#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
৪র্থ_পর্ব
~মিহি
রাফসানকে বেশ কয়েকবার বলার পরও রাফসান অভিকে যেতে দিল না। তার কথা একটাই একটুপর সবাই যাবে, অভিও তখনই যাবে। অভি আর কিছু বললো না। একটু পর সবাই বের হওয়ার জন্য উঠলো। অভি আশেপাশে তাকালো। নাহ! মীরা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে এলো সে। উপরে জানালার দিকে তাকাতে খুব ইচ্ছে হলো কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে বিদায় নিল সবার থেকে।
অভি কি জানালার দিকে তাকাবে? নাহ, তাকালো না। যাক, বাঁচলাম। খালুর বাড়ির সবাই চলে যাওয়ার পরপরই আমি শাড়ি বদলে ফেললাম। ভেবেছিলাম মায়ের শাড়ি পড়ার জন্য আমায় কথা শুনতে হবে, তেমন কিছুই হলো না। বাড়ির পরিবেশ একেবারে শান্ত, সবাই ক্লান্ত। খালামণিও আর আমার সাথে কথা বলতে আসেননি। রাতে খেতে ডেকেছিলেন শুধু, আমার ইচ্ছে নেই বলে দিয়েছিলাম। খালামণি বেশ ক’বার জোর করার পরও যাইনি আর। আমার এ মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। আমি ভুল করেছি, মারাত্মক বড় একটা ভুল। নতুন করে আর কোনো ভুলে নিজেকে আমি জড়াতে চাই না। রাতে আর ঘুম হলো না, সারারাত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নির্ঘুম রাত অতিবাহিত হলো।
ভালোবাসলে মানুষ ঠিক কতটা ছটফট করে আমি সেই নির্ঘুম সময়টাতে বুঝেছিলাম। শ্রাবণকে আমি ভালোবাসতাম কিন্তু সেটা আমি আর শ্রাবণ ব্যতীত কেউ জানতো না। শ্রাবণ বিবাহিত এটা না জেনেই আমি ভালোবেসেছিলাম তাকে। কিন্তু এখন তো জানি সে বিবাহিত তবুও কেন তার প্রতি এত টান? নিজের স্বার্থের জন্য অন্য কারো ঘর আমি ভাঙতে পারবোনা, কখনোই না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জানালার দিকে তাকালাম, নিচে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে। মনে হলো সবটুকুই আমার কল্পনা। কিন্তু পরমুহূর্তেই খেয়াল করলাম শ্রাবণ আমাকে ডাকছে। আমার কি যাওয়া উচিত? নাহ! আমি কোনোভাবেই যাবো না। ওর সাথে আমার কোন কথা নেই আর।
মায়া জিনিসটা বড্ড ভয়ঙ্কর, ভালোবাসার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। মায়া কাটিয়ে উঠতেই আমি ব্যর্থ হলাম, ভুলটা সেখানেই হলো। ভোরবেলা এখন, কেউ ঘুম থেকেই উঠেনি। আমার তো নির্ঘুম রাত কাটে রোজ। ধীর পায়ে নিচে নামলাম। ভালো করে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করলাম, কেউ নেই। সবটাই আমার কল্পনা। এত নিষ্ঠুর কেন হয় কল্পনাগুলো? যন্ত্রণার তীব্রতায় একটা গগণবিদারী চিৎকার দিতে ইচ্ছে হলো কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। প্রকৃতি কি চরম মাত্রার পরিহাস করছে আমার সাথে? করুক না, আমিও কষ্ট পেতে ভালোবাসি।
__________________________________________
একটু আগেই রাফসান কল করেছিল তিথিকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। তিথি একা গেলে মীরা বাসায় একা হয়ে যাবে ভেবে তিথি মানা করলো। রাফসান অবশ্য মীরাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে কিন্তু মীরা কি রাজি হবে? রাফসানের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে তিথির ভালোই লাগবে কিন্তু মীরাকে ফেলে না। তিথি ঠিক করলো মীরাকে সাথে নিয়েই যাবে। তিথি রাফসানকে টেক্সট করে জানিয়ে দিল সে মীরাকে সাথে নিয়ে আসবে।
“মীরু শোন,” কিছু একটা ভাবছিলাম। খালামণির কথায় ধ্যান ভাঙলো। খালামণির দিকে তাকালাম। অদ্ভুত সুন্দর হাসি খালামণির ঠোঁটে। স্বাভাবিক ব্যপার! ভালোবাসার সম্পর্ক পূর্ণতা পেলে মানুষ অকারণেই অনেক বেশি হাসে আর অপূর্ণ থাকলে অনেক বেশি হাসার ভান করে।
– “মীরু, তুই তৈরি হ। তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো আজ।”
– “কোথায়?”
– “পরে বলবো। তুই আগে তৈরি হয়ে নে।”
– “নানুমণি রাজি হবে?”
