“সেই তুমি💐 পর্ব -১৯+২০

সেই তুমি💐
পর্ব -১৯+২০
Samira Afrin Samia
#Nipa

পুরো রুমে স্তব্ধতা বিরাজ করছে। নাজমা চৌধুরীর দু চোখের পানি গাল বেয়ে ইয়াশের হাতের উপর পড়লে ইয়াশ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে নাজমা চৌধুরীর চোখের পানি মুছে দেয়।
— ইশিতা এখন কোথায় ইয়াশ?
— ও নিচেই আছে মা।
— মেয়েটা না জানি কত কিছু সহ্য করেছে। আমি জানি সমাজের মানুষ গুলো কেমন হয়। তারা অন্য কে ছোট করার জন্য কতটা নিচে নামতে পারে।
— মা তুমি মন খারাপ করো না। আর ইশিতা এখন ঠিক আছে। ও আগের সব কিছু ভুলার চেষ্টা করছে।
— ইয়াশ তুই আমার কাছে সত্যি করে বল কে ইশিতার সাথে এমন করেছে। আমার থেকে কিছু লুকাবি না।
— কি দরকার আগের কথা মনে করার?
— তোকে বলতে বলছি। এক কথা এক বার বললে হয় না?
বার বার বলা লাগে কেন?ইফান মনে মনে ভিষণ ভয় পাচ্ছে। নাজমা চৌধুরী সব কিছু জেনে গেলে কিছুতেই ইফান কে হ্মমা করবে না।
ইয়াশ ইফানের দিকে তাকাচ্ছে বার বার। ইফানের চোখে ভয়ের ছাপ স্পর্শ দেখতে পাচ্ছে ইয়াশ। তাই ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর কাছ থেকে সব কিছু লুকাতে চেয়ে কথা এড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
— কি হলো তোকে বলতে বলছি। তুই বার বার ইফানের দিকে তাকাচ্ছিস কেন?
এখন কি আমার কাছে কোনো কথা বলার জন্য তুই ইফানের থেকে পারমিশন নিবি?
— মা থাক ওসব। আমি অফিসে যাবো। আমার লেট হচ্ছে।
ইয়াশ রুম থেকে বের হতে নিলে
নাজমা চৌধুরী পেছন থেকে ডেকে
— তোকে আমার কসম লাগে। তুই আজ আমার থেকে কিছু লুকাবি না। ইশিতা আমার ছেলের বউ। এই চৌধুরী বাড়ির বড় বউ। ওস সম্পর্কে সব কিছু জানার আমার অধিকার আছে।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর কথা শুনে দরজার সামনে গিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে গেল। ইয়াশ এক পা ও নড়তে পারছে না। নাজমা চৌধুরী ইয়াশ কে নিজের কসম দিলো এখন ইয়াশ কি করে সব কিছু না বলে থাকবে?
— আমি জানি তুই অতন্ত্য আমার সাথে মিথ্যে বলবি না। কি হলো বল বাবা।
ইয়াশ কিছু ভেবে না পেয়ে বাধ্য হয়ে একসময় নাজমা চৌধুরীর কাছে সব কিছু বলে দিলো।ইফান কিভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ইশিতার সাথে ভালোবাসার নাটক করে ওকে ধোঁকা দিয়েছে। বন্ধুদের সাথে প্লেন করে কিভাবে কি কি করেছে তা সব প্রথম থেকে এক এক করে নাজমা চৌধুরীর কাছে বলেছে ইয়াশ। ইশিতার গর্ভে ইফানের সন্তান এটা জেনেও ইফান এই সন্তান কে অস্বীকার করেছে। বাচ্চা টার দায়িত্ব নেওয়া থেকে পিছুপা হয়ে গেছে। ইশিতা কে একা ছেড়ে দিছে সমাজের মানুষ গুলো অপমান ও লাঞ্ছনার স্বীকার হওয়ার জন্য।
সব কিছু শুনে নাজমা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মুখে কোনো কথা আসছে না। নিজের পেটের সন্তান এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারবে এট নাজমা চৌধুরী কোনো দিন স্বপ্নে ও কল্পনা করেননি। ছোট থেকে ইফান কে নিয়ে কত কষ্ট করেছে নাজমা চৌধুরী। তার পর ও ইফানের উপর একটু আঁচ আসতে দেয়নি। কত করুন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে কতো কষ্ট করে ইফান কে বড় করে তুলেছে। এতো কষ্টের পর আজ এমন একটা দিন দেখতে হবে তা নাজমা চৌধুরীর জানা ছিল না।
নাজমা চৌধুরী ইফানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইফান মাথা নিচু করে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। নাজমা চৌধুরীর দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। নাজমা চৌধুরী এটা ভেবে কাঁদছে উনার এতো দিনের কষ্ট বিফলে গেল। যে শিক্ষা দিয়ে ইফান কে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। সে শিক্ষা উনি ইফান কে দিতে পারেন নি। ইফান এমন হয়েছে এটা উনার ই ব্যথতা। নাজমা চৌধুরী বসা থেকে উঠে এক পা দু’পা করে ইফানের দিকে এগুচ্ছে।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে ইফানের দিকে যেতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
— মা!
