“সেই তুমি💐 পর্ব -১৭+১৮

সেই তুমি💐
পর্ব -১৭+১৮
Samira Afrin Samia
#Nipa

ইয়াশ বাইরে থেকে ইশিতার কান্নার শব্দ পেল। ইয়াশ বুঝতে পারছে ইশিতা ওয়াশরুমে গিয়ে কাঁদছে। ইশিতা কাঁদছে এটা বুঝার সাথে সাথে ইয়াশ ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
— ইশিতা,, ইশিতা বের হও।
ইশিতা তাড়াতাড়ি দু মিনিটে ভেতরে বের হও বলছি।
ইশিতা বাইরে থেকে ইয়াশের ডাক শুনতে পেয়ে খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে আবার চোখে মুখে পানি দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।
— কি হলো ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা লক করে কাঁদছিলে কেন?
— কই কাঁদছিলাম না তো।
— কাঁদছিলে না?
তাহলে কি আমি এমনি এমনি কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম?
ইশিতা কান্না আর চেপে রাখতে না পেরে ইয়াশের সামনে ই কাঁদতে লাগলো।
ইয়াশ ইশিতা কে কাঁদতে দেখে ইশিতার কাছে এসে আলতো করে ওর হাত ধরে
— এই মেয়ে এভাবে কাঁদছো কেন? আমি আছি না তোমার সাথে। তুমি কারো কথা কানে নিবে না। যে যাই বলুক না কেন আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো।
ইশিতা মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে
— আমার দিকে তাকাও। আর কান্না থামাও। শুধু শুধু লোকের কথা শুনে তুমি কেন তোমার চোখের পানি ফেলবে?
কি হলো বললাম না আমার দিকে তাকাতে।
ইশিতা ইয়াশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো
— আপনি কেন আমাকে বিয়ে করলেন?
আপনার ভাইয়ের পাপ আপনি কেন নিজের কাঁধে নিলেন? এখন তো সবাই আমার সাথে সাথে আপনাকেও কথা শুনাবে। আমি দোষ করেছি তাই আমাকে বাজে কথা শুনালে আমি তা মেনে নিতে পারবো। কিন্তু বিনা দোষে কেউ আপনাকে আমার জন্য কথা শুনালে আমি তা মেনে নিতে পারবো না।
আপনি আমাকে আমার মত একা ছেড়ে দিতেন। যেমনটা ইফান দিয়েছে।
ইয়াশ ইশিতার মুখে আঙ্গুল দিয়ে ইশিতা কে চুপ করিয়ে দিলো
— চুপ আর একটা কথাও বলবা না। কে আমাকে কি বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। যে কারনেই হোক আর যেভাবেই হোক আমি তোমার বিয়ে করেছি। তুমি এখন এই ইয়াশ চৌধুরীর ওয়াইফ। সো কারো রাইট নেই আমার ওয়াইফ কে নিয়ে কথা বলার। বা আমার ওয়াইফ কে বাজে কথা শুনানোর। যে আমার ওয়াইফের দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলবে আমি তার আঙ্গুল ভেঙ্গে দিব। যারা আমার ওয়াইফের দিকে বাজে ভাবে তাকাবে আমি তাদের চোখ তুলে নিবো।
ইশিতা ইয়াশের কথা গুলো শুনে আগের থেকে বেশি করে কাঁদতে লাগলো। ইয়াশ একটু আদুরে সুরে
— কি হলো আবার কাঁদছো কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি?
ইশিতা বুঝতে পারছে না এই জন্মে সে কি এমন ভালো কাজ করেছিল যার জন্য আল্লাহ ইয়াশের মত একজন কে তার ভাগ্যে লিখেছেন।
— আচ্ছা ইশিতা তুমি কি পারবে না সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে?
পারবে না আমার আর তোমার সন্তানের জন্য আগের সব কিছু ভুলে যেতে?
মানুষ মাত্রই তো ভুল তাই না?
তুমিও নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছো। তাই বলে এখন কি এই ভুল টা কে সারা জীবন আকড়ে রেখে বাঁচতে পারবে?

