সেই তুমি ৩ পর্ব ৭+৮

#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_০৭
#Tabassum_Kotha

“আমি আর হীর একে অপরকে ভালোবাসি।”- নীরবতা ভেঙে রায়ান কথাটা বলতেই উপস্থিত সবাই অবাক এর শেষ সীমায় পৌঁছে গেলো। সবার থেকে বেশি অবাক হীরকে লাগছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।
রায়ান দুই ক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করলো, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি বলেই একসাথে ছিলাম। এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে!

রায়ানেরর কথা শুনে সবাই মাথায় বজ্রপাত হওয়া মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। রায়ানের বাবা তার ছেলের ভুলভাল কথা আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,
— তুই কি পাগল হয়েছিস রায়ান? এসব কি বলছিস একটু পরেই তোর আর তাফসির বিয়ে। আর এখন তুই এসব কথা বলছিস?

— বাবা রিল্যাক্স আমি বুঝিয়ে বলছি। আমি বুঝতে পারছি তোমরা সবাই এসব দেখে অনেকটা অবাক হয়েছো। ইনফ্যাক্ট অনেকটা শকড্ হয়েছো। কিন্তু এটা খুবই নর্মাল বাবা।

তমা বেগম বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
— তোমার কাছে কি এসব ছেলে খেলা মনে হচ্ছে রায়ান? একটু পরে আমার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে আর এখন তুমি অন্য একটা মেয়ের সাথে বিছানায়! আমার তো বলতেও লজ্জা করছে ছিঃ!

— আন্টি এবার আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। ভুলে যাবেন না আমি আর হীর একে অপরকে ভালোবাসি। আজ আমার বিয়ে হয়ে যাবে বলেই আমরা একসাথে ছিলাম। এরপরে আর সময় পাবো কি পাবো না তাই আর কি…

রায়ানের আর কিছু বলার আগেই হীর ঠাস্ করে একটা চড় বসিয়ে দিলো রায়ানের গালে।
— লজ্জা করছে না আপনার এতো মিথ্যা কথা বলতে? এটা আমিও জানি আর আপনিও খুব ভালো করেই জানেন যে এখন আপনি যা যা বলছেন তার প্রতিটা শব্দ মিথ্যে।

— দেখো হীর এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই। সবাই সব জেনে গেছে। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এমনিতেও আমরা আর কতোদিন লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতাম। একদিন না একদিন ধরা পরতেই হতো।

— চুপ করুন আপনি। কেনো করছেন আপনি এসব? আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনার আর তাফসির বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। সবাইকে সত্যিটা বলুন প্লিজ।

— ঠিক আছে। বাবা! মা! সত্যিটা হলো আমি আর হীর অনেক আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্কে আছি। এর আগে আমরা সবার দৃষ্টির অগোচরে দেখা করতাম। আর আজ শেষ বারের মতো আমরা একসাথে থাকার প্ল্যান করেছিলাম। কারণ এর পর আর সুযোগ হতো না।

— আপনি আবারও মিথ্যে বলছেন। প্লিজ সবাইকে সত্যি টা বলে দিন। আপনার আর আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই সবাইকে বলুন প্লিজ।

রায়ান আর হীরের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাফসি মাথা ঘুরে মেঝেতে পরে যায়। যেখানে কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত বিয়ের আমেজ ছিল সেখানে এখন এক প্রকার কান্নার রোল পরে গেছে। তুর্য তাফসিকে কোলে তুলে হল থেকে বেরিয়ে আসে। তমা বেগম আর আফজাল সাহেব তুর্যর সাথে চৌধুরী মেনশনে চলে যায়। রায়ানের বাবা-মা তাদের পিছনে চৌধুরী মেনশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তাফসির এই অবস্থার জন্য রায়ান দায়ী হলেও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে না। খুবই ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি নিয়ে সে হল থেকে বেরিয়ে পরলো।
হীর একা সেই হলের মেঝেতে বসে কান্না করছে। আজ কেউ নেই তার পাশে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। পৃথিবীতে মা বাবা থাকা যে কতোটা জরুরি সেটা আজ হীর খুব ভালোই বুঝতে পারছে। যাদের সে আপন মনে করে এসেছে এতোগুলো বছর তারাই আজ তাকে একা ফেলে চলে গেলো। হাজারো আকুতি মিনতি করেও তাদের বিশ্বাস জোগাড় করতে পারলো না।

.

