনে চাপিয়ে নিয়ে এসেছে। কত খেয়াল রাখল। কত যত্ন করল। সব এমনি এমনি নাকি?’
–‘ওসব দায়িত্ববোধ থেকে করেছে।’
–‘তনু আমার সামনে থাকলে এখনই একটা লাথি খেতি তুই। এত গাধা কেন তুই? তোকে কি মুখ ফুটে সব বলতে হবে নাকি? আমি বাজি ধরে বলতে পারি ওই বেডাও তোর উপর মনে মনে লাড্ডু।’
তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তে চোখ কান সজাগ হয়ে উঠল ওর। কান খাড়া করে শুনল পেছনে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কে আসছে কে জানে?
–‘মিতা রাখি এখন। রাতে সময় পেলে কল করব। বাই।’
–‘এই শোন…
তনু কল কেটে পেছন ফেরার সাথে সাথে সামনে ইহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তনু ভেবেছিল শয়তান আলুর বস্তাটা আসছে। সেই ভয়েই কল কেটে দিয়েছে। এই সময় ইহান এখানে আসবে এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল তনুর কাছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ইহান তার রুমেই যাচ্ছিল। তনুকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে দেখে এগিয়ে এলো। ইহানের চোখ তনুর হাতের ফোনের দিকে।
–‘ কারো সাথে কথা বলছিলে নাকি?’
–‘হ্যা? হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার বান্ধবী মিতার সাথে কথা বলছিলাম।’
–‘অহ। তা কথা শেষ?’
–‘হুম।’
ইহান তীক্ষ্ণ চোখে তনুকে দেখছে। তনু এত ভয় পেয়ে গেল কেন? সত্যিই কি মিতার সাথে কথা বলছিল? নাকি ওই তুহিন নামের বদ ছেলেটা কল দিয়েছিল! ইহানের এখন নিজের গালে ঠাস করে কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে। যেচে পড়ে কেন তনুকে মোবাইল ফোন দিতে গেল।
তনু চোরা চোখে ইহানকে দেখছে। ইহান ভাই তার কথা শুনে ফেলেছে নাকি? মিতার সাথে যা যা বলছিল ইহান ভাই শুনে ফেললে সব শেষ।
রাশেদা দূর থেকে ওদের দু’জনকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখল। চোখ মুখের রেখা কুঁচকে উঠল তার। ইহান ওই মেয়েটার সাথে কী এত কথা বলছে? এসব মেয়েরা সুযোগ সন্ধানী হয়। বড়লোক ঘরের ছেলের নিজেদের রূপের জালে ফাঁসিয়ে বিয়ে করে নেয়। এই মেয়েও তো কম রূপবতী না। ইহানকে হাত করার ধান্দায় আছে নাকি ও! সাবিনা যে কী! এমন একটা মেয়েকে কেউ বাড়িতে রাখে? যেখানে তার অবিবাহিত একটা ছেলে আছে। ইহানের উপর তার সম্পূর্ণ ভরসা আছে। কিন্তু মেয়েটার রূপ দেখে রীতিমতো রাশেদার ভয় হচ্ছে।
যে সমস্যার সমাধান পৃথিবীর কারো কাছে থাকে না, সে-ই সমস্যার সমাধান মিতার কাছে থাকে। এবং সমাধান খুব সাধারণ সাদামাটা টাইপের হয়।
–‘তুই এটা শিওর হতে চাস তো যে, ওই ব্যাটার গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না?’
–‘হুম।’
–‘এটা খুব সহজেই জানা যাবে।’
–‘তোর মুখের কথা তো! কীভাবে জানব আমি?’
–‘যার গার্লফ্রেন্ড থাকা না থাকা নিয়ে তোর মাথা ব্যথা, তার থেকেই জেনে নিবি।’
–‘কীভাবে?’
–‘ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে তোর?’
–‘না।’
–‘আজই একটা আইডি খোল। কয়েকটা দিন পর ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠা। প্রোফাইলে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দিবি। তাহলেই দেখবি চ্যাল চেলিয়ে রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করবে। তারপর প্রথম কয়েকদিন হালকা পাতলা টুকটাক কথা বলবি। আস্তে আস্তে ওই ব্যাটার মনের গভীরে ঢুকবি। এভাবে ওর থেকেই ওর ব্যাপারে সব জেনে নিতে পারবি। এই সিম্পল বিষয়টাকে তুই ভেবে ভেবে পাহাড় সমান সমস্যার রূপ দিয়ে ফেলেছিস।’
–‘ইহান ভাই যদি আমার রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট না করে?’