রাত এগারো টা কি বারোটা, রোডের এক পাশে ইফানের কার সাইড করা। ইফান কারের উপর পা দুলিয়ে বসে আছে। রিহা কারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইফানের হাতে মদের বোতল। রিহা,ইফান কারে করে সেই সন্ধ্যা থেকে এখানে সেখানে ঘুরছে আর সাথে তো ড্রিঙ্ক করছে ই। ইফান আজ একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে যার কারনে আজ ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। ঠিক মত দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াতে গেলে পড়ে যাচ্ছে। ঠিক করে কথা ও বলতে পারছে না।
— রিহা তুমি জানো আজ আমি অনেক খুশি?
রিহা এতো ড্রিঙ্ক করেনি। তাই রিহা এখনও নিজের সেন্সে আছে।
— হুম জানি তো। তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ তুমি অনেক খুশি।
— হুম আজ সত্যি ই আমি নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি সুখী মনে করছি। ইশিতা কে দেখে কেউ আর কখনও এই ইফান চৌধুরীর সাথে ভালোবাসা নিয়ে ফান করতে আসবে না।
রিহা ইফানের কথা গুলো শুনে মনে মনে ভিষণ ভয় পাচ্ছে। ইফান ভুলেও যদি সব কিছু জানতে পারে তাহলে রিহার কি অবস্থা করবে তা ই ভাবছে রিহা।
— ইফান একটা কথা বলি?
ইফান লাফ দিয়ে কার থেকে নেমে গেলে নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে রিহা ধরে ফেলে।
— রিহা তুমি একটা কথা বলার জন্য পারমিশন নিচ্ছো কেন?
তুমি একটা না হাজার টা কথা বলতে পারো। তুমি ই আমার রিয়েল ফ্রেন্ড। তুমি সব সময় আমার পাশে থাকো। দেখো না রাফি টা চলে গেল। ওটা আমার ফ্রেন্ড ই না।
রিহা খুব কষ্ট করে ইফান কে দাঁড় করিয়ে রাখছে। ইফান শরীরের সমস্ত ভার রিহার উপর ছেড়ে দিলে রিহার ইফান কে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে।
— ইফান তুমি ইশিতা কে ভুলে যাও। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না?
ইফান চলো না আমরা বিয়ে করে নেই।
ইফান রিহার কথা শুনে নিজেকে রিহার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে ধপ করে নিচে পড়ে যায়। রিহা ইফান কে আবার দাঁড় করানোর চেষ্টা করে।
— আমি কখনও ইশিতা কে ভুলতে পারবো না রিহা। ও আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল।ইশিতা আমাকে মন থেকে না ভালোবাসলে কি হবে। আমি তো ওকে মন থেকেই ভালোবেসে ছিলাম। ইশিতা কে নিয়ে আমার জীবন সাজাতে চেয়েছিলাম। আমার মনে শুধু মাত্র ইশিতা কে জায়গা দিয়েছিলাম। এখন ইশিতা ওই জায়গায় না থাকলেও আর কেউ সেই জায়গা টা নিতে পারবে না। আমি নিজেই অন্য কাউকে সেই জায়গা টা দিতে পারবো না।
ইফানের এসব কথা শুনে রিহার ইশিতার উপর ভিষণ রাগ হচ্ছে। আর নিজের উপর ঘৃণা তৈরি হচ্ছে, কষ্ট ও হচ্ছে।
ইফান কেন ইশিতা কে এতো ভালোবাসে? কেন রিহা কে ভালোবাসতে পারে না?
আর রিহা ই কেমন যে তাকে ভালোবাসে না তার জন্য সে কত কিছু করছে। রিহা মনে মনে বলছে
— দেখো ইফান তুমি আমাকে ভালোবাসো না এটা জেনেও আমি তোমার জন্য পাগল। আমি কোনো দিনও তোমার ভালোবাসা পাবো না এটা জানার পরও যে কোনো মূল্যে তোমাকে পেতে চাই। তোমাকে পাওয়ার জন্য সব করতে। তোমাকে নিজের করে রাখার জন্য হাজার অপরাধ ও আমার কাছে কিছু না। তোমার জন্য এতো কিছু করার পরও তুমি কেন আমাকে ভালোবাসতে পারবে না? কেন ইশিতা কে ভালোবাসবে?
