সেই তো এলে তুমি পর্ব -২২+২৩

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২২
#Saji_Afroz

আলিয়া খাতুন নিহিরের ব্যাপারে সবটা জানার পর থেকে ভীষণ খুশি। মনেহচ্ছে তিনি যেন আকাশের চাঁদ পেতে চলেছেন। এতদিন কত কেউ কত কথাই না বলল। সবার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।
তায়শার কাছে নিহিরের ছবি দেখে তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, সত্যি এই ছেলে তোরে পাত্তা দিছে? একদম রাজপুত্রের মতন।
তায়শা হেসে বলেছিল, আমার কাছে পাত্তা পাওয়ার জন্য ঘুরঘুর করছে।
.
আজ ছেলের চাচী এবং চাচাতো ভাই এই বাড়িতে আসবে তায়শাকে দেখতে। তাই তাদের জন্য আয়োজনের কোনো কমতি রাখছেন না আলিয়া খাতুন। দোকান থেকে হরেক রকমের মিষ্টি, নাস্তা, ফল তো এনেছেনই; নিজেও
পিঠে বানাতে ব্যস্ত। কোনোমতেই তিনি এত ভালো প্রস্তাব হাত ছাড়া করতে চান না।
এদিকে নিহির তাদের সাথে আসবে না শুনে তায়শার মন কিছুটা খারাপ হয়। কিন্তু নিহির বলেছে, তার চাচীর যদি তাকে ভালো লাগে পরেরবার সে নিশ্চয় আসবে কথা পাকাপোক্ত করার জন্য।
এটা শুনে তায়শার মন কিছুটা হলেও ভালো হয়। তবে নিহির থাকলে বিষয়টা তার জন্য অনেক সহজ হত। এর আগে কখনো নিহিরের চাচী বা ভাই এর সাথে তার দেখা হয়নি বলে কিছুটা নার্ভাস লাগছে।
তায়শা তৈরী হয়ে নেয়। হালকা গোলাপি রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে সে। নাফিশার কথাতে মাথায় ওড়না দিয়েছে। পাত্রের চাচী আসছে বলে কথা!
তৈরী হয়ে সেলফি তুলে নিহিরকে পাঠায় তায়শা। নিহিরের ইচ্ছে করছে তাকে সামনে থেকে দেখতে। চোখ জুড়ে, মন ভরে দেখতে! কিন্তু চাচী কি না কি মনে করেন! এই ভেবে সে যাওয়ার কথা আর বলতে পারলো না। কেনো যে চাচী তাকে সাথে নিচ্ছেন না। হয়তো এটা কোনো নিয়ম বা তার ইচ্ছে।
তায়শার ফোনে আশিকের কল আসে।
মেজাজটায় তার খারাপ হয়ে যায়। সে বিরক্ত হয়ে তার নাম্বারটি ব্লক লিস্টে রেখে দেয়। যদি অন্য নাম্বার থেকে বিরক্ত করে তবে সিমটায় খুলে ফেলবে সিদ্ধান্ত নেয়। এমনিতেও নিহিরের কাছে তার অন্য একটি নাম্বার আছে। তাই এটা বন্ধ রাখলেও সমস্যা নেই। এই ভেবে মোবাইলের দিকে বিরক্তভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তায়শা।
.
.
সেনোয়ারা বেগম গাড়ি ভর্তি নাস্তা আনিয়েছেন। তা দেখে নিখিল হেসে বলল, পুরা মিষ্টি আর ফলের দোকান তুলে আনলে না কি?
-পারলে সেটাই করতাম।
.
তারা বেরুনোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেনোয়ারা বেগমের শাড়ির কুচি অগোছালো হয়ে আছে। বুশরা তা খেয়াল করে বলল, আপনার শাড়ির কুচি অগোছালো। যদি কিছু মনে না করেন আমি ঠিক করে দিই?
.
