সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -১৮

পর্বঃ১৮
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি নিষেধ।)

ড্রাইভিং সিটে বসে সায়ন অন্যমনষ্ক হয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে রুবেল ঘুমাচ্ছে আর মাঝের সিটে শ্রেয়া,যামিনী গল্প করছে।

ফোনে ব্লুটুথ কানেক্ট করে রাইদার নাম্বারে একের পর এক কল দিচ্ছে সায়ন। প্রতি বার কল দিলেই মিষ্টি স্বরে একজন মেয়ে বলছে,’দুঃখিত আপনার ডায়াল কৃত নাম্বারটি বন্ধ আছে,একটু পর আবার চেষ্টা করুন।’

একই কথা আবার ইংরেজিতে ও রিপিট করছে।কল কেটে সায়ন আবারো কল দেয় তখনও একই কথা শুনতে পায়।
গত রাত থেকে শত খানেক কল মেসেজ করেছে কিন্তু রাইদার কোনো খোঁজ নেই। সায়ন আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছে না। হাইওয়ে রোডে হুট করে সায়ন গাড়ি থামায়। স্টেয়ারিং এ কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে।

‘কি হলো গাড়ি থামিয়েছিস কেনো?’,শ্রেয়া প্রশ্ন করে।

‘গাড়ি চালাতে ভালো লাগছে না।’,চোখ বন্ধরত অবস্থায় সায়ন জবাব দেয়।

‘তোর শরীর খারাপ লাগছে?’,যামিনী চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘জানি না কিছুই ভালো লাগছে না।সব বিরক্ত লাগছে।’,আগের ন্যায় সায়ন জবাব দেয়।

‘তাহলে বেরিয়ে একটু ফ্রেশ এয়ার নিয়ে আয়।’,যামিনী সায়নকে বলে।

গাড়ি থেকে বের হয় গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় সায়ন। পকেট হাতরে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে। লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে টান দেয়। হাইওয়ে রোডে একের পর এক গাড়ি,বাস,ট্রাক ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে।
চোখ বন্ধ করেই সায়ন ভাবছে কোথা থেকে রাইদাকে খোঁজ করা শুরু করছে আর সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া হাওয়ায় ওড়াচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর যামিনী রুবেলকে ঘুম থেকে ডাকে তুলে।

‘কত ঘুমাস উঠ।’,যামিনী রুবলের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে।

‘ওরে বাবারে ভুমিকম্প! আল্লাহ বাঁচাও। ‘,রুবেল ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে।

‘বাসায় গিয়ে ঘুম দিস এখন বাহিরে গিয়ে সায়নকে সঙ্গ দে আর বল জলদি আসতে।’,যামিনী রুবলকে বলে।

‘তোরা শা*লা একটাও আমার ঘুম সহ্য করতে পারিস না।আমি ঘুমালেই তোরা শ*কু*নের মতো এসে আমার ঘুম নষ্ট করিস।ধ্যাত তোগো যন্ত্রণায় উগান্ডা যামু গা।’,গাড়ি থেকে বের হয়ে রুবেল বলে।

হাই তুলে রুবেল সায়নের দিকে এগিয়ে যায়। সায়নের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ ডলতে থাকে।

‘কিরে দেবদাস সেজে এখানে রাইয়ের শোকে দিন কাটাবি নাকি? ঢাকা যত দ্রুত যাবি তত দ্রুত রাইয়ের খোঁজ পাবি।’

রুবেলের কথা শুনে চোখ তুলে তাকায় সায়ন।সিগারেট ফেলে গাড়িতে উঠে বসে। রুবেল গাড়িতে উঠলেই সায়ন গাড়ি স্টার্ট দেয়। ফোন বের করে রাইদাকে আবারো কল দেয় এবার ফোনে রিং বাজে।
রিং বাজতে বাজতে কলটা কেটে যায় কিন্তু রাইদা কলটা রিসিভ করে না।সায়ন হার না মেনে আবারো কল দিতেই থাকে এক সময় কল দিলে নাম্বারটা ব্লক দেখায়।সায়নের আর বুঝতে বাকি নেই তার নাম্বারটা রাইদা ব্লক করে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সংযত করে সায়ন গাড়ি ড্রাইভ করে।

..