ইয়াশের ডাকে নাজমা চৌধুরী সাড়া শব্দ না করে ইফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ইফান নাজমা চৌধুরী কে ওর কাছে আসতে দেখে মাথা উপরে তুলে নাজমা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে
— মা আমার কথা টা ও তো একবার শুনবে।
নাজমা চৌধুরী সাথে সাথে ইফানের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ইফান থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে ওর মা’র দিকে তাকিয়ে আছে।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর কাছে এসে উনাকে ধরে
— মা এসব কি করছো তুমি? তুমি ইফানের গায়ে হাত তুললে?
নাজমা চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পড়ে
— আমার নিজের সন্তান এমন হবে এটা আমি কখনও ভাবতে পারিনি। আমি যদি আগে জানতাম আমার পেট থেকে এমন একটা অমানুষ জন্ম নিবে তাহলে আমি কখনও ই একে গর্ভে ধরতাম না এই দুনিয়াতে আনতাম না। আল্লাহর কাছে এটাই চাইতাম আল্লাহ যেন কখনও আমাকে মা না বানায়।
মায়ের দায়িত্ব সন্তান কে সঠিক শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ করে গড়ে তুলা। আমি পারিনি আমার সন্তান কে সঠিক শিক্ষা দিতে। আমি পারিনি আমার সন্তান কে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। এটা আমার ই তো ব্যর্থতা। আমি ই হয়ত মা হওয়ার যোগ্যতা রাখি না।
— মা এমন করে বলো না ইফান বাচ্চা তাই বুঝতে পারেনি। মানছি ও ভুল করে ওই ভুলটা শুধরে না নিয়ে আরও বড় ভুল করেছে।
কিন্তু ও যতই ভুল করুক তাই বলে তো আমরা ওকে দূরে ঠেলে দিতে পারি না। ওর ভুল টা ধরিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
— তুই আর ওর পহ্ম নিস না বাবা। আমি একটা অমানুষ জন্ম দিছি। তুই ওকে বল আমার সামনে থেকে চলে যেতে। আমি আর এক মুহূর্ত ও ওকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই না।
ইফান মনে মনে রাগে ফোসছে। ওর নিজের মা ওকে বিশ্বাস না করে একটা বাইরের মেয়েকে বিশ্বাস করে ওর থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সে যা করেছে তা যদি অন্যায় হয় তাহলে ইশিতা যা করেছে তা কেন অন্যায় হবে না?
ইশিতা আগে তাকে ধোঁকা দিয়েছে, শুধু ধোঁকা না সবার সামনে অপমান করেছে আর এজন্যই তো ইফান ইশিতার থেকে প্রতিশোধ নিয়ে ওকে ও ধোঁকা দিছে।
— আল্লাহ আমার কোন পাপের জন্য এই জানোয়ার টা কে আমার গর্ভে দিয়েছেন?