কোলাহলে পূর্ণ এই শহর আজকে জনমানবশূন্য। নিস্তব্ধ রাস্তার মাঝ বরাবর হেঁটে চলেছি। গন্তব্য জানা নেই। চিরচেনা সেই বাড়ি যেখানে আমার আপনজনদের বসবাস সেখানে হয়তো আজ আমার জায়গা হবে না। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। বারবার মনে হচ্ছে এখনই একটা বড় গাড়ি আসবে আর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে যাবে। কিন্তু আমার এই ইচ্ছাটাও অপূর্ণই রয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই।
কি এমন অপরাধ আমি করেছি যার শাস্তি আমাকে পেতে হচ্ছে? রায়ানের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই তবুও তিনি সবাইকে মিথ্যে বললেন। আর সবাই সেই কথাগুলো বিশ্বাসও করে নিলো। আচ্ছা চোখের দেখাও তো ভুল হতে পারে তাই না! এতোগুলো বছর ধরে তারা আমাকে চেনে জানে। তাদের সামনেই বড় হয়েছি আমি। তারপরেও আমি কেমন সেটা তারা বুঝলো না! বাকি সবার কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু তুর্য! তুর্যকে তো আমি ভালোবাসি সেও কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারলো না!
ধুর! আমিও না!!! কতো কি ভেবে ফেলি। তুর্য তো আমাকে ভালোবাসেই না,, সে তো ঐ মেয়েটাকে ভালোবাসে। বামুন হয়ে চাঁদ ধরতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করাটাও অপরাধ। তাই এবারও দোষ আমার। রায়ানের মিথ্যে বলার পিছনেও আমারই দোষ। আমার দোষ ছিল বলেই মা বাবা আমাকে ফেলে দিয়েছিল ছোটবেলায়। আমার দোষ আছে বলেই তাফসির বিয়ের আগ মুহূর্তে আমাকে আর রায়ানকে এক ঘরে পেয়েছে সবাই!! বড় আম্মু একদম ঠিক বলেন, “আমি সত্যিই অপয়া।”

.
দুঃখবিলাস করতে করতে হীর চৌধুরী মেনশনের বাইরে এসে পরে। এই প্রথম এতোটা পথ সে একা এসেছে। আজ তার কষ্টের সামনে রাস্তায় একা চলার ভয়টা নিতান্তই তুচ্ছ ছিল।
চৌধুরী মেনশনের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে হীর। সংকোচ বোধ হচ্ছে ভীষণ। কোন মুখে বাড়ির সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে? আজ তার জন্য তাফসির বিয়ে ভেঙে গেলো! যদিও সে ইচ্ছে করে কিছুই করে নি। সবটাই ষড়যন্ত্র কিন্তু এটা সে প্রমাণ করতে অক্ষম।

.
সন্ধ্যা নেমেছে। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। সেই সাথে অন্ধকার নেমে এসেছে তাফসির জীবনে। আর কিছুক্ষণ পর তার আর রায়ানের বাসর হওয়ার কথা ছিল। দুপুরের সময়টাতেও তার দুচোখ ভর্তি নতুন জীবনের স্বপ্ন ছিল। আর এখন! সেই স্বপ্নগুলোই কাঁচ ভাঙার মতো টুকরো টুকরো হয়ে চোখে বিঁধছে। ভীষণ ব্যথা হচ্ছে তার। তবে সেই ব্যথা টা হচ্ছে বুকের বা পাশে। এই জায়গাটাতেই রায়ানকে রেখেছিল সে পরম যত্নে। আজ সেই রায়ানই তার বুকে ধাঁরালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে তিল পরিমাণ দ্বিধা বোধ করলো না। বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বসে থাকা অবস্থায় দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো তাফসির চোখ দিয়ে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। একটু শান্তির লোভে দুচোখের পাতা এক করে নিলো সে। ঘুমাতে পারলে হয়তো কষ্টটা কিছুক্ষণ ভুলে থাকা যাবে। কিন্তু চাইলেই কি পারা যায়! নিচ থেকে অনেক চেঁচামেচির শব্দ আসছে।
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাফসি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