ফাহিমের রুমের বিছানা দখল করে আছে বাপ্পি,রাইদা,রুহি।অর্ক চেয়ারে বসেছে আর ফাহিম ফ্লোরে বসে খাটে হেলায় দিয়ে আছে।

‘কিরে ফোনের দিকে তাকিয়ে তোর চেহারা আমসত্ত্বের মতো হইলো কেন? ‘,বাপ্পি রাইদাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কই কিছু না পোস্ট দেখছিলাম।’,রাইদা ঢোক গিলে জবাব দেয়।

কিছুক্ষণ আগেই অর্কের ধমকে ফোনটা সুইচ অন করেছি রাইদা। সে ভাবতে পারেনি ফোন অন করে এতো কল মেসেজ দেখবে। শত খানেক কল, মেসেজ এসেছে অপরিচিত এক নাম্বার থেকে। তবে এগুলোর মধ্যে হু*মকি দেওয়া মেসেজও ছিলো যা দেখে রাইদার বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা সায়নের নাম্বার। ফোন অন করার পর থেকেই সায়ন একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছিলো তাই বাধ্য হয়ে রাইদা সায়নকে ব্লক করে দেয়। নাম্বার ব্লক করার পরও সায়ন মেসেজ পাঠায়।ব্লক লিস্টে গিয়ে সায়নের মেসেজটা পড়ে রাইদার চোখ বড়বড় হয়ে যায়।

‘রি একবার খালি সামনে পাই তোমায় তারপর থা*প্প*ড় দিয়ে দাঁত সবগুলো ফেলে দিবো এরপর হাত পা বেঁ*ধে বদ্ধ রুমে আঁটকে রাখবো। আঁটকে রেখে নিয়ম করে তিনবেলা একশত চুমু খাবো। লক্ষি মেয়ের মতো নাম্বার আনব্লক করে কথা বলো না হলে খুব খারাপি হবে বলে দিলাম।মনে রেখো তোমার বর মানে আমি এই আমার কাছেই তোমাকে ফিরতে হবে সেটা তুমি চাইলেও কিংবা না চাইলেও।’

চোখ বুলিয়ে রাইদা মেসেজটা আবার পড়ে। সায়নকে যতটুকু চেনে তাতে এসব সায়ন বলেছে মানে সত্যি সত্যি করবে।একশত চুমুর কথাটা পড়ে রাইদা জোরে বলে উঠে।

‘ছি ছি অসভ্য লোক।’,নাক মুখ কুঁচকে বলে রাইদা।

‘তুই আমারে কিছু বললি?’,বাপ্পি রাইদার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।

বাপ্পির কথা শুনে রাইদা ভ্যাবাচ্যাকা খায়।

‘তুই যেমন তোকে তো তাই বলবে।মেয়ে দেখলেই নাম্বার নেওয়ার জন্য পিছন পিছন দৌড় দ্যাস।’,ফাহিম বাপ্পিকে ফোঁড়ন কেটে বলে।

‘পায়েল কখন আসবে?খিদায় আমার পেটে মাছ সাঁতার কাটতেছে।’,অর্ক বিরক্ত হয়ে বলে।

এর মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠে। ফাহিমের মা মিসেস ফিরোজা গিয়ে দরজা খুলে।

রুমে ঢুকেই পায়েল চোখের সানগ্লাস খুলে বাপ্পিকে ধাক্কা মেরে বিছানায় বসে।

‘আসছে আমাদের মর্ডান শাঁ*ক*চু*ন্নি। সানগ্লাসে পুরা এ*লি*য়ে*ন লাগে তোরে।’,বাপ্পি পায়েলের হাত থেকে সানগ্লাস কেঁড়ে নিয়ে বলে।

‘বাপি দা তুই স্টাইলের কি বুঝবি ক্ষ্যাত পোলা।’,বাপ্পিকে ভেংচি দিয়ে বলে পায়েল।

‘জরিনা আমাকে এই নামে ডাকতে না করছি।’,পায়েলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে বাপ্পি।