–‘কেন করবে না? অবশ্যই করবে। সব সময় নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করবি না তো।’
–‘ও যদি আমাকে চিনে ফেলে। তাহলে কিন্তু আমার রক্ষে নেই।’
মিতা মহা বিরক্ত হলো। এই গাধী তনুটাকে নিয়ে যে ও কী করবে! গলায় বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে মিতা বলল,,
–‘কীভাবে চিনবে শুনি? তুই নিজের ছবি দিবি? নাকি নিজের নাম দিয়ে আইডি খুলবি। নাম,ঠিকানা, ছবি সবই তো ভুয়া। চিনবে কীভাবে তাহলে?’
–‘হুম। ঠিকই বলছিস। তাহলে কী এমনটাই করব?’
–‘আমি পথ দেখিয়ে দিলাম। এখন এই পথে হাঁটবি নাকি দৌড়াবি সেটা তোর ইচ্ছা।’
তনু ফুপু আম্মার ঘর থেকে বের হবার সময় দেখল ইহান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগে এক দৌড়ে সে ইহানের ঘরে চলে এলো। প্রতিদিনকার মতো ইহানের জিনিসপত্র গোছগাছ করছে তনু। বিছানার কুঁচকানো চাদরটা টেনে সোজা করে দিল। বালিশ গুলো জায়গা মত রাখল। সোফার উপর পড়ে থাকা বই বুকশেলফে সাজিয়ে রাখল। আলনার উপর থেকে কাপড়ের স্তুপ নামিয়ে একটা একটা করে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছে। সবশেষে ইহানের গিটারটা হাতে নিয়ে টুং করে আওয়াজ করার সাথে সাথে পেছন থেকে কারো গলা পেয়ে ভয় পেয়ে ঝট করে ফিরে তাকায় তনু। ইহান ভাইয়ের ফুপু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কটমট করে ওকে দেখছে। তনু ভয় পেয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
–‘তুমি এখানে কী করছো?’
রাশেদার প্রশ্নে তনু কোন উত্তর দিতে পারল না। আস্তে আস্তে হাত থেকে গিটারটা নামিয়ে রাখল তনু।
–‘এই ঘরে তোমার কাজ কী?’
তনু গলা দিয়ে টেনেও কথা বের করতে পারছে না। ঠোঁট দু’টো যেন আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে কেউ।
–‘কথা বলছো না কেন? কেন এসেছ এখানে?’
–‘এ-এমনি। কোন দরকারে আসিনি ফুপু। এমনি এসেছি।’
তীক্ষ্ণ চোখে তনুর মনে কী চলছে তা বোঝার চেষ্টা করে রাশেদা বলল,
–‘আমি তোমার ফুপু নই৷ কারণ অকারণে যেন আর তোমাকে ছাদে আসতে না দেখি মেয়ে। আমার কথা অমান্য করলে কিন্তু বেশি ভালো হবে না।’
–‘হুম।’
–‘যাও এখন। নিজের ঘরে যাও।’
রাশেদার ধমকে তনুর কলিজা কেঁপে গেল। এক সেকেন্ডও আর না দাঁড়িয়ে ছুটে পালিয়ে গেল তনু। আলুর বস্তা একটা বদ। জাত শয়তান মহিলা।
–‘চালাক! জাত চালাক মেয়ে। দেখে ছোট মনে হলে কী হবে, এর কাজকর্ম ছোট মানুষের না। চেহারা যেমন নিষ্পাপ তেমনই পেটের ভেতর বদ মতলবে ঠাঁসা। ভেবেছে সারাদিন ইহানের চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে রূপের আগুনে ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে ওকে হাত করে নিবে! আমি বেঁচে থাকতে অন্তত এমনটা হতে দেব না। সাবিনা চোখ বন্ধ করে চললেও আমার চোখে সবই ধরা পড়ে।’
#সুখের_পাখি
২৬
ফুপু ইহানকে নিয়ে কোন সন্দেহ করে না। ইহান এই মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাবে না। তার ভাইয়ের ছেলের রুচি এতটা সস্তা হতে পারে না। তাই বলে মেয়েটাকে সারাজীবন এখানে থাকতে দিলে হবে না। এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা করে তবেই এবার ফিরবেন তিনি। তার আগে না। সাবিনাকে বলে কোনো লাভ হবে না। যা করতে হবে উনার নিজেকেই করতে হবে। রাশেদা আলাপে আলাপে ইহানের কাছে বলে ফেলল,
–‘হ্যাঁ রে বাপ, মেয়েটাকে নিয়ে তোরা কিছু ভেবেছিস?’