.
“তোর সাহস তো কম নয়, তুই আবার এই বাড়ির দরজায় পা রেখেছিস!”
– হীরকে চৌধুরী মেনশনের সদর দরজায় দেখেই ভরকে উঠলেন তমা বেগম।

হীর মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

— তোর সাহস দেখে আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি হীর। তুই আবার চৌধুরী মেনশনে আসার দুঃসাহস দেখালি!

হীর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ঘনঘন নাক টানছে। তমা বেগমের প্রশ্নের কোনো উত্তর তার কাছে নেই।

— চুপ করে আছিস কেনো? উত্তর দে! আর উত্তর না দিতে পারলে বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। আর কখনও যেনো তোকে আমাদের বাড়ির আশে পাশে না দেখি। আমার মেয়ের জীবনে আগুন লাগিয়ে এখন এসেছিস তামাশা দেখতে তাই তো!

— বিশ্বাস করো বড় আম্মু আমি কিছু করি নি। রায়ান এর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। না আগে কখনও ছিলো। তার প্রতিটা কথা মিথ্যা।

— ঠিক আছে মানছি রায়ান মিথ্যে বলেছে। তোর আর রায়ানের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমরা যেটা স্বচক্ষে দেখেছি সেটা? সেটাকে কিভাবে উল্টে ফেলবো বলতো!

তমা বেগমের এই কথার পৃষ্ঠে আর কোনো কথা নেই হীরের মুখে।

তমা বেগমের চেঁচামেচিতে তুর্য ছাঁদ থেকে নিচে নেমে আসে। ড্রয়িং রুমে হীরকে দেখে তুর্যর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। দীর্ঘ সময় কান্না করার ফলে হীরের ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ দুটোও ফুলে আছে। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে হীরকে বিশ্বাস করতে, সবার সামনে গিয়ে হীরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে জোর গলায় বলতে যে তার হীর নির্দোষ, কোনো দোষ নেই তার হীরের। হীর ঠিক হীরার মতোই খাঁটি। কিন্তু কেনো যেনো আজ তুর্যর মধ্যকার ভাই সত্তা তাকে বারবার আটকে দিচ্ছে।
হীর অসহায় দৃষ্টিতে বারংবার তুর্যর দিকে তাকাচ্ছে। যেই মানুষটাকে মনে প্রাণে ভালোবাসা যায় তার দৃষ্টির মানেও হয়তো বোঝা অনেক সহজ। তাই তো তুর্য ঠিক বুঝতে পারছে যে তার হীরের এখন তাকে খুব করে দরকার। হীরের দিকে এক পা বাড়াতেই তুর্য তার পাশে তাফসিকে দাঁড়ানো দেখে তার কদম পিছিয়ে নেয়। ভালোবাসা কেনো যে এতোটা অসহায় হয়। তুর্য জানে হীরের তাকে প্রয়োজন কিন্তু সে আজ অপরাগ। তাফসি উপর থেকে হীরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তাফসির দৃষ্টিতে না আছে অভিমান না আছে রাগ। তমা বেগম হীরের হাত ধরে চৌধুরী মেনশন থেকে বের করে দিতে গেলে তাফসি তার মা কে বাঁধা দেয়। তাফসির বাঁধা দেওয়ায় তমা বেগম বেশ অবাক হন। কিন্তু তাফসি চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলে তমা বেগম হীরের হাতের মুঠো ছেড়ে দেন।

তাফসি ধীর পায়ে হীরের দিকে এগিয়ে যায়। হীর ভেবেছিল হয়তো তাফসি হীরকে বিশ্বাস করেছে। এই কথা ভেবে হীরের দুই ঠোঁট হালকা একটু প্রসারিত হতেই তাফসি বলে উঠে,
— তোর আর রায়ানের সম্পর্কের শেষ পরিণতি কি হয় অন্তত সেটা দেখার জন্য হলেও আমি তোকে এই বাড়িতে রাখবো।

— আপু তুই আমাকে ভুল..

