সুখের পাখি পর্ব -৩১+৩২

#সুখের_পাখি

৩১
তনু নিজের অনুভূতিকে আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। এক ছাদের নিচে, একসাথে ওঠাবসা করেও ইহানকে দিব্যি সে এড়িয়ে যেতে পারছে। তার কোন অসুবিধাই হচ্ছে না। ইহানও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। হঠাৎ তনুর থেকে এমন কঠিন আচরণ সে ঠিক নিতে পারছে না। একটু তো কষ্ট হচ্ছেই। তনুর দুষ্টুমি মিস করছে। তনু তার আইডিটাও ডিলিট করে দিয়েছে। মনের কোন টান না থাকলে যোগাযোগ রেখে কী লাভ? রাশেদা এসেছে। সাদাফ আর তনুর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে। তনু তার আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিয়েছে ফুপু আম্মার কথাই তার জন্য শেষ কথা। তার নিজের আর কোন মতামত নেই। ফুপু বাড়িতে এসেছে। ইহান খুশি হতে পারল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল, তার খুব প্রিয় ব্যক্তিগত একটা জিনিস অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে।

–‘বুঝলি রে বাপ, সাদাফের জন্য তনুকে আমি সেবারই পছন্দ করে গিয়েছিলাম। ওকে বলার পর নাক সিটকালো। কত ভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোদের এখানে পাঠালাম। তারপর কী ঘটল জানিস? সাদাফ তনুকে দেখেই পছন্দ করে ফেলল। আমাকে জানাল, ও তনুকেই বিয়ে করবে। অন্য কাউরে বিয়ে করবে না। আমি জানতাম তনুকে ওর পছন্দ হবেই। তনু মেয়েটাই এমন। ওকে কারো অপছন্দ হতেই পারে না। তোর ফুপাকেও বললাম। সে রাজি। তোর মা’কে বলার পর সে বলল, তনু রাজি থাকলে তারও কোন আপত্তি নেই। তনুর কথাবার্তায় বোঝা গেছে সাবিনা যা বলবে ও তা-ই করবে। এইজন্যই তো আমি এলাম। ওকে সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করব। আমার মন বলছে তনু রাজি হবে। এখন সমস্যা হলো। ওর তো বয়স কম। এবার নাকি সতেরো। ওর আঠারো না হলে বিয়েটা কীভাবে হবে বল তো।’

রাশেদাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। ইহানের মাথা দপদপ করছে। কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? রাশেদাই আবার বলল,

–‘এক কাজ করা যায়। এবার শুধু কাজি ডেকে ছোট্ট আয়োজনে বিয়েটা পড়িয়ে রাখা যায়। তনুকে তুলে নেব না। ও এখানে থেকেই কলেজ পড়বে। ওর খরচাপাতি সাদাফ দিবে। তনুর যতদিন এইচএসসি শেষ না হয় ততদিন সাদাফ দেশের বাইরে থাকবে। আর তো একটা বছরই। হ্যাঁ এটাই ঠিক হবে।’

ইহান কিছু বলতে গিয়েও পারল না। কী বলবে সে? রাশেদাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছে সে।

–‘এক বছর পর সাদাফ ফিরে এলে, তনুরও বিয়ের বয়স হবে। তখন বড় করে অনুষ্ঠান করে, আত্মীয় স্বজন, সমাজের মানুষকে জানিয়ে ধুমধাম করে ছেলের বউকে ঘরে তুলব।’

রাশেদা ইহানের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ইহান সিগারেট ধরাল। সবকিছু এত জলদি হয়ে যাচ্ছে কেন?
এই কথা তনু শুনলে সে কোনো প্রকাশ আপত্তি প্রকাশ করল না। সাদাফ তনুর বিয়ের আলোচনায় না চাইতেও ইহানকে থাকতে হয়েছে। তনু একবারও ইহানের দিকে তাকায়নি। সবার কথা শুনে তনু যখন মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল,

–‘ফুপু আম্মা আমার জন্য যা ভালো মনে করে আমি তাতেই রাজি।’

ইহান কথাটা শুনে যতটা অবাক হলো তার থেকে বেশি কষ্ট পেল। তনু নাকি তাকে ভালোবাসে। অথচ এখন কত সুন্দর করে বলছে ফুপু আম্মার কথাই সব। তার নিজের কোন মতামত নেই। তনু কেন বলছে না, আমি এখন বিয়ে করব না। ইহান সাদাফের দিকে দেখল। খুশিতে ব্যাটা বাক-বাকুম করছে। রাশেদা তনুর কথা শুনে বলল,