ফুপ্পি কোন মেয়ের কথা বলছে ইহান বুঝতে পারল না।
–‘কোন মেয়ে ফুপ্পি?’
–‘তনু না কী যেন নাম। হ্যাঁ, তনুই তো৷ ভেবেছিস কিছু?’
মৃদু হেসে ও বলল,
–‘ওকে নিয়ে আবার কী ভাবব?’
–‘ও কি সারাজীবন এখানেই থাকবে নাকি? এত বড় একটা মেয়ে, এসএসসি দিয়ে ফেলেছে। এবার ভালো একটা ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দিলেই তোদের দায়িত্ব কমবে।’
ইহানের মাথায় ফুপ্পি পাথর দিয়ে বাড়ি মারলেও ইহান হয়তো এতটা রিয়্যাক্ট করত না। প্রায় লাফিয়ে উঠে প্রতিবাদ করে ইহান।
–‘বিয়ে! এখনই?’
–‘হ্যাঁ। এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া ভালো।’
ইহান অসহায় মুখ করে করুণ গলায় বলল,
–‘তনু মাত্র স্কুল শেষ করেছে ফুপ্পি। ওর বয়স এখনও আঠারো হয়নি। এখন ওর বিয়ে দিলে বাল্যবিবাহ হবে। এটা এক ধরনের ক্রাইম, তুমি তো জানো।’
–‘কয়জন মানে হ্যাঁ? গ্রামেগঞ্জে গিয়ে দেখ, ওর বয়সের মেয়েরা দুই তিন বাচ্চার মা হয়ে যায়। এর পক্ষে ওই মেয়ে অনেক বড় হয়েছে। কতদিন এভাবে তোদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে ও?’
–‘বোঝা বলছো কেন ফুপ্পি? আমি যদি তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকি, তাহলে কি তুমি কখনও আমাকে বোঝা মনে করবে?’
–‘অবশ্যই না। তুই আমার ভাইয়ের ছেলে। আমার নিজের ছেলের থেকে কোন অংশে কম না তুই আমার কাছে।’
–‘তেমনই তনু মা’র ভাইয়ের মেয়ে। মা’ও তনুকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসে। মা ওর দায়িত্ব নিয়েছে। ওকে এখনই কোন অবস্থাতেই মা বিয়ে দিবে না। আর আমিও চাই না তনু এখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিয়ে করে সংসার করুক। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা ভীষণ জরুরি।’
রাশেদা বিরক্তি হয়ে বলল,
–‘এখন কি ও অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকি? নিজের পায়েই তো হাঁটাচলা লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি করছে।’
ইহান হোহো করে হেসে ফেলল। রাশেদা ওকে হাসতে দেখে আরও বিরক্ত হলো।
–‘হাসিস না তো৷ ওই মেয়ের বাপ মা’র কী হয়েছে? তোর মা’র ওর দায়িত্ব নিতে হবে কেন? সমাজ সেবিকা হয়েছে নাকি? জনদরদী মা তোর।’
ইহান মুখ কালো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–‘ওর কেউ নেই ফুপ্পি। ছোট বেলা তনুর মা মারা গেছে। ওর বাবাও কয়েকদিন আগে মারা গেছে। এই পৃথিবীতে আপন বলতে শুধু আমরাই আছি। আমরা ছাড়া ওর আর কেউ নেই।’
রাশেদা স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ ইহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তনুর বাবা মা’র সম্পর্কে কিছুই জানতো না সে।
তনুর প্রতি রাশেদার আচরণে আকাশ পাতাল পরিবর্তন বাড়ির সবাই-ই লক্ষ করেছে। সাবিনা মনে মনে খুশি হয়েছে। সে জানতো তনু তার নিষ্পাপ চেহারা আর মন ভোলানো ছেলেমানুষী আচরণ দিয়ে সবার মনে জায়গা করে নিতে পারবে। তনুকে কেউ বেশিদিন পছন্দ না করে থাকতে পারবে না। তনুর মত মেয়ে আর কয়টা আছে হ্যাঁ? সাবিনার তনুকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে।
মেয়েটার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই শুনে রাশেদা ইচ্ছা করেও তনুর সাথে কঠিন হতে পারল না। এই মেয়ে তো তার কোন ক্ষতি করছে না। বরং তার কথার আগে দৌড়ে দৌড়ে সবকিছু করে ফেলছে। তাহলে সে শুধু শুধু কেন মেয়েটাকে নিয়ে নিজের মনে বাজে ধারণা পোষণ করছে? ইহান যদি তনুকে পছন্দ করে করুক না। মেয়েটা তো ভালোই। দেখতেও কম রূপবতী না। সাবিনা মনের মতন ছেলের বউ পাবে। ইশশ, এমন একটা মেয়ে যদি তার নিজের ছেলের জন্য পেত। কতই না ভালো হতো।
তনু রাশেদার মাথার চুল টেনে দিচ্ছে। রাশেদা মেঝেতে বসে আছে। তনু সোফায় দু’পা তুলে অতি যত্নে নানান গল্প করতে করতে রাশেদার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে।
–‘ও মা! মাশাআল্লাহ! আপনার চুল তো অনেক লম্বা ফুপ্পি।’
রাশেদা তনুর কথা শুনে হাসলেন। বললেন,
–‘বিয়ের আগে আরও লম্বা ছিল। এখন তো চুল পড়ে মাথা টাক হয়ে গেছে।’
–‘ও বাবা! আরও লম্বা ছিল! আমার চুল কেন লম্বা হয় না?’