‘ওরে একটু বসতে তো দে।’,রুহি বাপ্পিকে সরিয়ে বলে।

‘নাশতা কিন্তু টেবিলে রাখা যা খিদে পেয়েছে খেয়ে নে আমি বের হচ্ছি।’,কথাগুলো বলে ফাহিমের মা মিসেস ফিরোজা ডাইনিং রুমে যায়। তার পিছু পিছু অর্ক,বাপ্পি,রুহি,রাইদা, ফাহিম,পায়েল রেল লাইনের মতো কাঁধে হাত দিয়ে সিরিয়াল ধরে যায়।

‘রান্নাঘরে সব আছে যা ইচ্ছা তোরা রান্না কর তবে রান্নাঘর যদি আগের বারের মতো নোংরা পেয়েছি তাহলে সবগুলাকে কানে ধরাবো।’,মিসেস ফিরোজা সবাইকে শাসিয়ে বলে।

‘আরে আন্টি আমি থাকতে নো টেনশন আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব পরিষ্কার করিয়ে যাবো।’,রুহি মিসেস ফিরোজাকে আশ্বস্ত করে বলে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে ফাহিমের মা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ফাহিমের বাবা মারা গেছে যখন ফাহিম তার মায়ের গর্ভে। মিসেস ফিরোজা শিক্ষিত হওয়ায় শিক্ষকতা করতে শুরু করে একসময় সরকারি হাই স্কুলে তার চাকরি হয়ে যায়। ফাহিমের বাবা এই ফ্ল্যাটটা নিজের দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে কিনেছিলো সেটাতেই মা ছেলে দিন কাটাচ্ছে।

সবগুলো ড্রাইনিং এ বসে যায় খেতে।রুহি সকলের প্লেটে নাশতা দিচ্ছে।অর্ককে দিতে নিলে অর্ক রুহির হাত থেকে বাটি কেঁড়ে নিয়ে নিজেই নিয়ে নেয়। এ দৃশ্য বাকি চার বন্ধুর চোখ এড়ায় না। চারজন একে অপরকে ইশারা করে।

গলা ঝেরে বাপ্পি বলে,’রুহি পাত্র পক্ষের কি খবর?শুনলাম ছেলে নাকি অনেক ভালো চাকরি করে?’

‘হ্যা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে।’,মাথা নিচু করে রুহি জবাব দেয়।

‘কবে যাবি দেখা করতে? আমাকে কিন্তু নিবি সাথে যতই হোক হবু দুলাভাই দেখা না করলে তো চলে না।’,রাইদা আঁড়চোখে অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে।

অর্ক শরীরের জোর দিয়ে রুটি ছিঁড়ে প্লেটে রাখছে কিন্তু খাচ্ছে।সম্পূর্ণ রুটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।

‘রুটির উপর রাগ না দেখিয়ে জায়গা মতো রাগ দেখা।’,ফাহিম অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে।

‘আমাদের প্রোগ্রামের সময় কিন্তু বেশি নেই।সামনের সপ্তাহে ডেট এর মধ্যে প্র্যাক্টিস সম্পন্ন করতে হবে।’,কথা ঘুরানোর জন্য পায়েল বলে।

‘আজকে সব প্লানিং করি তারপর কালকে থেকে প্র্যাক্টিস শুরু করবনি।হাতে মোটামুটি কয়েকটা দিন আছে।’,রাইদা পায়েলর কথার জবাবে বলে।

‘কিছু কেনাকাটা বাকি সেগুলো করতে বিকালে বের হই?তাহলে ঘুরাও হবে কাজও হয়ে যাবে।’,পায়েল বলে উঠে।

‘আপনি আমাদের স্টাইলিশ আপনি যা বলবেন তাই হবে জরিনা আপা।’,বাপ্পি পায়েলের চুল টেনে বলে।

