সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব -৩২+৩৩

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৩২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

এত সকাল বেলা আব্রাহাম’কে দেখে চমকে গেল আয়াতে’র আম্মু। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে, আব্রাহাম’কে ভেতরে আসতে বলল। আব্রাহাম ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল। জানি অবাক হয়েছেন আম্মু। আসলে আয়াত’কে নিয়ে অনেক বাজে স্বপ্ন দেখেছি। তাই একটু দেখার জন্য চলে আসলাম। কাউকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আমি এক নজর আয়াত’কে দেখেই চলে যাব।

–আয়াত’কে দেখা পরে হবে। কালকে রাতে রজনীর জন্য তোমার সাথে ঠিকমতো কথা বলা হয়ে উঠেনি। আয়াত বাসায় নেই। তোমাকে রান্না করে খাওয়াবে কে? আমি সকালে উঠে সবার জন্য খাবার তৈরি করেছি। এখন তুমি খাবে। তারপরে আয়াতে’র সাথে দেখা করতে যাবে। আয়াত নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। এত চিন্তিত হবার কিছু নেই। আয়াত নিরাপদ রয়েছে। চলো তোমাকে খেতে দেই। না হলে সারাদিন না খেয়ে থাকবে। আয়াতে’র আম্মুর ব্যবহারে মুগ্ধ হলো আব্রাহাম। কি সুন্দর ব্যবহার তার। এমন ভাবে কথা বলছেন। যেনো আব্রাহাম তার নিজের ছেলে। আয়াতে’র আম্মু আব্রাহাম’কে খাইয়ে দিয়ে, একটু শান্তি পেলেন। আব্রাহাম’কে আয়াতে’র রুমে যেতে বলে, তিনি সবাইকে ডাকতে গেলেন। আব্রাহাম আয়াতে’র রুমে আসলো। আয়াত ওয়াশরুম থেকে, ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে হাতে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হলো। আব্রাহাম’কে দেখে তার মুখে আঁধার ঘনিয়ে এলো। এই সময়ে আব্রাহাম’কে মোটেও প্রত্যাশা করে নাই। আব্রাহাম ছুটে আয়াতে’র কাছে যাবার চেষ্টা করল। আব্রাহাম’কে এগোতে দেখে, আয়াত দু’কদম পিছিয়ে গেল। থেমে গেল আব্রাহাম। মেয়েটা কাল থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেনো? তার কোনো কারন খুঁজে পেল না। কাতর স্বরে বলল।

–তুমি আমার সাথে এমন করছো কেনো? তোমার অবহেলা আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমার অবহেলা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। কালকে কি এমন হয়েছিল। যার কারনে তুমি আমাকে অবহেলা করছো?

–তুমি ভুলে গিয়েছো আব্রাহাম। তোমাকে বলে ছিলাম না। তুমি আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছো। ঠিক ততটাই কষ্ট তোমাকে অনুভব করাবো। তারপরে তোমাকে কাছে টেনে নিব। তাহলে এখন সহ্য করতে পারছো না কেনো?

–আগে তোমাকে দেখলে, আমার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে যেত। তোমার হাসিমাখা মুখখানা আমাকে এক আকাশ পরিমাণ মানসিক শান্তি দিত। কিন্তু কাল থেকে আমি তোমার থেকে সেই শান্তিটা পাচ্ছি না। আমি তোমার চোখের দিকে তাকালে, তোমার চোখের ভাষা বুঝে ফেলতাম। এখন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে, তোমার চোখের ভাষা বুঝতে পারছি না। আগে তুমি আমার আশেপাশে থাকলে, অদ্ভুত এক সুন্দর অনুভূতি কাজ করতো। কাল থেকে আমার অনুভূতি গুলোও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না আয়াত।

–জানো আব্রাহাম মানুষের ভালোবাসা চিরদিন থাকে না। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা কমতে শুরু করে দিয়েছে। তাই তুমি আগের মতো আমাকে অনুভব করতে পারছো না। অনুভূতি কমে গিয়েছে, তাহলে বুঝে নিতে হবে। ভালোবাসাটা ও আর আগের মতো নেই।