–‘আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আজাদকে(ইহানের বাবা) আসতে বলি। ওকে রেখে তো আর ছেলের বিয়ে করাতে পারি না। ভাগ্নের বিয়েতে মামা না থাকলে হবে! আজাদ এলেই সাদাফ, তনুর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হবে। তোমাকে তো বলেছিই সাবিনা। এখন শুধু কাজি ডেকে ধর্মমতে কবুল বলে বিয়ে হবে। তনুকে আমাদের বাড়ি যেতে হবে না। ওর এখনকার জীবনযাপনের ধারাও পাল্টাতে হবে না। সব এরকমই থাকবে।’

ইহান আর বসে থাকতে পারছিল না। উঠে চলে আসছিল সে। রাশেদা ডেকে বলল,

–‘কিরে বাপ, তুই তো কিছুই বললি না। ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। তোরও সময় আসছে।’

সাবিনা বলে উঠল,

–‘তনু কিন্তু তোর ভাবি হতে যাচ্ছে। এবার থেকে তুই আর তনুকে শাসন করতে পারবি না। উল্টো তনুই বরং কান টেনে তোকে শাসন করতে পারবে। বড় ভাইয়ের বউ বলে কথা।’

ইহান চলে এলো। পেছনে ওরা এখনও কথা বলছে,

–‘আহানটা কি আসতে পারবে না? কবে দেশে আসবে ও? ওর ডাক্তারি পড়া কি এখনও শেষ হয়নি! কত বছর লাগে হ্যাঁ? গেল তো কম সময় হলো না।’

সাদাফ বারবার তনুকে দেখছে। তনু এত সহজে রাজি হয়ে যাবে সাদাফ ভাবতে পারেনি। তনুর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে হবে। শুধু কি মামী বলেছে বলেই ও রাজি হয়েছে। নাকি তনুও সাদাফকে পছন্দ করে, জানতে হবে। এই মুহূর্তে সাদাফের নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে খুশী মানুষ মনে হচ্ছে। যে মেয়েটাকে সে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছে, সে মেয়েটার সাথেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তনুকে সে বউ রূপে পাবে।
ইহান তনুকে ওভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার পর তনুর আর খারাপ লাগার কোন কারণ নেই। বেহায়া হয়ে বারবার ইহানের কাছে গেছে সে। ইহান প্রতিবারই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

ইহানের বাকি তিন ফুপুকেও খবর দেওয়া হয়েছে। কেউই তনুকে চিনে না। এভাবে হুট করে বিয়ে ঠিক করে ফেলায় ওরা একটু রাগ করেছিল। কিন্তু রাশেদা বোঝানোর পর সবাই আসবে বলেছে। ইহানের বাবাকেও জানানো হয়েছে। আহান সবটুকু কথা না শুনেই বলে দিয়েছে এখন সে আসতে পারবে না। তার ফাইনাল এক্সাম সামনে। সাদাফকে সে বুঝিয়ে বলবে যেন রাগ না করে।
মিতা এই ব্যাপারটা একদমই মেনে নিতে পারছে না। কলেজে এই নিয়ে তনুর সাথে কয়েক দফা কথা কাটাকাটিও হয়ে গেল।

–‘ফাজলামি করিস না তনু। বিয়ে কোন মজা না। আজ এক জনের উপর রাগ করে অন্যজনকে বিয়ে করে নিবি। তারপর দু’দিন পর তাকে ছেড়ে দিবি। বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। তুই এখনই কোন আক্কেলে বিয়েতে রাজি হলি? আমি তোর ফুপুর সাথে কথা বলব। তুই ইহানকে ভালোবাসিস। তাহলে কীভাবে ওই সাদাফকে বিয়ে করবি!’

–‘একজনের ভালোবাসাতে কিছু হয়?’

মিতা উত্তেজিত গলায় বলল,

–‘না হলে নাই। তাই বলে অন্য একজনকে বিয়ে করতে হবে কেন? ওই সাদাফ শালা আবার মাঝখানে কোত্থেকে এসে টপকালো!’

–‘উনি ইহান ভাইয়ের বড় ফুপুর ছেলে।’

–‘আল্লাহ! তুই এত গরু কীভাবে হলি তনু? ইহানকে ভালোবেসে ওর ফুপুর ছেলেকে বিয়ে করে, সারাজীবন ওর চোখের সামনে থাকতে পারবি? পারবি ওই বেডার বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করে ইহানকে মামা বানাতে?’

