সেই তুমি ৩ পর্ব ১১+১২

#সেই_তুমি
#সিজন_০৩
#পর্ব_১১
#Tabassum_Kotha

“আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য রাজি।”

ব্যালকনির রেলিং এর কার্নিশ ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য। এক হাতে কফি মগ, আর এক হাত দিয়ে কপালে স্লাইড করতে করতে একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এটা তুর্যর প্রতিদিনের রুটিন।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে ব্যালকনি থেকে বাইরের দৃশ্য দেখতে অজানা এক তৃপ্তি পায় সে

হঠাৎ হীর এর মুখ থেকে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হলো সে।

” আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। কাল রাতের ঘটনার পর এখন মনে হচ্ছে এটা করাই ঠিক হবে ” — হীর।

— ওই প্রস্তাবের মেয়াদ শেষ।

— মানে।

— মানে হলো এই, কাল যখন তোকে আমি প্রস্তাব দিয়াছিলাম তখন তো মানা করে দিয়েছিলি তাই এখন আমি মানা করে দিচ্ছি।

— এটা কি খেলা চলছে?

— খেলা চলছে না, তুই তোর ইগোর জন্য মানা করেছিস ইগো আমারো আছে।

— আপনি সত্যিই একটা পাগল। এটা তাফসির জীবন মরণ এর প্রশ্ন আর আপনি পরে আছেন আপনার ইগো নিয়ে। কী মানুষ রে বাবা!

— তুর্য চৌধুরীর তোর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। ঘন্টা দুয়েক পর কালকের জায়গায় পৌঁছে গেলেই হবে।

তুর্য অপর দিকে ফিরে পুনরায় কফি তে মনোযোগ দিলো। হীরের মাথায় উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।

— আচ্ছা সত্যিকারে বিয়ে না করে মিছে মিছে বিয়ের নাটক করলে হবে না!

তুর্য ভ্রুঁ কুচকে হীর কে দেখছে।

— ওভাবে কি দেখছেন?

— দেখছি তুই পাগলাগারদ থেকে পালানোর পর থেকে একটু বুদ্ধিমতি হয়ে গিয়েছিস।

হীর এই কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। কিন্তু মনে হচ্ছে তুর্য তাকে উপহাস করেছে।

— হয়েছে হয়েছে! এতো ঢঙ দেখানোর কি আছে! আইডিয়া পছন্দ হয় নি বললেই হতো! আসবো আমি হুহ!

হীর চলে গেলে তুর্য আবার কফিতে চুমুক বসায়। দিনের শুরুটা হীর কে দেখে হলে দিনটা বেশ ভালো যায় তার।।

.
পার্পল কালারের একটা চুড়িদার পরে কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হীর। মিনিট পাঁচেক আগেই এসেছে সে। হাতে দুই-চার জোড়া চুরি আর খোলা চুল। এতোটা সাধারণ সাজে কোনো কনে কে সচরাচর দেখা যায় না।
তুর্য এখনও আসে নি। এই প্রথম তুর্য কোনো জায়গায় লেইট। “এমনিতে এতো পাংচুয়াল কিন্তু আজ লেইট!” ভাবতে থাকে হীর। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় তুর্য আসবে না। হীর এর বুকটা আচমকা ছ্যাঁত করে উঠে। সত্যি যদি তুর্য না আসে! তুর্য তাকে না ভালোবাসলেও তুর্যর প্রতি তার ভালোবাসায় কোনো খাঁদ নেই। এই সাজানো বিয়ের মাধ্যমে হলেও সে খানিকটা সময় পাবে তুর্যর পাশে থাকার। কিন্তু সে যদি মত পাল্টে ফেলে!

হীর এর ভাবনায় ছেদ পরলো গাড়ির ব্রেকের শব্দে। তুর্য এসেছে। না চাইতেও হীর এর মুখে প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।

তুর্যর পরনে একটা সাদা শার্ট, হাতা দুটো ফোল্ড করে কুনুই পর্যন্ত উঠানো। গাড়ির সামনে থেকে হীর এর কাছ অব্দি আসা পর্যন্ত হীর একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখের সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিয়ে হীর এর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলো সে।

— এতে কি আছে?

