সেই তুমি ৩ পর্ব ৫+৬

#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_০৫
#Tabassum_Kotha

রাতের অন্ধকার তার দায়িত্ব পালন করে বিদায় নিয়েছে বেশকিছুক্ষণ। চারিদিকে ভোরের আলোও ফুঁটে উঠেছে। জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের প্রথম কিরণ তির্যকভাবে প্রবেশ করে হীরের মুখের উপর পরছে। সারা রাত কান্না করে শেষ রাতের দিকে চোখ লেগেছিল হীরের।

ঘুম থেকে উঠে বসতেই মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হয়। চোখ-মুখও কেমন লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। কিছুক্ষণ সময় বিছানায় ঝিম মেরে বসে থেকে উঠে পরলাম। আজ তাফসির গায়ে হলুদ, অনেক কাজ করতে হবে।

.

সকাল সকাল চৌধুরী মেনশনে কাজের ধুম পরে গেছে। তাফসির হলুদের প্রোগ্রাম করা হবে আজ সন্ধ্যায় আর কাল বিয়ে। বিয়ের জন্য হল বুক করা হয়েছে কিন্তু তুর্যর বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী হলুদের প্রোগ্রাম বাড়িতে করা হবে। তমা বেগম এমনিতে বাড়ির কাজের ধারে কাছে না গেলেও আজ সে ভীষণ ব্যস্ত। মেয়ের বিয়ে বলে কথা! কাপড়, গয়না, বাকি সব কিছু নিজের হাতে সামাল দিচ্ছেন। কাল রাতে দীর্ঘ সময় শাওয়ারের পানিতে ভেজার ফলে হীরের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তবুও নিজের শরীরকে উপেক্ষা করে দিব্যি সারা বাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে নানা কাজে। তাফসির হলুদের জন্য তুর্যর ফুপি আম্মু হাফসা বেগম আর তার মেয়ে এসেছে। হাফসা বেগম চৌধুরী মেনশনে বেশি আসা-যাওয়া করেন না। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা অনুষ্ঠান না হলে তাকে দেখা যায় না। হাফসা বেগম আর তমা বেগমের মধ্যে কোন একটা ঝামেলা আছে তা দুজন সামনাসামনি হলে স্পষ্ট বোঝা যায়। তারা দুজন নিজেদের মধ্যে সব ঠিক আছে এমন টা দেখানোর অনেক চেষ্টা করলেও তাদের মধ্যে একটা তিক্ত ভাব সর্বদাই পরিলক্ষিত হয়।

হাফসা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। হীর কিচেন থেকে ড্রয়িংরুমে বার বার আসা-যাওয়া করছে নানা কাজে। হাফসা বেগম একদৃষ্টিতে হীরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলতে চায় সে হীরকে কিন্তু বলার সাহস করতে পারছেন না বা সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেকটা সময় ইতঃস্তত করার পর সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে হাফসা বেগম হীরকে ডাক দিলেন।

— হীর!

— জ্বি ফুপি আম্মু?

— কেমন আছিস মা?

— জ্বি আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?

হাফসা বেগম হীরের মাথায় হাত রাখতেই চমকে উঠলেন। জ্বরে হীরের গা পুড়ে যাচ্ছে। হাফসা বেগম আতঙ্কিত হয়ে হীরকে বললেন,
— তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এতো জর এসেছে! তুমি ডাক্তার দেখাও নি?

— এতোটুকু জ্বরে আমাকে কাবু করা সম্ভব নয় ফুপি আম্মু। আমি ঠিক আছি আপনি চিন্তা করবেন না। ঐতো কালকে একটু ভিজে ছিলাম তাই শরীর টা একটু গরম হয়ে উঠেছে। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।

হাফসা বেগম পুনরায় কিছু বলার আগেই তমা বেগম সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তমা বেগমকে দেখে হাফসা বেগম হঠাতই চুপ হয়ে গেলেন। কিছুটা কাচুমাচু করতে করতে হাফসা বেগম সেখান থেকে ওপরের ঘরে চলে গেলেন।

