সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -২৬+২৭

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৬

“ছেলেটা কে? যার জন্য উতলা হয়ে কাঁদছো!”

নোভা বিস্মিত হলো না। তার দাদাভাই তো এমনই। ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত মুখে বলার আগেই প্রতিটি স্পন্দন অনুভব করতে পেরেছে। পেরেছে প্রতিটি যন্ত্রণা, আনন্দ এবং প্রয়োজন বুঝতে। নোভা গাল বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া নোনাজলের উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু ঘুরল। দুই হাতের সাহায্যে মুছে ফেলার চেষ্টা করে পুনরায় আবরারের দিকে ঘুরে নিচের তাকিয়ে বলল,
“কেউ না দাদাভাই। এমনি ভাল লাগছে না। তাই কান্না পাচ্ছে।”
আবরার পরম যত্নে বোনের মুখটা দু’হাতে আগলে নিল। একহাত মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“দাদাভাই সব বুঝতে পারে সোনা। কে সে?”
নোভা ফুঁপিয়ে উঠল। এক মিনিট, দু’মিনিট যেতেই তা রূপ নিল গলা ফাটানো চিৎকারে। ভাইয়ের বুকে আঁছড়ে পরে মনের সবটুকু আক্ষেপ মিটিয়ে কাঁদল নোভা।সবটুকু দুঃখ ঝরিয়ে দিল দাদাভাই নামক মানুষটার বুকে।

আবরার বাঁধা দিল না। কেবল আগলে রাখল বুকের গভীরে। আদরে, মমতায়, ভালবাসায়।

কিয়দংশ সময় পর কান্নার বেগ কমে এলো। আবরার সময় দিল নিজেকে সামলে নেওয়ার, ধাতস্থ হওয়ার।
বুক থেকে মাথা তুলে চোখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিল। পুনরায় দু’হাতের আঁজলায় মুখ তুলে নরম গলায় বলল,
“বলবে না দাদাভাই কে? দাদাভাই সব ঠিক করে দেবে। দাদাভাই তো ম্যাজিক জানে, তাই না?”
নোভা আবরারের হাতের উপর হাত রেখে নিচু গলায় বলল,
“রিফাত ভাই।”
আবরার তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে গেল। শুভ্র চেহারা মূহুর্তেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে তার। দু’হাত মুঠো করে নিজের রাগ দমন করতে চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে নোভার দিকে তেড়ে এলো। দু’হাতের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“কতদিন ধরে চলছে এসব? আগে বলিস নি কেন আমাকে? কিছু বলিনা বলে খুব বাড় বেড়েছিস তাই না? সাহস কি করে হলো এসব করে বেড়ানোর? সারাদিন ওর সাথেই ছিলি তুই তাই তো? ছিহ্ নোভা ছিহ্! এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে?”
নোভা কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“ওর সাহস হয় কি করে আমার বোনের দিকে হাত বাড়ানোর! ওর হাত আমি আজ ভেঙে গুড়িয়ে দেব। যে পাতে খাচ্ছে সেই পাতই ছিদ্র করেছে ও। আমার ভালবাসা, আমার মায়ের ভালবাসার এই প্রতিদান দিল ।ওর সাথে আমার বোঝাপড়া করতে হবে। আজই, এক্ষুণি। আসছি আমি রিফাত। তোর বেঈমানীর শাস্তি দিতে আমি আসছি।”
নোভা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই নোভার গালে কসিয়ে চড় বসিয়ে দিল। ইভানা এসে আবরারের হাত ধরে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আবরার! আপনি! এটা কি করে করলেন আপনি? বোনের গায়ে হাত তুললেন? ছিহ!”
আবরার ইভানার দিকে রক্তচক্ষু করে তাকাতেই নোভা সামনে এসে দাঁড়াল। দু’হাত দু’দিকে মেলে বলল,
“ভাবীকে কিছু বলবে না। ভুল আমি করেছি। যা বলার আমাকে বলো।”
আবরার নোভার বাহু ধরে বলল,
“তোকে কিচ্ছু বলব না আমি। যাকে বলব তার কাছেই যাচ্ছি।”
নোভা করুণ গলায় বলল,
“রিফাত ভাইকে কিছু করবে না তুমি দাদাভাই।”
আবরার শক্ত গলায় বলল,
“লাশ ফেলে দেব।”