কেন ইফান কেন?
— আচ্ছা রিহা ইশিতা আমার সাথে এমন কেন করলো?
ইফানের কথা শুনে রিহা ইফানের কথার কোন জবাব দিলো না।
— আমি কি খুব বাজে ছেলে?
আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?
আমি ই ইশিতার ভালোবাসা পাবার যোগ্য ছিলাম না?
রিহা এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ইফান কে ধরে বলতে লাগলো
— আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে না? তুমি কেন ওই ইশিতা কে ভালোবাসলে?
ওই মেয়েকে তোমার লাইফ থেকে বের করার জন্য, ওকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য কতো কিছু করলাম। আর তুমি এখনও ওর কথাই বলে যাচ্ছো। মনে মনে ওকেই ভালোবেসে যাচ্ছো।
কেন ইফান?
কি আছে ওই মেয়ের মাঝে যা আমার মাঝে নেই। আমি তোমাকে পাঁচ বছর ধরে ভালোবাসি।এখন কি করে নিজের পাঁচ বছরের জমানো ভালোবাসা গুলো কে মাটি চাপা দিয়ে দেই? কি করে নিজের চোখের সামনে তোমাকে অন্য কারো হতে দেই?
রিহা চিৎকার করে কথা গুলো বললে ও কোন কথা ই ইফানের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। ইফান সেন্সলেস হয়ে গেছে।রিহা ইফানের মাথা ওর কোলে তুলে নিয়ে। ইফানের কপালে একটা চুমু দিয়ে
— আমি যেকোনো মূল্যে তোমাকে আমার করে নিবো। আমাকে তোমার ভালোবাসতে ই হবে। আমি তোমাকে ইশিতার থেকে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসা দিবো।

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। নাজমা চৌধুরী নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। ইশিতা ও ঘুমিয়ে গেছে। ইয়াশ রুমের লাইট অফ করে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে আধ শুয়া ভাবে বসে আছে।
হঠাৎ করে কলিংবেল বাজার শব্দ হলো। ইয়াশ বুঝতে পারলো ইফান এসেছে। সাথে সাথে ইয়াশ রুম থেকে বের হয়ে নিচে চলে এলো। ইয়াশ দরজার কাছে আসতে আসতে আরো কয়েক বার কলিংবেলের শব্দ হলো।
ইয়াশ মেইন ডোর খুলে কিছু বলতে যাবে। তখনই সামনে রিহা কে দেখতে পেলো। ইয়াশ আগে থেকে রিহা কে চিনে। রিহা কয়েক বার ইফানের সাথে ওদের বাসায় এসেছে।
— রিহা এতো রাতে তুমি এখানে?
— ভাইয়া ইফান
— কোথায় ইফান? কি হয়েছে ইফানের? ও ঠিক আছে তো?
— ভাইয়া ইফান ঠিক আছে। কিন্তু
— কিন্তু কি?
— আসলে ভাইয়া আজ ইফান একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে। তাই সেন্সলেস হয়ে গেছে। ও গাড়িতে আছে ভাইয়া। আপনি একটু ওকে
রিহার কথা শেষ করার আগেই ইয়াশ গিয়ে ইফান কে কার থেকে কাঁধে ভর করে নামিয়ে নিয়ে আসে। ইফান নিজের মধ্যে নেই। হেলছে দুলছে। আর অস্পষ্ট ভাবে বিরবির করে কি যেন বলছে।
— আ,,, আমি তো,,,তো–মাকে কখ—নো হ্মমা,,,,
ইয়াশ ইফানের উপর হাজার রাগ করে থাকলেও ইফান কে এ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ইফান কে কাঁধে ভর করে খুব সাবধানে রুমে নিয়ে যায়।
রিহা ও ওদের পিছনে ইফানের রুমে যায়।ইয়াশ ইফান কে বেডে শুইয়ে দিয়ে।
— রিহা অনেক রাত হয়েছে তুমি কি আজ আমাদের বাসায় থেকে যাবে নাকি তোমার বাসায় চলে যাবে?