ফুলি পাশেই বসে টিভি দেখছিল। ওদের কথা কানে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু ওর মনোযোগ স্টার জলসার সিরিয়ালের দিকে। মাঝে মাঝে বিরতির সময় রাশেদার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। ফুপুজান প্রথমে কী ছিল! আর এখন কী হইছে? পারলে তনুরে কোলে নিয়া বইসা থাকে। ফুলির সন্দেহ হচ্ছে ফুপুজান না আবার তনুকে ওর ছেলের বউ করতে চায়।
–‘তোমার চুলও তো কম লম্বা না তনু। কোমর ছাড়াইয়া পড়ে।’
টিভি দেখার ফাঁকে এই কথাটা বলে আবার সম্পূর্ণ মনোযোগ ওদিকে দিল ফুলি।
রাশেদা আর তনু কথা বলছে।
–‘আপনি আর কতদিন থাকবেন ফুপ্পি?’
–‘বেশিদিন থাকতে পারব না। আমার ছেলে দেশে আসবে।’
–‘ওহ। আপনার ছেলে কোথায় থাকে?’
–‘প্যারিস।’
–‘আপনার কি একটাই ছেলে? আর ছেলেমেয়ে নেই?’
–‘না রে মা। একটাই ছেলে আমার।’
–‘অহ।’
–‘ভাবছি এবার দেশে এলে ওকে বিয়ে করিয়ে দেব। তারপর যেখানে খুশি যাক। বউ আমার কাছেই থাকবে। বউকে নিয়ে যেতে দেব না। তাহলেই ছেলেও কোথাও যাবে না। বউয়ের টানেই ছুটে আসবে।’
তনু হেসে ফেলল।
–‘ভালো হবে। আমি বুঝি না পরিবার বাবা মা’কে ছেড়ে, নিজের দেশ ছেড়ে বাইরে থাকতে কষ্ট হয় না! ইহান ভাইয়ের বড় ভাইও নাকি চার পাঁচ বছর ধরে দূরে আছে। আমি তো বাবা একদিনও কোথাও গিয়ে থাকতে পারতাম না।’
তনু তোতা পাখির মতো অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, রাশেদা মুগ্ধ হয়ে তনুকে দেখছে। ওর কথা শুনছে। রাশেদার মনে মনে কী চলছে তা তনু ঘূনাক্ষরেও টের পেল না। তনু যদি সামান্য আবাসও পেত তাহলেও হয়তো রাশেদার সাথে এত খাতির লাগাতে চাইত না। আরও কয়েকটা দিন থেকে রাশেদা চলে গেল। তনুর এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাস করেছে তনু। রেজাল্টের আগের দিন রাতে টেনশনে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি তনু। না খেয়ে ঘরে গিয়ে শুয়েছিল। সাবিনা, ফুলি কত ডাকাডাকি করার পরও খেতে যায়নি। ইহান ওদের বেশি জোর করতে না করল।
–‘থাক মা। ওকে জোর কোরো না।’
সকাল থেকেও তনু চিন্তায় অস্থির হয়ে পায়চারি করে গেছে। মিতার সাথেও কয়েকবার কথা হয়েছে। মিতাও রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করছে। শেষপর্যন্ত রেজাল্ট পেয়ে তনুর বিশ্বাসই হতে চাইল না। ইহান অনলাইনে রেজাল্ট এনেছে। হাসি হাসি মুখ করে তনুর দিকে তাকিয়ে সবাইকে বলল,
–‘তনু তো কাজ সেরে ফেলেছে মা! এবার তো মিষ্টি খাওয়াতেই হবে। তোমরা থাকো, আমি বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে আসি।’
ইহান ভাইয়ের মুখে এই কথা শোনার পর তনুর আর কী লাগে? সে কার কথায় এত চেষ্টা করেছে? ইহান ভাই তাকে সঠিক পথে পরিচালনা না করলে এতদিনে তনুর পড়াশোনায় লাল বাতি জ্বলে যেত। তার আজকের খুশির পেছনে সবটুকু অবদান ইহান ভাইয়েরই।
কলেজে ভর্তি হয়েছে তনু। এর মাঝে তুহিনের সাথে একদিনও দেখা হয়নি ওর। তুহিন ওর ফোন নাম্বার, ফেসবুক আইডি জানে না। তাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছে। আজ তুহিন তনুর সাথে দেখা করতে এলো। একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে তনু তুহিনের সামনে পড়ে গেল। ওর ভালো রেজাল্টের জন্য তুহিন ওকে অভিনন্দন জানাল। উত্তরে তনু একটু হাসল। তুহিনের মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। কেমন মন মরা লাগছে ওকে। তুহিনের কিছু হয়েছে কি?