ইফান এবার রেগে গিয়ে
— অনেক হয়েছে মা। সেই কখন থেকে তোমরা শুধু আমাকে নিয়েই কথা বলে যাচ্ছো। আমার দোষ টা ই শুধু দেখে যাচ্ছো। ইশিতার কোনো দোষ তো তোমাদের চোখে পড়ছে ই না। আমি যদি কোনো দোষ করে থাকি তাহলে ইশিতা ও দোষ করেছে। আমি অপরাধী হলে ইশিতা ও সমান অপরাধী।
— কি বলতে চাইছিস তুই?
— আমি কি বলতে চাইছি তা তুই বুঝতে না পারলে কে বুঝতে পারবে ভাই?
তুই প্রথম থেকে সব কিছু জানিস।
তাহলে তো তোর এটাও জানার কথা কে কাকে আগে ধোঁকা দিছে। আমি ইশিতা কে আগে ধোঁকা দেয়নি। আমি তো ইশিতা কে মন থেকে ভালোবেসে ছিলাম। কিন্তু ও আমাকে ভালোবাসে নি। ও আমার সাথে শুধু মাত্র ভালোবাসার নাটক করেছে। আমি কি দোষ করেছিলাম যার কারনে ও ওই দিন ভার্সিটির সবার সামনে আমার গালে চড় মেরেছে। আমাকে অপমান করে ওর কি লাভ হলো? ও কেন আমার সাথে এমন করলো এটা কি একবার ও তোমরা ইশিতা কে জিঙ্গেস করেছো?
আমি নাকি ইশিতা কে বেড রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওর সাথে ভালোবাসার এক্টিং করেছি। শুধু ইশিতা কেন আমি নাকি আরও অনেক মেয়েদের সাথে রিলেশন করে ওদের কে বেড রুম পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে তাদের কে ছেড়ে দিছি।
আমি তো ইশিতার আগে অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে ভালো করে তাকাই ই নি।
তার পর ও ইশিতা আমার নামে এমন অপবাদ দিলো।
— ইশিতা তোর সাথে কেন এমন করেছে তা তুই একবার ও জানতে চাইলি না?
ওই কারণ টা খুঁজে বের করলি না যার জন্য ইশিতা তোকে থাপ্পড় মেরেছিল।
— ইশিতা নাহয় তোকে ভুল বুঝে তোর গালে একটা থাপ্পড় মেরেছে। তাই বলে তুই ওর সাথে এতো বড় অন্যায় করবি?
প্রতিশোধ নেওয়ার কি আর কোনো পথ ছিল না?
ইশিতা যা করেছে তা হ্মমা করা যায়। কিন্তু তুই ইশিতার সাথে যা করেছিস তা হ্মমার যোগ্য না।
তোদের দুজনের ভুল বুঝাবুঝির স্বীকার হয়ে একটা নিষ্পাপ শিশু কেন এই সমাজের মানুষের লাঞ্ছনার স্বীকার হবে?
— আমি তো ইশিতা কে বলিনি এই বাচ্চার জন্ম দিতে। ইশিতার ইচ্ছে হলে ও এ্যাবরেশন করিয়ে নিক। তাকে করে বাচ্চা টা ও দুনিয়াতে এসে কারো লাঞ্ছনার স্বীকার হবে না।আর ইশিতার ও বদনাম হবে না।
ইয়াশ ইফানের কথা শুনে রেগে গিয়ে ইফান কে একটা ঘুসি মারলো।
— তুই কি মানুষ? তোর ভিতরে মানুষের আত্মা নাকি জানোয়ারের?