তুমি থাকলে আমি গেস্ট রুম খুলে দিচ্ছি।
— না ভাইয়া। আমি থাকবো না। কার নিয়ে আসছি চলে যেতে পারবো।
— আচ্ছা। একা যেতে পারবে তো? নাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।
— না ভাইয়া আপনার কষ্ট করতে হবে না আমি একাই চলে যেতে পারবো।
রিহা চলে গেলে ইয়াশ ইফান কে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে চাঁদর টেনে দিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে চলে গেল।

সকালে ইয়াশ হাতে করে এক গ্লাস পানি নিয়ে ইফানের রুমে আসে। এসে দেখে ইফান এখনও মরার মত পড়ে ঘুমাচ্ছে। ইয়াশ প্রথমে কয়েক বার খুব স্বাভাবিক ভাবে ইফান কে ডাকে। কিন্তু ইয়াশের ডাকে ইফানের কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইয়াশ অযথা আর ইফান কে না ডেকে হাতে থাকা পানির গ্লাসের সবটুকু পানি ইফানের উঠে ঢেলে দেয়। ইফান চিৎকার দিয়ে এক লাফে ঘুম থেকে উঠে বসে।
— কে,,,,কে? কার এতো বড় সাহস আমার উপর পানি ফেলে।
ইফান সামনে তাকিয়ে ইয়াশ কে দেখে। মাথা চুলকিয়ে
— ভাই তুই?
— কাল সারা দিন, সারা রাত কোথায় ছিলি?
— ভাই! আসলে
— ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।
ইয়াশ এক মিনিট ও ইফানের রুমে না দাঁড়িয়ে বের হয়ে আসলো। কালকের কথা মনে করে ইয়াশের মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল ইফান কে মেরে ফেলতে।
ইয়াশ নিচে হলরুমে সোফায় বসে পায়ের উপর পা রেখে নিউজ পেপার পড়ছে। ইফান সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে
— মা আমার চা কই?
উফ মাথা টা ছিড়ে যাচ্ছে। কাল রাতে মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছিল। কি হয়েছে কিছুই মনে আসছে না। কখনও তো আমার এমন হয়না।
নাজমা চৌধুরী কিচেনে রান্না করছিল। ইশিতা ও সাথে হাতে হাতে সাহায্য করছে। নাজমা চৌধুরী ইফানের ডাক শুনে ইশিতা কে ইফানের জন্য চা নিয়ে যেতে বললো।
— ইশিতা মা তুই একটু ইফান কে চা দিয়ে আসতে পারবি?
ইশিতা এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ইফানের সামনে গেছে ইফান যদি উল্টা পাল্টা রিয়েক্ট করে তখন?
আর যদি এখন চা নিয়ে না যায় তাহলে নাজমা চৌধুরী কি মনে করবে।
নাজমা চৌধুরী চায়ের কাপ ইশিতার হাতে দিয়ে
— নে মা যা ইফান কে দিয়ে আয়।
ইশিতার হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলে ভালো হতো।
ইশিতা কাঁপা কাঁপা পায়ে কিচেন থেকে বের হয়ে হল রুমের দিকে এগুতে লাগলো।

চলবে….

সেই তুমি💐
পর্ব -১৮
Samira Afrin Samia
#Nipa

ইফান চোখ ডলতে ডলতে সোফার কাছে এসে ইয়াশের পাশে বসে।
— প্রতি দিন সেই এক নিউজ পেপার! কত ভালো লাগে তোর?
ইয়াশ ইফানের কথায় কান না দিয়ে নিচু হয়ে খুব মনোযোগ সহকারে নিউজ পেপার পড়ে যাচ্ছে।
ইশিতা চায়ের ট্রে নিয়ে ইফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
ইশিতার হাত থরথর করে কাঁপছে। সামনে কে আছে তা না দেখেই ইফান ট্রে থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চাপে ছোট করে একটা চুমুক দিলো। ইফান চা খেতে খেতে বললো
— বাহ!মা তোমার চায়ের স্বাদ তো দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
ইফান বুঝেছিল নাজমা চৌধুরী চা নিয়ে আসছে।
ইফান যখন সামনে তাকিয়ে দেখলো চা নিয়ে নাজমা চৌধুরী নয় ইশিতা আসছে তখন রেখে গিয়ে সাথে সাথে হাতে থাকা চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলে দিলো। ইফান বসা অবস্থা থেকে রেগেমেগে দাঁড়িয়ে গেল।
— তুই এখানে আমার জন্য চা নিয়ে আসছিস। তোর লজ্জা নাই। তোকে কতবার বলেছি আমার সামনে না আসতে। আমার কথা কি তোর কানে যায় না?