— প্লিজ এবার অন্তত এটা বলিস না যে ভুল বুঝছি। যা বোঝার, যা দেখার, যা শোনার সব শেষ। তুই একদম চিন্তা করিস না। এই বাড়ি থেকে তোকে কেউ বের করবে না। তুই যেই খেলা শুরু করেছিস তার শেষ আমিও দেখতে চাই।

হীর কিছু বলার আগেই তাফসি আর তমা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন। হীর মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো তার ঘরে চলে গেলো। তুর্য হীরের ঘরের দরজার সামনে গিয়েও ফিরে এলো। হাজার ইচ্ছা থাকলেও সে আজ অপরাগ। হীর কে সান্ত্বনা দেওয়া, তার এই অসময়ে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত তুর্যর। কিন্তু সে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলো তুর্য।

.

কষ্টের কালো রঙে মিশ্রিত রাতের প্রহর যেনো শেষ হয়েও হয় না। কয়েক ঘন্টা ধরে মেঝেতে হাঁটু ভেঙে, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে হীর। দুই গালে পানির সাদা সাদা দাগ লেগে আছে। হয়তো দীর্ঘক্ষণ চোখ দিয়ে পানি পরার কারণে এমন হয়েছে। মাথাটা সোজা করে জানালার বাইরে তাকালো হীর, নতুন এক ভোরের আশায়। বাইরে এখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনেকটা অবাক হলো হীর। মাত্র রাত ৩.৩৪ মিনিট। অথচ তার মনে হয়েছিল কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। দুচোখ ভেঙে ঘুম আসছে তার। শরীরও অসম্ভব রকম ক্লান্ত। মেঝেতে থেকে আস্তে আস্তে উঠে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো হীর।

ঘুমটা খুব ভালো মতোই আঁকড়ে ধরেছে হীরকে। ঘুমের ঘোরে একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে সে। আর এই দৃশ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তুর্য। হীর সজাগ থাকাকালীন তার সাহস হয় নি হীরের সামনে এসে তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার। কিন্তু সাহস না থাকলেও ভালোবাসা তো অফুরন্ত! সেই ভালোবাসার তাড়নাই তো তাকে ঘুমন্ত হীরের কাছে টেনে এনেছে। হীরের চোখের উপর আসা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো তুর্য। কপালে এক বিন্দু রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে হীরের। হয়তো তমা বেগম ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়ার পরেই মাথায় আঘাত লেগেছিল। তুর্য জমাট বাঁধা রক্তে আঙুল স্পর্শ করাতেই তড়িঘড়ি করে উঠে পরলো। অন্ধকার ঘরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত হাতিয়ে একটা ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে বের করলো। সেই বক্সে অনেক পুরোনো একটা এন্টিসেপ্টিক এর বোতল আছে। আর মাত্র কয়েক দিন বাকি সেটার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার। সেই এন্টিসেপ্টিকের বোতল থেকে খানিকটা ঔষধ একটা টিস্যুতে নিয়ে পরম যত্নে হীরের কপালের কাটা জায়গা পরিষ্কার করতে লাগলো তুর্য। ঔষধটা কাটা জায়গায় লাগতেই কেঁপে উঠলো হীর। হয়তো জ্বালাপোড়া করছে। পরিষ্কার শেষে একটু মলম লাগিয়ে দিলো তুর্য। মলম দেওয়া শেষে আগের মতো আবারও হীরকে দেখায় মনোযোগ দিলো সে। তার হয়তো হীরের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু তুর্য স্থির হয়ে আছে।