তিনি নিচে তাকিয়ে দেখলেন বুশরা ঠিক বলছে। নিজ থেকে যেহেতু ঠিক করে দিতে চায়ছে দিক। এই ভেবে বলল, হুম।
.
বুশরা খুব গুছিয়ে তার কাজটা সম্পন্ন করলো। তাকে ধন্যবাদ জানায় সেনোয়ারা বেগম। নিখিল বলল, তুমি তো আমাদের সাথে যেতে পারো।
-এখন বেরুনোর সময় নেই আমার। তৈরী হতেই অনেক সময় লেগে যাবে।
-তোমাকে নরমালেই ভালো মানায়।
.
সেনোয়ারা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন, দেরী হয়ে যাচ্ছে। বেরুনো উচিত আমাদের।
.
নিহির এসে নিখিল কে বলল, ড্রাইভার কে এড্রেস আমি দিয়েছি। তোকেও বলছি। যাতে পৌঁছতে অসুবিধে না হয়।
.
নিখিল ঠিকানা নিতে যাবে ঠিক তখনি তার ফোন কল এলো। সে বলল, ভাইয়া একটু অপেক্ষা করো।
.
সে ফোন রিসিভ করেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে কী হয়েছে তার জানার জন্য। নিখিল বলল, আমি এখুনি আসছি।
.
সে ফোন রেখে সবার উদ্দেশ্য বলল, সরি ভাইয়া আমি যেতে পারব না। আমার বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ। আমার ওখানে যাওয়া লাগবে।
-কোন বন্ধু?
-আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শাকিল।
-ও আচ্ছা! তুই এখুনি চলে যা। বাইকে যাস না। গাড়ি নিয়ে যা।
-আচ্ছা।
.
এই বলে নিখিল ছুটে চলে যায়। নিহির সেনোয়ারা বেগমকে বলল, তোমাকে একা যেতে হবে এখন।
.
তার একা যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহুর্তে বুশরাকে বলে নিজেকে ছোট করতেও মন চায়ছে না। তিনি বললেন, সমস্যা নেই। আমি সবটা ম্যানেজ করে নেব।
.
.
তায়শার বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই সেনোয়ারা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই এলাকায় অবশ্য এমন বাড়িই তিনি আশা করেছিলেন। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের বাড়ির চারটে রুমের সমান হবে এই পুরো বাড়িটা৷ নিহির বলে তিনি এই বিষয়ে কিছু বলবেন না। কিন্তু নিখিলের জন্য যেনতেন ঘরের মেয়ে বউ করে তিনি আনবেন না।
মনে মনে এসব আওড়াতে আওড়াতে ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। তাকে দেখে আলিয়া খাতুন সালাম জানিয়ে সাদরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলেন। সেনোয়ারা বেগম কাউকে পাঠিয়ে গাড়ি থেকে বাক্স গুলো নামাতে বললেন। আলিয়া খাতুন এতই অধৈর্য ছিলেন যে, তিনি নিজেই গাড়ির দিকে ছুটে গেলেন সেনোয়ারা কী এনেছেন তা দেখার জন্য। সেনোয়ারা কে একা রেখে তিনি বাক্স গুলো এনে তা খুলে দেখতে লাগলেন। এসব দেখে তার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। তার সাথে যোগ দেয় তায়শাও। সে এত দামী মিষ্টি দেখে লোভ সামলাতে পারলো না। খেতে শুরু করলো। নাফিশা এসে মা বোনের এসব কাণ্ড দেখে ধমকের সুরে বলল, মেহমানকে বসিয়ে রেখে তোমরা এসব নিয়ে পড়ে আছ? কী ভাববেন উনি!
.
এতক্ষণে আলিয়া খাতুনের হুশ হলো। তিনি নাফিশাকে নাস্তা রেডি করতে বলে ছুটে গেলেন। এসেই বললেন, দুঃখিত৷ আসলে আমি একা মানুষ তো৷ সবটা সামলাতে হয় নিজেকেই।
-মেয়েরা কী করে?