আমি তোকে এক সেকেন্ডের জন্য ও সহ্য করতেন পারি না। তোকে দেখলে রাগে আমার গা জ্বলে যায়।
ইফান রাগ করে ইশিতার হাতে থাকা ট্রে উল্টে ফেলে দিলে ইশিতার হাতে আর পায়ের উপর ও গরম চা পড়ে যায়। গরম চা হাতে পায়ে পড়ার সাথে সাথে ইশিতা আহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। ইয়াশের সামনে মুহূর্তের মধ্যে এমন কিছু হয়ে যাবে তা ইয়াশ ভাবতেই পারেনি। ইফানের এমন কান্ড দেখে ইয়াশ রেগে এসে ইফান কে দু থেকে তিনটে ঘুসি মেরে দেয়।
— স্কাউন্ডেল তোর সাহস কি করে হয় ইশিতার সাথে এমন বিহেইভ করার। আমি তোকে অনেক বার বারণ করছি ইশিতার সাথে বাজে ব্যবহার না করার জন্য। তুই তার পর ও ইশিতার সাথে এমন করেছিস।
— ভাই তুই এই নষ্টা মেয়ে টার জন্য আজ আমার গায়ে হাত তুললি?
এই মেয়েটা তোর মাথা খেয়ে নিয়েছে যার কারনে তুই ওকে ছাড়া আর কিছু দেখতে পারিস না।
— খবরদার, আর একবার ইশিতা কে নষ্টা মেয়ে বললে আমি তোর জ্বীব ছিড়ে ফেলবো।
— ওহ আচ্ছা! তাই নাকি?
তাহলে তো আমি হাজার বার ওকে নষ্টা বলবো।
আর হ্যা নষ্টা মেয়েকে তো নষ্টা বলাই উচিত।
— ইফান
ইয়াশ আবার ইফানকে মারতে আসলে ইশিতা এসে ইয়াশের হাত ধরে নেয়।
— আমি আপনার পায়ে পড়ছি আপনি আমার জন্য নিজের মধ্যে মারামারি করবেন না। ইফানের যা ইচ্ছে হয় তা বলুক আপনি ওকে কিছু বলতে যাবেন না।
— ওর যা ইচ্ছা হয় তা বলবে মানে?
ও আমার সামনে তোমাকে নষ্টা বলবে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তা শুনবো নাকি?
— দেখ ভাই এই মেয়ে তোকে কতটা কন্ট্রোলে নিয়ে নিছে। তুই এখন এই মেয়ের সব কথা শুনে চলিস। এমনকি ওর জন্য জীবনের প্রথম আজ তুই আমার গায়ে হাত তুললি।
এ মেয়ে সত্যি ই তোকে বশ করে নিয়েছে।
ইশিতা ইয়াশের হাত শক্ত করে ধরে রেখে
— প্লিজ আপনি শান্ত হন। মা এসব শুনতে পেলে তখন কি হবে আপনিই বলুন। আপনাদের দুই ভাই কে ঝগড়া করতে দেখলে মা কিছুতো তা মেনে নিতে পারবেন না।
ইফান ইশিতার কথা শুনে
— চুপ কর তুই।
আমার মা কে নিয়ে চিন্তা করতে তোকে কে বলেছে?
তুই যে কোন ধরনের মেয়ে তা অনেক আগেই আমার খুব ভালো করে জানা হয়ে গেছে।
আমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে কথা বলার অধিকার তোকে কে দিছে?