“রাতের অন্ধকারে, তোমাকে ঘুমের ঘোরে পেয়ে তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাকে আমি ছোট করতে পারি না। তোমার অপমান সবার সামনে হয়েছে। যাদের তুমি ছোট থেকে আপন মনে করে এসেছো তারা সবাই তোমাকে ভুল বুঝেছে। আর আমি! আমি মূর্তির ন্যায় সব দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখেছি। আমি এইসব কিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো কিন্তু সবার কাছে তোমার সত্যতা প্রমাণ করার পর। আজ যারা তোমাকে দোষারোপ করছে, খারাপ মনে করছে তাদের কাছে প্রমাণ করে দেবো তুমি কতোটা পবিত্র, কতোটা ভালো। তোমাকে তোমার প্রাপ্য আদর, ভালোবাসা আর সম্মান ফিরিয়ে দিয়েই তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো আমি হীর। আমাকে একটু সময় দাও আমি ওয়াদা করছি রায়ানের মিথ্যা আমি সবার সামনে প্রমাণ করবো। আর সেদিন তোমাকে সবার সামনে প্রপোজ করবো! চিত্কার করে সবাইকে জানিয়ে দিবো আমি তোমাকে ভালবাসি! আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। আমাদের ভালোবাসা সেদিন পূর্ণতা পাবে।”

হীরের কপালে আলতো করে একটা চুমু এঁকে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো তুর্য।
#সেই_তুমি🍁
#সিজন_০৩
#পর্ব_০৮
#Tabassum_Kotha

ভোরের সূর্যের প্রথম কিরণ হীরের চোখে মুখে পরতেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতেই গতকাল ঘটে যাওয়া সব অঘটনের দৃশ্য একের পর এক চোখের সামনে এসে জরো হতে লাগতো তার। দুচোখের কার্নিশ বেয়ে কখন যে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে সেও বুঝতে পারে নি। চোখের পানি মুছে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হীর। আলমিরা থেকে একটা সুতির সালওয়ার কামিজ বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে পানির প্রতিটি ফোঁটা কে অনুভব করছে সে। এখন আর চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। অশ্রু শুকিয়ে চৈত্রের খরার মতো হয়ে গেছে চোখ দুটি। গোসল শেষ করে কাপড় পাল্টে কিচেনে চলে গেলো হীর, উদ্দেশ্য সবার জন্য রান্না করবে।

নিচে নেমে বেশ অবাক হলো হীর। হঠাত্ বুকটা মুচড়ে উঠলো তার। গত ছয় বছরে এই প্রথম চৌধুরী বাড়িতে হীরের ঘুম থেকে উঠার আগেই নাস্তা টেবিলে সাজানো। অথচ এমনও সময় পার হয়েছে যখন একদিন হীর সকালে নাস্তা না বানালে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতো তমা বেগম। টেবিলে তুর্য আর তাফসি নেই। তমা বেগম আর আফজাল সাহেব মুখ গোমড়া করে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন। নিচে নামার জন্য এক পা এগিয়ে দিয়েও পিছিয়ে নিলো হীর। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এই পরিবারে তার অবস্থান কোথায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলো হীর। এই বাড়িতে কেউ তাকে আর চায় না। সে খুব ভালোই বুঝতে পারছে সবাই কি চায়! তবুও তার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাকে হাজার অপমান সহ্য করে হলেও এখানেই থাকতে হবে।

.

সকাল সকালই তুর্য তৈরি হয়ে নিলো। নিচে নামার আগে তাফসি কে দেখার জন্য তার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা বেগম তাফসির মাথার কাছে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাশেই খাবারের ট্রে রাখা আছে। তাফসি এখন আর কাঁদছে না। তবে তার মলিন মুখটা তুর্যর নজর এড়াতে পারে নি। একমাত্র বোনের এই কষ্ট তার হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। তার সাধ্যে কুলালে হয়তো এতোক্ষণে পৃথিবীর সব সুখ বোনের পায়ের কাছে এনে রেখে দিতো। কিন্তু সেই সামর্থ্যও আজ তার নেই। এতোটা অসহায় নিজেকে কখনও মনে হয় নি তুর্যর। এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো সে।
তমা বেগম বহু কষ্টে মেয়েকে সামলিয়ে হালকা কিছু খাইয়ে ভিটামিন ট্যাবলেট খাইয়ে দিলেন। মেয়ের মলিন হয়ে থাকা মুখটার দিকে যতোবার তার চোখ পরছে ততোবারই চোখ ভরে আসছে। আজ যেনো তাদের সব অর্থই বৃথা। এসব কিছুর বিনিময়েও তারা তাদের মেয়ের জীবনে সুখ আনতে অক্ষম। তাফসির কপালে একটা চুমু দিয়ে তমা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন।