‘ঠিক আছে তাহলে আমরা মিটিং শুরু করে দেই।’,অর্ক বলে।

‘শুনছি বলতে থাক।’,খেতে খেতে রাইদা বলে।

পরবর্তী প্রোগ্রামে তারা কীভাবে কি করবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু হয়। লাইভ পারফরম্যান্স হোক কিংবা ডান্স ভিডিও পর্দার সামনে রাইদা,বাপ্পি আর অর্ক সব সময় পারফর্ম করে।দুই জুটির পারফর্ম হলে পায়েল বাপ্পির সাথে জুটি বাঁধে। ফাহিম ভিডিও এডিটিং সহ গান সিলেকশন থেকে শুরু করে কোন প্রোগ্রামে ওরা পারফর্ম করবে সেটাও সে ঠিক করে। ফ্রেন্ডস ব্যান্ডকে দিয়ে পারফর্ম করাতে চাইলে ফাহিমকে কল দিয়ে কথা বলতে হয়।
রুহি আর পায়েল মেকআপ, ড্রেসআপ এর বিষয়টা হ্যান্ডেল করে থাকে।

..

রুবেল আর শ্রেয়াকে নামিয়ে দিয়ে যামিনীকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে সায়ন। যামিনী পিছন থেকে এসে সায়নের পাশের সিটে বসে। নিরবতা পালন করে সায়ন গাড়ি চালাচ্ছে।

‘তুই কি রাইকে ভালোবাসিস? ‘,হুট করে যামিনী প্রশ্ন করে।

‘গত আট বছর ধরে ভালোবাসি।’,মুখভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখে বলে সায়ন।

‘তার মানে তোরা পূর্ব পরিচিত?’,অবাক হয়ে যামিনী জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা ভালো মতোই আমরা একে অপরকে চিনি।’

‘রাই তোকে ভালোবাসে?’

‘আমি যতদূর জানি ভালোবাসে না ঘৃণা করে।’

‘আচ্ছা রাই যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে কি করবি?’

যামিনীর এমন প্রশ্ন শুনে সায়ন গাড়ির ব্রেক কষে। চোখ তুলে যামিনীর দিকে তাকায়।

‘হঠাৎ এই কথা বললি যে?তোর কি মনে হয় রি অন্য কাউকে ভালোবাসে?যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে এখন অবশ্য আমি এসব কেয়ার করি না। আমার একার ভালোবাসাতেই সংসার চলবে সমস্যা নেই শুধু রি কাছে থাকলেই হবে।’

কথাগুলো বলে সায়ন আবারো গাড়ি স্টার্ট দেয়।

‘না এমনি বললাম জানার জন্য। রাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তোর? ‘

‘আমার নাম্বার ব্লক করে রেখেছে আচ্ছা এক কাজ কর তোর নাম্বার থেকে রি কে কল দে তো।’

যামিনী ফেন বের করে রাইদাকে কল দেয়।

‘তোর কাছে রি এর নাম্বার ছিলো? ‘,সায়ন যামিনীকে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা ছিলো তো কেনো?’,যামিনী জবাব দেয়।

‘বলিসনি তো আমাকে আর আমি নাম্বারের জন্য কত কাহিনী করলাম।’,সায়ন বলে।

‘আমাকে জিজ্ঞেস করলে কাহিনী করা লাগতো না।’,যামিনী জবাব দেয়।

রাইদা খাওয়া শেষ করে রুমে এসে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করছিলো তখনই ফোন বেজে উঠে।ফোন হাতে নিয়ে দেখে যামিনী কল দিয়েছে।কল রিসিভ করবে কিনা ভাবতে ভাবতে রিসিভ করে ফেলে। রাইদা বারান্দায় গিয়ে যামিনীর সাথে কথা বলতে থাকে।

‘কেমন আছো রাই?’,ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়ে কথা বলতে শুরু করে যামিনী।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো আপু?তুমি বলে ফেললাম সরি।’,রাইদা হেঁসে বলে।

‘তুমি বলবা আমাকে,আপনি ডাক কেমন পরপর লাগে।তুমি হঠাৎ ঢাকা ফিরে গেছো আমাকে জানালা না কেনো?’,যামিনী প্রশ্ন করে।