নোভা চেঁচিয়ে উঠল।
“নাহ। কিচ্ছু করবে না তুমি দাদাভাই।”
আবরার হকচকিয়ে গেল।
“কাকে কি করব না আমি? কি হয়েছে আপুনি? কি বলছো তুমি?”
নোভা চোখ বন্ধ করে আবার খুলল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। সবটাই তার স্বপ্ন ছিল। দিবা স্বপ্ন। জাগ্রত স্বপ্ন।
আবরার পুনরায় তাড়া দিল।
“বলবে না দাদাভাই কে?”
নোভা আবরারের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করল। দু’হাতে আঁকড়ে ধরল দাদাভাইয়ের হাত দু’টো।
মাথা নিচু করে নরম গলায় বলল,
“মাফ করো আমাকে দাদাভাই। তার নাম বলার ক্ষমতা আমার নেই। বলতে পারতাম যদি সে আমাকে ভালবাসতো। সে-ই তো আমাকে ভালবাসে না। তবে এত আড়ম্বর করে তার নাম বলে কি হবে? থাক না সে একান্তে, গোপনে।”
আবরার অবাক চক্ষে তাকাল। বোনটা তবে বড় হয়ে গেল!
নোভার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে পাশে বসল আবরার। ঠিক এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল ইভানা। হাতে ধরে রাখা ট্রে-তে দুইমগ কফি। আবরার সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
নোভার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল,
“ওই যে মেয়েটাকে দেখছ, তাকে ঠিক কত দিন ধরে মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছিলাম জানো? আট আটটা বছর। একটা দুটো দিন নয় নোভা, দুহাজার নয়শত বাইশ দিন। ঠিক কতগুলো ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড অতিবাহিত হয়েছে জানো? হাজার হাজার, লক্ষ, কোটি প্রহর আমি অপেক্ষা করেছি তার। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ভালবেসেছি একান্তে, নীরবে। সে নিজেও জানত না কেউ তাকে ভালবেসে গভীর আগ্রহ নিয়ে বসেছিল। হয়তো এখনো জানে না। বোঝে না ভালবাসার গভীরতা। এত এত অনিশ্চয়তার মাঝেও ভালবাসতে এতটুকু কার্পণ্যতা করিনি আমি। রোজ নিয়ম করে ভালবেসেছি। বেনিয়মে ভালবেসেছি। হয়তো সে অন্য কাউকে ভালবাসতে পারতো, হয়তো সে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতো, হয়তো সে আমার নাও হতে পারতো। তবুও কিন্তু আমি ভালবেসেছি নোভা। তার সম্মতি না পেয়েও। এটা ভেবে যে হয়তো একদিন সে আমার হবে। আমাকে ভালবাসবে। শতশত ক্রোশ দূরে থেকেও আমি আমার ভালবাসার উপর ভরসা রেখে ভালবেসেছি তাকে। আজ থেকে কাল আরও একটু বেশি। পরশু আরও খানিকটা বেশি। এভাবেই চলেছে ছয়টি বছর। তুমি এক দেশে, এক শহরে থেকে ভরসা রাখতে পারবে না? ভালবাসতে পারবে না? ভালবাসা ভালবাসাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে আপুনি। হোক সেটা মানুষ অথবা পাথর। সত্যিকারের ভালবাসা কখনো বিফলে যায় না। যদি মানুষটা সঠিক হয় তবে তুমি তাকে ভালবাসো। ভালবাসতেই থাকো। একদিন নিশ্চয়ই ফিরে পাবে সেই ভালবাসা। দ্বিগুণ হারে ফিরে আসবে । আর যদি মানুষটা সঠিক না হয় তবে ফিরে এসো। ফিরে এসো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে। সঠিক ভালবাসা যেমন প্রাণ বিস্তার করে তেমনি ভুল ভালবাসা প্রাণনাশও করে। তাই যা করবে ভেবেচিন্তে করবে, ঠিক আছে?”
নোভা মুচকি হেসে মাথা নাড়াল।
ভেজা গলায় বলল,
“তুমি ম্যাজিশিয়ান দাদাভাই।”
আবরার বোনের কপালে আদুরে চুমু এঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
আদুরে কণ্ঠে বলল,
“শুধু তোমার জন্য।”
নোভা চোখ ঘুরিয়ে ইভানার দিকে তাকাল। ইভানা অনিমেষ তাকিয়ে আছে আবরারের দিকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে চিন্তা ভাবনার উর্ধ্বে বিচরণ করছে।
নোভা নিচু গলায় বলল,
“দাদাভাই, ভাবী বোধহয় তব্দা খেয়েছে।”
আবরার হেসে বলল,
“বেচারি!”
নোভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
আবরার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কারো নজর না লাগুক আমার পুতুলটার হাসিতে।”