দরজার আড়ালে লুকিয়ে হীর এতোক্ষণ তমা বেগমের যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তমা বেগম বেরিয়ে যেতেই হীর তাফসির একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এক রাতেই তাফসির চেহারা ভেঙে গেছে। হয়তো সারা রাত জেগেই কান্না করেছে, তাই তো চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। হীরের খুব ইচ্ছে হচ্ছে তাফসির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, তাফসিকে জরিয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে সবটা খুলে বলতে। কিন্তু শত ইচ্ছা থাকলেও আগের মতো সেই অধিকার টা আর নেই।

খুবই ক্ষীণ কন্ঠে তাফসিকে ডাকলে সে চোখ খুলে হীরের দিকে তাকায়। হীর ভেবেছিল হয়তো তাফসি তাকে দেখে রাগ করবে কিন্তু হীরকে ভুল প্রমাণিত করে তাফসি খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলো হীরের এখানে আসা টা।

বিছানা থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিলো তাফসি। হীর সাহায্য করতে চাইলে হাতের ইশারায় মানা করে নিজেই উঠে বসলো।
— দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বস ওখানে।

হীর তাফসির ব্যবহারে ভীষণ অবাক হলো।
— তুমি রাগ করো নি আমাকে এখানে দেখে?

— রাগ করার কি আছে এখানে? তুই তো আর এই ঘরে নতুন আসছিস না।

— না মানে, আসলে,, কালকের ঘটনার পর,,,

— দেখ হীর, তুই আমাকে যা ই মনে করিস,, আমি কখনই তোকে আমার শত্রু মনে করি নি। আর তুই রায়ান কে ভালোবাসিস এই কথাটা একবার আমাকে বললে বিশ্বাস কর আমি নিজেই তোদের রাস্তা থেকে সরে দাড়াতাম।

— তুমি আমাকে ভুল বুঝছো আপু। বিশ্বাস করো আমার আর রায়ানের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। রায়ান সবাই কে মিথ্যা কথা বলেছে।

— তোর বলা প্রতি টা কথা আমি বিশ্বাস করতাম। যদি না তোদের এক বিছানায় না দেখতাম।

— এসব মিথ্যে বিশ্বাস করো!

— থাক ওসব কথা। বাদ দে। আর ভালো লাগছে না ওসব কথা। আমি রায়ান কে ভালোবাসি। সবসময় এমনভাবেই ভালোবেসে যাবো। তাতে কি হয়েছে সে আমাকে ভালো না বাসলে! আমি তার খুশি চাই।

— আপু! এসব কি বলছো?

— বাবা-মা আর তুর্য কে আমি কনভিন্স করতে পারবো তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

— কি বলছো তুমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

— তুই আর রায়ান যা চাইছিস তাই হবে।

— তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও আমার কথা প্রমাণ করার! প্লিজ!

— এর থেকে বেশি আর কিছু আমার কাছে চাস না হীর। অনেক কষ্টে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। এমন যেনো না হয় সহ্য করতে না পেরে আমি নিজেই সব শেষ করে ফেলি।

— আপু!

— চলে যা প্লিজ!

হীর কিছু বলতে গিয়েও কান্না চেপে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে গেলো। সে তো চায় সবকিছু যেনো আবার আগের মতো হয়ে যাক। কিন্তু এখানে তো সব তার ভাবনার বিপরীতেই হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও সে পারছে না সব ঠিক করতে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে হীর একটা উপায় বের করলো সবকিছু ঠিক করার। রায়ানের মুখ থেকেই সব সত্যি কথা বের করবে সে, সেটা যে করেই হোক। যেই ভাবনা সেই কাজ। মোবাইল ফোন আর কিছু টাকা ব্যাগে ভরে রায়ানের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো হীর।
এর আগেও বেশ কয়েকবার তাফসির সাথে ওই বাড়িতে গিয়েছে সে। এজন্য খুব বেশি সমস্যা হয় নি তার।

.
.