তুই নিজের সন্তানের দায়িত্ব দিতে পারবি না বলে ওকে পৃথিবীতে আসতে দিতে চাস না।
আরে ইশিতা নাহয় তোর কেউ না কিন্তু ইশিতার গর্ভে তো তোর ই অংশ।
আর এখন তো তোকে কারো দায়িত্ব ই নিতে হবে না।
আমি ইশিতা কে ইসলামিক নিয়ম মেনে বিয়ে করেছি। এখন ইশিতা আমার ওয়াইফ। সে দিক দিয়ে ওর বাচ্চা আমার ও বাচ্চা। এই বাচ্চা আমার পরিচয় নিয়ে এ পৃথিবীতে আসবে। আমার নামে আমার পরিচয়ে বড় হবে। ওর প্রতি তোর কোনো দাবি থাকবে না। তুই কোনো দিন ওর সামনে ওর বাবার পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে পারবি না।
আমি জানি একদিন তুই ঠিকই তোর ভুল বুঝতে পেরে এই বাচ্চা টা কে আপন করে নিতে চাইবি। কিন্তু সে দিন আসা পর্যন্ত আর কিছুই করার থাকবে না।
— আমার কোন ইচ্ছে নেই এই বাচ্চা কে নিজের পরিচয় দিতে। তোর ইচ্ছে হলে তুই খুব করে এই বাচ্চা কে নিজের পরিচয়ে বড় করে তুল।
আর হ্যা ভাই কথায় কথায় আমার গায়ে হাত তুলবি না। হাত কিন্তু আমার ও আছে।
ইফানের কথায় নাজমা চৌধুরী রেগে চিৎকার দিয়ে
— ইফান তুই কি এখন বড় ভাইয়ের উপর হাত তিলবি?
— বড় ভাই যদি কথায় কথায় আমার গায়ে হাত তুলতে পারে তাহলে আমি কেন পারবো না।
ভাইয়ের কোনো অধিকার নেই আমার গায়ে হাত তুলার।
ইফানের কথা শুনে ইয়াশ হতভম্ব হয়ে গেল। যে ভাই কে ছোট থেকে নিজের বুকে আগলে রেখে মানুষ করেছে সে আজ তাকে মারার কথা বলছে।
নিজের বুক উজাড় করে ভালোবাসা দিছে আজ সে বলছে তাকে মারার অধিকার নেই।
ইয়াশের চোখে পানির বিন্দু গুলো চিকচিক করছে। শুধু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না।
— সত্যি ই বলেছিস তুই হাত তো তোর ও আছে। আর হ্যা তোকে মারার সত্যি ই আমার অধিকার নেই। আমার ভুল হয়ে গেছে ভাই।
বড় ভাইয়ের এই ভুলটা হ্মমা করতে পারবি না?
— ইফান তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। আজ থেকে এ বাড়িতে তোর জন্য জায়গা হবে না।
— তোমার বাড়িতে থাকার আমার ইচ্ছে ও নাই। তুমি তোমার বড় ছেলে আর তার বউ কে নিয়েই থাকো। আমি এসব আদিখ্যেতা দেখে এ বাড়িতে থাকতে পারবো না। আর একটা কথা বলে দিয়ে যাচ্ছি যত দিন এ বাড়িতে ইশিতা থাকবে ততদিন আমি এ বাড়ির চৌকাঠে পা রাখবো না।
ইফান কথা গুলো বলে সাথে সাথে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। এক বার ও পিছনে ফিরে দেখলো না।
নাজমা চৌধুরী কেঁদে যাচ্ছে। ইয়াশ ঠিক একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আজ যেন নাজমা চৌধুরী এক নতুন ইফান কে দেখলো। যে ইফানের সাথে আগে কখনও পরিচয় ছিলো না।
— ইয়াশ আমাদের ইফান টা এমন কি করে হয়ে গেল?
ইফান তো আগে এমন ছিল না। আমি তো ইফান কে এই শিক্ষা দিয়ে মানুষ করিনি তাহলে ওর এমন হলো কি করে?
— ইফান তো ওর দিক দিয়ে ঠিকই আছে মা। ওর গায়ে হাত তুলার ওকে শাসন করার অধিকার তো আমার নেই।
আমাদের ইফান এখন বড় হয়ে গেছে মা।
— আমাকে হ্মমা করে দিস বাবা। আমার সামনে ইফান আজ তোর সাথে এমন ব্যবহার করলো আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।
— তুমি আমার কাছে হ্মমা চেয়ে আমাকে পাপের ভাগীদার করো না মা। সন্তান মায়ের মা কাছে হ্মমা চাইতে পারে কিন্তু মা কোনো দিন সন্তানের কাছে হ্মমা চাইতে পারে না। মা সন্তানের কাছে হ্মমা চাইলে আল্লাহ ওই সন্তানের উপর নারাজ হবেন।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে
— ইফান কেন তোর মত হলো না বাবা? ছোট থেকে তোরা এক সাথে থেকে বড় হয়েছিস তার পর ও ইফান আর তোর মধ্যে কত পার্থক্য।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে
— কেঁদো না মা সব ঠিক হয়ে যাবে।
— কি করে সব ঠিক হবে?
