সেদিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -১৭

পর্বঃ ১৭
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি নিষেধ।)

বিছানায় গুটিশুটি হয়ে রাইদা শুয়ে আছে। ভোরবেলা সেই যে ঘুম ভেঙেছে এরপর আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে।
রান্নাঘরে আলেয়া বেগম, মাইমুনা কাজ করছে।সাবিনা তার ছেলেকে খাওয়াতে ব্যস্ত।আলেয়ার ছোট ছেলের বউ ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে আর মারিয়া গেছে বাজারে। গত রাত থেকে ঘরের কারো মুখে কোনো কথা নেই সকলেই বাক্য শূন্য হয়ে গেছে।
মারিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে উঠানে আসে। মারিয়ার পিছন পিছন রাকিব আর মনিও আসে। রান্নাঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগ ফেলে টুলে বসে পরে মারিয়া। মনি আর রাকিব রাইদার রুমে গিয়ে দাঁড়ায়। রাইদা ওদের দু’জনকে খেয়াল করেনি।

‘কিরে বিলাইয়ের মতো হাঁপাস ক্যান?’,আলেয়া বেগম বিরক্ত হয়ে মারিয়াকে জিজ্ঞেস করে।

‘আবার কি হইছে?’,মাইমুনা কাজ ফেলে মেয়ের সামনে এসে বসে জিজ্ঞেস করে।

‘আমি যহন বাজারে গেলাম দেহি মাইনসে রাই আপার বিয়া নিয়ে আজেবাজে কথা কইতাছে।রাই আপার লগে তার মায়ের চরিত্র লইয়াও অনেক কিছু কইতাছে।’,মারিয়া জবাব দেয়।

‘তো এইডা আর নতুন কিচ্ছু হইলো? মা যেমন মাইয়া তো তেমনই হইবো।ঠিকই আছে তাল গাছে তালই ধরে আম ধরে না।আকাম করছে মাইনসে তো কইবোই’,মাইমুনা মারিয়ার সামনে থেকে সরে চুলার সামনে গিয়ে বসে।

‘ঘটনা হেইডা ঘটনা আরেকটা ঘটছে।’,মারিয়া ভিতু চোখে বলে।

‘এতো ঢং না কইরা কইয়া ফেল কি হইছে।’,সাবিনা মারিয়াকে বলে।

‘অমিত তালুকদারকে কারা জানি পিডাইয়া দুই পা ভা*ই*ঙ্গা দিছে লগে ডাইন হাতও ভা*ঙ*ছে।মেহেদী তালুকদারের এক হাত ভা*ঙ*ছে আর ওগো লগে যেইসব পোলাপাইন আছিলো ওগো এমন পিডাইছে সব বিছনার থেইকা দুই মাসের আগে উঠবার পারবো না।’,ঢোক গিলে মারিয়া জবাব দেয়।

‘কস কি! কার এতো কলিজ তালুকদারের পুতের ঠ্যাং হাত ভা*ঙ্গে?’,মাইমুনা অবাক হয়ে বলে।

‘মাইনসে কইতাছে সায়ন ভাই এডি করছে হয়তো।’,ওড়না আঙুলে প্যাঁচিয়ে মারিয়া বলে।

‘ওগো যে জানে মা*রে নায় এইডাই অনেক।জাহিদ কইছিলো উডানে নাকি ওরা রাইরে নিয়া অনেক খারাপ খারাপ কথা কইছে তহন সায়ন মারতে গেছিলো পোলাপাইন আঁটকায় দিছে।’,সাবিনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে।

‘পোলাডায় তেইলে গু*ন্ডা!’,আবারো অবাক হয়ে মাইমুনা বলে।

‘গু*ন্ডা কিনা জানি না তয় রাইরে মেলা ভালোবাসে ছোড কাল থেইকা।ছোড কালে যা করছে হেই জায়গায় ঠ্যাং হাত ভা*ঙ্গা ভা*ঙ্গি কিচ্ছু না।’,কথাগুলো বলে সাবিনা বাজারের ব্যাগ থেকে মাছ, তরকারি বের করতে থাকে।

