সে জানে পর্ব -০৯

#সে_জানে
#Part_9
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha

একটু সামনে যেতেই একটা ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে যায় নুপুর। দিবসকে গাড়ি থামাতে বলে। দিবস না চাওয়া সত্ত্বেও গাড়ি থামাতেই নুপুর হুট করে নেমে যায় গাড়ি থেকে, দৌড়ে ছুটে চলে ওই ছেলের পিছনে। নুপুরের এমন আচরণ দেখে আশ্চর্য হয় দিবস। হঠাৎ এই ভাবে কেন গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে গেলো বুঝতে পারছে না সে! নুপুর কোথায় যাচ্ছে তা দেখার জন্য সেও গাড়ি থেকে নেমে গেলো। দিবস কিছু দূরে গিয়ে দেখে নুপুর দাঁড়িয়ে আছে৷ দিবস পিছন থেকে নুপুরের কাধে হাত রাখতেই সে চমকে উঠে পিছনে তাকায়। দিবস বিশেষজ্ঞদের মতো
‘ এই ভাবে নেমে আসলে কেন? কি হয়েছে? আমাকে বলো।

নুপুর মাথা নিচু করে আছে।

দিবস লক্ষ্য স্থির রেখে
‘ কি হলো নুপুর বলো! এই ভাবে এই খানে কেন এলে?

নুপুর মাথা নিচু করে নিজেকে সংযত করে,
‘ আসলে আমার বমি বমি পাচ্ছিলো। গাড়িতে উঠে আমার বমি করার অভ্যেস আছে। তাই চানাচুর মাখানো দেখে নেমে গিয়েছি। চানাচুর মাখানো আমার ভালো লাগে। চানাচুরের কুচি কুচি পেয়াজ যখন মুখে কামড়ে পরে অনেক ভালো লাগে, ইশ জিভে পানি চলে এসেছে।

দিবস নুপুরের পিছনে তাকিয়ে দেখে ছোট একটা ছেলে বড় একটা থালে চানাচুর মাখানোর সব কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিবস বিজ্ঞ চোখে তাকালো ছেলেটার দিকে তারপর নুপুরের দিকে তাকিয়ে
‘ আমায় বললেই পারতে এই ভাবে গাড়ি থেকে নামার কি দরকার ছিলো। যাইহোক আর এমন করবে না।

নুপুর বাধ্য মেয়ের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে
‘ ঠিক আছে।

নুপুরের পাশে বেশ ভাবুক ভংগিমা নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে দিবস। নুপুর কিছু লুকাচ্ছে তা বুঝতে বাকি নেই তার। কিন্তু কি লুকাতে পারে! কি এমন আছে যেটা দিবস জানতে পারবে না! জানলে কি এমন ক্ষতি হবে?

নুপুরের মামা বাড়িতে গিয়ে দিবস ফ্রেশ শুয়ে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ে। এতো খাতিরযত্ন পেয়েও কেন যেন ওই বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে পারছে না দিবস। এতো জলদি নুপুর কাউকে দেখেই নেমেছে এটা স্পষ্ট। কিন্তু কে সে!

নুপুর রুমে এসে কাপর-চোপর গুছিয়ে তার ওয়ারড্রবে রাখছে। দিবসকে চিন্তিত দেখে
‘ কি ভাবছেন?

দিবস উঠে বসে গালে হাত দিয়ে
‘ ভাবছি তোমার মামাতো বোনের কথা। আরেকটু বড় হলে ভালো হতো। খাতিরযত্ন আরো বেশি পাওয়া যেত। এখন তো মাটির নিচে দিয়ে হাটে।

দিবসের কথা শুনে নুপুর কিছু বলতে যাবে তার আগেই নুপুরের মামাতো বোন
‘ কি বললেন দুলাভাই! আপনার জন্য মায়ের হাতের চিংড়ি মাছের বড়া এনেছিলাম আর দিলাম না। আমি আপুকে নিয়ে খেয়ে ফেলবো তারপর মাকে গিয়ে বলবো আপনি খেয়েছেন।