–অসম্ভব! আমার ভালোবাসা এতটা তুচ্ছ না। যে এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। আমার ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলে, আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিতে পারতাম। তোমাকে কত নির্জন স্থানে পেয়েছি। তুমি আঘাত পাবে। এমন কোনো কাজ কখনো করেছি। তোমাকে বিয়ে করেছি। কখনো স্বামীর অধিকার চেয়েছিলাম। তোমার হাত পর্যন্ত ধরতে আমার বুক কাঁপত। আজকে তুমি কি কথা শোনালে আয়াত। আমি সত্যিই এতটা খারাপ। আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায় না। আমি কি ভালোবাসার পাবার যোগ্য না৷ আচ্ছা তুমি আমার সেই আয়াত তো যে, আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। আমাকে কষ্ট দিতে গিয়ে, নিজেই হেরে যেত। আমার কষ্টে কান্না করে ফেলতো। আমি তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না আয়াত। এক রাতের ব্যবধানে তুমি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছ।

–সকাল সকাল কি সব ভুলভাল বকছো? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার? রাতে ঘুমাওনি? সকালে খেয়েছো কিছু? আয়াতে’র কথার মধ্যে এবারও অস্থিরতা খুঁজে পেল না আব্রাহাম। এই আয়াত তো আব্রাহামে’র অস্থিরতায় অস্থির হচ্ছে না। তবে কি আবরার ভাইয়ার ভালোবাসা দেখে, আয়াতের মন মানসিকতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিজের ভাবনাকে নিজেই ধিক্কার জানালো আব্রাহাম। নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। সেই বা হঠাৎ এমন পাগলামি করছে কেনো? কেনো এত অস্থির হচ্ছে, কেনো ভেতরটা হাহাকারে ভরে গিয়েছে। আব্রাহাম’কে অন্যমনস্ক দেখে আয়াত কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করছে।

রজনীর ঘুম ভেঙে আবরার’কে পাশে দেখতে পেয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ঘুমের রেশ এখনো ভালোভাবে কাটেনি। আবরারের মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। চেহারায় মলিনতা এসে ধরা দিয়েছে। যে মানুষ’টা তাকে ভালো রাখার জন্য নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। সে তাকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। আজকে বুক চিরে কান্না আসছে রজনীর। চাইলেও নিজের শক্ত রাখতে পারছে না। পাশে থাকা স্বামী নাম মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে কান্নাই করে ফেলল। রজনীর মনে হচ্ছে কতদিন পরে মানুষটাকে দেখলো। এতটুকু দেখে মনটা ভরলো না। মানুষটাকে মনের গভীরে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কষ্টরা যেনো তার সন্ধান না পায়। রজনীর কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আবরারের। সারারাত রজনীর পাশে বসেছিল। ভোরের দিকে কখন যে, চোখটা লেগে এসেছিল। তা জানা নেই আবরারের। রজনীর কান্না দেখে অস্থির হয়ে উঠে বসলো। রজনীকে-ও তুলে বসালো। রজনীর দু’গালে হাত রেখে, চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল।

–আমার বউটার কি হয়েছে। এভাবে কান্না করছে কেনো? এভাবে কান্না করো না। তুমি এমনিতেই অসুস্থ। শরীর আরো খারাপ করবে। আবরারের আদুরে কণ্ঠে বলা কথা গুলো রজনীর কান্নার বেগ কমিয়ে দিল। রজনী আবরার’কে অবাক করে দিয়ে আবরারের মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলল। আবরার কেমন জানি শীতল হয়ে উঠলো। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, রজনী তাকে এতটা ভালোবাসে। কথায় আছে না ধৈর্যের ফল সব সময় ভালো হয়। আবরারের ধৈর্যের ফল আল্লাহ তায়া’লা তাকে এত সুন্দর করে দিবে। তা আবরার কখনো কল্পনা ও করতে পারে নাই। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল। আজ নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ বলে মনে হচ্ছে। অপেক্ষার ফল সব সময় মিষ্টিই হয়। আবরার রজনী’কে রাগানোর জন্য বলল।