– “সেসব আমি দেখবো।”
খালামণি আমার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলেন। আমিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। আমারো ঘরে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, একটু খোলা হাওয়া দরকার যেখানে প্রাণভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবো। ব্যাগ থেকে এখনো কাপড়-চোপড় বের করিনি আমি। কী ভেবে যেন সাদা রঙের একটা সালোয়ার-কামিজ বের করলাম। আজকাল সাদা পড়তে একটু বেশিই ভালো লাগে। সাদার মাঝে অন্যরকম একটা শুভ্রতা আছে, মনকে প্রশান্তি দেয়।
রেডি হয়ে বের হবো এমন সময় আবারো চোখ গেল ডায়েরিটার দিকে। খোলা জানালার দমকা হাওয়ায় ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো পরপর পাল্টাচ্ছে। হাতে নিলাম ডায়েরিটা। দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতেও আগের মানুষেরই হাতের লেখা,
“আজ দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। না তুমি জানতে আর না আমি। কাকতালীয়ভাবে হওয়া এই সাক্ষাৎটা আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি। আমি কখনো তোমায় নিয়ে এসব আশা করিনি। হ্যাঁ আমার মনে কিছুটা অনুভূতি আছে তোমায় নিয়ে, সেজন্যই সরাসরি তোমায় না বলে চুপি চুপি ডায়েরি লিখি।”
অদ্ভুত তো! এটা কি কোন গল্প নাকি কারো জীবনের বাস্তব ঘটনা? আরও কিছু ভাবার সময় পেলাম না। খালামণি ডাকতে শুরু করেছে। আমি নিচে নামলাম। আমার বেরোনো নিয়ে কেউ কিছু বললো না কিন্তু নানুমণির নির্লিপ্ত চোখের ভাষাটা আমি ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারছিলাম না তখনো।
___________________________
– “এটা ঠিক কী ঘটলো আমাদের সাথে?”
– “তেমন কিছু না, মিয়া-বিবি তাদের প্রাইভেসির জন্য আমাদের বলি দিয়ে গেল।”
– “ধূর! এর চেয়ে ভালো আমি বাড়িতে থাকতাম।”
– “আমার সাথে থাকতে বুঝি খারাপ লাগছে?”
– “না তো আঙ্কেল।”
– “এক থাপ্পড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে! মানা করছিনা আঙ্কেল বলতে? বাংলা বুঝেন না?”
– “আপনার মতো বুড়োকে আমি ভাইয়া কিংবা নাম ধরে ডাকতে পারবোনা।”
অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। নীরবতাই ভালো, কথা চললেই ঝগড়া হয়। এর চেয়ে চুপ থাকা ভালো না? “তুমি বসো, আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।” কথাটুকু বলেই অভি উঠে গেল। এই শীতে আইসক্রিম আনতে গেল? এই ছেলের সাধারণ জ্ঞানটুকুও নাই?
অভির উপর থেকে ধ্যান সরিয়ে সামনে তাকালাম। একমুহূর্তের জন্য আবারো নিজের চোখকে অবিশ্বাস হলো। সামনে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে, একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আবারো ভুল দেখছি না তো আমি? বারবারই কেন আমি এ ভ্রমে পড়ছি?
আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। শ্রাবণ এসে আমার হাত ধরে পার্কের এককোণে নিয়ে গেল। আমি তখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শুধু।
– “মীরা, আমার কথা শোনো প্লিজ।”
– “হাত ছাড়েন আমার।”
– “মীরা, আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার বউ-বাচ্চা, এসব একটা ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল। আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
– “আর কত নাটক শ্রাবণ? আটটা মাস পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম তোমায়, চেয়েছিলাম তোমার হতে কিন্তু তুমি তো শুরু থেকে শুধু প্রতারণাই করে এসেছো।”
– “তোমায় ভালো না বাসলে আমি কেন এখানে আসতাম তোমার জন্য একটাবার ভেবে দেখো পারলে। যদি মনে হয় আমার কথা তুমি শুনবে তাহলে আমার নাম্বারে কল দিও।”
শ্রাবণ চলে গেল। আমি আর পারছিনা, চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। যন্ত্রণার মাত্রাটা কি সীমা অতিক্রম করে ফেললো তবে? কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। কেন শ্রাবণ, কেন? আমার ভালোবাসার এই মূল্য দিলে আমি? ছিঃ! আমি কোনটাকে ভালোবাসা বলছি? আমি একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে ফেলেছি, কত বড় পাপ করে ফেলেছি আমি! নিজের উপর ঘৃণা লাগতে শুরু করলো তখন। আচমকা কেউ একজন কাঁধে হাত রাখলো। আমায় উঠে দাঁড় করালো। মাথা ঘুরছে তখন আমার, চারপাশ ঝাপসা দেখছি। চোখের পানি বাঁধা মানছে না। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। শুধু একটা জিনিস অনুভব করলাম, কেউ খুব যত্নে আমায় আলিঙ্গন করলো কিন্তু সে যত্নের গভীরতা মাপার মতো শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো অবস্থাই আমার তখন ছিল না।
চোখে পানির ছিটে পড়লো। ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই অভির উদ্বিগ্ন চেহারাটা মুখের সামনে ভেসে উঠলো। আমায় চোখ খুলতে দেখে সে কী প্রশান্তি পেল আমার জানা নেই তবে তার চোখজোড়া তৃপ্তির ছোঁয়া পেল। অভিকে নিয়ে আপাতত আমার ভাবতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু একরকম জোর করেই অভি আমার মস্তিষ্কে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। আচ্ছা, শ্রাবণ কী বলতে চায় আমাকে? ও কি সত্যিই ভালোবাসে আমায়, নাহলে কেন আসতো আমার খোঁজে? আমার কি উচিত ওকে কল করা?
চলবে…
[