আর কিছুই তো ঠিক হওয়ার মত রইলো না।

সপ্তাহ কয়েক হয়ে গেল। ওই দিনের পর থেকে ইফান এখন পর্যন্ত একদিন ও বাসায় আসেনি। নাজমা চৌধুরী ইফানের কথা ভেবে সারা দিন চোখের পানি ফেলে। ইয়াশ ও আগের থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। ঠিক মত বাসায় আসে না খাওয়া দাওয়া ও ঠিক মত করে না। সারা দিন কাজের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।

চলবে…..

সেই তুমি💐
পর্ব -২০
Samira Afrin Samia
#Nipa

এরই মাঝে ইয়াশ ইফানের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো ইফান রিহাদের বাসায় থাকে।
ইয়াশ সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে বসে আছে।
ইশিতা রুমে গিয়ে ইয়াশ কে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনিতে গেল। ইশিতা ইয়াশের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা বুঝতে পারছে আজও ইয়াশ ইফানের কথা মনে করে মন খারাপ করে বসে আছে।
ইশিতা পেছন থেকে আস্তে করে
— শুনছেন?
ইয়াশ ইশিতার ডাক শুনে অজানা চিন্তার ঘোর থেকে ফিরে এসে
— কিছু বলবে?
— কিছু দিন ধরে দেখছি আপনি সব সময় মনমরা হয়ে থাকেন। ঠিক সময়ে বাসায় আসেন না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া ও করেন না। আপনাকে এই অবস্থায় দেখে মা ও আরো ভেঙ্গে পড়ছে।
আপনি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়েন সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন তাহলে মায়ের কি হবে?
— আমি কেন যেন দিন দিন আমার সব শক্তি হারিয়ে ফেলছি। মনে হচ্ছে আমার পাশে সবাই আছে কিন্তু কেউ আমার আপন না। ইফান কে ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি এখন ও বলে ওর উপর আমার কোনো অধিকার নেই।
ইয়াশের কন্ঠ ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে।
— ইফান কি করছে তা এখন বুঝতে পারছে না। যেদিন বুঝবে সেদিন ঠিকই পস্তাবে।
আপনি নিজেকে একটু শক্ত করে মায়ের পাশে দাঁড়ান। আপনি ছাড়া তো মায়ের ও আর কেউ নেই।
আপনি বাসায় আসেন না বলে মা ও সারা দিন রুম থেকে বের হয় না। আপনার সাথে বসে এক সাথে খাবার খেতে পারবে না বলে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকে।
আমি অনেক জোর করেও খাওয়াতে পারি না।
— ইফান টা বড্ড র্সাথপর।
অনেক বেশি ভালোবাসা দিয়েছিলাম তো তাই ওর বিহেইভিয়ার গুলো ঠিক মেনে নিতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব। ও কি করে এমন হয়ে গেল?