মাইমুনা চিন্তিত ভঙ্গিতে কাজ করতে থাকে।

রুমে শুয়ে রাইদা রান্নাঘরের সকল কথা শুনছিলো। পাশ ফিরে শুলে দেখে রাকিব আর মনি দাঁড়িয়ে আছে। ইশারায় দু’জনকে ডেকে বসতে বলে। মনি এসে রাইদার মাথার কাছে বসে।রাকিব চেয়ার টেনে সামনে বসে।মনি হাত তুলে রাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে আতংকে উঠে।

‘একি আপা আপনের তো জ্বর আইছে।’,মনি রাইদার কপালে হাত রেখে বলে।

‘এসব জ্বর রাইকে কাবু করতে পারে না।গত রাতে যা হয়েছে সেই তুলনায় এই জ্বর কিছু না।কিরে রাকিব বললি না তো এতো কিছু ঘটলো যে?’,হাসি দিয়ে রাইদা বলে।

‘কোন বিষয়ে আপা?’,রাকিব বোকার মতো প্রশ্ন করে।

‘এই যে তালুকদারের ছেলেদের হাত পা ভা*ঙা হয়েছে সেই কথা আমাকে সবার আগে জানানো উচিত ছিলো না? কে এই কাজ করেছে জানিস?’,আবারো হেঁসে জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘না আপা কেউ জানে না কারা করছে তয় অবস্থা অনেক খারাপ।তালুকদারের গাড়িতেও আ*গু*ন লাগাইয়া দিছে।ভেতরে মানু আছিলো না খালি গাড়ি পু*ড়*ছে।’,রাকিব বলতে থাকে।

‘যেই ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হচ্ছে।কাজটা কে করেছে সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না।’,শোয়া থেকে উঠে বসে রাইদা বলে।

‘কে করছে আপনে কেমনে জানলেন আপা?’,মনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘একমাত্র ইমতিয়াজ সায়ন ছাড়া কারো এতো সাহস নেই এই কাজ করার।দুনিয়ার অন্য মানুষকে চিনতে ভুল হলেও এই মানুষকে চিনতে আমার কখনো ভুল হবে না।ওরে আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি। ওর রাগ কোন পর্যায়ের তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। ইমতিয়াজ সায়ন নিজের আসল রুপ দেখানো শুরু করেছে সবে।’,শেষের কথাটা রাই জোরে চিল্লিয়ে বলে।

রান্নাঘর থেকে সকলে রাইদার কথাগুলো শুনে একে অপরের দিকে তাকায়। সকলের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।
হাসতে হাসতে বিছানা থেকে উঠে পুকুরের দিকে যায়।রাইদাকে এখন দেখে কেউই বুঝবে না এই মেয়ের সাথে গত রাতে কত কিছু ঘটেছে।

পুকুরের ঘাটে বসে পানির দিকে তাকালে রাইদা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।

‘ইমতিয়াজ সায়ন আগের বার তোমায় ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এবার রাই তোমায় শেষ করে ছাড়বে।আমার জীবনে যখন জোর করে এসেছো সেটার মূল্য তো তোমায় দিতেই হবে।’,কথাগুলো বলে রাইদা পানিতে হাত দিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি এলোমেলো করে দেয়।

হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে বসে রাইদা। সাবিনা রাইদার জন্য নাশতা এনে ওর রুমেই দেয়।

‘মনি আর রাকিবের খাবার কোথায়?’,খাবারের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে সাবিনাকে জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘নবাবের ঝি নিজে খাওন পাইছিস কপাল তোর।আমগো মান সমান তো সব খাইছিস।’,সাবিনার পিছনে দাঁড়িয়ে মাইমুনা বলে।

‘যাও যা আছে নিয়ে এসে ওদের খেতে দাও। দরকার হলে যে রেঁধেছে তাকে টাকা দিয়ে দিবো তারপরও কানের কাছে পটরপটর করতে নিষেধ করো।’,মাইমুনার কথার জবাব না দিয়ে সাবিনাকে রাইদা বলে।

সাবিনা রান্নাঘরে চলে যায়।রাইদা খেতে শুরু করে। পাশে বসা মনি আর রাকিব মাইমুনাকে রাগে ফুঁসতে দেখে ভয়ে চুপ করে থাকে।

‘আপা থাক কিছু লাগবো না।বাইত থেইকা মোরা খাইয়া আইছি।’,মনি রাইদার বাহুতে হাত রেখে বলে।