নোভা মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমাকে খুব মিস করব দাদাভাই। তুমি একেবারে চলে আসো না প্লিজ।”
আবরারের মনটাও বিষাদ ভারাক্রান্ত হলো। চোখেমুখে নেমে এলো বিষাদের ছায়া।
তবুও নিজেকে শক্ত করে বলল,
“মাত্র তো ছয়টা মাস সোনা। তারপর তো আবার দাদাভাই চলে আসবে। তাছাড়া রিফাত তো আছে। ও খেয়াল রাখবে তোমাদের।”
নোভার মলিন মুখটা আরও মলিনতায় ছেয়ে গেল। কান্নারা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলেও গিলে ফেলল তৎক্ষনাৎ।

শহরের বুকে লোকে লোকারন্য স্থানে অবস্থিত ফ্ল্যাটটাও নির্জনতায় মুড়ে আছে। সাথে বিষাদে মুষড়ে আছে রিফাত নামক প্রেমিক পুরুষটি। নোভা চলে যাওয়ার পর থেকে নিস্তব্ধ পরিবেশে গুমরে গুমরে কাঁদছে সে। নাহ, শব্দ হচ্ছে না, চোখে জল ঝড়ছে না। কাঁদছে কেবল অন্তরাত্মাটা। কাঁদছে শূন্য হৃদয়টা। কাঁদছে হাহাকার করা খা খা মরুভূমির ন্যায় বুকটাও। বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। আবছা রোশনাইয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে নিজের ধ্বংস স্তুপ। ওই তো কাপুরুষের ন্যায় ছুটে বেড়াচ্ছে বেহায়া মনটা। ওই তো দেখতে পাচ্ছে সে। নিয়নের আলোয় আলোকিত পথে কাল কুচকুচে অবয়বটাই তো…

“আমায় ওই হলদে রঙের রাজ্যে নিয়ে যাবেন?”
আবরার ভ্রুকুটি করে তাকাল।
ইভানা আঙুল উঁচিয়ে দূরের রাস্তা দেখিয়ে বলল,
“ওই যে নিয়নের আলো। ওই তো হলদে পৃথিবী। হলদে রাজ্যের রানী করবেন আমায়? প্লিজ আজকের জন্য। কাল তো চলেই যাবেন। তখন কে আবদার করবে? সেই তো বন্দী খাঁচার পাখি হয়ে বাঁচতে হবে আমায়।”
আবরার মলিন হাসল। হাত বাড়িয়ে দিল ইভানার দিকে। মুখে বলল,
“চলুন ম্যাম। আপনার আদেশ শিরোধার্য।”
ইভানা বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত রাখল।
আবরারের দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলল,
“ভালবাসলে কি বুকের ভেতর ভূমিকম্প হয় ?”