.
এই প্রশ্ন শুনে মিথ্যে হাসি দিয়ে আলিয়া খাতুন বললেন, ওরা করতে চায়। আমিই দিইনা৷ বড় আদরে রেখেছি ওদের। কোনো কাজই পারে না। এই বিষয়ে যে বোন আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্য এত বড় ঘরের মানুষ আপনারা। নিশ্চয় কাজের লোক আছে?
-বেশ কয়েকজন আছে। তবুও আমি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করি। প্রত্যেকেরই এটা উচিত বলে আমি মনে করি।
-কাজের লোক না থাকলে অন্য কথা! এত টাকা দিয়ে ওদের রেখে আবার নিজে করার দরকার কী?
-সেটা আমার ভালো লাগা থেকেই করি।
.
আলিয়া খাতুন এই বিষয়ে আর এগুলো না। বুঝতে পারলেন, ছেলের মা অসুস্থ হওয়াই চাচী বাড়ির মালকিন হয়ে বসে আছে।
একবার বিয়েটা হয়ে যাক, তায়শা হবে সেই বাড়ির মালকিন। তার কথাতেই এই চাচীকেও উঠা বসা করতে হবে। কোনোমতে বিয়েটা করিয়ে দিতে পারলেই হয়।
সেনোয়ারা বেগম বললেন, মেয়ের বাবা কোথায়?
-দোকানে আছে। আসলে কিছু সময় দোকানে না থাকলেও লোকসান হয়৷ আর তিনি একেবারেই অলস হয়ে থাকতে পছন্দ করেন না।
-দোকান বলতে?
-তার মুদি দোকান আছে। ওখানেই আছে।
.
শেষমেশ মুদি দোকানদারের মেয়েকে পছন্দ করলো নিহির! তার চেয়ে ঢের ভালো তো ওই বুশরা ছিল।
সেনোয়ারা বেগম খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বললেন, মেয়েকে ডাকুন।
.
নাফিশা এসে নাস্তা গুলো রেখে যায়। আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি আলিয়া খাতুন। কিন্তু সেনোয়ারা বেগম কিছুই মুখে তুলছেন না। তার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। একটু বাদে নাফিশার সাথে তায়শা আসে। তায়শা কে দেখে তার মন কিছুটা হলেও ভালো হয়। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘মাশাআল্লাহ’ শব্দটি।
এখন বুঝতে পারছে, কেনো নিহির এমন একটা পরিবেশের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।
তিনি শুনেছেন, ছেলেরা পড়াশোনা করে টাকা কামাই করে একটা সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার জন্যে।
নিহির হয়তো সেই নীতিটায় অনুসরণ করেছে।
তায়শার সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো সেনোয়ারার। তিনি তায়শার জন্যে আনা চেইনটা তার গলায় পরিয়ে দেন। এরপর আলিয়া খাতুনকে বললেন, নিহির যেহেতু আগেই ওকে পছন্দ করেছে এর উপরে কোনো কথা থাকতে পারে না। আপনাদের সাথে হয়তো নিহিরের দেখা হয়নি?
-জি না! বাবাজিকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে।
-তবে কাল ওদের এনগেজমেন্ট করিয়ে দিই?
.
কালই এনগেজমেন্ট এর কথা শুনে আলিয়ার চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসে। এত কম সময়ে এত আয়োজন কীভাবে করবে?
সেনোয়ারা বেগম তার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, বড় কোনো আয়োজন নয়। পারিবারিক ভাবে এনগেজমেন্ট টা হবে। সেই আয়োজনটা আমিই করব। আপনারা শুধু উপস্থিত থাকবেন। আমাদের ঘরের সদস্য আর আপনাদের, এছাড়া আর কেউ নয়।
.
এই বলে তিনি উঠে পড়লেন। তায়শার কাছ থেকে তার আঙুলের সাইজ জিজ্ঞাসা করে বললেন, আজ আসি। কাল দেখা হবে।
.