সব তোর জন্য। তুই আমার ভাইকে আমার বিরুদ্ধে নিয়ে গেছিস। তোর মত ক্যারেক্টারলেস মেয়ের জন্য ভাই আজ আমাকে মারলো।
ইফান ইশিতা কে আবার ক্যারেক্টারলেস বলায় ইয়াশ ইফানের শার্টের কলার ধরে ইফান কে ধাক্কা দিয়ে সোফায় ফেলে দিলো। সোফার কোনায় ইফানের কপাল লেগে কেটে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে।
নাজমা চৌধুরী কিচেন থেকে বাইরে এসব আওয়াজ শুনতে পেয়ে কি হয়েছে তা দেখার জন্য কিচেন থেকে বাইরে বের হয়ে আসলো। নাজমা চৌধুরী হলরুমে এসে দেখতে পেলো ইফানের কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে ইয়াশ পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর ইশিতা ইয়াশের হাত ধরে রেখেছে। নিচে ট্রে পড়ে আছে সাথে চায়ের কাপ গুলো ও ভেঙে পড়ে আছে। এখানে কি হয়েছে নাজমা চৌধুরী বুঝতে না পেরে ইফানের কাছে এসে
— কি হয়েছে তোর?
তোর কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে কেন? কি করে কাটলো?
আর চায়ের কাপ ভেঙে পড়ে আছে কেন?
আমি কিচেন থেকে এতক্ষণ কিসের শব্দ পেলাম?
নাজমা চৌধুরী কে দেখে ইশিতা ইয়াশের হাত ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। ইয়াশ স্বাভাবিক হয়ে
— কিছু হয়নি মা। ইশিতার হাত থেকে পড়ে গিয়ে এগুলো ভেঙে গেছে।
— ওহ। কিন্তু ইফানের কপাল কাটলো কিভাবে?
ইফান ইয়াশ কে এতোটা স্বাভাবিক দেখে আরও রেগে গিয়ে
— আজ মায়ের কাছ থেকে কিছু লুকাস না ভাই।
মা ও জানুক মায়ের বড় ছেলে কেমন মেয়েকে বিয়ে করে বউ করে ঘরে তুলেছে।
মায়ের আদরের বউ মা’র ক্যারেক্টার কেমন তা তো মা’র জানা দরকার তাই না?
ইয়াশ রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। দু’হাত শক্ত করে মুঠো বন্দী করে রাগে থরথর করে কাঁপছে।
— ইফান যতটুকু বলেছিস এখানেই থেমে যা। নইলে ভালো হবে না বলে দিলাম।
— খারাপ কি হবে?
মা তো একদিন না একদিন জানতে ই পারবে।
যা জানার কথা তা পরে না জেনে আগে জেনে গেলেই ভালো।
— ইফান তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করে ফেলছিস।
ইফান বাম হাত দিয়ে কপালে যেখানে কেটে গেছিল সেখান থেকে রক্তের এক ফোঁটা আঙ্গুলের উপর নিয়ে হাত টা ইয়াশের সামনে এনে ছিটা দিয়ে রক্তের ফোঁটা ফেলে দিয়ে।
— লিমিট তো তুই ক্রস করেছিস। বাইরের একটা মেয়ের জন্য নিজের ভাইয়ের কপাল থেকে রক্ত ঝড়িয়েছিস।তোর কাছে আমার থেকে ওই মেয়েটা বেশি হয়ে গেল।
নাজমা চৌধুরী ইফান ইয়াশ কারো কোনো কথাই বুঝতে পারছে না। জীবনের প্রথম আজ নাজমা চৌধুরীর সামনে উনার দুই ছেলে নিজেদের মাঝে এমন ভাবে ঝগড়া করছে। মারামারি করছে।
— এখানে এসব কি হচ্ছে আমাকে কেউ একটু বুঝিয়ে বলবি?
কিসের কথা হচ্ছে তোদের মধ্যে? আর ইশিতা কে নিয়ে ইফান কি বলছে?