চলবে…#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ২৭

“ভালবাসলে কি বুকের ভেতর ভূমিকম্প হয়?”
ইভানার কথা শুনে আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিঞ্চিৎ সময় পর মুচকি হাসল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ইভানার ভাষায় হলদে রাজ্যে।

চওড়া রাস্তা। দুই পাশে ল্যামপোস্টে মিটিমিটি জ্বলছে হলদে রঙের আলো। কৃত্রিম আলোয় রাস্তাটাই হয়ে উঠেছে মায়াপুরী, মায়ারাজ্য।
ইভানা মুগ্ধ দৃষ্টিতে রাতের শহর দেখছে। নিয়নের আলোয় এক সময়ের ব্যস্ত নগরীর ঘুমন্ত রূপ অবলোকন করছে। ঠিক যেন ঘুমন্ত এক চঞ্চল শিশু। যে জেগে গেলেই মাতিয়ে রাখবে হৈ-হুল্লোড়ে।

চলতে চলতে ইভানা আবরারের দিকে তাকাল। চোরা চোখে বার বার দেখতে লাগল শুভ্র মুখখানা। আবরার বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। ইভানা পুনরায় তাকাতেই হুট করেই নজর ফেলল আবরার। ঠিক ইভানার চোখ বরাবর। ধরা খেয়ে খুকখুক করে কেশে উঠল ইভানা। লজ্জায় ঝিমিয়ে গেল।
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“আমি আছি তো। চলে যাচ্ছি না আজই। বাড়ি গিয়ে দেখ।”
ইভানা মলিন কণ্ঠে বলল,
“কাল তো যাচ্ছেন।”
আবরার পকেটে গুঁজে রাখা একটা হাত বের করে স্বীয় কপালের বা’পাশে বুলিয়ে বলল,
“মিস করবে আমাকে? খারাপ লাগছে তোমার?”
ইভানা মাথা নিচু করে ফেলল। কি বলবে সে!
আবরার নতজানু মুখটা তুলে ধরল আঙুলের সাহায্যে। থুতনিতে শাহাদত আঙুল ছুঁয়ে বলল,
“তাকাও। বলো না মিস করবে?”
ইভানা মলিন হাসল। সাথে তাল মিলিয়ে হাসল আবরারও। চিবুকে হাত গলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“মাত্র ছয়টা মাস। প্লিজ সহ্য করে নাও। পরেরবার সাথে নিয়ে যাব। তোমার জীবনটা স্বপ্নের ন্যায় সাজিয়ে দেব।”
ইভানা মলিন কণ্ঠে বলল,
“সেই তো তিনটে মাস। তারপর তো সব আগের মত।”
আবরার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল,
“তুমি যাবে আমার সাথে? সারাজীবনের জন্য?”
ইভানা মৌনতা পালন করল। আবরার উত্তর পেয়ে গেল। তাই আর ঘাঁটাল না। মেয়েটা তো আগেই বলেছিল দেশ ছাড়বে না।

আকাশে পূর্ণ চাঁদ ঝলমল করছে। ঠিক একটা কাঁসার থালার মত। ইভানা চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আজ পূর্ণিমা। চাঁদের মধুচন্দ্রিমা।”
আবরার অবাক হয়ে তাকাল।
“তুমি কি করে জানলে? চাঁদেরও মধুচন্দ্রিমা হয়? সত্যি?”
ইভানা জ্ঞানীদের মত বলল,
“চাঁদ আজ পূর্ণ যৌবনা। দেখছেন না সব রূপ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চাঁদের মধুচন্দ্রিমা হবে না কেন? চাঁদ দেখেই পৃথিবীর মানুষগুলো এত রোমান্টিক হয়ে যায়। রচনা করে কতশত কবিতা, উপন্যাস। তাহলে স্বয়ং চাঁদ কেন বিবাগী থাকবে? সত্যি সত্যি হয় চাঁদের মধুচন্দ্রিমা।”
আবরার কিঞ্চিৎ ভেবে বলল,
“প্রতি মাসে একবার?”
“হ্যা” ইভানার সরল স্বীকারোক্তি।
আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসল। কণ্ঠে দুষ্টুমি বজায় রেখে বলল,
“চাঁদটা কত ভাগ্যবান। মাসে মাসে তার মধুচন্দ্রিমা হচ্ছে। আর আমার মত অধম কে দেখ, বছরেও হবে কি-না সন্দেহ । তোরই দিন ভাই চাঁদ। চালিয়ে যা।”
ইভানা চোখ ছোট ছোট তাকিয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ পর বলল,
“চাঁদ ভাগ্যবান নয়, ভাগ্যবতী। নারীদের চাঁদের সাথে তুলনা করা হয়। তাহলে চাঁদও নারী।”