‘আজকে প্রথমবার তো খাচ্ছিস না এর আগেও এই বাড়িতে খেয়েছিস।আমি যতক্ষণ এই বাড়িতে আছি তোরাও আছিস।এখন যে এখানে এসেছিস নিশ্চয়ই বাসায় না বলে এসেছিস?বাসায় জানলে কখনোই আসতে দিতো না সেটা জানি আমি।’,মনির দিকে তাকিয়ে রাইদা বলে।

রাইদার কথা শুনে মনি আর রাকিব মাথা নিচু করে ফেলে।সাবিনা খাবারের প্লেট এনে দু’জনের হাতে দিয়ে চলে যায়।মারিয়া এসে বিছানায় বসে। রাইদা খাওয়া শেষ করে মারিয়াকে বলে ফোনটা চার্জ থেকে খুলে আনতে। মারিয়াও গিয়ে ফোন এনে দেয়। ফোন হাতে নিয়ে অর্ককে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেয় রাইদা। মেসেজ পাঠিয়ে ফোন বন্ধ করে ফেলে।

‘শোন রাকিব খাওয়া শেষ করে একটা গাড়ি ঠিক করবি যে আমাকে লঞ্চ ঘাটে ছেড়ে আসবে।ঠিক দুপুর তিনটায় গাড়িটাকে বলবি এসে আমাকে পিক করে নিতে।আর হ্যা কাকও যেনো এ বিষয়ে টের না পায়।’,খাওয়া শেষ করে রাকিবকে বলে রাইদা।

‘আপনে আইজকা চইলা যাবেন আপা?’,মন খারাপ করে রাকিব জিজ্ঞেস করে।

‘আমাকে আমার শহরে ফিরতে হবে।এই গ্রাম প্রতিবার আমাকে বিভৎস স্মৃতি দিচ্ছে।এবারের স্মৃতিটা আমায় আরো শক্ত করে দিলো।’,ভাবনায় ডুব দিয়ে রাইদা বলে।
..

লাগেজ সব গাড়ীতে তুলে রাইদা পিছনে ফিরে তাকায়। সাবিনা,আলেয়া বেগম,মনি,ছোট মামার বউ,মরিয়ার টলমল চোখে দেখতে পেয়ে রাইদা নিজেকে সংযত করে। সকলে চেষ্টা করেছিলো রাইদাকে আটঁকাতে কিন্তু কেউ পারেনি।

‘খালামনি আমার কথাটা রেখো।আমার ভালো চাইলে এটা তোমাকে করতেই হবে।তোমার বোনকে এ বিষয়ে কিছু জানাবে না এখন আর সায়ন এসে যতই পাগলামি করুক আমার বিষয়ে কিছু ওকে জানাবা না।’,সাবিনাকে জড়িয়ে কানে কানে বলে রাইদা।

সাবিনা কোনো জবাব দেয় না। মাথা নাড়িয়ে সম্মত্তি দেয়।
‘নানু আবার দেখা হবে জলদি।মনি ভালো করে পড়াশোনা করবি আর এটা রাখ।রাকিব তুইও ভালো করে পড়বি। মারু পরীক্ষা শেষ করে অবশ্যই বেড়াতে যাবি ঢাকা।মামি নিজের খেয়াল রেখো। সবাই ভালো থেকো।’, সকলকে বিদায় দিয়ে রাইদা গাড়ীতে চড়ে বসে।

শেষবারের মতো মাইমুনার সাথে কোনো কথা বলে না রাইদা। গাড়ী চলে যেতেই মনি আর রাকিব নিজের হাতের খামটা খুলে যেটা রাইদা দিয়ে গেছে। উভয়ের খামটা খুলে কিছু টাকা পায়।মারিয়া কান্না আটঁকাতে না পেরে রুমে চলে যায়। যেই রুমে রাইদা ছিলো সেই রুমে গিয়ে দেখে বিছানার উপর অনেকগুলো মেকআপ,জামাকাপড়, তার জন্য রাইদা রেখে গেছে। সায়নের দেওয়া নীল শাড়ীটাও রেখে গেছে।বিছানায় বসে মারিয়া কাঁদতে থাকে।