তনু চুপ করে রইল। এই মুহূর্তে মিতার কথা তার কানে ঢুকছে নাকি বলা মুশকিল। সে অন্য কোথাও তাকিয়ে আছে।

–‘বিয়ে কবে?’

–‘জানি না।’

–‘জানিস না!’

–‘উঁহু। এখনও ডেট ফাইনাল হয়নি। তবে এখন শুধু বাড়িতে কাজি ডেকে কালেমা পড়িয়ে বিয়ে হবে। আচার অনুষ্ঠান সব দু-এক বছর পরে হবে। বিয়ের পর সাদাফ ভাই প্যারিস চলে যাবে। আমি এখানেই থাকব। এইচএসসি পাস করার মনে হয় তুলে নিয়ে যাবে।’

রাগে মিতার গা রি রি করছে। অথচ তনুটা কত স্বাভাবিক! এসব কথা বলতে ওর একটুও কষ্ট হচ্ছে না! কেমন মেয়ে ও? এত কঠিন মন! মিতা তনুর চোখের দিকে তাকাল। ওর ছলছল চোখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল। একটু নরম হলো মিতা। তনুর পাশে বসে ওর হাত ধরে কোমল গলায় বলল,

–‘তনু, কেন করছিস? কেন এমন করছিস তুই? বিয়েটাই বা কেন করছিস? এসবের তো কোন দরকার নেই। বিয়েটা কি করতেই হবে! না করলে হয় না। এখন কি আমাদের বিয়ের বয়স! পুরোটা জীবনই তো পড়ে আছে। আগে অনার্সটা অন্তত শেষ করি।’

–‘আমাকে তো পড়াশোনা করতে দেওয়া হচ্ছে। বিয়ের জন্য পড়াশোনার কোন ক্ষতি হবে না। সাদাফ ভাই কত শিক্ষিত। উনি নিশ্চয়ই উনার বউকে মূর্খ রাখবেন না। আমি চাইলে আমাকে পড়তে দেওয়া হবে। রাশেদা ফুপুও অনেক ভালো মানুষ।’

মিতা হার মানল। তনুর এই জেদ সে ভাঙতে পারবে না। কেউই পারবে না। যদি কেউ পারে তা একমাত্র ইহান। তনুটা জেদ করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।

তনু কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলে সাদাফ ওকে ডাকল। তনু দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,

–‘কিছু বলবেন?’

–‘না মানে, তুমি কি বিকেলে ফ্রি আছো?’

–‘কেন?’

–‘তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে বের হতাম।’

–‘আচ্ছা। আমি রেডি হয়ে থাকব। কখন যেতে হবে?’

–‘এই ধরো চার টার দিকে। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসব।’

–‘ঠিক আছে।’

সাদাফ খুশি হয়ে গেল। তনু ওর সামনে থেকে ঘরে চলে গেল। ইহান এই খবরটা ফুলির কাছ থেকে পেল। ফুলি ইহানকে চা দিতে গিয়ে কথায় কথায় বলে ফেলল,

–‘আজ বিকালে সাদাফ ভাইজান তনুরে নিয়া ঘুরতে বাইর হইব। তনু দেখলাম সাজগোজ করতাছে। সাদাফ ভাইজানরেও খুশি খুশি লাগল। ওদের জুড়ি আল্লাহ ভালোই মিলাই দিছে। দুইজনরে একসাথে কত সুন্দর লাগে।’

ইহান ফুলির কথা শুনতে শুনতে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলল। তার কানে একটা কথাই বাজছে।

–‘তনু সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার জন্য সাজগোজ করছে! ঘুরতে যাবে ওরা।’

ইহানের রাগ হতে লাগল। ক্রমশ কপালের শিরা দপদপ করতে লাগল। সে কি তনুকে যেতে না করবে? কেন করবে সে? কোন অধিকারে করবে? আর তনুই বা তার কথা শুনবে কেন? আগের মতো তনুর উপর অধিকার খাটতে পারবে না সে। সাদাফ ভাই তনুকে নিয়ে ঘুরতে যেতেই পারে। কয়দিন পর তনু ওর বউ হবে। বউ! তনু সাদাফ ভাইয়ের বউ! তনুর বিয়ে হয়ে যাবে!
#সুখের_পাখি