তমা বেগম হীর কে কর্কশ কন্ঠে বললেন,
— এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার কি দরকার? যা অনেক কাজ পড়ে আছে। একটু পরেই মেহমান আসা শুরু হয়ে যাবে। তাফসীকেও তৈরি করতে হবে। তাড়াতাড়ি কর।

— জি বড় আম্মু আমি যাচ্ছি। আপনি চিন্তা করবেন না সব হয়ে যাবে।

.
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য। কাল রাতে স্মোক করতে করতে ব্যালকনিতে রাখা কাউচে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে টেরও পায় নি। একটু আগেই হট্টগোলের শব্দে ঘুম ভেঙেছে। আচমকা পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলে খানিকটা চমকে উঠে তুর্য। এতোটা ভালোবেসে তাকে জড়িয়ে ধরার মতো এ বাড়িতে একমাত্র হীর ই আছে। কিন্তু স্পর্শটা অনেক অপরিচিত মনে হচ্ছে তুর্যর কাছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে স্পর্শটা হীরের নয়। পিছনে কে আছে জানার জন্য হাত দুটো ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো তুর্য।

“সারপ্রাইজ!”
বলে চেচিয়ে উঠলো তুর্যর সামনে থাকা মেয়েটি।

তুর্য এক মুহূর্ত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তুর্য সেখান থেকে সরে এলে মেয়েটি তুর্যর হাত টেনে ধরে। এতে তুর্য বেশ বিরক্ত হয়ে মেয়েটার হাত থেকে নিজের হাত জোরে টান দেয়।

“তুর্য তুমি আমার সাথে এমন করছো কেনো?” – মেয়েটা অনেকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে তুর্যকে জিজ্ঞেস করলো।

তুর্য রাগে ফুসফুস করতে করতে মেয়েটিকে বললো,
— হু দ্য হেল আর ইউ? আর তোমার সাহস কি করে হলো আমার হাত ধরার? কে তুমি?

— তুর্য! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না! আমি কিয়ারা। অবশ্য চেনার কথাও না। অনেক বছর হয় তোমার আর আমার দেখা হয়নি। তুমি যখন লন্ডন চলে গেলে তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম।

কিয়ারা হাফসা বেগমের একমাত্র মেয়ে। কিয়ারা হীরের এক-দেড় বছরের ছোট বয়সে। কিন্তু হীরের থেকে কয়েকশগুণ বেশি আধুনিক। আধুনিকতার সাথে সাথে সৌন্দর্যেও হীরের থেকে কোন অংশে কম নয় কিয়ারা।

এতক্ষণে তুর্য কিয়ারা কে চিনতে পারলো।
— আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। আই এম সরি এমন ব্যবহারের জন্য। কিন্তু নেক্সট টাইম থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরা বা আমার পারমিশন ছাড়া টাচ করবে না। আমার এসব পছন্দ নয়।

— ওকে সরি। আসলে এতো বছর পর তোমাকে দেখে এক্সাইটমেন্ট ধরে রাখতে পারি নি।

— ইটস ওকে। এখন তুমি বাইরে যেতে পারো আমি ফ্রেশ হবো।

তুর্য কিয়ারাকে বাইরে যেতে বলে ওয়াশ রুমে চলে গেল। কিয়ারা কিছুক্ষন তুর্যর যাওয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তুর্যর তরফ থেকে এতটা রুডনেস সে আশা করেনি তাই অনেকটা ব্যথিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল। সারাদিনের কাজের চাপে তুর্য আর হীরের একবারও দেখা হয়নি। বিকেলের দিকে হীর নিজে হাতে তাফসিকে হলুদের জন্য তৈরি করে দিল। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ী আর কাঁচা ফুলের গহনায় তাফসীকে ভীষণ সুন্দর লাগছে যেমনটা নতুন বউকে লাগে। তাফসির সাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে তাফসী হীরকেও তৈরি হয়ে নিতে বলল। তাফসি হীরের জন্যও শপিং করেছে।
হীর নিজের ঘরে এসে গোসল করে নিল। তারপর তাফসির কিনে আনা শাড়ীটা কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে হালকা মেকআপ করে নিলো। সেই সাথে দু চোখ ভর্তি কাজল আর কিছু ফুলের গয়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। হীর সাধারণত চুল খোলা রাখে না। কিন্তু আজকে গয়নার সাথে বাঁধা চুল কেমন যেনো বেমানান লাগছিল তাই খোপার চুল খুলে পিঠে এলিয়ে দিল। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিয়ে তৈরি হীর। একবার নিজেকে আয়নায় ভালোমতো দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হীর। ঠিকঠাকই লাগছে তাকে। এখন কেউ তো আর তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে না, তাই ওমন আহামরি সুন্দরী দেখার কি দরকার?