‘আসলে আপু ইমার্জেন্সি কল এসেছিলো তাই হুট করে চলে এসেছি।তোমরা কবে ফিরবে?’,রাইদা বলে।

যামিনী উত্তর দিতে নিলে সায়ন ফোন কেঁড়ে নেয়। লাউডস্পিকার বন্ধ করে ফোন নিজের কানে নেয়।

‘খবরদার কল কাটার দুঃসাহস করবা না।তুমি কি ভেবেছো নাম্বার ব্লক করলে আমার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে?’,গম্ভীর গলায় সায়ন জিজ্ঞেস করে।

‘আমি কিছু ভাবিনি।সবসময় উল্টা পাল্টা আপনিই ভাবেন।যামিনী আপুকে ফোনটা দেন না হলে আমি কল কেটে দিবো।’,রাইদা বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়।

‘ত্যাড়ামি না করে আমি দু’টো প্রশ্ন করবো তুমি জবাব দিবা।’

‘আপনি আমাকে হু*ম*কি দিচ্ছেন মিস্টার ইমতিয়াজ সায়ন?’

‘যেটা মনে করো সেটাই। সব বাদ তোমার শরীর কেমন আছে সেটা বলো আগে।’

‘আমিও ভালো আছি আমার শরীরও ভালো আর কিছু?’

‘তুমি না বলে চলে এসেছো কেনো? আমাকে এখনো ভয় পাও?’

‘জি না আপনাকে কেনো কাউকেই আমি ভয় পাই না।আপনাকে জাস্ট আমার বিরক্ত লাগে মোটেও সহ্য হয় না।’

‘ভয় পাও না বলেই বিয়ে হওয়ার পরেরদিন দুপুরেই গ্রাম থেকে পালিয়েছো।তুমি ভয় পাচ্ছিলে যদি ইমতিয়াজ সায়ন এসে অধিকার খাটিয়ে তোমায় নিয়ে যায়।’

সায়নের এমন কথায় রাইদা মৃদু কেঁপে উঠে।

‘আপনার যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন এতে আমার কিছু যায় আসে না।’

‘তুমি কোথায় আছো ঠিকানা দাও আমি একবার তোমার সাথে দেখা করতে চাই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

‘আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।কিছু বলার হলে এখন বলেন।’

‘শিওর?এখন বলবো?’

‘হ্যা বলেন শুনছি।’

‘ভালোবাসি তোমায় রি। খুব জলদি আমাদের দেখা হবে। নিজের খেয়াল রাখবা আর সাবধানে থাকবা।বাসায় ফিরে আমার নাম্বার থেকে কল দিবো তুমি নাম্বারটা আনব্লক করে রাখো।’

কথাগুলো বলে সায়ন কল কেটে দেয়। রাইদা ফোন কানে দিয়েই আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ পর ধ্যান ভাঙে পায়েলের ডাকে।

‘কিরে এখানে কি করছিস? রুমে চল।’,পায়েল রািদার বাহুতে হাত দিয়ে বলে।

‘কিছু না চলে।’

পায়েলের সাথে রাইদা রুমে চলে যায়।

..

যামিনীকে নামিয়ে দিয়ে সায়ন গাড়ি ঘুরিয়ে বাসায় ফিরে আসে। গ্যারাজে গাড়ি রেখে লাগেজ নিয়ে বাসায় ঢুকে যায়।
কলিংবেল দিলে নিপা এসে দরজা খুলে দেয়।

‘নিপা কে এসেছে এই সময়?’,সায়নের মা মিসেস রিনা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘বড় ভাই আইছে খালাম্মা।দেন ভাই আমি আপনের লাগেজ নিয়া রুমে রাখতাছি।’,সায়নের কাছ থেকে লাগেজ নিয়ে নিপা বলে।

‘লাগবে না তুই কাজ কর। আমি রুমেই যাচ্ছি কেউ এখন আর বিরক্ত করবি না আমাকে।’,রুমের দিকে যেতে যেতে সায়ন বলে।

