সে এক মনগড়া প্রেমকাব্য পর্ব -০৫

#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
৫ম_পর্ব
~মিহি

– “মীরা, ঠিক আছো তুমি?”

– “হুহ।”

– “কী হয়েছে এখন বলো আমায়। তুমি ওখানে ঐভাবে বসে ছিলে কেন আর একটু আগে যেই ছেলে তোমার সাথে কথা বলছিল, সেটা কে? তুমি চেনো ওকে?”

– “ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ওর নাম শ্রাবণ, আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম। কখন কীভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলাম কেউই বুঝিনি, আটমাস প্রেমের পর আমার কাকার মাধ্যমে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে কিন্তু বিয়ের দিন আমি জানতে পারি শ্রাবণ বিবাহিত। ওর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।”

– “এতকিছু জানার পরও তুমি আবার ঐ ছেলের সাথে কথা বললে? কী বলেছে ও? তোমায় বিরক্ত করছিল না তো?”

– “ও আমায় ভালোবাসে, বিয়েটা নাকি একটা ষড়যন্ত্র। ও আমার সাথে কথা বলতে চায়।”

– “মীরা শোনো, ছেলেটা তোমায় ভালোবাসে কিনা আমি জানিনা তবে কথা বলে সব শেষ করে দেওয়া উচিত তোমার। একজন বিবাহিত পুরুষ, হোক জোর করে বিয়ে কিংবা ষড়যন্ত্র করে বিয়ে, সে তো বিবাহিত! তার প্রতি দুর্বল হলে তোমার চলবে না।”

অভিকে সব কথা বলার পর আমার যতটা হালকা লাগছিল, তার চেয়েও বেশি আফসোস বেশি হতে লাগলো। একটা অপরিচিত ছেলে যাকে আমি ঠিকমতো চিনিই না, তাকে নিজের জীবনের এসব কথা বলা কি ঠিক হলো? আসলে আমরা যখন একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন পরিচিত-অপরিচিত আমাদের কাছে ম্যাটার করেনা। আমরা শুধু এমন একটা মানুষের সঙ্গ চাই যে আমাদের কথাগুলো শুনবে, একজন ধৈর্যবান শ্রোতা।

অভি আমার পাশে বসে আছে। খালামণি-খালুর এখনো দেখা নেই। তারা যে কোথায় সময় কাটাচ্ছে, তারাই জানে। অভি আইসক্রিম এনেছিল, তা আপাতত গলে পানি হয়ে চুয়ে চুয়ে পড়ছে। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অভি একেবারেই চুপ। একটু পর পর কিছু একটা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে কিন্তু বলছে না।

– “কিছু বলবেন?”

– “আসলে…না…মানে আসলে আমরা তো বন্ধু, তাই না?”

– “কখন হলাম?”

– “ওহ! হইনি? তাহলে থাক।”

– “বলেন কী বলতে চাচ্ছেন।”

– “শ্রাবণকে তুমি এখনো ভালোবাসো?”

– “জানিনা আমি। তবে শ্রাবণ যদি আমার জন্য সব ছেড়ে আসে, আমি ওকে ফেরাতে পারবো না।”

– “ও বিবাহিত জানার পরেও?”

– “ভালোবাসার দুর্বলতা! অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছি ওর প্রতি।”

– “এটা কখনোই ভালোবাসা না, এটা তোমার আবেগ। ভালোবাসা কারো ক্ষতি করে নিজে পূর্ণতা পায় না। ভালোবাসা সবাইকে খুশি রাখতে জানে।”

– “ধরেন, আপনি একজনকে ভালোবাসেন, সেও আপনাকে ভালোবাসে। এখন, অন্য একজন আবার আপনাকে ভালোবাসে কিন্তু আপনি তো আর দুইজনকেই ভালোবাসতে পারবেন না। তাহলে আপনি কাকে বেছে নিবেন?”

– “যাকে আমি ভালোবাসি যেহেতু আমরা দুজনেই একে অপরকে ভালোবাসি।”

– “কিন্তু তৃতীয়জনের মন তো ভেঙে যাবে।”

– “তাতে আমার কিছু করার নেই তো। আমি সর্বোচ্চ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারি।”

– “একটু আগেই যে বললেন ভালোবাসা সবাইকে খুশি রাখতে জানে। তাহলে তৃতীয়জনকে কেন কষ্ট পেতে হলো? সে কি খুশি থাকার অধিকার রাখে না?”

– “তুমি আমায় কী বোঝানোর চেষ্টা করছো?”