— শাড়ি আর কিছু এক্সেসরিজ।

— কিন্তু কেনো? কার এগুলা?

— ঐ যে পাশে বেঞ্চিতে যেই আঙ্কেল বসে আছেন! দেখতে পাচ্ছিস?

— হ্যাঁ হ্যাঁ!

— এটা তাকে দিয়ে বল তুর্য পাঠিয়েছে,, এটা পরে বউ সেজে আসুন দ্রুত,, আজ আপনার আর তুর্যর বিয়ে। তুর্য অপেক্ষা করছে!

তুর্যর কথার অর্থ খুব ভালোই বুঝতে পারছে হীর। ভয়ে বড়সড় একটা ঢোক গিলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে কেটে পরলো।

“না মানে সত্যি! সবসময় এমন ভয় দেখানো কি খুব প্রয়োজন? আমার মতো একটা ইনোসেন্ট পিচ্ছিকে এভাবে টর্চার করে কেনো যমরাজ টা! যমরাজ! হ্যাঁ যমরাজ! আস্ত একটা পচা। ভাগ্যিস কাজী অফিসে ওয়াশরুম ছিল নয়তো নির্ঘাত আমি মারা পরতাম।”

বিরবির করতে করতে কিছু সময় পর তৈরি হয়ে গেলো হীর।
লাল শিফন শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে তার। সেই সাথে কিছু ব্যাঙ্গলস্ আর এক জোড়া জরোয়া ঝুমকো। এক্সট্রা লাল ওড়না টা মাথায় পরে নিজেকে একবার আয়নায় দেখলো হীর। সম্পূর্ণ না হলেও অনেক টা নতুন বউয়ের মতো লাগছে তাকে। এই দিনটার স্বপ্ন ছোট থেকে দেখে এসেছে সে। আজ হয়তো পূর্ণতা পেতে চলেছে তার স্বপ্ন!

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হীর এর চোখ কপালে। ইয়া বিশাল লাইন ওয়াশরুমের বাইরে। লেডিস ওয়াশরুম হওয়ায় সব মহিলা রা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রাগী চোখে দেখছে হীর কে। প্রায় ৩০ মিনিট সময় ধরে সে ভিতরে ছিল। নিজের আটাশ খানা দাঁত প্রদর্শনী করে সেখান থেকে ছুটলো সে।

— খুব জোর বেঁচেছি বাবা!

— এতো দেরি করে কেউ! আধা ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আ…

হীর কে দেখে আর কোনো শব্দ তুর্যর মুখ থেকে বের হলো না। তুর্য চেয়েছিল খুব করে বকে দিতে। কিন্তু এখানে সে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। লোকে বলে, “একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর তার বিয়ের সাজে লাগে।” কথাটা হয়তো হীরের জন্যই বলা হয়েছিল। আহামরি কোনো সাজ না থাকার পরেও কোনো অপ্সরীর থেকে কম লাগছে না তাকে। তুর্যর ইচ্ছে করছে এই অপ্সরী কে দুনিয়া থেকে লুকিয়ে নিজের মনের স্বর্গে রাখতে। তুর্য অপলক তাকিয়ে আছে হীর এর কাজল কালো চোখের দিকে। তুর্যর এভাবে তাকিয়ে থাকা হীর কে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।

.
বড় আম্মু, বড় আব্বু আর তাফসির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে তুর্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে লাল শাড়িতে, তাও আবার তুর্যর সাথে দেখে, বড় আম্মুর চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এখুনি।সবাই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আসলে কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত সেটা তারা বুঝতে পারছে না। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে পুরো বাড়ি জুড়ে। মনে হচ্ছে ঝড়ের পূর্বের শান্ত আবহাওয়া এটা।

“আমি আর হীর বিয়ে করে নিয়েছি।”-
নীরবতা ভেঙে শীতল গলায় বললেন তুর্য।

তুর্যর কথাটা শুনে মনে হলো বোমা ফাটানো হয়েছে। এখনি এর আফ্টার এফেক্ট দেখা দেবে।

— তোমরা কিছু বলছো না যে!(তুর্য)

তমা বেগম অবিশ্বাসের সুরে এগিয়ে এলেন তুর্যর দিকে।
— তুই এটা করতে পারিস না তুর্য। বল তুই মজা করছিস!