.
সন্ধ্যা শুরু হতেই হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। তুর্য একটা সাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা পড়ে আছে। ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে তুর্যকে। এমনিতেই সে দেখতে মাত্রাতিরিক্ত হ্যান্ডসাম তার উপর সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে আরো বেশি সুদর্শন লাগছে। আজ যে কোন মেয়ে তুর্যকে দেখে তার প্রেমে পাগল হয়ে যাবে নিশ্চিত। তাফসীর বান্ধবীরা, কিয়ারা এবং অন্যান্য মেয়েরা আড়চোখে বারবার তুর্যর দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তুর্যর সেদিকে কোন হুশ নেই। তার অস্থির দুটি চোখ কিছু খুঁজছে। পুরো ট্যারেসজুরে তুর্যর চোখ বিচরণ করছে তার প্রেয়সীর খুঁজে। তার প্রিয়তমা আসলে কে সেটা নিয়ে সে নিজেই দ্বীধায় ভুগছে। তবুও এই মুহূর্তের জন্য সে তার সব দ্বীধা, সব অনুতাপ ভুলে যেতে চায়। শুধু মনে রাখতে চায় যে, তার চোখ এই ক্ষণে হীর কে সামনে চায়।

তুর্যর দীর্ঘক্ষণের প্রতিক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে হলুদ শাড়িটা কিছুটা টেনে ট্যারেসের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো হীর। শাড়ি পরে তার অবস্থা নাজেহাল। কুচি অনেকটা নিচে নেমে গেছে, যার ফলে হাতে ধরে ধরে হাটতে হচ্ছে তাকে। চুলগুলো খুলে দেওয়াতে সেগুলো চোখ-মুখের উপর আসছে বারবার। একহাতে শাড়ির কুচি, অন্যহাতে ফুলের ডালা, আবার মুখের উপর চুল সব মিলিয়ে ভীষণ অগোছালো লাগছে হীরকে। তবুও তুর্যর কাছে তাকে কোনো হূর এর থেকে কম লাগছে না। অগোছালো শাড়ি আর এলোমেলো চুলে যেনো হীরের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তুর্য বাড়ি ফেরার পর এই প্রথম হীরের খোলা চুল দেখতে পেলো। কোমড়ের নিচ পর্যন্ত হালকা ঢেউ খেলেনো কালো চুলগুলো যে কারো মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

হীরের সৌন্দর্য বিলাসে মত্ত ছিল তুর্য। হঠাত্ কিয়ারা এসে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। সবার দৃষ্টির আড়ালে হীর তুর্যকেই দেখছিল। এক মুহূর্তের জন্য কাল রাতে ঘটে যাওয়া সবকিছুই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু কিয়ারার এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া দেখে আবারও হীর বুঝে গেলো যে তুর্যর উপর তার কোনো অধিকার নেই। বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানিটুকু মুছে নিলো হীর।

.
ছেলের বাড়ির মেহমান এসে তাফসিকে হলুদ দিয়ে চলে গেছে। এই সারা সময় তুর্য আর হীর দুজনেই খুব ব্যস্ত ছিল। বাকি যেটুকু সময় ছিল তাতে কিয়ারা তুর্যকে এক মুহূর্তের জন্যও একা ছাড়ে নি। খুব ভালো ভাবেই হলুদের প্রোগ্রাম শেষ করে সবাই নিচে চলে আসে। একমাত্র হীর আর তুর্যই সবকিছু গুছানোর জন্য ছাদে থেকে যায়। তুর্য সকাল থেকেই সুযোগ খুঁজছিল হীরের সাথে কথা বলার,, হীরকে বোঝানোর যে সে যেটা দেখেছে সেটা আদৌ সত্যি নয়। তুর্য সুযোগ বুঝে হীরের সামনে গিয়ে দাড়ায়।