–সত্যি করে বলো মেয়ে, তুমি সত্যি রজনী তো? আমার কেনো জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি করে বলো, আমার বউকে কোথায় রেখে এসেছো। তুমি আমার বউয়ের রুপে অন্য কেউ না তো আবার। আবরার’কে অবাক করে দিয়ে, রজনী রাগ করল না। আবরার’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল।

–আমি অনেক খারাপ তাই না। তোমাকে খালি কষ্ট দিয়েছি। তোমাকে কখনো বোঝার চেষ্টা করি নাই। তুমি আমাকে ভালোবেসে শুধু কষ্টই পেয়েছো। স্ত্রী হিসেবে আমি ব্যর্থ। আমার জন্য তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছো। অথচ তোমাকে পাবার জন্য আমি কোনো চেষ্টাই করি নাই। আমারই দোষ কি বলো। আমি কি জানতাম। এই ঝগড়ুটে ছেলে টাকে আমি ভালোবেসে ফেলবো। যাকে এক সময় দু-চোখে সহ্য করতে পারতাম না। তাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাকে ছাড়া এক মুহুর্ত কল্পনা করতে পারি না। তুমি আমার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছো আবরার। তুমি আমার অস্তিত্বে মিশে গিয়েছো। তোমাকে ছাড়া থাকা এক মুহুর্ত সম্ভব নয়। আমি যতগুলো দিন বাঁচব। তোমার সাথে বাঁচতে চাই। তোমাকে ভালোবাসতে চাই। তোমাকে ভালোবাসে বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দিবে, তোমাকে ভালোবাসার। রজনীর কথা গুলো শুনে আবরারের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আজকে আবরারের নিজেকে সার্থক বলে মনে হচ্ছে। গভীর ভাবে রজনী’কে নিজের সাথে মিলিয়ে রেখেছে। রজনী আরো কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু রজনীর শরীরের অবস্থা ভালো না দেখে, আবরার রজনীকে রাগাতে বলল।

–হয়েছে আর ভাষণ দিতে হবে না। মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসছে। যাও গিয়ে ব্রাশ করে আসো মেয়ে। আবরারের কথা শুনে মুখ ফুলালো রজনী, মুখটা গম্ভীর করে ওয়াশরুমে চলে। কত সুন্দর করে ভালোবেসে কথা গুলো বলছিল। তার অনুভূতিতে এভাবে পানি ঢেলে দিল আবরার। শা’লা বুইড়া আমি জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। আনরোমান্টিক কোথাকার। তোমার কপালে বউ জুটতো না। রজনী জন্য তোমাকে বিয়ে করেছে। রজনী’র শুনে আবরার হাসতে লাগলো। তবে একটু অভিমান হলো, তাকে বুড়ো বলল, আবার আনরোমান্টিক ও বলল। বউ তুমি আগে সুস্থ হয়ে নাও। তারপরে বোঝাবো আবরার চৌধুরী কি জিনিস। বলে সে-ও ফ্রেশ হতে চলে গেল। দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছে, রজনী আবরার’কে দেখে মুখ বাকিয়ে অন্য দিকে ঘুরলো। রজনী’র কান্ড দেখে আবরারের প্রচুর হাসি পাচ্ছে, তবে এখন হাসা চলবে না। বউ তাকে বুইড়া, আনরোমান্টিক বলেছে। প্রতিশোধ নিতে হবে। দু’জন মিলে, ফ্রেশ হয়ে বেড়তেই আয়াতে’র আম্মু খাবারের জন্য ডেকে চলে গেল। হঠাৎ করেই রজনীর আয়াতে’র কথা মনে পড়লো। চিন্তিত হয়ে বলল।

–আমার কাছে আয়াত গিয়েছিল। জানো আহনাফ ভাই আয়াত’কে থাপ্পড় মেরেছে। আমি রেগে কড়া কথা শোনাতে যাচ্ছিলাম। তখনই আহনাফ ভাই আমাকে সেন্সলেস করে ফেলে। পরে কি হয়েছে মনে করতে পারছি না। আয়াত কোথায়? আমার বোন ঠিক আছে তো?