৩২
তনু সাদাফের সঙ্গে বাইরে গেছে। যার সাথে কয়দিন পর বিয়ে হবে তার সাথে কোথাও যেতে কেন মানা করবে তনু? লোকটার বউ হবে সে। নিজের হবু বউকে নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা থাকতেই পারে। তনুরও সাদাফকে সহ্য করে নিতে হবে। বিয়ে হলে তো লোকটার সাথেই তাকে সারাজীবন কাটাতে হবে। হালকা হলুদ রঙের কুর্তি পরেছে তনু। মুখে প্রসাধনীর কোন ছোঁয়া নেই। তবুও চোখ সরানো যাচ্ছে না। সাদাফ মুগ্ধ চোখে একদফা তনুকে দেখে নিল। মনে মনে বলল,

–‘মাশাআল্লাহ! তোমাকে দেখতে দেখতেই আমি আমার এই জীবন কাটিয়ে দিতে পারব তনু। তুমি কেন আরও আগে আমার জীবনে এলে না। আর এলে তো এলে, তাও এই সময়ে। বিয়ের পরও আমি কীভাবে তোমাকে ছেড়ে দূরে থাকব? কীভাবে তোমাকে রেখে বিদেশ যাব?’

তনু সাদাফের কাছে এসে বলল,

–‘চলুন।’

–‘হ্যাঁ! হুম, হু চলো।’

ইহানও তখনই নিচে এসেছিল। তনুকে সাদাফ ভাইয়ের সাথে যেতে না করবে সে। এখনও তো বিয়ে হয়নি। বিয়ের পর যাক তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ইহান এসে দেখে তনু রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বিস্মিত চোখে ইহান তনুকে দেখতে থাকল।
সাদাফ ইহানকে দেখে বলল,

–‘কোথাও যাচ্ছিস ইহান?’

–‘না।’

–‘তাহলে আমাদের সাথে চল।’

–‘না।’

–‘ঠিক আছে। তাহলে আমরাই যাই। চলো তনু।’

তনু ইহানের চোখের সামনে দিয়ে সাদাফের সাথে চলে গেল। ইহান শুধু চেয়ে দেখল। কিছুই বলতে পারল না। আটকাতে পারল না তনুকে।

–‘ফুলি! ওই ফুলি!’

চিৎকার করে উঠল ইহান। ফুলি ছুটে এলো।

–‘কী হইছে ভাইজান?’

ফুলিকে ইহান কেন ডেকেছে? আর ফুলি কেন তার ডাকার সাথে সাথে ছুটে আসবে?

–‘কিচ্ছু না। যা তুই। ডাকলেই দৌড়ে আসতে হবে! যা চোখের সামনে থেকে। দূর হ।’

ইহানকে রাগতে দেখে ফুলি ভয় পেয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ছুটে চলে গেল। ইহান মাথার চুল টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ফুলি বড় বড় চোখে দূর থেকে ইহানকে এরকম করতে দেখে বুকে থুথু দিয়ে বলল,

–‘সত্যই ভাইজানের লগে কিছু আছে। ওই জিনিস সব সময় আছড় করে না। মাঝে মধ্যে করে। আর তখনই ভাইজান এইরকম উদ্ভট কাজকর্ম করে। কীরকম চুল টাইনা ছিড়া ফেলতাছে। টাকলা হইয়া যাইব তো। আম্মাজানরে কত কইলাম। ভাইজানরে কোন হুজুরের থেইকা তাবিজ টাবিজ আইনা দেন। আম্মাজান কেন যে আমার কথা কানে নেয় না! আমার কথা শুনলে আজ ভাইজানের এই দশা হইত!’

সাদাফ তনুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু তারা কোথায় যাবে তা ঠিক করেনি। মামার গাড়ি নিয়েছে সাদাফ। তনু চুপচাপ নির্বিকার পাশের সিটে বসে আছে। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে। বাতাসে ওর চুল উঠে এসে মুখে আছড়ে পড়ছে। সাদাফ আড়চোখে মুগ্ধ, বিহ্বল হয়ে তনুকে দেখছে। তনু মাঝে মাঝে বাঁ হাতে চোখে মুখে চলে আসা অবাধ্য, বেয়াড়া, নাছোড় চুলগুলোকে সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছে। সাদাফ তনুকে দেখতে দেখতে একটুর জন্য অ্যাক্সিডেন্ট করে বসতো৷ সামনে থেকে যে আরেকটা গাড়ি আসছিল তা সাদাফ খেয়ালই করেনি। হঠাৎ সামনে তাকাতে তাড়াহুড়ো করে কোনোরকমে সাইড কাটিয়ে নিয়ে এযাত্রায় জীবন বাঁচায়। এই ঘটনাতেও তনুর কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সাদাফ খানিকটা লজ্জা পেল। তনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

–‘তোমার লাগেনি তো?’