তাকে বাড়িয়ে দিতে যায় নাফিশা। আলিয়া খাতুন তায়শাকে বললেন, বড়লোকের বড়লোকি কারবার আরকি। আবার এনগেজমেন্ট এর কী দরকার? বিয়েটায় এভাবে করিয়ে নিয়ে গেলে হত না?
.
তায়শা বিরক্ত হয়ে বলল, উফফ মা! কালকের জন্য সব গুছিয়ে রাখো এত কথা না বলে।
.
.
আজ নিহির অফিসে যায়নি। সেনোয়ারা বেগম বাড়ি ফিরতেই সে তার পাশে এসে বসলো।
মায়ার কাছ থেকে এক গ্লাস পানি পান করে তিনি বললেন, মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে।
-সত্যি?
-হু। কিন্তু…
-কি?
-মেয়ের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। তাছাড়া আমাদের সাথে ওরা মেলেনা। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
-তাহরিমা তো আমায় এতকিছু বলেনি। অবশ্য আমি জিজ্ঞাসাও করিনি।
-ওর বাবা মুদি দোকানদার। জানোনা তুমি?
.
নিহির অবাক হয়ে বলল, তাই?
-হ্যাঁ।
.
তাহরিমা যেভাবে চলে, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের অবস্থা এত ভালো না। তাহরিমার কথাবার্তায় এসব মনেও হয়নি। তাহরিমা নিজেকে অন্যভাবে প্রেজেন্ট করে কেনো? এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে নিহির।
সেনোয়ারা বেগম বললেন, মেয়ের মাকেও এতটা ভালো আমার লাগেনি। তার মেয়ে না কি কোনো কাজই করতে পারবে না। আমরা যেন তাকে কাজ করতে আনছি!
.
নিহির বলল, মেয়েকে ভালোবেসে বলে ফেলেছেন হয়তো।
-কি জানি। যাই হোক, তুমি যখন এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। আমি আর কিছু বলব না৷ আজ সুন্দর থেকে একটা রিং নিয়ে এসো। কাল তোমাদের আন্টি বদল হবে।
.
নিহির মুখে হাসিয়ে ফুটিয়ে বলল, তাই!
-হু। দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত থাকব আমরা। এতটুকুই। আসলে আমি চাচ্ছিলাম নিখিলের জন্মদিনটা ধুমধাম করে করব। সেদিন তোমাদের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করব।
.
নিহির এতেই খুশি হয়ে যায়। কিন্তু দূর থেকে এসব শুনে ভালো লাগলো না বুশরার। নিখিলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ধুমধুমভাবে হতে পারলে, নিহিরের এনগেজমেন্ট কেনো নয়? সেনোয়ারা যে দু’জনের মাঝে তফাত করে, এটা নিহির বোঝে না#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_২৩
#Saji_Afroz

খুব দ্রুতই যেন কাঙ্ক্ষিত সময়টা চলে এল। আজ নিহির ও তায়শার এনগেজমেন্ট হবে। যদিও পারিবারিকভাবে হচ্ছে। তবুও নিহির তায়শাকে তার মনের মতো করে সাজতে বলেছে। তাকে নিয়ে শপিং এ গিয়েছে। তায়শা নিজের জন্য সাদা একটি গাউন নেয়। সেই গাউনে তাকে কেমন লাগে তা দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে নিহির।
নিহির স্যূট পরে নিখিলের কাছে আসে। বরাবরের মতোই নিখিল তৈরী হতে গিয়ে রুমটা অগোছালো করে রেখেছে। নিহির বলল, নতুন তো নিয়ে দিলাম। সেটাই পর না।
-আর বলো না ভাইয়া। ভালো লাগছে না সেইটা আবার।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তোর ইচ্ছে মতো পরে নে। আমার ভাইকেও সেই লাগতে হবে।
-হু। আচ্ছা ভাইয়া, তোমার শালিকা আছে।
-আছে একজন।
-বাহ। এইবার জমবে!