..
দরজায় ক্রমাগত কেউ নক করছে সেই শব্দে সায়নের ঘুম ভাঙে। উঠে দরজা খুলে দেখে মহিউদ্দিন আর তার নানা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
উন্মুক্ত শরীরেই বিছানার উপর এসে বসে সায়ন।ফোন হাতে নিয়ে দেখে বিকাল সাড়ে চারটা বাজে। এক হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে ধরে রাখে। ঘুম থেকে উঠেই মাথা ব্যথা হওয়ায় প্রচন্ড বিরক্ত হয় সায়ন।গতরাতে সারা রাত বাহিরে কাটিয়ে তালুকদারের ছেলেদের মে*রে*ছে। মা*র*তে মা*র*তে জা*নেই মে*রে ফেলতো জাহিদ না আটঁকালে। শেষে রাগ না কমায় জামিল তালুকদারের খালি গাড়ীতে আ*গু*ন লাগিয়ে দেয়। ভোর বেলা বাড়ি ফিরেছে।বিছানার এক কোণায় তার শুভ্র রঙের পাঞ্জাবিটা পরে আছে যেটা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। পাঞ্জাবিটা বিয়ের স্মৃতি হওয়ার সেটা খুলে জাহিদকে দিয়ে অন্য একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে নেয় রাতে। বিয়ের কথা মনে হতেই রাইদার কথা মনে হয়।রুবেল সকালে ফিরেছে কিন্তু তার সাথে এখনো দেখা হয়নি তাই খবরও নিতে পারেনি।

‘রাগকে কন্ট্রোল করতে শিখো সায়ন না হলে বউমা কিন্তু থাকবে না।আগের বার কিন্তু তোমার এই রাগের কারণেই সে তোমার থেকে পালিয়েছিলো।তালুকদারের ছেলেরা বউ মাকে নিয়ে যা বলেছে সেটা তাদের বলা উচিত হয়নি কিন্তু তাই বলে এভাবে কেউ মারে?’,মহিউদ্দিন রুমে ঢুকে বলে।

‘সায়ন যে মা*র*ছে প্রমাণ আছে?’,সায়নের নানা জিজ্ঞেস করে।

‘না বাবা কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে।জামিল তালুকদার যে কি করবে কে জানে।’,মহিউদ্দিন চিন্তিত হয়ে বলে।

‘প্রমাণ নাই যেহেতু চুপ থাক। তুই যা আমি ওর লগে কথা কইয়া আহি।’
মহিউদ্দিন ঘর থেকে বের হয়ে যায়। চেয়ার টেনে সায়নের নানা তার সামনে বসে। মুখ তুলে সায়ন তার নানার দিকে তাকায়।

‘তোমার নানীর লগে আমার বিয়া হইছে তখন ওর বয়স এগারো আর আমার বয়স তহন বাইশ।আমারে দেখলে ডরে শাশুড়ীর পিছনে লুকাইতো।সেই বউরে ডর না দেখাইয়া ভালোবাসা দিয়া জয় করছি।তোমার এহন কাম হইলো বউরে ডর না দেহাইয়া ভালোবাসা দেহানো।মাইয়া মানুষরে বল দিয়া না ভালোবাসা দিয়া জয় করতে হয়।বউয়ের কাছে যাও গিয়ে বুঝাও।’

নানার কথায় সায়নের মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করে। কলাপাড়ে চলে যায় গোসল করতে।গোসল সেরে না খেয়েই ঘর থেকে বের হয়ে যায় কাউকে কিছু না বলে।
মাস্টার বাড়ির উঠানে আসলে সায়ন কাউকে দেখতে পায় না।ঘরের দরজায় কয়েকবার করাঘাত করলে সাবিনা দরজা খুলে। সায়ন সালাম দিলে সাবিনা তাকে নিয়ে বসার ঘরে বসায়।

‘আপনাদের কিছু কথা জানানোর ছিলো।আপনারা নিশ্চয়ই খবর শুনেছেন গতরাতে অমিত সহ কয়েকজন ছেলেকে কে জানি মে*রে হাসপাতালে পাঠিয়েছে?ওদের আমিই পিটিয়েছি। মা*রা*র কারণ গতরাতে রাইকে অপমান করেছে সেটা না অন্য কারণও আছে।আমি যেদিন গ্রামের আসি সেদিন রাতে আপনাদের উঠানে একটা ছেলেকে ঘুরাঘুরি করতে দেখি।এরপর পরের দিন রাতের বেলাও এসে ছেলেটাকে দেখি আপনাদের বাসায় উঁকি দিতে। সুযোগ বুঝে ছেলেটাকে ধরলে জানতে পারি অমিত তালুকদার আপনাদের বাড়িতে ওকে নজর রাখতে বলেছে।অমিত নাকি সুযোগে ছিলো বাসা ফাঁকা পেলেই দলবল নিয়ে এসে রাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার।’,সায়ন বিস্তারিত ঘটনা সাবিনাকে বলে।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মারিয়া সব শুনতে থাকে। আলেয়া বেগম এনে নাশতার ট্রে রাখে।

