সেই তুমি ৩ পর্ব ৩+৪

#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_০৩
#Tabassum_Kotha

আমার বাম হাত চেপে ধরে স্বজোরে টেনে হাসপিটালের সিড়ি দিয়ে নামাচ্ছেন তুর্য। এতো জোরে হাত ধরেছেন যে ব্যথায় শ্বাস আটকে আসছে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় হেঁচকা টানে বারবার পরে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সেদিকে তুর্যর বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশেষে পুরো হসপিটাল জুরে আমাকে টেনে হিচড়ে এনে গাড়ির বোনেটের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। নিলয়ের মুখ থেকে কাল রাতের ঘটনা শুনে এমনিতেই উনার উপর রাগ হচ্ছিল আমার। তারওপর উনার এই ধরনের ব্যবহারে রাগ যেনো আরো কয়েকগুন বেড়ে গেলো।

তুর্যর মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটো দিয়ে মনে হচ্ছে এখনই আগুন বের হবে আর সেই আগুনে আমি ঝলসে যাবো। তুর্য আমাকে চড় মারার জন্য হাত উঠিয়েও নামিয়ে নিলেন। হয়তো মাঝ রাস্তায় তামাশা করতে চান না।
তুর্য নিজেকে যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রন করে আমাকে গাড়িতে ঠেলে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সীটে বসলেন। উনার রাগ থাকতেই পারে, কিন্তু তাই বলে আমার রাগ তো আর কমে নি। হয়তো আর কমবেও না। শরীরে মারের দাগ মিশে গেলেও চরিত্রের দাগ মিশে যাওয়া সম্ভব না। তুর্য কিছুক্ষণ ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে রাগ টা কে নিয়ন্ত্রন করে গাড়ি চালানো তে মনোযোগ দিলেন। কষ্টে মনে হচ্ছে নিশ্বাস আটকে আসছে আমার। কিছুতেই ভুলতে পারছি না নিলয়ের কথাগুলো। জানালার কাচের বাইরে তাকিয়ে আছি আর চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জলকণা গড়িয়ে পরছে। পুরো রাস্তা উনার সাথে আমি একটা কথাও বলি নি।
বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নেমে আমি সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। তুর্য মূর্তির ন্যয় গাড়ির দরজার বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন। হয়তো হাসপাতালের বাইরে যেই কথা গুলো না বলা রয়ে গেছিলো সেগুলোই বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তাকে এই সুযোগ আমি দিতে চাই না।

.
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাটুতে মুখ গুজে বসে আছি। যেই ঘরটাতে আমি থাকি সেটা এমনিতেও অনেক ছোট, তারওপর ঘরে আলো জ্বালা হয় নি। রাত যতো গভীর হচ্ছে, অন্ধকার ততোটাই জেকে বসছে। কিন্তু আমার অন্ধকারে থাকতেই ভালো লাগছে। কেনো যেনো আলোর প্রতি একটা তীব্র বিতৃষ্ণা কাজ করছে। মনে হচ্ছে এই অন্ধকার আমার কতোই না আপন,, আমার সব কষ্ট অন্ধকার তার কালোর মধ্যে শুষে নিচ্ছে। আচ্ছা তুর্যকে ভালোবাসা কি আমার অপরাধ হয়েছে! আমি নিজ ইচ্ছায় তো তাকে ভালোবাসি নি, কখনও পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না যে তুর্যকে ভালোবাসবো। ভালোবাসা টা কখন যেনো নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে। কথাগুলো চিন্তা করতে করতেই চোখ ভিজে যাচ্ছে পানিতে।