–‘উঁহু।’

–‘কোথায় যাবে এখন?’

–‘আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।’

–‘শপিংয়ে যাবে?’

–‘হু।’

ইহান কতক্ষণ মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থেকে উঠে পড়ল। শান্তি লাগছে না তার। অনেকক্ষণই তো হয়েছে ওরা গেছে। এখনও আসছে না কেন? সাদাফ ভাই তনুর সাথে কী করছে? দীর্ঘ সময় বাইরে থেকে এসেছে। হাত ধরা, কিস করা ওর কাছে সামান্য ব্যাপার। কিন্তু ইহানের কাছে এটাই শান্তি হারাম করে দেওয়া ব্যাপার। সাদাফ ভাই কি তনুর হাত ধরেছে? ওর কাছে যাবার চেষ্টা করবে? করলেও কি তনু চুপ থাকবে? না। তনু নিশ্চয়ই অসভ্যতা মেনে নিবে না। ওরকম ছেলেদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা তনুর খুব ভালো করে জানা আছে। তনু সাফাদ ভাইকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে না। দরকার পড়লে হাত পা চালাবে।

–‘হ্যাঁ। তনুকে আমি যতটা চিনেছি… না, তনু বাধা দিবে কেন? ওদের তো বিয়ে হবে। বিয়ের পর তো সবই… আহহ…

মাথা চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল ইহান। বিনা কারণে চিৎকার করতেই থাকল। ওর চিৎকার শুনে ফুলি ছুটে এসেছে। ইহানকে এভাবে চেঁচাতে দেখে ফুলি চিন্তিত গলায় বলল,

–‘ভাইজান! ও ভাইজান, কী হইছে আপনার? ও ভাইজান। আম্মাজান! ও আম্মাজান, আইলেন না গো আম্মাজান। ভাইজান কীরকম করতাছে। ফুপুজান। ভাইজান কী হইছে আপনার?’

–‘ফুলি আমার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে রে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথা ফেটে যাবে।’

–‘কী হইছে ভাইজান। আমারে কন? ডাক্তার ডাকমু? আম্মাজান গো…

–‘আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। বুকের ভেতর জ্বলছে পুড়ছে। আমার মাথায় পানি ঢাল। বরফ আন। আমার সারা শরীর জ্বলে গেল।’

সাবিনা এসে ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে হা-হুতাশ করতে লাগল। কী করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ করে ছেলেটার কী হলো? ইহানকে ধরাধরি করে দোতলার বেডরুমে নিয়ে এলো। ওকে শুইয়ে দিয়ে ফুলি গিয়ে বালতি করে পানি নিয়ে এলো। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইহানের মাথায় পানি ঢালতে লাগল। সাবিনা ভেজা কাপড় দিয়ে ওর গা মুছে দিচ্ছে। রাশেদা হতবুদ্ধি হয়ে ছুটাছুটি করে একে ওকে ফোন করে যাচ্ছে। ইহান এখনও সেই কথাগুলোই বলে যাচ্ছে।

–‘আমার ভেতরটা এভাবে পুড়ছে কেন মা? কী হয়েছে আমার? ফুলি আমার কী হয়েছে? মাথায় এরকম যন্ত্রণা হচ্ছে কেন? এরকম অস্থির কেন লাগছে? আমি কি আর বাঁচব না?’

–‘এইসব অলক্ষুণে কথা বইলেন না ভাইজান। আপনার কিচ্ছু হইব না। আল্লাহ আপনারে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখবে। আপনার মত ভালো মানুষের কিচ্ছু হইব না।’

ইহান দুপুরেও ভালোই ছিল। মুহুর্তে ছেলেটার কী হয়ে গেল ভেবে পাচ্ছে না সাবিনা। তার এই পাগল ছেলেটার কিছু হলে সে মরেই যাবে। দুই ছেলে হলেও ছোট ছেলের জন্য তার টানটা একটু বেশিই। হয়তো ইহান সব সময় নিজের কাছে ছিল বলেই। আহান তো জীবনের অর্ধেকটা সময় হোস্টেলে থেকে, বাইরে থেকে কাটিয়েছে। রাশেদা ফোন কানে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে বলল,