— আমি মজা করছি না আম্মু। আর যতোদূর বুঝি এটা মজা করার মতো বিষয় নয়।

— আমি এটা মানতেই পারছি না। শেষমেশ তুইও! একটা কাজের মেয়ে কে বিয়ে করে নিয়ে এলি!

— আম্মু হীর কাজের মেয়ে না। আমাদের মতোই এই বাড়ির একজন সদস্য সে। আব্বু হীর কে মেয়ে বানিয়েই এনেছিল এ বাড়িতে। তাই ওকে কাজের লোক বলাটা তোমার ভুল হচ্ছে।

— ঠিক আছে মানছি হীর কাজের লোক নয় কিন্তু রায়ানের সাথে যে মুখে কলঙ্ক মিশিয়েছে সেটাও কি অস্বীকার করবি?

— ওসব কিছু মিথ্যে আম্মু। হীর আর রায়ানের কোনো সম্পর্ক নেই। যা কিছু হয়েছে সব রায়ানের সাজানো।

— তুই এতো শিউর হয়ে কিভাবে বলছিস!

— কারণ হীর এর সম্পর্ক আমার সাথে! হীর আমাকে ভালোবাসে! আর আমি হীর কে।

তুর্যর কথা শুনে আমি নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুর্য কিভাবে জানলেন আমি তাকে ভালোবাসি? আচ্ছা সত্যি কি তুর্য আমাকে ভালোবাসে!

— তুই মিথ্যে বলছিস। এই মেয়েটার কুকীর্তি লুকানোর জন্য এসব বলছিস। তোর থেকে আমি এটা কখনও আশা করি নি তুর্য। তুই আমার গর্ব ছিলি,, আর সেই তুই কি না আমার সব আশায় পানি ঢেলে দিলি।

— আম্মু, আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো এভাবে বিয়ে করাতে কিন্তু বিশ্বাস করো আমি যা করেছি ভেবে চিন্তেই করেছি। আর তার থেকে বড় কথা হীর তোমাদের সবার পরিচিত।

তুর্য কে বলে কোনো লাভ না হলে তমা বেগম হীরের কাছে গিয়ে তার দুই বাহু কে গিয়ে চেপে ধরে।
— কি জাদু করেছিস আমার ছেলেকে? এতোকিছু নিজের চোখে দেখার পরও তোর কথাতেই বিশ্বাস করলো! আমার ছেলের জীবন নষ্ট করার আগে একবারও ভাবলি না! তুই নিজে তো একটা নষ্ট। আমার মেয়ের জীবনের সব সুখ খেয়েছিস এখন আমার ছেলেকে ধরেছিস। এটা বোধহয় তোর বড় আব্বুর পাপের ফল,, যেই পাপ সে তোকে আমাদের পরিবারে এনে করেছিল।

বড় আম্মুর কথাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছে। সত্যি বোধহয় অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি বিয়ে টা করে!
#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_১২
#Tabassum_Kotha

“এনাফ আম্মু। তোমার রাগ আমি মানছি কিন্তু তুমি হীরকে এভাবে অপমান করতে পারো না।”

তমা বেগম কে উদ্দেশ্য করে তুর্য কথাটা বললে থমকে যায় তমা বেগম। কলিজার টুকরা ছেলের মুখ থেকে এই কথা শুনতে হবে কখনও এটা তার কল্পনার বাইরে ছিল।

— তুই এই মেয়েটার জন্য তোর মা কে অপমান করছিস!