–‘কেমন আছো তনু?’
–‘ভালো। তুমি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। উত্তর দিল না। তনুই জিজ্ঞেস করল,
–‘কোন কলেজে ভর্তি হয়েছ?’
–‘আমি এখানে থাকব না তনু। বাবা আমাকে দেশের বাইরে মামার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ওখানেই পড়াশোনা করব।’
–‘অহ, ভালোই তো।’
আর কী বলা যায় তনু ভেবে পাচ্ছে না। তুহিনও ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। অনেকটা সময় দু’জন চুপ করে থাকল। তনুর অস্বস্তি লাগছে। এই গাধার সামনে থেকে যেতে পারলে বাঁচে সে। বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করবি কর না গাধা! এতে মুখের চেহারা এমন বানিয়ে রাখার মানে কী? আর তার কাছেই বা কেন এসেছিস? শেষ বিদায় নিয়ে কান্নাকাটি করতে? আস্ত গাধা একটা!
–‘তনু!’
–‘হুম বলো।’
–‘তুমি কি আজও আমাকে উত্তর দিবে না?’
–‘কিসের উত্তর?’
তনু সত্যিই জানে না কিসের উত্তরের কথা বলছে তুহিন। এদিকে তুহিনও জানে না ওর লেখা চিঠি তনু পায়নি। ওটা ইহান পড়ে পুড়িয়ে ফেলে দিয়েছে।
–‘আমরা কি আগেও যোগাযোগ রাখতে পারি না তনু?’
কী বলবে তনু? গাধাটা কোনোভাবেই কি তার পিছু ছাড়বে না! তনুর হেসে বলল,
–‘হ্যাঁ, অবশ্যই পারি।’
–‘তাহলে আমাকে তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তনু।’
চট করে তনুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যাগের ভেতরই তার ফোন আছে। তবুও সে মুখ কালো করে বলল,
–‘আমার তো মোবাইল ফোনই নেই। নাম্বার দেব কোত্থেকে?’
কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়। ঠিক তেমনই ফোন নেই কথাটা বলতে দেরি হলো কিন্তু তনুকে ভয় পাইয়ে দিয়ে ব্যাগের ভেতর তনুর ফোন বেজে উঠতে দেরি হলো না। ইহান ভাইয়ের মিষ্টি কন্ঠ রিংটোন হিসেবে সেট করে রেখেছে তনু। মিষ্টি গলায় ইহান ভাই গাইছে,
“ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো”
আজকের দিনের মন অপ্রস্তুত অবস্থায় মনে হয় তনু জীবনে কখনও পড়েনি। মিথ্যে বলে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় তনুর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। তুহিন আর কিছু বলে তনুকে আরও লজ্জায় ফেলল না। তার যা বোঝার সে বুঝে নিয়েছে। তনু তাকে কখনও ভালোবাসবে না। এটাই সত্য। তাকে এটা মেনে নিতে হবে। সবাই ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পায় না।
–‘আজ রাতে আমার ফ্লাইট। আমি চলে যাচ্ছি। আর কবে দেখা হবে জানি না। হয়তো দেখা না’ও হতে পারে। ভালো থেকো তনু। সব সময় এরকম হাসি খুশি থেকো। কখনও যদি তোমার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন হয়, তাহলে মনে রাখবে বন্ধু হিসেবে তুমি আমাকে সব সময় তোমার পাশে পাবে। শুধু একবার মনে কোরো। চলি তনু।’
চলবে🍂