‘কি সাংঘাতিক ব্যপার।হেই লইগাই ঐ রাইতে উডানের বালতি ভর্তি পানি মাডিতে পইড়া আছিলো।’,আলেয়া বেগম সে রাতের ঘটনা মনে করে বলে।

‘হতে পারে পালাতে গিয়ে কোনো ভাবে পানি ভর্তি বালতির সাথে ধাক্কা খায় আর পানি মাটিতে পড়ে যায়।তবে এখন আর চিন্তা নেই ওদের এমন শিক্ষা দিয়েছে আর কখনোই এ বাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।’,সায়ন আলেয়া বেগমকে আশ্বস্ত করে বলে।

‘ভালা করছো এমনেও আমাগো মারুরে জ্বালাইতো ওরা।ওগো যন্ত্রণায় অতিষ্ট হইয়া গেছিলাম।’,আলেয়া বেগম বিরক্ত হয়ে বলে।

‘রাই কেমন আছে?ও এখন সুস্থ? কখন উঠেছে?ওর সাথে কি এখন দেখা করা যাবে?’,একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে সায়ন।

‘হ্যা ও সুস্থ কিন্তু তোমার লগে দেখা করবার চায় না।তুমি নাশতা কইরা চইলা যাও আর এই বাড়ি আইবা না।’,মুখ ঘুরিয়ে সাবিনা কথাগুলো বলে।

‘রাই নিজে এসব বলেছে? আমি তো বিরক্ত করতে আসিনি শুধু একবার দেখে চলে যাবো।আমাকে ও যদি বলে আমি আর এ বাড়ি আসবো না কিন্তু ওর কাছ থেকে শুনতে চাই।’,সায়ন উতলা হয়ে বলে।

‘হ ও কইছে।এহন ঘুমাইতেছে রুমে তুমি পরে আইসো।’

সাবিনার কথার মধ্যে ভরসা করতে পারে না সায়ন।বসা থেকে উঠে রাইদার ঘরের দিকে বড় বড় কদম ফেলে যায়। রুমে গিয়ে রাইদাকে না দেখে সায়নের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

‘রাই কোথায়? ওর লাগেজ ও নেই।খালামনি রাই চলে গেছে?’,রেগে জিজ্ঞেস করে সায়ন।

সাবিনা কোনো জবাব দেয় না।রাইদা বারবার নিষেধ করে গেছে যাতে সায়নকে তার ফোন নাম্বার, ঠিকানা কিছুই না দেওয়া হয়।এমনকি আজকে যে সে ফিরছে সেটাও যাতে সায়ন না জানতে পারে।রাইদার কথা রাখতেই সাবিনা চুপ করে আছে।

‘তিনটার দিকে লঞ্চ ঘাটে যাওয়ার লইগ্গা বাহির হইছে তুমি এহন গেলে পাবা ওরে।লঞ্চ ছাড়তে মেলা দেরি আছে।’,মাইমুনা এসে জবাব দেয়।

‘ওর ফোন নাম্বার বা ঠিকানা কিছু থাকলে দেন প্লিজ।’,সায়ন দুই হাত জোর করে সাবিনাকে বলে।

সাবিনা সায়নকে এড়িয়ে ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।মাইমুনা জানায় তার কাছে ফোন নাম্বার নেই।
সায়ন পাগলের মতো ছুটে ঘর থেকে বের হয়।ফোন বের করে উঠানে দাঁড়িয়ে জাহিদকে কল দিয়ে বলে একটা বাইক নিয়ে আসতে।কল কেটে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়। রাগে সায়নের হাত পা কাঁপছে। রাইদার উপর না চাইতেও সে রেগে যাচ্ছে। একটা সিগারেট শেষ করেই আরেকটা ধরায়।

‘শাড়ীডা আপা থুইয়া গেছে আপনার কাছে রাইখা দেন আর আমার কাছে আপার এই নাম্বারটা আছে নেন। ‘,কথাগুলো বলে মারিয়া সায়নের হাতে শাড়ী আর কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ঘরে চলে যায়।