–তুমি চিন্তা করো না। আয়াত একদম ঠিক আছে। তুমি আয়াত’কে ফোন করে জানিয়ে ছিলে না। আয়াত বুদ্ধি করে সাথে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। তারাই তোমাকে আর আয়াত’কে উদ্ধার করেছে। তোমার আর আয়াতে’র বুদ্ধি আছে মানতে হবে। আহনাফ ভাইকে পেলে আমি ছাড়বো না। কথা গুলো বলতে বলতেই আবরারের দু-চোখ রক্তিম বর্ন ধারণ করল। আবরারের দু-চোখ বলে দিচ্ছে, আহনাফের সাথে দেখা হলে, কিছু একটা হবে। হঠাৎ করেই আবরার বলে উঠলো। আহনাফ ভাই আয়াত’কে মেরেছে এই কথা আব্রাহাম’কে জানানোর প্রয়োজন নেই। যা করার আমি করবো। কথা গুলো বলেই দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করল। রজনী একা একা বলতে লাগলো।

–আমি তো আয়াত’কে ফোন দেই না৷ তাহলে সবাই কেনো বলছে আমি আয়াত’কে ফোন দিয়েছি। আয়াতই বা আমার খোঁজ পেল কি করে? সবকিছু কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভিষণ ভাবে রজনীর মাথার ওপরে চাপ পড়লো। সে আর ভাবতে পারলো না। সে-ও আবরারের পিছু পিছু চলে গেল।

আয়াত’কে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করেই আব্রাহাম আয়াতে’র কাছাকাছি চলে আসলো। তবে আয়াত’কে স্পর্শ করল না। একবার আয়াত’কে একবার নিজেকে দেখছে। তার আর আয়াতের মাঝে সে কিছু একটা কমতি খুঁজে পাচ্ছে। আব্রাহামে’র এমন আচরণ দেখে, আয়াত কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলো। দ্রুত আব্রাহামে’র থেকে দূরে সরে আসলো। আব্রাহাম মলিন হাসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল।

–আমি কাছে আসলেই এভাবে দূরে সরে যাও কেনো? আমার শরীরে ছোঁয়াচে রোগ আছে নাকি? আয়াত অপ্রস্তুত হয়ে বলল।

–তেমন কিছু না। তুমি আমার অনুমতি ছাড়া আমার কাছে আসবে না। আপাতত তোমার কাছে আসাটা আমি পছন্দ করছি না। আয়াতে’র কথা শুনে হতাশ হলো আব্রাহাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।

–সে আমি যাবই তুমি চাইলেও তোমার কাছে যাব। তুমি না চাইলেও আমি তোমার কাছে যাব। আগে তো আদুরে বেড়ালের মতো আমার সাথে মিলে থাকতে, এখন আমার ছোঁয়া তোমার পছন্দ নয়। তবে কার ছোঁয়া তোমার পছন্দ।

–আব্রাহাম!

–চিৎকার করো না মেয়ে, তুমি যতটা না ভয়ংকর। তার থেকে দিগুণ ভয়ংকর আমি। আগুন নিয়ে খেলতে এসো না। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ধংস করে দিব তোমাকে। আব্রাহামে’র শীতল কণ্ঠে বলা কথাটা আয়াতে’র পুরো শরীর কাঁপিয়ে তুলল। আব্রাহাম কখনো আগে তার সাথে এভাবে কথা বলেনি আজ হঠাৎ তার কি হলো। আয়াত আব্রাহাম’কে অবাক করে দিয়ে একটি ভয়ংকর কথা বলে ফেলল।