“তাহলে তো চাঁদের বরের চাঁন কপাল।”

ইভানা ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকাল। হেসে বলল,
“চাঁদ কে মামা বলা হয়। সেদিক থেকে সে কিন্তু পুরুষও হয়। তাহলে ভাবুন চাঁদের বউ কত ভাগ্যবতী।”

আবরার ভাবুক হলো। কিঞ্চিৎ ভেবে বলল,
“এই তুমি কি আমাকে সিডিউস করতে চাইছো? নাকি আমাকে আনরোমান্টিক বলতে চাইছো কৌশলে?”

ইভানা ঠোঁট টিপে হাসল। ঢিল একদম জায়গা মতো লেগেছে। ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
“ওমা, আমি এসব বলেছি নাকি? কখন বললাম?”
আবরার ইভানার বাচনভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
“তুমি বহুত দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো কাঁচাগোল্লা।”
ইভানা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
“আপনি আমাকে এভাবে ক্রাশ খাওয়াতে পারেন না।আমি ব্রাশ করে আসিনি।”
আবরার ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কি বলছো জোরে বলো। আমার পিন্ডি চটকাচ্ছ?”
ইভানা হেসে বলল,
“নাহ! পিন্ডি চটকানো ছেড়ে দিয়েছি।”

“কেন? প্রেমে পড়েছো?”

“উঁহু। ইভানারা প্রেমে পড়ে না।”

“তবে?”

ইভানা খানিকটা সময় নিল। ধীরে ধীরে বলল,
“ভালবাসে।”
“দুটোর মধ্যে পার্থক্য?”
“আমায় ভুলে যেতে পারবেন? পারবেন আমার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে? যদি আমি কখনো না থাকি তখন অন্য কাউকে নিয়ে সাজাতে পারবেন নতুন সংসার?”

আবরার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না।
ইভানা পুনরায় বলল,
“আপনি জানেন, ভালবাসার রঙ কি?”
আবরার মৃদুস্বরে বলল,
“লাল!”
ইভানা মুচকি হাসল। ধীর কণ্ঠে বলল,
“লাল রঙটা ভীষণ উজ্জ্বল, উজ্জীবিত। লাল রং দেখে ঝাঁকে ঝাঁকে অলিরা উড়ে আসে। লাল রং সহজেই মানুষ কে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। তাই লাল রং দেখে প্রেমে পড়াটা খুব সহজসাধ্য। অন্য দিকে ধূসর রং! ভীষণ বিবর্ণ। উজ্জ্বলতা নেই মোটেও। এই রং দেখে উড়ে আসে না অলির ন্যায় প্রেমিক পুরুষগুলো। এই রং দেখে কেবল তারাই প্রেমে পড়ে, যারা প্রকৃত পক্ষে ভালবাসার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। রীতিমতো ধারণ করে বুকের গভীরে। তারাই কেবল ধূসর রঙের প্রেমে পড়ে। তাই প্রেমের রং লাল হলেও ভালবাসার রং আসলে ধূসর। এটাই প্রেম আর ভালবাসার পার্থক্য। ঠিক যতটা পার্থক্য লাল আর ধূসরের মধ্যে । তবে কিছু ক্ষেত্রে লাল রংটা সময়ের সাথে সাথে বিবর্ণ হয়ে যায়। প্রেম থেকে রূপ নেয় ভালবাসায়।”

আবরার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যাকে ভালবাসার ময়দানে নিতান্তই বাচ্চা ভেবেছে, সে আসলে ততটাও বাচ্চা নয়। ভালবাসার অভাব বোধহয় এক জীবনে তাকে বুঝতে হবে না।