আচমকা তুর্য আমার সামনে এসে দাড়ালে ভয় পেয়ে গেলাম। উনাকে এড়িয়ে অন্যদিকে যেতে নিলে উনি আবারও আমার সামনে এসে দাড়ালেন। উনার মুখের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।

— হীর আমার কথা শোন। তোর সাথে অনেক জরুরী কথা আছে আমার। কাল রাতে যা হয়েছে সবটাই একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল।

উনার কথার পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে এবার উনি আমার হাত চেপে ধরলেন। তুর্যর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন।

— তোর সাহস কি করে হয় আমাকে ইগনোর করার? যেখানে আমি যেচে তোর সাথে কথা বলতে এসেছি সেখানে তুই আমাকে অ্যাটিটিউড দেখাচ্ছিস! তোর আমাকে অ্যাটিটিউড দেখানোর সামর্থ্য নেই। তুর্য আহমেদ চৌধুরী তোর মতো একটা মেয়ের কাছে নিজের সাফাই গাইতে এসেছে এটাই তোর সাত পুরুষের ভাগ্য।

— ছাড়ুন। আপনি আমাকে ব্যথা দিচ্ছেন। অবশ্য এতে নতুন কিছুই নেই। যেই কাজ টা আপনি সবসময় করেন আজও সেটাই করেছেন।

এতোক্ষণে তুর্যর হুশ হলো যে রাগের মাথায় সে যেটা করেছে সেটা অন্যায়। সে তো হীরকে বোঝাতে এসেছিল। কিন্তু হীরকে আরো বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো।

হীর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললো,
— সত্যি বলেছেন আপনি। আমার মতো মেয়ের সামর্থ্য নেই যে আপনাকে অ্যাটিটিউড দেখাই। আপনাকে ইগনোর করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আফসোস আপনি রাগ আর অভিমানের ভাষা টা বুঝতে অক্ষম। আপনার আমার কাছে সাফাই গাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে ক্ষমা করবেন আমি আপনাকে ভালোবাসার দুঃসাহস করেছি। ভুলটা আমারই। ঐযে বলে না,, বামুন হয়ে চাঁদ ধরতে চাওয়া অপরাধ। একদম ঠিক। আমিই অপরাধী যে আপনাকে ভালোবেসে কাছে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।

তুর্য মূর্তির মতো দাড়িয়ে হীরের বলা কথাগুলো শুনছে। সত্যি হীর তাকে ভালোবাসে। কিন্তু রাগের মাথায় সে হীরকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। ক্রমশ তুর্যর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেলে হীর কাঁদতে কাঁদতে নিচে চলে যায়। তুর্য হীরকে আটকানোর চেষ্টা করলেও হীর আর থামে না। ড্রয়িং রুম পাড় হয়ে হীরের ঘরে যেতে হয়। আর ড্রয়িং রুমে সবাই বসে থাকায় তুর্য হীরের ঘরে যেতে পারে নি।
#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_০৬
#Tabassum_Kotha

এলোমেলোভাবে রায়ানের সাথে একই বিছানায় শুয়ে আছে হীর। গ্রে কালারের স্টোনের শাড়ি টা তুর্য নিজে হীরের জন্য কিনে এনেছিল। সেই শাড়িটার অর্ধেক আঁচল মেঝেতে পড়ে আছে। এতোসব দৃশ্য মেনে নিলেও রায়হানের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা হীরকে কোনো মতেই মেনে নিতে পারছে না তুর্য আর বাকি সবাই। কিছুক্ষণ বাদেই রায়ান আর তাফসির বিয়ে। এমন একটা সময়ে এই পরিস্থিতি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হীরকে রায়ানের সাথে এই অবস্থায় দেখে ধীরে ধীরে তুর্যর পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। নিজের চোখের সামনে যা দেখতে পাচ্ছে আদৌ কি সেটা সত্যি? সত্যি কি রায়ান আর হীর একসাথে!

কিছুক্ষণ আগে,,

.