হঠাত্ কিছু একটা মনে হতেই চমকে উঠলাম আমি। হতে পারে যা আমি ভাবছি সেটা আদৌ সত্যি নয়। এমনও তো হতে পারে তুর্য আমাকে আর নিলয়কে একসাথে দেখে কষ্ট পেয়েছেন এজন্যই এমন করেছেন! হ্যাঁ তাই হবে, হয়তো তুর্যও আমাকে ভালোবাসেন। তাই তো নিলয় কে মেরেছেন। আমাকে ভুল বুঝেই আমাকে মেরেছেন। নাহ তুর্য আমাকে ভালোবাসেন, তাই তো আমাকে নিয়ে এতোটা পজেসিভ। আমিই উনাকে ভুল বুঝে যা নয় তা বলেছি। আমার উনার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
জানি না সঠিক ভেবেছি নাকি ভুল তবুও নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বসা থেকে উঠে তুর্যর ঘরের দিকে হাটা ধরলাম। বারবার মনে হচ্ছে আমি যেটা চিন্তা করছি সেটাই সঠিক। তুর্য সত্যি আমাকে ভালোবাসেন আর এর জন্যই আমার প্রতি উনি এতোটা পজেসিভ।

তুর্যর ঘরের দরজা হালকা ফাঁকা করা থাকায় নক না করেই ঢুকে পরলাম। বরাবরের মতো এবারও উনার ঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন। ডীম লাইটের মৃদু আলোতে ব্যালকোনির কাচ খোলা সেটা বোঝা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে ব্যালকোনির কাঁচ একটু সরাতেই আমার পা থমকে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে আমার সব স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। অর্ধ পোশাকে একটা মেয়ে তুর্যর বুকের উপর শুয়ে আছে ব্যালকোনিতে রাখা কাউচে। যেই পরিস্থিতিতে তারা দুজন রয়েছে, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বুঝতে আমার আর বাকি নেই। বুক ফেঁটে বেরিয়ে আসা চিত্কার দুহাত দিয়ে চেপে ধরে দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। এই দৃশ্য দেখার আগে আমি অন্ধ হয়ে গেলেও মন্দ হতো না।

.
জেসিকা কে বুকের উপর থেকে উঠিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো তুর্য। জেসিকা তুর্যর আচমকা ব্যবহারে খানিকটা কেঁপে উঠলেও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো,

— হুয়াট হ্যাপেন্ড বেবি? এভাবে আমাকে নিজের থেকে দূরে করে দিলে যে?

তুর্য বসা থেকে উঠে গিয়ে কাউচে রাখা টিশার্ট টা গায়ে জরিয়ে নিয়ে বললো,
— তোমার এখানে আসা ঠিক হয় নি জেসি।

জেসিকা খানিকটা ব্যথিত হয়ে তুর্যর গলা নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে বললো,
— দেশে ফিরে তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো বেবি। আগে আমাকে ছাড়া এক মূহুর্তও থাকতে পারতে না। আর এখন! এতোদিন ধরে এসে একটা ফোনও করো নি। উল্টো আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এলাম,, তাতেও তুমি খুশি নও।

— এমন কিছুই নয়। আমি শুধু বলেছি যে তোমার এভাবে হুট করে আমার বাড়িতে আসা ঠিক হয় নি। আমার ফ্যামিলি তোমাকে দেখলে ভুল বুঝবে।

— ভুল বুঝার কি আছে? উই আর ইন আ রিলেশনশীপ। আর কিছুদিন পরে আমরা বিয়ে করবো।

— লুক জেসি,,,

তুর্য কিছু বলার আগেই জেসিকা তুর্যকে থামিয়ে দিয়ে তুর্যর ঠোঁটে ঠোট ডুবিয়ে দিলো।

তুর্যর ঘরের বাইরে গিয়েও, চোখের দেখা অনেক সময় ভুল হয় ভেবে ফিরে এসেছিল হীর। সে ভেবেছিল হয়তো সে যেমনটা দেখেছে সত্যিটা তেমন নয়। কিন্তু এখন নিজের চোখে তুর্য আর সেই মেয়েটাকে কিস করতে দেখে হীর এর মন পুরোপুরি ভেঙে গেছে। নিজের চোখের সামনে তুর্যকে অন্য একটা মেয়ের সাথে এই পরিস্থিতে দেখার চেয়ে হীরের মরে যাওয়াও হয়তো অনেক ভালো ছিল। দুচোখের পানি আর কান্না আটকে ধরে হীর তুর্যর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যকারো সাথে কল্পনা করাও কষ্টকর। সেখানে হীর তার ভালোবাসাকে অন্যকারো হয়ে যেতে দেখে এলো এই মাত্র। তার কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত সে বুঝতে পারছে না।