‘তুই এত জলদি ফিরলি যে?কিছু হয়েছে?’,মিসেস রিনা সায়নের পথ আঁটকে জিজ্ঞেস করে।

‘কিছু হয়নি সরো ফ্রেশ হয়ে পরে বিস্তারিত বলবো।’,সায়ন তার মাকে এড়িয়ে ঘরে যায়।

মিসেস রিনা বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে।সায়নের বিয়ের ব্যপারটা সায়নের পরিবারের কেউ এখনো জানেনি।

‘ভাইয়া ফিরেছে?কই রুমে?’,সায়ন্তিকা নিজের রুম থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা রুমে মাত্র ঢুকলো।’,মিসেস রিনা জবাব দেয়।

সায়ন্তিকা দৌড়ে গিয়ে সায়নের রুমে ঢুকে। ওয়ারড্রব থেকে সায়ন নিজের গেঞ্জি বের করছিলো তখন।

‘ভাইয়া বিকালে আমি একটু শপিং মলে যাবো।’,সায়নের বিছানায় বসে পা দোলাতে দোলাতে সায়ন্তিকা বলে।

‘তো যাবি আমাকে কেনো বলছিস?’,বিরক্ত হয়ে সায়ন জবাব দেয়।

‘বলছিলাম আমি একটু নিয়ে যাবা প্লিজ।ড্রাইভার চাচার শরীর খারাপ না হলে তার সাথেই যেতাম।’,সায়ন্তিকা জোর পূর্বক হেসে জবাব দেয়।

‘উবার ডেকে যা আমি পারব না।’,কথাটা বলে সায়ন ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।

‘মা ভাইয়াকে বলো না নিয়ে যেতে।’,সায়নের রুম থেকে বের হয়ে ন্যাকাকান্না করতে করতে সায়ন্তিকা নিজের মায়ের কাছে গিয়ে বলে।

‘আচ্ছা আমি দেখছি সায়নকে বলে।’,মিসেস রিনা মেয়েকে আশ্বস্ত করে।

গোসল সেরে বের হয়ে সায়ন বিছানায় বসে ফোন হাতে নিয়ে আবারো রাইদাকে কল দেয়। কল দিয়ে সায়ন চরম হতাশ হয় রাইদা তার নাম্বার এখনো ব্লকে রেখেছে।

নিপা এসে চা দিয়ে যায় সায়নকে। চা খেতে খেতে রাইদার সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইল খুঁজতে থাকে।অনেকক্ষণ খোঁজা খুঁজির পর রাইদার ইনস্টাগ্রাম আর ফেসবুক আইডি পেয়ে যায়। শেষে হোয়াটসঅ্যাপে গেলে একই নাম্বার থেকে খোলা রাইদার হোয়াটসঅ্যাপ আইডিও পেয়ে যায়। রাইদার সোশ্যাল মিডিয়াতে গিয়ে আপলোড করা ছবিগুলো সায়ন দেখতে থাকে তখনই মিসেস রিনা রুমে আসে।

‘তোর কি আজকে কোনো কাজ আছে?মেয়েটাকে নিয়ে যদি একটু বের হতি।’,বিছানায় বসে মিসেস রিনা বলে।

‘কাজ নেই তারপরও তোমার মেয়েকে নিয়ে বের হতে পারবো না।ওর সাথে বের হলে আমার পকেট খালি করে দেয়।এমন চলতে থাকলে আমার বউ এসে ওর যন্ত্রণায় পালাবে।’,ফোনের থেকে চোখ তুলে সায়ন জবাব দেয়।

‘দেখছো মা বিয়ে করেনি এখনই বউয়ের জন্য কি দরদ।’,পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে সায়ন্তিকা বলে।

‘এত কষ্ট করে বিজনেস মেইনটেইন করি শুধু বউয়ের জন্যই।’,সায়ন উঠে সায়ন্তিকার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বলে।

‘এমন ভাবে বলছিস মনে হচ্ছে বউই সব তোর।বিয়ে করার আগেই আমরা পর বিয়ে হলে তো তোকে খুঁজেই পাব না।’,মিসেস রিনা মন খারাপ করে বলে।