–তুমি যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা করো। তাহলে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে। আয়াতে’র কথা শুনে, মলিন হাসলো আব্রাহাম। আয়াত’কে বিকেলে বাসায় যেতে বলে, বুক ভারি করা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।

চলবে…..#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

রজনী এখন আগের থেকে মোটামুটি সুস্থ হয়েছে। রজনী আবার চৌধুরী বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। আয়াত নিজের বাসায় ফিরে এসেছে। তবে আয়াত সময়ের সাথে অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। প্রয়োজন ছাড়া আব্রাহামে’র সাথে কথা বলে না। সব সময় আব্রাহামে’র চোখের আড়ালে থাকে। দু’জনের মধ্যে বেশ দুরত্ব তৈরি করছে ফেলছে আয়াত। দু’জন এখন আলাদা রুমে ঘুমায়। আব্রাহামে’র এতে কোনো আক্ষেপ নেই। ভালোবাসার মানুষ’টা কাছে রয়েছে, দিনশেষে তার পাশে রয়েছে। এতেই তার শান্তি। আয়াত নিজের রুমে মনমরা হয়ে বসেছিল। তখনই আয়াতে’র ফোনটা বেজে উঠলো। আয়াত ফোনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। পুরো শরীর ভয়ে অবশ হয়ে আসছে। ফোন’টা রিসিভ করবে কি-না ভেবে পাচ্ছে না আয়াত। ফোনটা একবার বেজে বেজে কেটে গেল। আবার আয়াতে’র ফোনটা বেজে উঠলো। আয়াত এবার কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে, ফোনটা রিসিভ করল। আয়াত ফোন রিসিভ করতেই কারো রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এলো।

–ফোন তুলতে এত সময় লাগে? আমার থেকে দূরে গিয়ে খুব সাহস হয়ে গিয়েছে তাই না? তোমার সাহস কিভাবে কমাতে হয়। সেটা আমার ভালো করে জানা আছে। এখনো আব্রাহাম’কে মারছো কেনো?

–আমি আব্রাহাম’কে মারতে যাব কেনো? আমি আব্রাহাম’কে মারতে পারবো না। যার চোখে আমি আমার জন্য অস্থিরতা দেখেছি। যার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। তাকে আমি কি করে নিজ হাতে মারবো। এই কাজ আমি করতে পারবো না। আমাকে এতটা নিকৃষ্ট কাজ করতে বলো না। আমি আব্রাহাম’কে মারতে পারবো না। আয়াতে’র কথা শেষ হবার সাথে সাথে, ওপর পাশ থেকে কিছু অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ হলো আয়াতে’র ওপরে। আয়াত রাগে-ক্ষোভে দু-চোখ বন্ধ করে নিল। ইচ্ছে করছে মানুষটা’কে মাটির নিচে পুঁ’তে ফেলতে। কিন্তু তার কাছে কোনো উপায় নেই। সে নিরুপায়। ভেতরটা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আব্রাহাম’কে নিজ হাতে খুন করবে। ভাবতেই পুরো শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। আয়াত’কে নিশ্চুপ থাকতে দেখে, অপর পাশ থেকে শাসিয়ে বলল।

–নিজের বোন’কে জীবিত অবস্থায় পেতে চাও। নাকি মৃত দেহটা প্যাকেট করে পাঠিয়ে দিব। আগন্তুকের কথা শুনে, আয়াতে’র অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। মানুষ’টা কতটা ভয়ংকর তা সে বুঝে গিয়েছে। কিন্তু আব্রাহাম’কে সে কি করে মারবে। আয়াতে’র মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠান্ডা মাথায় ভেবেও আয়াতের শূন্য মস্তিষ্ক কাজ করতে চাইছে না। মস্তিষ্ক কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। আয়াতে’র ছটফটানি দেখতে না গেলেও ওপর পাশ থেকে আয়াতে’র নিরবতা দেখে পৈশাচিক হাসি হাসলো। একটু হলে-ও মেয়েটাকে পথে নিয়ে আসতে পেরেছে। আয়াত অনেকক্ষণ যাবত কিছু বলছে না দেখে, আগন্তুকটি রেগে বলল।