নিজের ঘরে এসে শাওয়ার ছেড়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি। কনকনে শীতের রাত। ঠান্ডা পানির প্রতিটি ফোঁটা বরফের তীরের মতো শরীরে এসে পরছে। তবুও আমার মনে আগুন জ্বলছে। মনে হচ্ছে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে বুকে অজস্র আঘাত করে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তাত্ব হয়ে গেছে। সেই রক্ত অশ্রু হয়ে আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝরে পরছে। কিন্তু তাতেও আমার কষ্ট কমছে না। কি করলে এই কষ্ট কমবে? বারবার তুর্যর সেই দৃশ্য চোখের সামনে আসছে।

.
জেসিকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছে থেকে সরিয়ে দিলো তুর্য।
— হাও ডেয়ার ইউ জেসি? ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিটস। আমি তোমাকে রিলেশনের আগেই বলেছিলাম এটা শুধুই টাইম পাস। এর চেয়ে বেশি আমার কাছে থেকে এক্সপেক্ট কোরো না। আমার জীবনে অন্যকেউ আছে এটাও বলেছিলাম কিন্তু তারপরও তোমার এমন ইনসেইন ভিহেবিয়র এর মানে কি?

— আই এম ইন লাভ উইথ ইউ তুর্য। জানি এই রিলেশনটা শুধুই টাইম পাস ছিল কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ডোন্ট ডু দিস টু মি। আই ওয়ান্ট ইউ।

— বাট আই ডোন্ট। আই ওয়ান্ট সামওয়ান এলস্। আই নিড সামওয়ান এলস্। আই লাভ সামওয়ান এলস্।

— আই কান্ট লিভ উইথাওট ইউ। (কাঁদতে কাঁদতে)

— ডোন্ট টক রাবিশ। জাস্ট গেট আউট ফ্রম হিয়ার।

জেসিয়া কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে গেলো।
তুর্য কিছুক্ষণ সময় কাউচে উপুর হয়ে বসে থেকে কিছু একটা ভেবে উঠে পরলো। হীরের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তুর্য। ব্যালকোনি থেকে ঘরে ফিরে আসার সময় শক্ত কিছু একটা তুর্যর পায়ে আটকে যায়। ছোট্ট সেই জিনিসটা হাতে নিতেই তুর্যর বুকটা মুচড়ে উঠে। কালো পাথরের ছোট্ট একটা কানের দুল মেঝেতে পরে ছিল। এই দুলটাই আজকে সারাদিন হীরের কানে দেখেছে সে। তুর্যর আর বুঝতে বাকি নেই যে একটু আগে হীর এই ঘরে এসেছিল। তাকে আর জেসিয়াকে আপত্তিকর অবস্থাতে দেখেও নিয়েছে। হীর তাকে ভুল বুঝেছে ভাবতেই কেমন অস্থিরতা কাজ করে তুর্যর মনে।
কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে থেকে কানের দুলটা ট্রাউজারের পকেটে ভরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায় তুর্য।

শাওয়ারের পানি বন্ধ করে আগের মতোই হাটু চেপে বাথরুমের মেঝেতে মূর্তির মতো বসে আছে হীর। একটু আগে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো চোখের সামনে দিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে। খনিকে খনিকে বুকটা কেঁপে উঠছে কষ্টে। হঠাত দরজায় খটখট শব্দে ধ্যান ভাঙলো হীরের। চোখের পানি শুকিয়ে গালে দাগ পরে গেছে। বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আধভেজা কাপড়েই অন্যমনষ্ক হয়ে দরজা খুলে দিলো হীর।