-জমাবি অবশ্যই।
-আমার যদি তাকে ভালো লেগে যায়?
-আমার মনেহয় দুই ভাই একই নৌকায় পা দেওয়া ঠিক হবে না। মানে একই ঘরে বিয়ে করা ঠিক হবে না।
-উহু ভাইয়া! ভাবী যখন সুন্দরী তার বোনও হবে। যদি হয় আমি চান্স মিস করব না।
-সেই দেখা যাবে। তৈরী হয়ে নে তাড়াতাড়ি।
.
.
সেনোয়ারা বেগমকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত বুশরা। তিনি শুনেছেন, বুশরা ভালো শাড়ি পরাতে জানে। অবশ্য সেদিন তার কুচি ঠিক করা দেখেই এটা তিনি বুঝতে পেরেছেন।
শাড়ি পরানোর পর তাকে ধন্যবাদ জানায় সেনোয়ারা বেগম। এরপর বললেন, তুমি চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারো।
-একেবারে বিয়েতে যাব ম্যাডাম৷ আপনি বলেছেন এতটুকুতেই খুশি হয়েছি।
.
এই বলে রুম থেকে বেরুই বুশরা৷ সে জানে তিনি মন থেকে কথাটি বলেননি। তাছাড়া ওখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেও বুশরার নেই।
হঠাৎ নিখিলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তার রুমে ছুটে এলো বুশরা। সাথে বাকিরাও এলো। নিখিল প্রায় কেঁদে জানালো, তার যে বন্ধুটি এক্সিডেন্ট করেছিল তার মৃত্যু হয়েছে।
একথা শুনে সকলে বেশ দুঃখ অনুভব করলো। নিহির তাকে শান্তনা দিয়ে বলল, আল্লাহ এতটুকুই তার সময় নির্ধারণ করেছেন। তুই ভেঙে পড়িস না। গাড়ি নিয়ে যা। এই সময়ে তোর ওখানে থাকা প্রয়োজন।
.
ভাইকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নীরবে চোখের পানি ফেললো নিখিল। এরপর তাদের বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
সেনোয়ারা বেগমকে বলল নিহির, আমাদেরও বেরুনো উচিত।
-নিশ্চয়।
.
মা এর খেয়াল রাখতে বলে বুশরাকে তারাও বেরিয়ে পড়ে।
.
.
নিহিরদের অনেক আগেই রেস্টুরেন্টে চলে এসেছে তায়শা ও তার পরিবার। এতবড়ো রেস্টুরেন্টে তায়শা আগে আসলেও আলিয়া খাতুন, তার স্বামী ও নাফিশা প্রথমবার এসেছে।
আলিয়া খাতুন মিনমিনে স্বরে তার স্বামীকে বললেন, আমাদের তায়শার জন্যে এখানে আসার ভাগ্য হয়েছে। ভালোই হলো আশিকের সাথে বিয়েটা হয়নি। কী বলো?
.
তিনিও তাল মিলিয়ে বললেন, ঠিকই বললে।
.
এদিকে তায়শাকে ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত নাফিশা। খানিকবাদে তায়শা খাবার অর্ডার দেয়। নাফিশা বলল, উনারা না আসতেই এটা করছিস কেনো? আসুক না। তারা কী আয়োজন করেছে তাও তো জানিস না।
-খিদে পেয়েছে তো।
-বিল বেশি আসবে এখানে।
-ওসব ওরা সামলাবে।
.
খাবার আসতেই তারা এমনভাবে খেতে শুরু করলো, যেন অনেকদিন না খেয়ে ছিল! একমাত্র নাফিশা নির্বাক হয়ে তাদের কাণ্ড দেখছে।
এরইমধ্যে প্রবেশ করে নিহির ও তার চাচী। তারা খাওয়ার মধ্যে এতই মগ্ন ছিল যে, নিহিরদের উপস্থিতি টের পায়নি। নাফিশা তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। বুশরাকে ডেকে বলল, তারা এসেছে।
.