‘ঠিক আছে বুঝেছি আপনারা মা মেয়ে আর ড্রামা কইরেন না। আমি মলে নিয়ে যাবো তবে তোমার মেয়ে যা কিনবে সেই টাকা তুমি দিয়ে দিবা।’,সায়ন কথাগুলো বলে বিছানায় শুয়ে পরে।

‘ঠিক আছে দিয়ে দিবো।খাবার দিচ্ছি খেয়ে নে।’,কথাটা বলে রিনা সায়নের রুম থেকে বের হয়।সায়ন্তিকাও মায়ের পিছন পিছন যায়।

সায়ন শুয়ে শুয়ে রাইদার প্রোফাইল থেকে ডিটেইলস কালেক্ট করতে শুরু করে।

..

দুপুরে রুহি,অর্ক,বাপ্পি আর পায়েল মিলে রান্না করে।রাইদা, ফাহিম বসে বসে ওদের রান্না দেখে।মূলত রান্নার রুহি করেছে বাকি তিনজন হেল্প করতে এসে উল্টো কাজ বাড়িয়েছে। মিসেস ফিরোজা বাসায় ফিরে চারটার দিকে ততক্ষণে সকলে খেয়ে রেস্ট করে।

বিকাল পাঁচটা বাজতেই মিসেস ফিরোজাকে বাসায় রেখে উবার ডেকে সকলে চলে যায় শপিং মলে। এক ঘন্টা ঘুরাঘুরির পর পায়েল জানায় যা প্রয়োজন ছিলো কেনা হয়েছে এখন এখান থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যেতে। সকলে একত্রে হাঁটতে থাকে।

বাপ্পির ফোনে কল আসলে সে কল রিসিভ করে একটু সাইডে গিয়ে কথা বলতে শুরু করে।

‘হ্যালো, আম্মু শুনতে পাচ্ছো?আমি বাহিরে পরে কল দেই?হ্যালো আম্মু।’,এক সাইডে দাঁড়িয়ে বাপ্পি কথার বলার চেষ্টা করছিলো। বিরক্ত হয়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে পাশ ফিরে ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে।

রাইদা,অর্ক,রুহি,পায়েল,ফাহিম অনেকটা আগে চলে গেছে বাপ্পিকে ছেড়ে।

হুট করে বাপ্পি একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খায়। যেমন তেমন ধাক্কা না এমন ধাক্কা খায় মেয়েটার হাতের আইসক্রিম ফ্লোরে পড়ে যায়।

‘সরি আপু আমি খেয়াল করিনি।’,মেয়েটাকে বাপ্পি বলে।

তখনই মেয়েটা চিৎকার করতে শুরু করে।

‘এই আপনার কি চোখে সমস্যা? আমার আইসক্রিম ফেলে দিলেন।’,চিৎকার করে মেয়েটা বলে।

বাপ্পি অবাক হয়ে মেয়েটার কথাবার্তা শুনে তাকায়। চিৎকারের শব্দ শুনে বাপ্পির বন্ধুরা পিছনে তাকায়। সকলে দৌড়ে বাপ্পি কাছে আসে।

‘কি হয়েছে?’,রাইদা বপ্পিকে জিজ্ঞেস করে।

‘এই লোকটা আমার আইসক্রিম ফেলে দিয়েছে। পাবলিক প্লেসে হাঁটার সময় কি চোখ কপালে রেখে হাঁটেন নাকি মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করে। ‘,মেয়েটা আরে চিৎকার করল বলে।

‘এই মেয়ে গলার ভলিউম কমিয়ে কথা বলো।বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় বাসায় শেখায়নি?’,রাইদা রাগ সংযত করে বলে।

‘না শেখায় নি আমাকে আপনাকে শিখিয়েছে?আপনাকে শেখালেই হবে।এইসব ছেলেদের যারা সাপোর্ট করে তাদের সাথে এভাবেই কথা বলা উচিত।’,আগের ন্যায় চিৎকার করে মেয়েটা বলে।