ইভানা মৃদুস্বরে বলল,
“এজন্য ইভানারা প্রেমে পড়ে না। তারা ভালবাসে। ধূসর রঙে আকৃষ্ট প্রেমিক পুরুষদের।”

“আপনি ধূসর রঙের আমিটাকে ভালবাসতে পারবেন তো? যদি কখনো সাদা চামড়াগুলো কুঁচকে যায়। নেতিয়ে যায় সমস্ত শরীর। যে চোখে চোখ পড়লে আপনি পুলকিত হন, হাজার বছর কাটানোর স্বপ্ন দেখেন যে চোখে চেয়ে সে চোখ যদি অন্ধ হয়ে যায়। যদি আপনাকে আর স্বপ্ন দেখাতে না পারে। যদি টানটান শরীরটায় কাটাছেঁড়া দাগ পড়ে, যদি মসৃণ হাতদুটো মসৃণতা হারিয়ে ফেলে, খসখসে, অনুজ্জ্বল হয়ে যায় সিল্কি চুলগুলো। সেদিনও ভালবাসবেন এভাবে? নাকি লাল রঙের পেছনে ছুটবেন নতুন করে? নতুন কারো স্বপ্নে বিভোর হবেন?”

আবরার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
“আমার কি রাগ করা উচিৎ?”

“কেন? আমি রাগের কথা বলেছি?”

“বলো নি?”

“উঁহু।”

“তবে এগুলো কি ছিল? আমার ভালবাসাকে সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছো তুমি।”

“এটা সন্দেহ নয়। এটা আমার জানার কৌশল। আমাকে তো জানতে হবে আপনার ভালবাসার পরিধি।”

“আমি রং চিনি না ইভানা। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কোনোটাই না। আমি জানি না কোনটা ভালবাসার রং, কোনটা ঘৃণার রং। আমি চিনি কেবল তোমাকে আর আমার বুকের বা পাশে ঢিপঢিপ করতে থাকা হৃদপিণ্ডের কম্পন কে। যা তোমার কাছে এলেই দ্বিগুণ হারে দৌড়ায়। আবার তোমার কাছে এলেই শান্ত হয়। তাই বিবর্ণ বা ধূসর কোনোটাই আমার কাছে ম্যাটার করে না। আমার কাছে আসল কেবল তোমার হাসিমুখ। দিনশেষে এটাই তো প্রাপ্তি। আমি তোমার সাথে বুড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখি কাঁচাগোল্লা। কুঁচকে যাওয়া চামড়া সেখানে আবশ্যিক। তুমি যখন, যেভাবে থাকো সেভাবেই আমি একটা কথাই বলব ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। যার কোনো পরিধি নেই। সীমা পরিসীমা নেই। আছে কেবল গভীরতা, মাদকতা আর উন্মাদনা।”

ইভানার ঠোঁট জোড়া খানিকটা প্রসারিত হলো। ওষ্ঠদয়ের কোণে শোভা পেল সরু হাসির রেশ। বক্ষস্থলে বয়ে গেল শীতল হাওয়া। যা ভালবাসার রং ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।

“তুমি আছ আমি আছি তাই
অনুভবে তোমারে যে পাই।”
নোভার কর্ণকুহরে বাজছে সেই মনোলোভা কণ্ঠের মনোগ্রাহী সুর। নিজের উপর বিরক্ত হলো সে। যে মানুষটা তাকে দু’পয়সার দাম দেয় না। তার ভালবাসাকে চার আনার সম্মান দেয় না। তাকে ভালবেসে সন্যাসিনী হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। তবুও বেহায়া মনটা বারবার উচাটন করছে। পুড়ছে তার জন্য। দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আলমারিতে তুলে রাখা সবগুলো রঙিন জামা বের করে বিছানায় ছড়িয়ে দিল। একে একে সবগুলো বের করে আলমারির সামনে থেকে সরে এলো। বড় একটা ব্যাগ খুঁজে গুনে গুনে ভেতরে ঢোকালো। এরপর লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল চিৎপটাং হয়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here