বিয়ের দিন সকাল সকাল আফজাল সাহেবের পুরো পরিবার বিয়ের হলে এসে উপস্থিত হয়। গতকাল রাতে তুর্য অনেক চেষ্টা করেও হীরের সাথে কথা বলতে পারেনি। তবে সে ঠিক করেছে যে তাফসির বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে হীরকে সবকিছু খুলে বলে দেবে। তার মনের সব কথা, হীরের প্রতি তার সব অনুভূতি,, ভালোবাসা এবং তার করা একটি ভুলের কথাও সে হীরকে জানিয়ে দেবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি আর না। এবার সময় এসেছে তুর্য আর হীরের এক হয়ে যাবার। অনেকটা সাহস আর এক সমুদ্র ভালোবাসা বুকে নিয়ে তুর্য হীরের সামনে নিজের ভালোবাসা নিবেদনের জন্য প্রস্তুত।

.
.
যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাফসি আর রায়হানের বিয়ের সময় ততই এগিয়ে আসছে। তাফসি কে সাজানোর জন্য বিউটিশিয়ানরা এসে পড়েছে। রায়ান আর তার পুরো পরিবারও আগেই হলে এসে পড়েছে। কয়েকঘন্টা পরেই এই হলে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।

চোখে হাজারো নতুন জীবনের স্বপ্ন সাজিয়ে বধু সাজছে তাফসি। ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে জমিয়ে এক সমুদ্র ভালোবেসে এসেছে সে রায়ানকে। আজ তার ভালোবাসা বৈধভাবে পূর্ণতা পেতে চলেছে। ভাবতেই কেমন সুরসুরি লাগছে তাফসির। তাফসির সাজ প্রায় শেষের দিকে এখন শুধু চুলে খোপা করে বিয়ের লেহেঙ্গাটা পড়া বাকি।
বেশ অনেকক্ষণ যাবত হীরকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তুর্য নিজে পছন্দ করে হীরের জন্য একটা গ্রে কালারের শাড়ি এনেছে। হীরের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করেই তার নিজের জন্য গ্রে কালারের পাঞ্জাবী। তুর্য নিজে শাড়ি টা হীরকে দিলে যদি হীর না নেয়, সেই ভয়ে তাফসিকে দিতে বলেছিল। তাফসির কোনো কথা হীর ফেলতে পারবে না এটা তুর্য খুব ভালো করেই জানে। তাই তো সেই শাড়িটা গায়ে জরিয়ে আছে হীর।

তুর্য হীরকে এদিক ওদিক কিছুক্ষণ খুঁজে কিন্তু পায় না। পরে সে নিজেই নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে রায়ান যেই রুমে ছিল সেই রুমের দরজা খুলছে না অনেকক্ষণ। রায়হানের ছোট বোন রিয়া অনেক বার দরজা ধাক্কায়। ভিতর থেকে রায়ানের কোনো সারা না পেয়ে সে তার মা-বাবাকে ডাকার জন্য সেখান থেকে চলে যায়। রায়ানের বাবা-মা আর তুর্য একসাথে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছিলেন। সেখানে গিয়ে রিয়া রায়ানের দরজা না খোলার কথা বললে তুর্যও অনেকটা ঘাবড়ে যায়। তুর্য আর রায়ানের বাবা-মার পিছন পিছন তাফসীর বাবা-মা ও সেখানে উপস্থিত হয়। কয়েকবার রায়ানের নাম ধরে ডাকার পরও কোন সাড়া না পেলে দরজা ভাঙতে বাধ্য হয়। হট্টগোলের শব্দে তাফসিও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। দরজা খুলতেই হীর আর রায়ান কে সবাই একই বিছানায় একে অপরের সাথে লেপ্টে থাকা অবস্থায় পায়।

.