‘সামান্য আইসক্রিমের জন্য এমন করছো? তোমার আইসক্রিমের টাকা দিয়ে দিচ্ছি বিদায় হও এখান থেকে।’,ব্যাগ থেকে হাজার টাকার নোট বের করে রাইদা বলে।

‘আপনি আমাকে টাকা দেখাচ্ছেন? আপনি জানেন আমার বাবা আর ভাই আপনাকে কিনতে পারবে টাকা দিয়ে।’,মেয়েটা আঙুল উঁচিয়ে রাইদাকে বলে।

মলের মানুষজন জড়ো হয়ে কানাঘুষা করছে আর তামাশা দেখছে।

‘চুপ বেয়াদব মেয়ে।অনেকক্ষণ ধরে তোমার বেয়াদবি সহ্য করছি আরেকটা কথা বললে থা*প্প*ড় দিয়ে তোমার নাম ভুলিয়ে দিবো।’,রাইদা রেগে বলে।

‘রাই ছেড়ে দে ছোট পোলাপান বুঝতে পারেনি।’,অর্ক রাইদাকে আঁটকে বলে।

‘কিসের ছোট ও?ওর সাহস কি করে হয় বাপ্পিকে আজেবাজে কথা বলার।এই মেয়ে টাকার গরম দেখাচ্ছো আমাকে?নিজে দুই টাকা জীবনে ইনকাম করছো? সারাজীবন বাপ ভাইয়ের ঘাড়ে ঝুলে খাও আবার অন্যকে টাকার গরম দেখাও? ‘,রাইদা রাগ কন্ট্রোল না করতে পেরে বলে।

‘আপনি কিন্তু অতিরিক্ত করছেন আমার ভাইয়াকে ডাকবো।’,মেয়েটা বলে।

‘ডাকো তোমার ভাইকে, পারলে তোমার চৌদ্দ গুষ্টিকে ডাকো আমিও তাদের বলতে চাই এই বেয়াদব মেয়েকে তারা আদব কেনো শেখায়নি।’,দাঁতে দাঁত চেপে রাইদা বলে।

অর্ক রাইদাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যেতে চায়।অর্কের থেকে হাত ছাড়িয়ে রাইদা মেয়েটার সামনে গিয়ে ওর ডান হাত টেনে এক হাজার টাকা গুঁজে দেয় হাতে।

‘পরের বার কাউকে কিছু বলার আগে অবশ্য আদব কায়দা শিখে নিবা।’

কথাটা বলে রাইদা সেখান থেকে চলে যায়।

হাতের মুঠো খুলে টাকাটার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা কেঁদে দেয়।

‘কাঁদিস না সায়ু ভাইয়াকে কল দিয়ে বল সব।ভাইয়া এই রাগী আপুটাকে শায়েস্তা করবে।’,সায়ন্তিকার বান্ধবী তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে।

সায়ন্তিকা ফোন বের করে তার ভাইকে কল দেয়।

রাইদার মেজাজ এখনো খারাপ হয়ে আছে।তার বন্ধুরা বিষয়টা বুঝতে পেরে চুপ করে আছে কেউ কিছু বলছে না। এক্সিট গেট দিয়ে একে একে মল থেকে বের হয়।

সায়ন গাড়ি পাকিং করে বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো তখন সায়ন্তিকা কল দিয়ে কান্না করতে থাকে। সায়ন্তিকার কান্না শুনতে পেয়ে সায়ন মলের ভেতরে ঢুকে। দোতলায় উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে সায়ন্তিকাকে খুঁজতে থাকে তখনই তার চোখ যায় নিচের দিকে যেখানে এক্সিট গেট দিয়ে রাইদা বের হচ্ছিলো।প্রথমে সায়ন ভাবে মনের ভুল কিন্তু শিওর হওয়ার আগেই রাইদা বেরিয়ে যায়।সায়নও ভিড় ঠেলে দৌড়ে মল থেকে বের হয় কিন্তু কোথাও রাইদাকে পায় না।হাঁপাতে হাঁপাতে মলের সিঁড়িতে বসে রাইদাকে কল দেয়।

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here