— আমি তোমাকে অপমান করছি না আম্মু। শুধু হীর কে তার প্রাপ্য সম্মান টুকু দিচ্ছি। হীর আমার বিবাহিতা স্ত্রী। এই চৌধুরী বংশের একমাত্র পুত্রবধূ। এ বাড়িতে তোমার যতোটা সম্মান আছে আজকের পর থেকে হীর ও সেই একই সম্মানের অধিকারী।

তমা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তুর্যর সাথে আর কথা বলে কোনো লাভ হবে না সেটা সে ভালোই বুঝতে পারছে। আফজাল সাহেবের এই বিয়ে তে কোনো আপত্তি নেই। হীর কে সে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। পারিপার্শিক পরিস্থিতি যেমনি হোক না কেন সম্পর্ক এতো দ্রুত রূপ বদলায় না!
তবে এই পুরো ঘটনার একমাত্র নিরব দর্শক ছিল তাফসি। এতোটাই শান্ত চোখে সে এসব দেখছিল যেনো মনে হচ্ছে সে আগে থেকেই সবটা জানে!

“যাকে দেখানোর জন্য এতোকিছু করলাম সে তো কোনো রিয়েক্ট ই করলো না! ধূর ছাই! যা ই করি উল্টোই হয়!”
কথাগুলো বির বির করছিলাম হঠাত্ তুর্য পিছন থেকে মাথায় চাঁটি মারলেন।
— তোর কি সত্যি মাথায় সমস্যা আছে?

— অ্যা?

— আবার বলে অ্যা!

— মানে?

— একা একা বিরবির করছিস কেনো?

— কোই না তো!

তুর্য ল্যাপটপ নিয়ে বসে তার কাজে মনোযোগ দিলেন। এদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা। বিয়ে তো হলো, এখন যদি তুর্য তার স্বামীর অধিকার চেয়ে বসে! না, না! এটা কিছুতেই হবে না। আমি হতেই দেবো না ওসব। কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি?

তুর্য ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে হীর কে দেখছে। রুমের একদিক থেকে অন্য দিকে পায়চারি করছে। শাড়ির কুঁচি হাটু অব্দি তুলে ধরে রেখেছে। মাথায় দেওয়া এক্সট্রা ওড়না টা খুলে কাঁধে পরে রয়েছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন আছে সে, সে তুর্যর আর বুঝতে বাকি নেই।

— হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? স্টপ দিস। ইউ আর ইরিটেটিং মি নাও।

শাড়ির কুঁচি ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পরলাম। প্রশ্ন টা করা প্রয়োজন কিন্তু সাহস পাচ্ছি না।

আমার মৌনতা দেখে তুর্য নিজেই প্রশ্ন শুরু করলেন।
— কি ভাবছিস এতো!

— কিছু না। আপনি কাজ করুন।

— বাই এনি চান্স, তুই বাসর পালন করতে চাস না তো! যেটা লজ্জায় বলতে পারছিস না?

তুর্যর কথা শুনে আমার চোখ কপালে। কি বলছে লোকটা!

— বাসর! তাও আবার আমি! হা হা হা। নাইস জোক।

তুর্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার দৃষ্টি আমাকে আরও বিব্রত করে তুলছে।

— ওভাবে কি দেখছেন? আরেহ বাবা আমি কেনো বাসর করতে চাইবো? আপনি বারবার বললেই তো আর আমি পাগল হয়ে যাবো না। তাই না! কোনো পাগলই আপনার সাথে বাসর করতে চাইবে।

তুর্য ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। উনি এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন আর আমি এক পা এক পা পিছাচ্ছি। পিছুতে পিছুতে আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে কিন্তু তুর্য আমার দিকেই আসছেন। হঠাত্ করেই আমার হৃত্স্পন্দন বাড়তে শুরু করেছে। এতো দ্রুত হার্টবিট উঠা নামা করছে যে সেই শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। তুর্য একদম আমার মুখ বরাবর এসে পরেছেন। এখন আর উনাকে ভয় করছে না। এখন ভয় হচ্ছে যদি আমার হৃত্স্পন্দন এর তীব্র শব্দ তুর্য শুনে ফেলে! আমি আর তার চোখে দেখতে পারবো না… বাম হাতে বুকের পাশটা জোরে চেপে ধরে আছি, যেনো সে শব্দ শুনতে না পারে।

— এতো অ্যাবনর্মাল বিহেভ করছিস কেনো?