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর কাছে কিছু বলার আগেই ইফান বলতে লাগলো
— মা তোমার বড় ছেলে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে যে সমাজের চোখে দুশ্চরিত্রা নষ্টা কলঙ্কিনী নামে পরিচিত।
যে বিয়ের আগে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের নামে বদনাম তুলেছে, নিজের মুখে চুনকালি মেখেছে ওই মেয়েটা ই তোমার ঘরের বউ হয়ে এসেছে মা। তোমার বড় ছেলে সব কিছু জেনে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।
আর হ্যা মা তোমার বৌমা ইশিতা তো প্রেগন্যান্ট।

এসব কথা শুনে ইশিতা অঝোরে কেঁদে কেঁদে নিজের চোখের নোনাজল গুলো ব্যয় করছে।
ইয়াশ ইফান কে মারতে আসলে নাজমা চৌধুরী এসব শুনে সেন্সলেস হয়ে যায়।ইয়াশ সে মুহূর্তে ইফান কে কিছু না বলে মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।
— মা মা কি হয়েছে তোমার?
মা চোখ খুলো। ইফান আজ মায়ের কিছু হয়ে গেলে আমি তোকে জ্যন্ত রাখবো না।
— মায়ের যা হয়েছে তা তোর জন্য হয়েছে আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন?
কোন মা ই এমন একটা মেয়েকে তার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবে না।
— ইফান তুই কি মানুষ? ইশিতার সাথে এসব কিছুর জন্য তুই নিজে দায়ী হয়ে এখন বুক ফুলিয়ে বলছিস ” এমন মেয়েকে কোন মা তার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবে না ”
ইশিতা কে যদি মেনে নেওয়া না যায় তাহলে ইশিতার সাথে যে এতো নোংরা খেলা খেলেছে তাকে কি মেনে নেওয়া যাবে?
ইশিতা নাজমা চৌধুরীর কাছে এসে
— মায়ের কি হয়েছে?মা চোখ খুলছে না। আপনি এখন এসব কথা বাদ দিয়ে মাকে রুমে নিয়ে যান। আর মা’কে দেখার জন্য ডক্টর কে ফোন দিয়ে আসতে বলেন।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে পাঁচকোল করে রুমে নিয়ে গেল।
ডক্টর এসে নাজমা চৌধুরীর পাশে বসে উনার পালস চেক করছে। ইয়াশ ইশিতা নাজমা চৌধুরী মাথার দিকে বা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াশ বার বার ডক্টর কে জিঙ্গেস করছে নাজমা চৌধুরীর কি হয়েছে
— বলুন না ডক্টর কি হয়েছে মায়ের?
— ভাবীর তো আগে থেকেই লো প্রেসার। একটু টেনশন নিলেই সমস্যা হয়ে যায়।আর সকাল থেকে মনে হয় মুখে কিছু দেয়নি।
ইশিতা পাশ থেকে
— আমি মা’কে অনেক বার করে বলেছি কিছু খেয়ে নিতে কিন্তু মা কিছু খেলো না। বললো রান্না শেষ করে একেবারে সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করবে।
— হুম তাই এমন হলো। আচ্ছা ইফান তোমার মায়ের এতো কিসের চিন্তা?
চিন্তা করতে করতে একেবারে মাথা ঘুরে গেল।
ইয়াশ কিছু বলতে যাবে তখনই নাজমা চৌধুরীর জ্ঞান ফিরলো। নাজমা চৌধুরী ডক্টর কে দেখে
— ভাইজান আপনি এখানে?
দেখলেন আমার একটু কিছু হলো না,না হলো তাতেই আমার পাগল ছেলে দুইটা আপনাকে কষ্ট দিতে গেল।
নাজমা চৌধুরী ডক্টর মাহফুজ আহমেদ কে ভাইজান বলে ডাকেন। অনেক বছর আগে থেকে উনিই সবার চিকিৎসা করেছেন। ইয়াশের বাবা বেঁচে থাকাকালীন উনি ইয়াশের বাবার ও চিকিৎসা করেছে। সে থেকে উনি ইয়াশদের ফ্যামিলির একজন হয়ে গেছেন।
— কষ্ট কিসের ভাবী? এটা তো আমার কাজের মধ্যেই পড়ে। নিজের কাজ করতে আবার কিসের কষ্ট? আর মায়ের কিছু হলে ছেলেরা তো ব্যস্ত হবেই।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিলে ইয়াশ অপরাধী চোখে নাজমা চৌধুরীর দিকে তাকালো
— তা ভাবী এতো কিসের টেনশন আপনার?