মুখের খাবার প্লেটে ফেলে তায়শাও তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেনোয়ারা বেগমকে সালাম জানিয়ে বলল, আসলে খিদে লেগেছিল তো।
-ইটস ওকে। তোমার মুখে খাবার লেগে আছে। টিস্যু দিয়ে মুছে নাও।
.
নাফিশা তাকে সাহায্য করে। এদিকে তাদের দেখেও খাওয়া থামায়নি আলিয়ারা। সেনোয়ারা বেগম ওয়েটারকে ডেকে বললেন, আমার গেস্টদের জন্য স্পেশাল মেন্যু বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। ওসব দিলে না কেনো?
-ম্যাম তারা আপনার গেস্ট বুঝতেই পারিনি। তাই যা চেয়েছে দিয়েছি।
.
সেনোয়ারা বেগম তাদের উপরে খুবই বিরক্ত হলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না। ভেবেছেন আগে রিং পরানো শেষ করবে। পরে খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে গল্পগুজব করা যাবে। কিন্তু এদের বোধহয় এনগেজমেন্ট থেকেও খাওয়া নিয়ে তাড়া বেশিই!
.
সেনোয়ারা বেগম রিং পরিয়ে নিতে বললেন। আলিয়া বলল, এইভাবে খাওয়া রেখে উঠলে খাবারের অপমান হবে। আপনারা বসুন। শেষ করছি।
.
খাওয়া শেষ করে নিহিরকে ভালো করে দেখে তিনি বললেন, মাশাআল্লাহ! চাঁদের টুকরো একটা।
.
নিহির হেসে ধন্যবাদ জানায় তাকে। এরপর তায়শাকে রিং পরিয়ে দেয়। সকলে করো তালি দিয়ে উঠে। এইবার সেনোয়ারা বেগম বললেন, এখন তায়শা পরাবে নিহিরকে।
.
আলিয়া বলল, বেশ তো! পড়াক।
.
এই বলে সেনোয়ারার দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি বললেন, রিং দিন মেয়েকে। ছেলেকে পড়িয়ে দিক?
-সে কী! রিং আনেননি?
.
সেনোয়ারা অবাক হয়ে বলল, রিং আমি কেনো আনব? তায়শার জন্যে তো আনলাম। নিহিরের টা আপনারা আনবেন৷ আর এটাকেই তো এনগেজমেন্ট বলে তাইনা?
.
তিনি সেনোয়ারার থেকেও বেশি অবাক হয়ে বলল, সবকিছু আপনি করবেন বলেছেন। আমি ভাবলাম এত টাকা আপনাদের রিংও আপনারাই আনবেন।
.
মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, তাহলে আর কী করার! দ্বিতীয় দফা খেয়ে নিন। পরে কখনো যদি ইচ্ছে হয় মেয়ের জামাই এর হাতে একটি রিং পরিয়ে দিয়েন।
.
নিহির চাইলেই এখুনি রিং কিনে আনতে পারে। কিন্তু এটা তার চাচী পছন্দ করবে না ভেবে সে তা করলো না। এদিকে তায়শা নিহিরকে ইশারা করে বারবার এটাই বুঝাচ্ছে, যেন বের হয়ে একটা রিং কিনে আনে। কিন্তু সে তা করেনি। কথা ঘুরানোর জন্য বলল, আমারও খিদে পেয়েছে। আসুন খেয়ে নিই।
.
সেনোয়ারা বললেন, আমাদের জন্য স্পেশাল টেবিল করা হয়েছে। ওখানে যাওয়া যাক?
.
সবাই সেদিকে যাচ্ছে। নিহির ও তায়শা পাশাপাশি যাচ্ছে। তখনি নাফিশা তাদের মাঝখানে এসে বলল, আহারে! আজকে হতে হতেও তোমাদের এনগেজমেন্ট টা সম্পূর্ণ হয়নি।
.