–আব্রাহামে’র হসপিটালের ছাদে রেলিং নেই। কালকে হসপিটালে গিয়ে, আব্রাহাম’কে ছাদে নিয়ে যাবে। আব্রাহাম’কে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাবে। দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। তুমি শুধু আব্রাহাম’কে ছাদ থেকে ফেলে দিবে। বাকিটা আমি বুঝে নিব। বলেই আগন্তুক কল কেটে দিল। কল কেটে যাবার সাথে সাথে আয়াত কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে কি করে আব্রাহাম নামক মানুষটা’কে নিজ হাতে মেরে ফেলবে। আয়াত জ্ঞান শূন্য হয়ে নিজের চুল দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছে।

রাতে আব্রাহাম বাসায় এসেছে। আব্রাহাম’কে দেখেই আয়াত দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। আব্রাহাম দরজা পর্যন্ত পৌছানোর আগেই সে দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল। আয়াতে’র ব্যবহারে আব্রাহাম গভীর ভাবে আহত হচ্ছে, তবে আয়াতে’র মুখের দিকে তাকিয়ে, আয়াত’কে কড়া কথা শোনাতে পারছে না। আব্রাহাম দরজার কাছে এসে নরম কণ্ঠে বলল।

–তুমি আমাকে দেখলে, এভাবে পালিয়ে পালিয়ে যাও কেনো? আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না। আমি এতটাই ভালোবাসার অযোগ্য। আমি যে আর নিতে পারছি না আয়াত। অনেক হয়েছে। এই শাস্তির খেলা বন্ধ করে দাও। একসাথে থেকে-ও কাছাকাছি আসতে পারছি না। বিষয়টি আমাকে ভিষণ করে পিড়া দিচ্ছে। তুমি আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলে না। আমি কষ্ট পেয়েছি। তুমি আমাকে যতটা কষ্ট দিতে চেয়েছিলে। তার থেকে দিগুণ কষ্ট তোমার অবহেলা আমাকে দিচ্ছে। এই যে তুমি আমার সাথে কথা বলো না। তোমার এই নিরবতা আমাকে ভিষণ করে পোড়ায়। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না আয়াত। এবার তো দয়া করো। নাকি মূল্য বেশি পেয়েছো বলে, আমাকে সস্তা ভাবা শুরু করে দিয়েছো। আব্রাহামে’র কথা গুলো আয়াতে’র বুকের ভেতরটায় দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে, আয়াত দু’হাতে মুখ চেপে ধরে রেখেছে। আব্রাহাম আরো কিছুক্ষণ কথা বলে, একাই চলে গেল। বাসাটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। কেউ বলবে এই বাসায় দু’জন মানুষ থাকে। প্রতিদিনের মতো আজকে ও দু’জনের খাওয়া হলো না।

পরের দিন সকাল বেলা আবরার হসপিটালে যাবার জন্য তৈরি হতে যাচ্ছিল। তখনই রজনী আবরারের হাত ধরে ফেলে। আজকে আবরারের হসপিটালে যাওয়া চলবে না। আজকে সারাদিন রজনীর সাথে থাকতে হবে। কিন্তু আবরার’কে হসপিটালে যেতেই হবে। কতদূর থেকে মানুষ এসে, তার অপেক্ষায় বসে আছে। আজকে যদি সে না যায়। তাহলে তারা সবাই ঘুরে চলে যাবে। বিষয়টি সত্যি দৃষ্টি কটু দেখায়। বিনা কারনে কেনো সে সবাইকে ফিরিয়ে দিবে। এভাবে সে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। আবরার রজনীর দু’গালে হাত রেখে বলল।