দরজার বাইরে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে তুর্য। এতোক্ষণ অপরাধবোধে দৃষ্টি নিচু হয়ে থাকলেও হীরের অবস্থা দেখে তুর্যর বুকটা ধক্ করে উঠলো। দীর্ঘ সময় পানিতে ভেজার কারণে হীরের চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গোলাপী আভায় রাঙা ঠোঁট জোড়া ঠান্ডায় কালচে হয়ে গেছে। সেই সাথে ঠকঠক করে কাঁপুনি তো আছেই। এতোক্ষণ কান্না করার পরেও হীরের চোখের পানি বাঁধ মানছে না, তবুও নিজেকে শক্ত রেখে তুর্যর সামনে ঠায় দাড়িয়ে আছে। নিজেকে কারো সামনে দুর্বল দেখাতে চায় না হীর। কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে গেছে হীরের।

ভাঙা ভাঙা কন্ঠে হীর বললো,
— এতো রাতে আপনি আমার ঘরের বাইরে? কিছু প্রয়োজন ছিল আপনার?

তুর্য হীরের প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে হীরকে জিজ্ঞেস করলো,
— তোর এই অবস্থা কেনো? এতো ঠান্ডার মধ্যে এভাবে ভিজেছিস কেনো?

— আমি কেনো ভিজেছি সেই কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে বাধ্য আমি?

— আমি একটা সোজা প্রশ্ন করেছি যার সোজা উত্তর আমি চাই। কেনো ভিজেছিস সেটা বল।

হীর কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তুর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতোটা মায়া জরানো মুখ হীর এই শহরে আরেকটা দেখেছে বলে তার মনে হয় না। এই মায়াভরা মুখটাই তার সর্বনাশের কারণ।

— আপনার কোনো কাজ থাকলে বলুন। নয়তো চলে যান। আমি ঘুমাবো। দুচোখ ভেঙে ঘুম আসছে আমার।

বলেই হীর দরজা আটকে দিতে গেলে তুর্য হাত দিয়ে দরজা ঠেলে ধরে। একটা ধাক্কায় দরজা খুলে দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পরে তুর্য।
#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_০৪
#Tabassum_Kotha

তুর্যর তীক্ষ্ম দৃষ্টি প্রবাহিত হতে হতে এক পর্যায়ে হীরের ভেজা শরীরের উপর এসে স্থির হয়। কালো জামাটা হীরের ভেজা শরীরের সাথে লেপ্টে থাকায় শরীরের অনেকটা ভাঁজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। না চাইতেও তুর্যর দৃষ্টি সেখানে আবদ্ধ হচ্ছে বারবার। তুর্যর কামনায় ভরা দৃষ্টি হীরের দৃষ্টিগোচর হতেই হীরের শরীর কেঁপে উঠে ঘৃণায়। যেই মানুষটাকে এতোটা ভালোবেসে, যার সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে সেই মানুষটার কাছে থেকে এসব সে স্বপ্নেও আশা করে নি।
অন্যান্য সময় তুর্যর একটি দৃষ্টির জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা করি আর আজ সেই দৃষ্টি আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে ঘৃণায়। উনার দৃষ্টিতে লালসা স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। ছিঃ! উনি এতোটা নিচ আমার জানা ছিল না। কিছুক্ষণ আগে ঐ মেয়েটার সাথে এতোকিছু করার পর এখন আবার আমার উপর কুদৃষ্টি দিচ্ছেন!