— কোথায় অ্যাবনর্মাল বিহেভ করছি? আমি ঠিক আছি।

— ইয়া রাইট। সেটা তোকে দেখেই বুঝতে পারছি।

তুর্য ধীরে ধীরে আমার আরও কাছে আসছেন। এদিকে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। এসি রুম তবুও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। হাত পা ও কাঁপছে। কি মুশকিল! একবার মাত্র তুর্য আমার কাছে আসছেন তাই আমার এই অবস্থা,, আর এখন থেকে তো রোজই আমার উনার সাথে থাকতে হবে! তখন আমার কি হবে! তুর্যর ঠোঁট জোড়া আমার ঠোঁটের ঠিক সামনে। সর্বোচ্চ এক ইঞ্চি দুরত্ব রয়েছে আমাদের মাঝে। উনার উষ্ণ নিশ্বাস আমার চোখে মুখে আছড়ে পরছে। নিজেকে কেমন মাতাল মাতাল লাগছে। আমার কিছু বুঝে উঠার আগেই তুর্য তার ঠোঁটদ্বয় আমার ঠোঁটে চেপে ধরলেন। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঠিক সেটাই হলো যেটার ভয় আমি পাচ্ছিলাম।
তুর্য আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে মনের সুখে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বুঝে উঠতে পারছি না কি করবো। কিছু না ভেবেই নিজের সব শক্তি দিয়ে তুর্য কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলাম। ধাক্কা টা মনে হয় বেশ জোরে হয়ে গেছে।

টাল সামলাতে না পেরে তুর্য মেঝেতে পরে যায়।এবার আর রক্ষে নেই। নির্ঘাত মারা পরবো।তুর্য রক্ত চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আজকে আমাকে পুরিয়ে মারবেন। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। কিন্তু না। ভয় পেলে আরও ভয় দেখাবেন। আমাকে শক্ত থাকতে হবে।

— হোয়াটস্ রঙ ওইথ ইউ? আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট?

— আপনি আমাকে এইভাবে স্পর্শ করতে পারেন না। ভুলে যাবেন না এই বিয়ের শর্ত। আপনার আর আমার মধ্যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক নেই যে আপনি স্বামী হওয়ার অধিকার নিতে আসবেন। এই ঘরে আপনি আপনার মতো থাকবেন আর আমি আমার মতো। কেউ কারো ওপর অধিকার ফলাতে যাবো না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

তুর্যর স্বাভাবিক চেহারা ক্রমশ শক্ত হতে থাকে। মুহূর্তেই রাগে লাল হয়ে যায় সে। বোঝাই যাচ্ছে সে বেজায় রেগে আছে। দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে সে। তুর্যর জীবনে রিজেকশন সে খুব কমই ফেস করেছে। কিন্তু আজ কাছের মানুষের থেকে পাওয়া রিজেকশন মানা তার পক্ষে ভীষণ কঠিন। সে হীর কে ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চায় না কিন্তু তার আত্মসম্মান টাও তার কাছে অনেক বড় কিছু। চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নেয় তুর্য। সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার এই অমানবিক রাগ দেখাতে চায় না।
আলমিরা থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে যায় সে।

‘তুর্য কিছু না বলেই চলে গেলেন! আমি বেঁচে গেছি! নিশ্চয়ই তুর্য আমাকে ভয় পেয়েছেন! আমিও শক্তিশালী হয়ে গেছি!’

হীর একটা বিজয়ী হাসি দিয়ে বেডের এক কোনায় শুয়ে পরে। ভীষণ ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।

.

ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে আমি হাওয়ায় ভাসছি। এই ধরনের স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। কিন্তু আজকের টা একটু ভিন্ন ধরনের। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। হঠাত্ কেউ নিচে ফেলে দিলে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলাম। এবার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেছে। স্বপ্ন নয় বাস্তবেই আমাকে কোল থেকে নিচে ফেলে দিয়েছেন তুর্য!

— আপনি কেমন মানুষ হ্যাঁ? একটা ঘুমন্ত বাচ্চা কে কেউ এভাবে উঠিয়ে ফেলে দেয়?

— ওয়েট আ মিনিট! এখানে বাচ্চা কে?

— আমি!

— নাইস জোক। বাই দ্য ওয়ে ওটা কাউচ। এখানে পরে এমনও কোনো আহামরি ব্যথা পাবে না।

ভালো মতো লক্ষ্য করে দেখলাম, সত্যি কাউচে ফেলেছেন।

— কোথায় ফেলেছেন এটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো কেনো ফেলেছেন? আমি ঘুমিয়েছিলাম!

— আমার বেডে তুমি শোবে না। যেহেতু আমাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক নেই সেহেতু আমার সাথে এক বিছানায় তুমি শুতে পারবে না।

রাগে আমার নিজের চুল নিজরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে। আস্ত একটা যমরাজ এই লোকটা। কিন্তু আমার ঘুম আমি এই লোকের জন্য নষ্ট করবো না।
হীর বালিশ নিয়ে উল্টো দিক ফিরে আবার ঘুমিয়ে পরলো। তুর্য বিছানায় বসে এক দৃষ্টিতে হীর কে দেখছে। অনেক কথা জমে আছে তার মনে। ইচ্ছে ছিল আজ রাতটা তার মনের সব কথা হীর কে বলে পার করবে। কিন্তু হীর যে তাকে সহ্য করতে পারে না এটা তার ধারণার বাইরে ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলো তুর্য। পাশেই গিটার টা পরে আছে। বহুদিন হয়ে যায় গিটারে কোনো সুর তোলা হয় না।

সিগারেট জ্বালিয়ে এক টান দিতেই হীর এর দিকে ফিরে তাকায় তুর্য। তবে এবার সিগারেট টা না ফেলে অ্যাশট্রে তে রেখে গিটার কাঁধে নেয়। হীর ঘুমিয়ে আছে। ব্যালকনির কাচ খোলা থাকায় বাতাস এসে হীরের চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। এই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করেছে সে। কিন্তু আজ কেমন তিক্ত লাগছে সব। অপর দিকে ফিরে সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে আগের স্থানে রেখে দিলো সিগারেট টা।

…..

এই চেনা শহর, চেনা সময়
সময় গড়ালে অচেনাও হয়
এই তোমায় নিয়ে আমি ভাবি
তোমায় অনেক চিনে ফেলেছি
আসলে কি করেছি?

তোমায় আমি চিনি না, আবার বোধ হয় চিনি
তোমায় আমি চিনি না, আবার বোধ হয় চিনি..
….

তুর্যর গানের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তুর্য কে এর আগে কখনও গান গাইতে শুনি নি। তার গাওয়া গানটা আগেও শুনেছি তবে তার কন্ঠে গানটা যেনো জীবন পেয়েছে। প্রতিটা কথা আমার বুকে এসে বিধছে।

….

এই ভালোবাসা দিলাম তোমায়
কিন্তু একটা কিন্তু থেকেই যায়
যখন দূরে দূরে থাকো তুমি
তখন অনেক ভালোবেসে ফেলি, হায়!
আসলে কি বেসেছি?

তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি
তোমায় ভালোবাসি না, আবার বোধ হয় বাসি!!!

….

গিটারের প্রতিটা সুর যেনো আমার বুকে রক্ত ঝরাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে গানের কথাগুলো তুর্যর মুখ থেকে শুনতে। আচ্ছা আমার মনের যেই অবস্থা তুর্যরও কি সেই একই অবস্থা?

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here