আমি কিছু বললাম না, মাথা ধরেছে আমার। এইমুহূর্তে একটু বিশ্রাম দরকার আমার। এত ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। অভিকে কিছু বলার আগেই খালামণি আর খালু আসলো। আমি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললাম। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্য জায়গায়। খালু গাড়ি আনেনি। তিনি আর অভি দুজনেই রিকশায় করে এসেছেন কিন্তু এখন যাওয়ার সময় খালামণি আর খালু এক রিকশায় যেতে চাচ্ছেন তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি ছোট, আমার সামনে সরাসরি বলতেও পারছেন না। আমি আর কী করবো! বললাম,”খালামণি, খালু, তোমরা বরং এক রিকশায় যাও। আমি অভি ভাইয়ার সাথে যাবো।” আমার কথা শোনামাত্র খালামণির মুখে রঙধনুর সাতরঙ এসে একসাথে ভীড় করলো। অন্যদিকে, অভি তো হা! আমি যে তাকে ভাইয়া ডাকছি তা বিশ্বাস করতে বোধহয় তার কষ্ট হচ্ছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। খালু দুইটা রিকশা ঠিক করলো। একটায় খালামণি আর খালু উঠলো, অন্যটাতে আমি আর অভি। রিকশায় উঠার পর থেকেই আমার আবারো মাথা ঘুরাচ্ছে। একটু পর পর মাথায় হাত দিচ্ছি, কোনোভাবে ব্যথা কমানোর চেষ্টা। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিনা। ভালোবাসা হারিয়ে ফেললে কেমন অনুভূতি হয় আমি এতদিন জানতাম না কিন্তু এখন অনুভব করতে পারছি। একটা অস্থির ভাব এসেছে আমার মধ্যে। ঠিক কী কারণে অস্থির লাগছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিনা। হাত-পা রীতিমতো ঘামছে। বার বার নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। আচমকা অভি আমার হাত ধরলো। অনেকটা বিনয়ের সহিত হাতে হাত রেখে বললো, “মাথা ঠাণ্ডা করো। আমার সাথে যেহেতু সমস্যা শেয়ার করছো, আমিই সমাধান করে দিব। তুমি নিশ্চিত হও। শ্রাবণের সাথে বাসায় গিয়ে শেষবার কথা বলে নিও। এই নাও আমার ফোন, এটাতে আমার নাম দিয়ে একটা নম্বর সেভ করা আছে। আমার আরেক ফোনের নম্বর। কোনো সমস্যা হলে কল দিও।” পকেট থেকে ফোনটা বের করে আমার হাতে দিল অভি। অভি কি দয়া দেখাচ্ছে আমার উপর? ওকে তো আমি ঠিকমতো চিনিও না, সেখানে ওর থেকে সাহায্য কেন নিব আমি? অদ্ভুত হলেও সেই মুহূর্তে এসব কথা আমার মাথায় আসেনি। অভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, রিকশার হঠাৎ ব্রেকে অভির কপালের সাথে আমার কপালে ধাক্কা লাগলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম। অভি আরেকবার কপালে আলতো টোকা দিয়ে বললো, “একবার টোকা লাগলে শিং গজায়।” অভির এই কথায় আমার হাসি আসছে এখন। এসব কথা গ্রামেগঞ্জেও আর এখন তেমন বলা হয়না অথচ শিক্ষিত শহুরে ছেলে হয়ে কিনা অভি এসব বিশ্বাস করে! হাস্যকর।

বাড়ির সামনের রাস্তায় রিকশা থামলো। আমাদের রিকশাটা আগে এসেছে। অভি নেমে ভাড়া মিটিয়ে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, মনে হলো কিছু বলবে। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম।

– “আপনি কি কিছু বলবেন?”

– “তোমার ফ্যামিলি তো রক্ষণশীল যা বুঝলাম, প্রেম করলা ক্যামনে?”

– “আট মাসের প্রেম, চিঠিতেই যত কথা। সামনাসামনি দেখা সপ্তাহে একবার কিংবা মাসে দু’বার।”

– “তাতেই এত উতলা? এটা নিঃসন্দেহে প্রেমই, ভালোবাসা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না এ সম্পর্কটাকে।”

– “হয়তো। আসি আমি।”

– “এক কাপ চা খাওয়াতে পারতে।”

– “আপনিও পারতেন, খাওয়ান নি তো।”

– “এখন চলো, সামনেই ক্যাফে আছে একটা।”

– “জব করেন আপনি?”

– “আপাতত না তবে…”

– “যেদিন নিজের টাকায় খাওয়াবেন, সেদিন খাবো।”

অভি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা এত ভ্রু কুঁচকায় কেন! আমি মৃদু হেসে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম।

_________________________________

“মনে পড়লে অকারণ
কাউকে বলা বারণ,
রিমঝিম ঝিম বরষায়
তুই আজ ভেজার কারণ।”

ধীরস্বরে গানটা বাজছে। প্রথমে বুঝতে একটু সময় লাগলো কিন্তু একটু পর আবিষ্কার করলাম টিউনটা অভির ফোনের মেসেজ টিউন। দরকারি কোনো মেসেজ হতে পারে ভেবে ওপেন করলাম। অভি টেক্সট করেছে, “হ্যালো মিস!” দেখে রেখে দিলাম। এইমুহূর্তে আমার একজনকেই টেক্সট করতে ইচ্ছে হচ্ছে, সে হলো শ্রাবণ কিন্তু আমি যদি শ্রাবণের সাথে কথা বলি সেটা হবে আমার জীবনের দ্বিতীয় বড় ভুল। আমি চেষ্টা করছি কোনভাবে শ্রাবণের উপর থেকে ধ্যান সরাতে, তাহলেই আমি ভালো থাকতে পারবো। হঠাৎ মনে পড়লো ডায়েরিটার কথা। অদ্ভুত তো! ডায়েরির প্রথম দুই পৃষ্ঠার কথাই আমার সাথে মিলে গেল কিন্তু কিভাবে? কাকতালীয়? সচরাচর আমি কাকতালীয় বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে চাইনা। আমার মনে হয় কাকতালীয় বলে কিছু হয় না, সবকিছুর পেছনেই একটা যুক্তিযুক্ত কারণ অবশ্যই থাকে। ডায়েরির প্রতি কৌতূহল দমাতে পারলাম না। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলাম। ডায়েরির শেষ পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে “মেঘবালক” লিখে কেটে ফেলা হয়েছে। যতটা যত্নে লেখা হয়েছে, তার দ্বিগুণ নির্মমতায় কাটা হয়েছে লেখাটা। কী এমন কারণ রয়েছে যার জন্য লেখাটা এভাবে কাটা হয়েছে? ডায়েরির তৃতীয় পৃষ্ঠা উল্টাতেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার।

চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here