একথা শুনে তায়শা হেসে বলল, ধুর! রিং তো পেয়ে গেছি। যেকোনো একজনের হাতে থাকলেই হলো।।
.
এই বলে সে হেঁটে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। তার পিছু নেয় নাফিশা। সেনোয়ারা বেগম এসে নিহিরকে নিয়ে একটু আড়াল হয়ে বললেন, দুইটা রিং ছেলে পক্ষ আনে কোথাও শুনেছ তুমি? জানিনা কেমন ফ্যামিলির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছ। তায়শা তো স্মার্ট বেশ। সেও কী কিছুই জানেনা? অন্তত তোমাকে বলতে পারতো সমস্যা হলে!
.
নিহির লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে।
আসলেই তো! তায়শার যদি রিং নিতে সমস্যা হয় তবে সে এটা শেয়ার করতেই পারতো। কালই তো তাকে নিয়ে গাউন ও রিংটা নিলো নিহির। একবারও নিহিরের রিং এর কথা জিজ্ঞাসা করলো না। আর এনগেজমেন্ট হয়নি বলেও তার আফসোস নেই। নিজের ডায়মন্ডের রিং পেয়েই সে খুশি।
তায়শার খুশি কী এসবেই সীমাবদ্ধ?
.
.
রাত বারোটা পেরিয়ে যায়। নিখিল তার বন্ধুর বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরে আসে। খালেকুজ্জামান দরজা খুলে দিলে নিজের রুমে আসে সে। নিখিল বেশ ক্লান্ত অনুভব করছে। তার মনটাও বিষণ্ণ। প্রিয় বন্ধুকে হারানোটা সহজে মেনে নিতে পারছে না সে। সবকিছু কেমন যেন লাগছে।
হতাশ হয়ে বিছানায় বসে রয়েছে নিখিল।
-আসব?
.
বুশরাকে দেখে ভেতরে আসতে বলল নিখিল। সে বলল, আপনি ঘুমাননি?
-আসেনি ঘুম। দাফন সম্পন্ন হয়েছে?
-হ্যাঁ। মানুষের জীবন কত অদ্ভুত তাইনা? একটা মিনিটের বিশ্বাস নেই জীবনের।
-আসলেই।
.
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বুশরা বলল, ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভালো লাগবে।
.
নিখিল গোসল সেরে আসে। দেখলো তার পড়ার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে বুশরা। নিখিলকে দেখে সে বলল, নিশ্চয় কিছু খাননি সারাদিন। ভাত খেয়ে নিন।
.
নিখিলের আসলেই খিদে পেয়েছে। এত রাতে বলা ছাড়াও তাকে কেউ খাবার দেবে ভাবেনি।
সে বলল, ধন্যবাদ।
.
বুশরা যেতেই নিখিল খেতে বসে। তৃপ্তি নিয়ে খায় সে। খাবার নিশ্চয় বুশরাই করেছে। মেয়েটা ভালো রান্না করে।
কয়েকটা দিন কেটে যায়।
প্রিয় বন্ধুর শোকে নিখিল বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। তার জন্মদিন নিয়ে যে এত আয়োজন করা হচ্ছে, এই বিষয়েও সে অবগত নয়।
এদিকে সেনোয়ারা বেগম কাল জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তায়শা ও নাফিশাকে আসতে বলেছে। তিনি ইচ্ছে করেই পুরো ফ্যামিলিকে বলেননি। কারণ তাদেরকে সেনোয়ারার পছন্দ না।
অপরদিকে তায়শা কাল নিহিরের বাড়ি দেখার জন্য অনেক বেশি উত্তেজিত। নিহিরের কাছে যা শুনেছে, বিশাল বড়ো তাদের বাড়ি। এতবড়ো বাড়ির বউ হবে ভাবতেই ভালো লাগছে তার। আজকের দিনটা যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, সেই কামনায় করছে তায়শা।
.
। ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here