–‘সাদাফকে কল করেছি। আসছে ওরা। ও এসেই নাকি ইহানকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। অপেক্ষা করতে বলছে।’

তনু ফিরে আসছে। কথাটা শুনেই ইহানের অস্থিরতা অর্ধেক কমে গেল।
সাদাফকে ফোনে কথা বলতে শুনেছে তনু। সাদাফ যখন বলছিল,

–‘কী হয়েছে ইহানের? আমরা বেরুবার সময়ও তো ওকে ভালো দেখে এসেছি। আচ্ছা, টেনশন করো না তোমরা। আসছি আমি। আমি এসে দেখছি হাসপাতালে নিতে হবে নাকি।’

ফোনের এটুকু কথাই তনুর আত্মা বের করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কী হয়েছে ইহান ভাইয়ের। তনুর চোখ জ্বালা করতে লাগল। সাদাফ শুধু একবার তনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

–‘সরি তনু। আমাদের ফিরতে হবে। ইহানটা যে কী করে না! এতটা কেয়ারলেস কেন ছেলেটা!’

সাদাফ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরলো। তনু সাদাফকে জিজ্ঞেস করতে পারল না ইহানের কী হয়েছে।
ওরা বাড়ি ফিরে এসে দেখে ইহান সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওর গা খালি। মাথার চুল ভেজা। কপালের উপর ছড়ানো। ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানির ফোঁটা গায়ের উপর পড়ছে। ইহানকে চোখের সামনে দেখে তনুর দেহে প্রাণ ফিরে এলো। সাদাফ এগিয়ে গিয়ে ইহানকে জড়িয়ে ধরল।

–‘ফোনে মা বলছিল তুই নাকি কেমন করছিস। কী হয়েছিল? এখন ঠিক আছিস? যা ভয় পেয়েছিলাম রে ভাই! থ্যাঙ্ক গড! তোর কিছু হয়নি। কী হয়েছিল বল তো আমায়? কবে থেকে এরকম হচ্ছে? ডাক্তার দেখিয়েছিস?’

–‘সাদাফ ভাই আমার কিছু হয়নি। তুমি অযথাই টেনশন করছো। ফুলিটা এমনিই চিৎকার চেঁচামেচি করে মা, ফুপ্পিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। সিরিয়াস কিছুই ঘটেনি।’

ফুলির চোখ এখনও ভেজা। ধরা গলায় ফুলি প্রতিবাদ করে বলল,

–‘এমনিই এমনিই চিৎকার চেঁচামেচি করছি আমি? ভাইজান কীরকম করতাছিল। মাথা নাকি ফেটে যাচ্ছে। বুকের ভেতর জ্বলে যাচ্ছে। আমার মনে হয় ভাইজানের বড় কোন অসুখ হইছে। ভাইজান কাউরে কয় না।’

ইহান ফুলিকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।

–‘বলেছে তোকে অসুখ হয়েছে? ডাক্তার কবে থেকে হলি শুনি? সবাইকে এরকম ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোর চাকরি খাব।’

তনু এক দৃষ্টিতে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখ দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। একটু সময়ের মধ্যে এমন হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য ইহান উল্টো মা, ফুপুর উপর চোটপাট করে ঘরে চলে গেল।

–‘আমি কইছি না আম্মাজান, ভাইজানের লগে কিছু আছে। মাঝে মাঝে আছড় করে। আপনি তো আমার কথা শুনেন না।’

ফুলি কথা শেষ করার আগে রাশেদা চোখ রাঙিয়ে ওকে থামিয়ে দিল।

–‘ এসব কুসংস্কারি কথা বন্ধ না করলে সত্যি সত্যিই চাকরি খাব তোর।’

ফুলি চুপ হয়ে গেলেও তনুর মনে একটা খুঁতখুঁতে ভাব থেকেই গেল। কী হয়েছিল ইহান ভাইয়ের? ওরা ফিরতে ফিরতে আবার ভালোও হয়ে গেল। তনুকে ওরকম ভাবে কেন দেখছিল? ওই দৃষ্টির মানে কী!
তনু আকাশ পাতাল ভেবেও কিছুই বুঝতে পারল না। তার ছোট্ট মাথায় এত প্যাঁচ খেলে না।

চলবে 🌸
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here