কোনোকিছু না ভেবে ঠাস্ করে তুর্যর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। আমি নিজেও জানি না এতো সাহস আমার মধ্যে এলো কিভাবে! শুধু এতোটুকু জানি এই খারাপ মানুষটার খারাপ দৃষ্টি আমি আর নিতে পারছিলাম না। তুর্য থাপ্পড় মারার পর থেকে মাথা নিচু করে রেখেছেন। প্রায় দেড় মিনিটের উপরে হয়ে গেছে। তারপরেও উনার কোনো নড়াচড়া নেই। এখন আমার সত্যি ভয় করছে। যতোই হোক বাড়িটা তুর্যদের, আর আমি এই বাড়ির আশ্রিতা। তুর্য যদি একলা ঘরে আমাকে আজকে মেরেও ফেলেন তবুও আমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসার মতো কেও নেই। তুর্যর চেচামেচি, বকাঝকা, মার সব আমি দেখেছি। কিন্তু উনার এই ধরনের নীরবতা এই প্রথম আমার চোখে পরলো। উনার এভাবে থাকা আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এইটা ঝরের পূর্বের নীরবতা। না জানি আমার সাথে কি হতে চলেছে।
মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, হঠাত্ করেই চারপাশ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হয়ে পরছে। আচ্ছা আমি কি জ্ঞান হারাচ্ছি!

.
ঘুমের ঘোরে কারো গরম নিশ্বাস আমার মুখের উপর আছড়ে পরছে। ঘুমের পাকড়াও এতোটাই জোরালো যে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চোখ খুলতে পারছি না। গরম নিশ্বাসের গতি ক্রমশ বেড়ে আমার ঠোঁট বরাবর এসে পরেছে। এখন আমার চোখ না খুললেই নয়। গালে আলতো কামড় পরতেই ঘুমের রেশ সম্পূর্ণ কেটে গেলো। চোখ খুলতেই তুর্যকে ঠিক আমার মুখের সামনে উপুর হয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। উনার শরীরের ভরও আমার উপরই দেওয়া। মানুষ কতোটা নিচ হলে একটা মেয়ের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে পারে। তুর্যর চোখ দুটো বন্ধ করা অবস্থায় তাই বুঝতে পারেন নি যে আমি সজাগ হয়েছি। তুর্যর প্রতিটি স্পর্শ আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে ঘৃণায়। আর সহ্য না করতে না পেরে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে উনাকে নিচে ফেলে দিলাম।
তুর্য হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন আকস্মিক আক্রমনের জন্য উনি প্রস্তুত ছিলেন না, তাই এভাবে দেখছেন। বিছানা থেকে নেমে উঠে দাড়াতেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলেই তুর্য আমার হাত ধরে টান দিয়ে তার বুকের সাথে চেপে ধরলেন। তার শরীরের সেই পরিচিত ঘ্রাণ আমার নাকে ভেসে আসছে। একটা সময় ছিল যখন এই ঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে দিতো। আর আজ সেই একই ঘ্রাণ আমাকে চরম অস্বস্তিতে ফেলছে। তুর্যর বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তুর্যকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম।

— আমাকে স্পর্শ করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না। বেরিয়ে যান আমার ঘর থেকে।

তুর্য এবার তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হীরের দুই বাহু চেপে ধরলো। হীরের বাহু ধরে স্বজোড়ে ঝাঁকিয়ে তুর্য বললো,
— কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো? কি অন্যায় করেছি আমি যার কারণে তুই এমন করছিস?

— হাত ছাড়ুন আমার।

— তোর চোখে আমার জন্য এতো ঘৃণা কেনো? তুই রাতে আমার ঘরে গিয়েছিলি তাই না? কেনো গিয়েছিলি? কেনো এতোটা বিরক্তিবোধ হচ্ছে তোর আমাকে দেখে?

— আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি বাধ্য নই। ছাড়ুন আমার হাত।

— না ছাড়বো না। ততোক্ষণ হাত ছাড়বো না যতোক্ষণ না আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি।

— কোনো উত্তরই আপনি পাবেন না। আপনার মতো একটা চরিত্রহীনের কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। চলে যান এখান থেকে নয়তো আমি চিত্কার করবো।

তুর্য হীর কে ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।
— তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? তোর এতো সাহস নেই যে তুই আমাকে হুমকি দিবি।

বাহু শক্ত করে ধরায় হীর ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো,
— ছাড়ুন। আমাকে কষ্ট দিয়ে, আঘাত দিয়ে কি অনেক আনন্দ পান আপনি? কি অপরাধ আমার যে সারাক্ষণ আমাকে কষ্ট দেওয়ার অজুহাত খুঁজেন।

— তোর এতো কথা আমি শুনতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই তুই কেনো আমার ঘরে গিয়েছিলি?