কাগজটা খুলে সায়ন দেখে একটা ফোন নাম্বার।পকেট থেকে ফোন বের করে কল দেয় কিন্তু নাম্বার বন্ধ। একের পর এক কল দিতেই থাকে কিন্তু নাম্বার বন্ধই দেখায়।
জাহিদ বাইক নিয়ে এলে সায়ন ছুটে লঞ্চ ঘাটে । লঞ্চ ঘাটে এসে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথাও রাইদাকে পায় না। দুপুর থেকে একটা লঞ্চ ও এখনো ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়েনি। ঢাকার উদ্দেশ্য যে সকল লঞ্চ এখন ছেড়ে যাবে সব কয়টায় খোঁজ করে কিন্তু কোথাও রাইদার দেখা মেলে না।

রাইদাকে খুজেঁ না পেয়ে মাঝ রাস্তায় বসে পরে সায়ন। হুট করে তার মনে হয় বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে একবার খোজঁ নেওয়া দরকার। বাইক নিয়ে ছুটে বাস স্ট্যান্ডে।
বাস স্ট্যান্ডে গিয়েও সায়নকে খালি হাতে ফিরতে হয়।বিকালের বাস সে যাওয়ার অনেক আগেই চলে গেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যার পর সায়ন বাড়ি ফিরে রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে পরে।

রাইদার শাড়ীটা বুকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।আগে তো শুধু রাইদার প্রতি ভালোবাসা ছিলো কিন্তু কোনো সম্পর্ক ছিলো না দু’জনের। গতরাতে বিয়ে হওয়ার পর সায়নের এখন নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। রাইদাকে হারানোর ভয়ে সায়ন কাবু হয়ে গেছে। শোয়া থেকে উঠে বসে শাড়ীটা পাঞ্জাবির উপর রেখে একটা সিগারেট ধরায়।চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে কি করা যায়।

সিগারেটটা ফেলে সায়ন রুমের দরজা খুলে বের হয়। বসার ঘরে গিয়ে দেখে যামিনী, শ্রেয়া,রুবেল,সানজিদা,জাহিদ,সায়নের নানা বসে আড্ডা দিচ্ছে।

‘আমরা কালকে সকালেই ঢাকা ফিরছি তোরা নিজেদের লাগেজ গুছিয়ে নে।’,যামিনী, শ্রেয়া আর রুবেলের উদ্দেশ্যে বলে সায়ন।

‘কাইলই ফিরবা? আরো কয়ডা দিন থাইকা যাও।’,সায়নের নানা বসা থেকে উঠে এসে সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে বলে।

‘কীভাবে থাকি বলো নানাভাই আমার বউ যে ঢাকা ফিরে গেছে আমায় না বলেই।বর হিসেবে এখন আমার দায়িত্ব বউয়ের সাথে ছায়ার মতো থাকা।আমি কথা দিচ্ছি আবার আসবো সাথে করে বউকে নিয়ে আসবো।’,সায়ন তার নানাকে জড়িয়ে বলে।

‘রাই ঢাকা ফিরে গেছে?মেয়েটার কি অবস্থা কে জানে।আমি আরো ভেবেছিলাম কালকে ওকে দেখতে যাবো।’,যামিনী চিন্তিত হয়ে বলে।

‘আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো হবে।’,রুবেল বলে।

সায়ন তার নানাকে ছেড়ে জাহিদকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।


বাস থেকে নেমে একটা সিএনজি ভাড়া করে রওনা দেয় রাইদা। ঢাকার জ্যামে আটঁকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে।
ফাহিমের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে কলিংবেলের সুইচ টিপ দেয়। কয়েক মিনিট পর ফাহিম নেমে আসে উপর থেকে। গেটের তালা খুলে দিতেই রাইদা লাগেজ রেখেই সাইড ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ফাহিম গেটে তালা দিয়ে রাইদার লাগেজ নিয়ে পিছন পিছন উপরে উঠে।

দরজার সামনেই ফাহিমের মা দাঁড়িয়ে ছিলো।রাইদা এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে।

‘কতদিন পর তোমাকে দেখলাম,শান্তি লাগতেছে।আমার মেয়েটা একদম শুকিয়ে গেছে। ‘
ফাহিমের মায়ের কথা শুনে রাইদা হেঁসে দেয়।