ইয়াশ ইজি চেয়ার থেকে উঠে রুমে আসতে নিলে ইশিতা ইয়াশের হাত ধরে ফেলে। ইশিতা এই প্রথম নিজে থেকে ইচ্ছে করে ইয়াশের হাত ধরেছে। ইশিতা ইয়াশের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নেয়।
ইয়াশ আজ ইশিতার এমন কান্ড দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল।
— আমি যখন ভিতর থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। নিজের বেঁচে থাকার উদেশ্য টা হারিয়ে নিজেকে নানা ভাবে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম তখন কেউ আমার পাশে ছিল না। সবাই নিজের থেকে আমাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমার কাছে আমার পাশে আপন বলতে কেউ ছিল না। তখন আপনি আমার হাত টা ঠিক এই ভাবে শক্ত করে ধরেছিলেন। কে কি ভাবলো কে কি বললো তার পরোয়া না করে আমার সাথে আমার পাশে থেকেছেন। আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।
আমি যাতে সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন সাজাই সব সময় তা চেয়েছেন।
সত্যি বলতে আপনি যদি আমার হাত টা না ধরতেন তাহলে হয়ত এতদিনে নানা ভাবে আমি আমার জীবন শেষ করে দিতাম।
আমার সাথে যা যা হয়েছে তার পরেও আমি নতুন করে সব কিছু গড়ে তুলেছি। নতুন করে স্বপ্ন সাজিয়েছি। নতুন করে বাঁচতে শিখেছি।এতো কিছুর পরেও আমি সব ভুলে যেতে পেরেছি তাহলে আপনি পারবেন না সব কিছু ভুলে যেতে?
ইয়াশ ইশিতার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে
— তোমার কাছে এমন কেউ ছিল যে তোমার হাতটা ধরবে। সব সময় তোমার পাশে থাকবে। আমার কাছে তো এমন কেউ নেই।
— আপনি ওই দিন বলেছিলেন না। আমি আপনার জন্য নিজের দুঃখ গুলো ভুলে গিয়ে আবার আপনার সাথে নতুন করে পথ চলা শুরু করতে পারবো কিনা।
ওই দিন আপনি বলেছিলেন আজ আমি বলছি।
আপনি কি পারবেন না আমার জন্য আর আমার সন্তানের জন্য যা হয়েছে সব ভুলে যেতে। আমি আমার বাকি টা জীবন আপনার সাথে কাটাতে চাই। আপনার হাত ধরে জীবনে বাকি পথ টুকু চলতে চাই।
ইয়াশ অবাক চোখে ইশিতা কে দেখছে। ইশিতা ইয়াশের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।
— তুমি যা বলছো ভেবে বলছো তো?
— হুম এতো দিন তো অনেক ভাবলাম। এখন সব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের মনের কথা শুনছি।
আপনার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিছে নাকি তা জানি না। তবে আপনার প্রতি আমার একটা দূর্বলতা জন্ম নিয়েছে। যে দূর্বলতার মানে আমি খুব ভালো করেই জানি। আমি এখন আপনাকে হারালে নিজেকে আর সামলে নিতে পারবো না। বাঁচতে পারবো না আর। সব কিছু হারিয়ে যাকে পেয়ে আবার নিজেকে দাঁড় করিয়েছি তাকে হারালে আবার দাঁড়ানোর মত আমার মাঝে এক টুকরো শক্তি ও থাকবে না।আপনি যে কখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছেন আমি নিজেও জানি না। আপনি পাশে থাকলে মনে হয় আমার কাছে সব কিছু আছে। আর আপনাকে হারানোর কথা মাথায় আসলে মনে হয় আমার কাছে কেউ নেই আমি সম্পূর্ন একা।আপনি ছাড়া আমি অপূর্ণ। আপনাকে ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনাকে দেখে আমি আবার ভালোবাসায় বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।
আচ্ছা আপনি সব সময় আমার হাত ধরে আমার পাশে থাকবেন তো?
কথা টা বলার সাথে সাথেই ইশিতার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। আবারও চোখের পানি পড়তে নিলে ইয়াশ তার হাত পেতে হাতের তালুতে পানির বিন্দু গুলো ধরে নেয়।– আজকের পর থেকে তোমার চোখ থেকে আর এক ফোঁটা পানি নিচে পড়বে না। আমি পড়তে দিব না। আমাকে ছাড়া তুমি যেমন অসম্পূর্ণ তেমনই তোমাকে ছাড়া আমি ও অসম্পূর্ণ।
আমি আমার জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এই ভাবে তোমার হাত ধরে তোমার পাশে থাকবো।
তোমাকে কখনও নিজের থেকে আলাদা হতে দিব না।কখনোই না। তোমাকে নিয়ে পূর্নতা পাবে আমার জীবন।
ইশিতা ইয়াশের কথায় হু হু করে কেঁদে উঠলো।
আজ ইশিতা জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিস টা নিজের করে পেয়েছে। এমন একজন মানুষকে সারা জীবনের জন্য পেয়েছে। যে মানুষ টার সাথে সে চোখ বুঁজে জীবনের বাকিটা পথ পারি দিতে পারবে।
— দেখো তো এই কয়দিনে খেয়াল ই ছিল না।
— কি খেয়াল ছিল না?