–পাগলামি করো না। আমি তোমার জন্য রাতে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। সব সময় তাড়াতাড়ি বাসায় আসার চেষ্টা করি। সবাই কতদূর থেকে এসেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের কত বড় বড় সমস্যা। একজন ডক্টর হয়ে, বিনা কারনে রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়। তারা বিপদে পড়েই আমাদের কাছে আসে। আজ তাদের জায়গায় যদি আমাদের বাবা-মা থাকতো। তাহলে তুমি ঠিক একই ভাবে বলতে পারতে। আবরারের কথা রজনী বুঝতে পারলো। ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগলে-ও বাহিরে প্রকাশ করল না। হাসিমাখা মুখ করে বলল।

–আচ্ছা ঠিক আছে যাও। আবরার রজনীর মন খারাপ বুঝতে পারলো। তবে তার কিছু করার নেই। দু’হাতে রজনী’কে নিজের সাথে মিলিয়ে নিল। রজনীর ললাটে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে চলে গেল। রজনী বই নিয়ে পড়তে বসলো।

ছাদের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে আব্রাহাম। কতদিন পরে আয়াত আব্রাহামে’র কাছে বায়না ধরলো। প্রেয়সীর অবদার নিকোচ করার সাধ্য তার আছে। আয়াত মুক্ত পাখির মতো ছাদের চারপাশে গোল হয়ে ঘুরছে। আব্রাহাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহর দেখায় ব্যস্ত। আজকাল তার চোখ দু’টোও যেনো আয়াত’কে মন ভরে দেখতে চায় না। তবে কি আয়াতে’র কথাই সত্য। মানুষের ভালোবাসা চিরদিন থাকে না। আব্রাহাম’কে অন্য অন্যমনস্ক হতে দেখে, আয়াত আব্রাহামে’র দিকে নিঃশব্দে এগোতে লাগলো। এগোতে এগোতে আব্রাহামে’র অতি নিকটে চলে আসলো। আব্রাহাম’কে ধাক্কা দিতে যাবে। তার আগেই আব্রাহাম সরে দাঁড়ালো। আয়াত পড়ে যেতে নিলে, আব্রাহাম আয়াতে’র হাত ধরে ফেলল। আয়াত ভয়ে দু-চোখ বন্ধ করে নিল। আয়াতে’র ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো আব্রাহাম।

–আমাকে মারতে চাও বললেই পারো। নিজেই তোমার জন্য জীবন দিয়ে দেই। এত ছলনা করার কি আছে। আমাকে তোমার বাচ্চা মনে হয়। তোমাকে এত মিডিল ক্লাস বুদ্ধি কে দিয়েছে। কাউকে খু’ন করতে চাইলে, শান্ত মস্তিষ্কে খু’ন করতে হয়। এটা তোমার জানা নেই। আমার থেকে খু’ন করা শিখবে। এটা কিন্তু আমি ভালো পারি। এখন যদি আমি তোমার হাত ছেড়ে দেই। তোমার ছোট শরীরটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে। এই বুদ্ধি নিয়ে আসছো আমাকে মারতে। আমার সাথে যুদ্ধ করতে হলে, তোমাকে আরো বুদ্ধি অর্জন করতে হবে। শুধু শুধু নিজের সময় নষ্ট করলে, সাথে আমারও। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারি না। তোমার বোন পালিয়ে গেল। এখন তার স্বামী তাকে, খু’ন করার হুমকি দিচ্ছে, আর তুমি আমাকে সোজা খুন করতে চলে আসলে? কেমন মেয়ে তুমি নিজের স্বামীর চেয়ে বোনের দরদ বেশি। ভালোবাসি বলেই সহ্য করছি। আমার মতো করে কেউ তোমাকে সহ্য করবে না। বলেই আব্রাহাম চলে গেল। ধরা পড়ে গিয়ে আয়াত অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে রইলো। সত্যি মানুষটা’কে বেশি আঘাত করে ফেলল। আয়াত আর ভাবতে পারলো না। নিচে নেমে আসলো। বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে, পুরো রুম অন্ধকার করে দিল।

অন্ধকার রুমের মধ্যে হাতে স্যালাইন অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে একটা মেয়ে। আকাশ নিঃশব্দে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল। এক পলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, পাশে থাকা বৃদ্ধ মহিলাটি’কে বলল।