‘হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।ফাহিমকেও ডাকো ও খায়নি।’
রাইদা মাথা নাড়িয়ে বাথরুমে চলে যায়। ফাহিমের মা নিজের ছেলের থেকেও ওর বন্ধু বান্ধবীদের বেশি ভালোবাসে।সবাইকে নিজের ছেলে মেয়ের চোখে দেখে।রাইদাকে তো নিজের মেয়ে বলেও দাবি করে। রাইদার বাসায় মন না টিকলে কিংবা কোথাও যাওয়ার জায়গা না হলে ফাহিমের বাসায় এসে ওর মায়ের সাথে গল্প করে।

গোসল করে চুল মুছতে মুছতে রাইদা ডাইনিং রুমে আসে।তোয়ালেটা মাথায় পেচিয়ে চেয়ার টেনে বসে যায় খেতে।পাশের চেয়ারে খাবার সামনে নিয়ে ফাহিম ফোন টিপছে।

‘সকালে তুই অর্ককে মেসেজ না দিয়ে আমাকে মেসেজ দিলেই পারতি।’,ফোনের দিকে তাকিয়ে ফাহিম বলে।

‘তোর তো ঠিক ঠিকানা নেই কখন ঘুম থেকে উঠবি কেউ জানে না তাই অর্ককে মেসেজ দিয়ে বলেছি তোকে যাতে কল করে জানায় আমি তোর বাসায় এসে উঠবো।’,রাইদা প্লেটে খাবার নিয়ে জবাব দেয়।

‘তোর ফোন বন্ধ পেয়ে অর্ক কল দিয়েছে নে কথা বল।’,নিজের ফোন রাইদার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ফাহিম।

‘কল কেটে গ্রুপ কল দিতে বল সবার সাথেই কথা বলি।’

রাইদার কথা মতো ফাহিম গ্রুপ কল দেয়।ফোনটা রাইদার সামনে রাখে।সকলে কল রিসিভ করে রাইদাকে দেখতে পায়।

‘কিরে তুই কি টেনশন দিয়ে আমাদের মা*র*তে চাস?ফোন বন্ধ কেন তোর? ‘,অর্ক রেগে জিজ্ঞেস করে।

‘চার্য নেই ফোনে।’,খেতে খেতে রাইদা জবাব দেয়।

‘তাই বলে সারাদিন বন্ধ থাকবে?’,বাপ্পি বলে উঠে।

‘আরে বাদ দে তো চলেই এসেছে এখন ফোন কেনো বন্ধ ছিলো সে সব জিজ্ঞেস করে রাইয়ের মাথা খাচ্ছিস কেনো?’,পায়েল বিরক্ত হয়ে বলে।

‘তুই চুপ কর তোরে জিজ্ঞেস করছি?’,বাপ্পি পায়েলকে ধমক দিয়ে বলে।

‘কালকে সকালে দেখা হচ্ছে তখন তোকে বুঝাবো।’,পায়েল বাপ্পির কথার জবাবে বলে।

‘তোর ফিরতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? সব ঠিক ঠাক ছিলো?’,রুহি জিজ্ঞেস করে।

খাওয়ার মাঝেই রাইদা অন্য মনস্ক হয়ে যায়।গত রাতের কথা মনে পড়ে। বন্ধুদের কাছে পুরো বিষয়টা জানাবে না বলে ঠিক করে।

‘কিরে জবাব দিচ্ছিস না কেনো?’,ফাহিম রাইদাকে ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করে।

‘কই কি হইছে?কিছু বলছিলি?’
রাইদার এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।

‘তোকে বললো কি আর তুই জবাব টা দিলি কি?মাথা ঠিক আছে তোর?’,বাপ্পি জিজ্ঞেস করে।

‘এত জার্নি করে এসেছে তাই হয়তো ঘুম চোখে উল্টো পাল্টা বলছে।মেয়েটারে খেয়ে ঘুমাতে দাও আর তোমারও ঘুমাও। একদম সকাল সকাল সবাই চলে আসবা নাশতা বানিয়ে আমি রেডি করে রাখবো।’,ফাহিমের মা রাইদার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে।

ফাহিমের মায়ের কথা মতো কল কেটে দেওয়া হয়।রাইদা খাবার খেয়ে গিয়ে ফাহিমের মা ফিরোজার সাথেই ঘুমায়।

(চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here