হীর ব্যথা পাওয়ার কথা বলার পরেও তুর্য গ্রাহ্য না করলে হীরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
— আপনার ঘর, আপনার জীবন, আপনার ভালোবাসা! আমি কোথাও নেই। আপনার জীবনের ত্রিসীমানাতেও আমি নেই। ভুল হয়ে গেছে আমার,, অনেক বড় অপরাধ হয়ে গেছে আপনাকে আপন ভেবে। আপনাকে মনের ঘরে রাজত্ব করতে দেওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আমার সর্বনাশের জন্য আমি নিজে দায়ী। আমি নিজেই নিজের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। আপনার কোনো দোষ নেই। আমার এই পতনের দায় আমি কাউকে দেবো না।

হীরের পাগলের মতো আওড়াতে থাকা কথার এক কোণাও হয়তো তুর্যর বোধগম্য হয় নি।

— কি বলছিস এসব?

— আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান। আমি আপনার পায়ে পরছি চলে যান এখান থেকে। আমি আর নিতে পারছি না। আমিও তো একটা মানুষ। একটু আমার দিকটা চিন্তা করেন। আমি কিভাবে এতো কষ্ট সহ্য করবো! চলে যান,, একা ছেড়ে দিন আমাকে।

হীর তুর্যকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘরের বাইরে বের করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিলো। তুর্য বন্ধ দরজার বাইরে মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে আর হীরের বলা কথাগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে। হীরের পাগলামী আর তার প্রতি রাগ দেখে এটা তুর্য ভালোই বুঝেছে যে হীর তাকে আর জেসিকা কে একসাথে দেখেছে। কিন্তু একসাথে দেখলেও হীরের এইভাবে রিয়েক্ট করার কারণ তুর্য কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। তবে কি হীরের মনেও তুর্যর জন্য অনুভূতি কাজ করে! সবকিছুই কেমন ঘোলাটে মনে হচ্ছে তুর্যর কাছে। হীরের অনুভূতিগুলো বোঝার সামর্থ্য তার নেই। হয়তো তার অপরাধবোধ তাকে এতোটাই শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে যে, সে বুঝতেই চায় না!

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে তুর্য। দুচোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে তার। নিজের একটি ভুলের জন্য আজ সে হীরের চোখে অপরাধী হয়ে গেছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও এই ভুলের মাশুল সে দিতে পারবে না। “হীর তাকে ঘৃণা করে” কথাটা ভাবতেই কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করে তুর্যর মধ্যে। বুকের বা পাশে তীব্র চিনচিনে ব্যথা করছে তার। এতোটা কষ্ট হচ্ছে যা হয়তো চিত্কার করে সবাইকে বলতে পারলে কমতো। কিন্তু ছেলেদের কষ্ট পাওয়া বারণ। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও মুখে হাসি ফুঁটিয়ে রাখতে হয়!

চোখের পানি দুহাতে মুছে, সিগারেটের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে ব্যলকোনিতে গিয়ে দাড়ালো তুর্য। সিগারেটের আগুন জ্বালিয়ে একের পর এক টান দিয়েই যাচ্ছে। ধোয়ার কুন্ডলী রাতের কালো আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বুকের ভিতরের কষ্টের আগ্নেয়গিরির তাপ কম করার বৃথা চেষ্টা করছে। অপরদিকে বিছানায় উপুর হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদে চলেছে হীর।

দুজনের মনেই আজ কষ্টের লাভা টগবগ করে ফুঁটছে। দুজনের কারণ এক না হলেও ব্যথা টা সমপরিমানের। ভালোবাসায় শিক্ত দুটি হৃদয় দুই দিকে একটি নির্ঘুম রাত পার করে দিলো।

চলবে..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here