–মেয়েটির জ্ঞান এসেছিল খালা? কিছু খেয়েছে? এভাবে থাকলে মেয়েটা মারা যাবে। তাদের বাসার কারো খোঁজ মিলল। এভাবে অচেনা একটা মেয়েকে কতদিন আমাদের বাসায় রাখবো। আমার বউও তো নেই। আমার বউয়ের বোনের বিয়ে, সেখানে গিয়েছে। এই মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে, আমি আমার পরিবারকে কষ্ট দিয়ে ফেলছি। কিছু একটা করুন খালা।

–তুমি অনেক ভালো মানুষ আকাশ বাবা। তা-না হলে অচেনা একটা মেয়ের জন্য কেউ এতটা করে। তুমি এমনিতেই গরীব মানুষ। মেয়েটার জন্য তোমার কত টাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেল। মেয়েটার পরিবারের কারো খোঁজ পেলে, তারা হয়তো তোমাকে কিছু টাকা দিয়ে দিত। তুমি চিন্তা করো না। তুমি বিয়ে বাড়িতে যাও। এই মেয়ের দেখাশোনা আমি করবো। বয়স হয়ে গিয়েছে। কোনো কাজ কাম নেই। একা একা সময় কাটে না। আমি না হয় এই মেয়ের দেখাশোনা করবো।

–আমি টাকার চিন্তা করি না খালা। টাকা চলে গেলে টাকা আবার আসবে। কিন্তু একটা জীবন চলে গেলে, সেই জীবন আর ফিরে আসবে না। না জানি কোন বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে। তার বাবা-মা হয়তো চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আকাশের কথা শুনে মহিলাটি কিছু একটা ভেবে বলল।

–আমি একটা কথা বলি বাবা। তুমি মেয়েটার ছবি তুলে, চারিদিকে ছড়িয়ে দেও। মেয়েটার বাবা-মা দেখলে অবশ্যই তাদের মেয়েকে নিতে আসবে। বৃদ্ধের কথা শুনে, মুখটা গম্ভীর হয়ে আসলো আকাশের রাগান্বিত চোখে তাকালো বৃদ্ধের দিকে। আকাশকে কড়া চোখে তাকাতে দেখে বৃদ্ধ মহিলাটি মাথা নত করে নিল। আকাশ নিজের রাগ দমিয়ে নিয়ে বলল।

–তোমার কোনো ধারন আছে খালা। আজকাল মানুষ কতটা খারাপ হয়। মেয়েটির বাবা-মায়ের বদলে মেয়েটিকে অন্য কেউ নিয়ে যায়। তখন আমরা কি করবো। ওর আসল বাবা-মায়ের কাছে কি জবাব দিব। এসব কথা একটা বার ভাবলে না খালা। আকাশের কথায় সত্য তা আছে। বৃদ্ধ মহিলাটি ভেবে বলল।

–তুমি ঠিক কথা বলেছো। আমি আগে ভেবে দেখি নাই। আমি হলাম গিয়ে মূর্খ মানুষ। তুমি শিক্ষিত মানুষ। তোমার চিন্তা ভাবনার সাথে আমার চিন্তা ভাবনা তাই মিলে বাবা।

–খালা আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আবার যেতে হবে। তুমি কিছু মনে না করলে, আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে। অনেক দূর থেকে এসেছি তো। তাই গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে। আকাশের কথা শুনে, মহিলাটি এক মুহুর্ত দেরি করল না। পানি আনার জন্য বাহিরে চলে গেল। মহিলাটি চলে যাবার দিকে তাকিয়ে আকাশ আনমনে হেসে উঠলো। তারপরে পকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করল। আরেক পকেট থেকে একটা ঔষধের বোতল বের করল। সেখানে থেকে সামান্য ঔষধ নিয়ে মেয়েটির স্যালাইনের মধ্যে দিয়ে, হাসতে হাসতে চলে গেল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here