অজানা গন্তব্যে আপনমনে কার ড্রাইভ করে চলছে তুর্য। একদিকে তার বোন আর অপরদিকে তার ভালোবাসা। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে। আর সে কারোর কষ্টই দূর করতে পারছে না। আর এই সমস্যার জন্য দায়ী শুধু রায়ান। রায়ানের জন্যই তার আপনজন রা এতো কষ্টে আছে! রায়ানের সাথে শেষবারের মতো কথা বলতে তুর্য রায়ানের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরায়।

.
রায়ানের বাড়িতে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হীর। আজকে কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে ফিলিং আসছে হীরের এই বাড়ি থেকে। আগে কখনো এমনটা হয় নি। বারবার মনে হচ্ছে কোন কিছু ভয়ানক ঘটতে চলেছে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের ভয় কে দমিয়ে রুমে প্রবেশ করলো হীর।

রুমের বাম পাশের সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছে রায়ান। হীর ঘরে ঢোকার আগেই মোবাইল এ ভিডিও মোড অন করে নিয়েছে। রায়ানের মুখ থেকে সত্যি টা উগলে ক্যামেরায় বন্ধী করে নেবে।

দরজায় টোকা পরতে, রায়ান ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই কড়া গলায় বললো,
— কফি টেবিলে রেখে চলে যাও।

হালকা গলা ঝাড়ি দিয়ে হীর বললো,
— আমি হীর। ভিতরে আসতে পারি?

হীরের গলা শুনে বেশ অবাক হয়ে ঝট করে দাঁড়িয়ে পরলো রায়ান। সে হীর কে এই সময় তার বাসায় মোটেও এক্সপেক্ট করে নি। সে খানিকটা চমকে গেলেও হীরের সামনে নিজেকে স্থির রেখে হীরের এখানে আসার কারণ জানতে চাইলো।

— তুমি কেনো এসেছো এখানে?

হীর মোবাইল টা একটু উঁচু করে রেখে রায়ানের মুখ বরাবর এসে দাঁড়ায়।
— আমি এখানে আপনাকে বোঝাতে এসেছি যে আপনি যা করছেন সেটা কতো বড় অন্যায়। এতে শুধু আপনি তাফসির না আমাদের চারজনেরই জীবন নিয়ে খেলছেন। আপনি কি জানেন এর পরিণাম কতোটা ভয়াবহ হতে পারে?

— না। জানি না। সত্যি বলতে জানতে চাইও না।আমি যা করেছি সবার ভালোর জন্য করেছি। আর কেউ না জানুক অত্যন্ত তো তুমি আর আমি জানি এটাই সবার জন্য ভালো। আমি তাফসিকে ভালোবাসি না এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে কি লাভ বলো যেখানে ভালোবাসা নেই।

রায়ানের ধীরে ধীরে সব স্বীকার করে নেওয়াতে হীরের মনে একটা নতুন আশার আলো সঞ্চার হয়।

— কিন্তু তাফসি আপনাকে অনেক ভালোবাসে সেটা তো আপনি জানেন। অন্তত ওর ভালবাসার কথা বিবেচনা করে হলেও এমনটা করবেন না।

— তাফসির ভালোবাসার কথা চিন্তা করেই বিয়ে টা করছিলাম। কিন্তু এখন যখন সবাই সত্যটা জানে তখন আর লুকিয়ে কি লাভ বলো।

হঠাৎ করে রায়ানের কথার সুর পাল্টে যাওয়ায় খানিকটা বিচলিত হয়ে ওঠে হীর।
— মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি? বুঝতে পারছি না ঠিক।

রায়ান একটু বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
— এখন যেহেতু সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। এই সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়াই ভালো। তাই তো তোমাকে বিয়ে করে লাইফে সেটেল হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছি। আমার বিশ্বাস আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি তুমি আমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসো।

রায়ানের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে হীর বলল,
— কি বলতে চাইছেন আপনি? এখানে আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই যার সামনে আপনি মিথ্যা নাটক করছেন! সুতরাং মিথ্যা কথা বলা বন্ধ করুন। নিজের ভুলটা স্বীকার করুন আর তাফসি কে বিয়ে করে ভুলটা শুধরে নিন।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here