এখন তো বাসায় বউমা এসে গেছে এখন আপনার শুধু রেস্ট নেওয়ার কথা।
তা না করে চিন্তা করে নিজের শরীর অসুস্থ করছেন।
নাজমা চৌধুরী মাহফুজ আহমেদ এর মুখে বউ মা কথা টা শুনে মাথা ঘুরিয়ে একবার ইশিতার দিকে তাকায়।
— দেখেন ভাবী এখন তো বয়স হচ্ছে তাই একটু নিজের খেয়াল রাখবেন। বলা তো যায় না কখন কি থেকে কি হয়ে যায়।
— হুম ভাইজান।
— ইয়াশ তোমার মায়ের যত্ন নিও। আর ইশিতা তুমি এখন কেমন আছো?
— জ্বী আঙ্কেল আমি ভালো আছি।
আপনি কেমন আছেন?
— এই তো আমি একদম ফিট আছি।
আচ্ছা আজ তাহলে উঠা যাক।
— না ভাইজান। আমাদের সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করে তার পরই যাবেন।
ইশিতা তুমি ডাইনিং টেবিলে সবার জন্য খাবার দেও।
— আচ্ছা মা আমি যাচ্ছি।

সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করে মাহফুজ আহমেদ চলে গেলে নাজমা চৌধুরী ইফান আর ইয়াশ কে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে যায়।
নাজমা চৌধুরী বেডে পা দুলিয়ে বসে আছে। ইয়াশ আর ইফান পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
— ইয়াশ, ইফান একটু আগে নিচে যা যা বলেছে তা কি সত্যি?
— মা ইশিতা এখন আমার ওয়াইফ। ওর সাথে আগে কি হয়েছে না হয়েছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আর তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।
এখন আমি শুধু এটা জানি ও আমার ওয়াইফ আর ওর গর্ভের সন্তান আমার।
— আমি এসব কিছু জানতে চাই নি। আমি যা জানতে চাইছি তা বল।
ইয়াশ ওর মায়ের কাছে এসে নিচে দুই হাঁটু গেড়ে বসে নাজমা চৌধুরীর হাত ধরে
— হ্যা মা ইশিতা প্রেগন্যান্ট। আমাদের বিয়ে টা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি আর ইশিতা ও আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আমাদের এই বিয়ে করতে হয়েছে।
নাজমা চৌধুরী গম্ভীর গলায়
— ইশিতা যাকে ভালোবাসতো সে তাকে বিয়ে করেনি কেন?
আর ওই ছেলেটা এখন কোথায়?
ইয়াশ একবার ইফানের দিকে তাকিয়ে
— ইশিতা একটা মানুষ রূপী জানোয়ারকে ভালোবেসেছিল। ওই জানোয়ার কে ভালোবেসে বিশ্বাস করে ও অনেক বড় ভুল করেছে। এই ভুলের জন্য ইশিতা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর এখনও পাচ্ছে। তুমি এসবের জন্য ইশিতা কে ভুল বুঝো না মা।
তুমি ইশিতা কে মেনে নিবে না মা?
— মেনে নিবো নাকি মেনে নিবো না তা পরে দেখা যাবে। এখন তুই বল ওই ছেলেটা কে যাকে ইশিতা ভালোবাসতো।
— মা এসব জেনে এখন কিছু হবে না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের দরকার আগের সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করার। ইশিতা কে এসব থেকে বের করে এনে ওকে সুস্থ স্বাভাবিক একটা জীবনে প্রান ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে দেওয়ার। ওই সব বাজে ঘটনা গুলো ভুলে যাওয়ার জন্য সাহায্য করা দরকার।
— আমি শুধু এটা জানতে চেয়েছি ওই মানুষ টা কে?
যে একটা মেয়ের সাথে এমন নিচু কাজ করতে পেরেছে। ওর মা বাবা ওকে ভালো শিক্ষা দিতে পারেনি নাকি ও নিজেই বাবা মা’র দেওয়া শিক্ষা সঠিক ভাবে নিতে পারেনি। যে ছেলে গুলো মেয়েদের সন্মান নিয়ে খেলা করে ওদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
ইফান তার মায়ের কথা গুলো শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here