ইয়াশ আলতো করে ইশিতার পেটের উপর হাত রেখে
— আমাদের বাচ্চার কথা খেয়াল ছিল না।
ইয়াশ হঠাৎ করে ই শি ত পেটে হাত রাখলে ইশিতা একটু লজ্জা পেয়ে যায়। ইয়াশ ইশিতা কে দেখে বুঝতে পারলো ইশিতা লজ্জা পেয়েছে। তাই সাথে সাথে ইশিতার পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ইশিতা কে স্বাভাবিক করার জন্য ইয়াশ আবার বলতে লাগলো
— আমাদের বাবু বলবে ওর বাবা টা খুব বাজে একটু ও ওর খেয়াল রাখে না। ওকে একটু ও সময় দেয় না ভিষণ পঁচা বাবা ওর।
ইয়াশের কথা শেষ হওয়ার আগেই ইশিতা বলে উঠলো।
— একদম না। বাবুর আব্বু মোটেও বাজে না। বাবু তো বুঝে ওর আব্বু কাজে ব্যস্ত থাকে তাই ওর খেয়াল রাখতে পারে না। ওর আব্বুর কাজ শেষ ঠিক ওকে অনেক সময় দিবে। তাই বাবু আব্বু কে পঁচা বলবে না।ইয়াশ কি বলবে বুঝতে পারছে না। আজ এতো দিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষ কে নিজের বলে দাবী করতে পারবে ইয়াশ। ইশিতা যে আর কখনও ইয়াশের হাত ছাড়বে না এটা ইশিতার চোখের দিকে তাকিয়ে ই খুব ভালো করে বুঝতে পারছে ইয়াশ। ইয়াশ আজ নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বড় সুখী মানুষ বলে দাবী করতে পারবে। ভালোবাসার মানুষ টা সাথে থাকলে আর কিছুর ই প্রয়োজন পড়ে না।
— আচ্ছা এখন মায়ের কাছে চলুন। আপনি মা’কে বুঝালে মা ঠিকই বুঝবে। ইফান ভুল বুঝে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তাই বলে তো এখানেই আমাদের জীবন থেমে যাবে না। আমাদের তো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনের পথে আগে এগুতে হবে। ইফান যেদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবে সেদিন ও ঠিকই বাড়ি ফিরে আসবে। আমাদের এখন শুধু সেদিনের অপেক্ষা করতে হবে যেদিন ইফান নিজের কুকর্মের জন্য আফসোস করে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের কাছে আপনার কাছে হ্মমা চাইবে।

নাজমা চৌধুরী রুমে শুভ আছে। ইয়াশ আর ইশিতা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াশ দরজায় টুকা দিয়ে
— আসবো মা?
নাজমা চৌধুরী উঠে বসে
— তুই আমার রুমে আসার জন্য পারমিশন নিচ্ছিস?
ইয়াশ কিছু না বলে রুমের ভেতর এসে নাজমা চৌধুরীর পাশে বসলো।
— মা তুমি এমন করলে কিভাবে হবে বলো তো?
ইফানের জন্য সারা চোখের পানি ফেলো। খাওয়া দাওয়া ও করো না। তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে আমাদের কি হবে?
তোমার হাত আমাদের মাথায় না থাকলে আমরা কি পারবো জীবনে একা চলতে?