আফজাল সাহেব, তমা বেগম, হাফসা বেগম, তুর্য আর রায়ানের বাবা-মা মূর্তির মত ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝতে পেরে রিয়া দৌড়ে গিয়ে রায়ান ক জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। তমা বেগম তার মেয়ের জামাইকে হীরের সাথে দেখে রাগে বিস্ফোরিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে হীরের মুখে ছুড়ে মারলো। আচমকা শরীরে পানি পড়ায় হীর আর রায়ান দুজনেই চমকে উঠে বসলো। চোখ মুখ হাত দিয়ে মুছে সামনে তাকাতেই বাড়ির সবাইকে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুক কেঁপে উঠল হীরের। কি এমন অন্যায় করেছে সে,, যার জন্য সবাই তার উপর এতটা রেগে আছে! পাশ ফিরে তাকাতেই আরেকটা ঝটকা লাগল হীরের। তার পাশে রায়ান কেনো বসে আছে? চোখ ফিরিয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকাতেই যেনো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তার। শাড়ির আঁচল টেনে নিজের শরীরকে ঢেকে নিলো হীর। হীরের মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কাল সকাল থেকে জ্বর তারওপর কাল রাত থেকে না খাওয়া এর কারণেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সে যে মাথা ঘুরে ঘুরে এই রুমে পড়ে ছিল সেটা সে নিজেও জানে না। আর রায়ান তার সাথে কিভাবে এলো এই ব্যাপারে তারও কোন হদিস নেই।

পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হীল আর রায়ান দুজনেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান কিছু বলছে না আর হীরের বলার মত কিছুই নেই। কারন সে কিছুই জানে না কি হয়েছিল আর কি হচ্ছে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে তার দ্বারা অনেক বড় কোনো অন্যায় হয়েছে।

নিরবতা ভেঙ্গে তমা বেগম বাজখাই কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— এই দিন দেখার জন্যই তোকে এত আদর যত্ন করে বড় করেছিলাম তাই না রে হীর? কি না করেছি তোর জন্য আমরা আর তুই কিনা আমার মেয়ের সংসারে আগুন লাগিয়ে দিলি!

আফজাল সাহেব তমা বেগমকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করছেন।
— আহা তমা! থামো। এসব কি বলছো তুমি?

তমা বেগম আফজাল সাহেব কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবার বলতে শুরু করলেন।
— এই প্রতিদান দিলি তুই আমাদের আদর-যত্নের। আমরা তোকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলাম আর সেই তুই কিনা আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলি। আমার মেয়ের হবু স্বামীর সাথে ছিঃ! এসব করার আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে পারলি না তুই।

— বড় মা বিশ্বাস করো আমি কিছুই করি নি। এখানে কি হয়েছে আমি কিছুই জানি না।

— বিশ্বাস আর তোকে? তুই যা করেছিস তারপর তোকে আর বিশ্বাস করা সম্ভব না।

হীর কাঁদতে কাঁদতে আফজাল সাহেবের কাছে গেলো।
— বড় বাবা তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো তাই না। তুমি তো জানো আমি এমন কিছুই করতে পারি না।

আফজাল সাহেব কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন হয়তো সে বিশ্বাসের চেয়ে চোখের দেখা কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। হীর কিছুক্ষণ আকুল দৃষ্টিতে তার বড় বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। হীরের কান্নাভেজা অস্থির দৃষ্টি বাড়ির সবার দিকে আটকে যাচ্ছে বারবার। সবার চোখে তার জন্য একফোঁটা বিশ্বাস খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কারো চোখে আজ হীরের প্রতি কোন বিশ্বাস দেখা যাচ্ছে না।
তাফসি মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। তার সামনে তার ছোটবেলার ভালোবাসা, তার হবু স্বামী অন্য একটা মেয়ের সাথে এই অবস্থায়! সেই মেয়েটাও তার নিজের ছোট বোনের মতো। এই মুহূর্তে তার প্রচুর আর্তনাদ করা উচিত। তার কান্না করা উচিত, হীর আর রায়ানকে দোষারোপ করা উচিত। কিন্তু সে এতোটা নীরব কেনো? কেনো সে কিছুই বলছে না। তাফসির এই নীরবতাকে হীর ভীষণ ভয় পাচ্ছে। সে সাহস পাচ্ছে না তাফসির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর।

সবাই হীরকে অবিশ্বাস করলেও তুর্য কিছুতেই চোখের দেখাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার হীর কিছুতেই এমন করতে পারেনা। হীরের চরিত্রে দোষ… না, না এটা সম্ভব নয়। হীর কখনই এটা করতে পারে না। এমনিতেও সে হীরকে ভুল বুঝে অনেক কষ্ট দিয়েছে।

চলবে..
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here