নাজমা চৌধুরী কিছু বললেন না। ইশিতা এখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভেতর আসছে না। নাজমা চৌধুরী ইশিতার দিকে তাকিয়ে
— কিরে মা তুই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ভেতরে আয়।
ইশিতা মনে হয় নাজমা চৌধুরীর মুখ থেকে এই কথা শুনার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলো।
ইশিতা সাথে সাথে নাজমা চৌধুরীর কাছে চলে আসে।– আমাকে হ্মমা করে দিস মা।
— আপনি আমার কাছে হ্মমা চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না মা। আপনি আমাকে নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। আমাকে নিজেকে মেয়ের জায়গায় বসিয়েছেন।
ইশিতা কথা শেষ করার আগে নাজমা চৌধুরী বলে উঠলেন
— আমার ছেলে তোর সাথে এতো অন্যায় করেছে। তার পর ও আমি ওকে কোন শাস্তি দিতে পারলাম না। তোর সামনে দাঁড়ানোর মুখ নেই আমার। তোকে দেখলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
— ইফান আমার সাথে অন্যায় করেছে এতে তো আপনার কিছু করার নেই মা। আর ইফান যেমন আপনার ছেলে হয়ে আমার সাথে অন্যায় করেছে। তেমনই তো আপনার বড় ছেলে সব কিছু জেনে শুনে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। দু’জনই তো আপনার ছেলে একজন ভালো হয়েছে একজন খারাপ হয়েছে এতে কি আপনার কিছু করার আছে?
আপনি তো দু’জনকে সমান শিক্ষা ই দিয়েছেন। একজন আপনার আদর্শ আপনার শিক্ষা সঠিক ভাবে নিয়েছে আর আরেকজন নেয় নি। এতে আপনি কেন নিজেকে অপরাধী মনে করবেন?
আর আমার তো কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের গালে হাত রেখে
— অনেক ভাগ্য করে এমন লহ্মী একটা বউ পেয়েছিস। দোয়া করি তোরা সারা জীবন খুব সুখে থাকিস। তোদের সংসার ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ থাকুক। তোদের সম্পর্কে কারো নজর না লাগুক।
ইশিতা একটু অধিকারী কন্ঠে
— হুম ছেলের বউয়ের প্রশংসা করা হয়ে গেলে এখন খেতে যাই। কদিন ধরে সবাই এক সাথে বসে খাওয়া হয় না।

ইফান রিহার সাথে বসে ডিনার করছে। বাড়ি থেকে আসার পর রিহাদের বাসায় ই থাকছে। রিহা ইফানের প্লেটে মাছ তুলে দিয়ে
— ইফান তুমি ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করো। তাই আজ আমি নিজের হাতে তোমার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করেছি। খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।
ইফান বিরক্তি নিয়ে
— রিহা এতো টা দিলে কেন?
আমাকে কি তোমার রাহ্মশ মনে হয়?
— ইফান এমন করে কথা বলো কেন? আমি কত ভালোবেসে স্পেশালি তোমার জন্য রান্না করেছি। আর তুমি এমন বিহেইভ করছো।
— এমন বিহেইভ করবো না তাহলে কেমন বিহেইভ করবো তুমি ই বলো।
— তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি এখন খাও। আর খেয়ে বলো আমার রান্না কেমন হয়েছে। ভালো না হলে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।
ইফান আর রিহা কথা বলতে বলতেই রিহার বাবা ডাইনিং টেবিলে এসে গেল। রিহার বাবা মনির চৌধুরী একটা চেয়ার টেনে বসে।
— তা ইফান দিন কাল কেমন চলছে?
ইফান মাথা নিচু করে খেতে খেতে
— এই তো আঙ্কেল ভালো।
— হুম। কি করছো এখন?
— তেমন কিছু না।আসলে আঙ্কেল
ইফান বলার আগেই রিহা বলে উঠলো
— বাবা ইফান রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসেছে।
— রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে মানে ?
সত্যি নাকি ইফান?
ইফান মাথা নাড়িয়ে
— হ্যা আঙ্কেল।
— তুমি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে এসে একদম ঠিক করোনি ইফান। ওটা তোমার ও বাড়ি। তুমি ও তোমার বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ পাবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here