দিবস কাঁদো কাঁদো গলায়
‘ ওরে এমন করিস না। আমি তো মজা করেছিলাম। চিংড়ি মাছ আমার অনেক প্রিয় নিয়ে আয়।

দিবসের বাচ্চামি দেখে হেসে ফেলে নুপুর। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ওদের কথপোকথন শুনছে।

ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়ে দিবসের সাথে কথা কথায় কথায় যুদ্ধ করছে। আর দিবস তার কথায় বোম ফেলছে।

বিকেলে নুপুর আর দিবস সবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো তখন পাশের বাসার কয়েকজন মহিলা আসে নতুন জামাই দেখার জন্য।
সবাই দিবসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আর কানাঘুষা করছে। একজন তো নুপুরের মাকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরেই বলে দিলো

‘ ডিভোর্সি হয়েও আপনার মেয়ে এতো ভালো জামাই পেয়ে গেলো আপা। তাও অবিবাহিত। আপনার মেয়ের তো ভাগ্য খুলে গেছে দেখি।

কথাটা দিবসের গায়ে তীরের মত বিধলো। নুপুর মাথা নিচু করে ফেললো। দিবস রাগ সামলাতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে

‘ তাতে কি আপনার চুল্কানি হচ্ছে আন্টি? সরি মাফ করবেন। কিন্তু আমার বউকে কেউ অপমানিত করবে তাও আমার সামনে তা তো আর আমি হাজবেন্ড হয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো না। আপনাদেরও তো মেয়ে ছেলে আছে,ওদের খোঁজ রাখেন? আজ কালকের ছেলেমেয়েরা প্রেম করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিলে বাচ্চা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলে। তারপর কি হয়? ছেলেটা মেয়েকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর মেয়েটা তার এই চরিত্র নিয়েই আরেকজনের গলায় ঝুলে পরে। এমন অবৈধ ডিভোর্স থেকে বৈধ ডিভোর্স হাজারগুন ভালো। আমার স্ত্রী কোন খারাপ কাজ করেনি। এতে লজ্জার কিছু নেই। আর আমার বউকেই ফার্দার এমন মন্তব্য করার আগে একশোবার ভাববেন।

নুপুরের মায়ের চোখে পানি। এটাই তো চেয়েছিলো তিনি তার মেয়ের জন্য। যে কিনা শত সংকটে তার মেয়েকে আগলে রাখবে। পাশে থেকে ভরসা দেবে। নুপুরের মা ওই মহিলার দিকে চোখ মুছে তাকিয়ে

‘ ভাবি আপনার মেয়ের কথা ভুলে গেছেন? বিয়ের আগে কি করেছিলো আমরা সবাই সব জেনেও চুপ ছিলাম। তাহলে আমার মেয়ের ক্ষেত্রে কেন এমন?
আর বেইজ্জতি হবার আগে চলে গেলেই আমি খুশি হবো।

মহিলা গুলো হনহন করে বড় বড় পায়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে। আবার হয়তো নতুন কোন কুৎসা রটাবে। তাতে কি! মানুষকে তার আয়না দেখানো খুবই প্রয়োজন।

রাতের খাবার-দাবার শেষে নুপুর আর তার মা সবকিছু গোছাচ্ছে। নুপুরের মা প্লেট সাজাতে সাজাতে
‘ অনেক ভাগ্য করে দিবসের মতো ছেলে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়েছি। জানিস নুপুর আমি মনে মনে এমন একটা ছেলেই তোর জন্য চাইতাম। বলেছিলাম না তুই অনেক ভাগ্যবতী হবি।

নুপুর নিশ্চুপে কাজ করতে করতে
‘ হুম

নুপুরের মা নুপুরের দিকে তাকিয়ে
‘ দিবস বাবাকে ভালো রাখিস মা। আগলে রাখিস যত্নে। ভালো জিনিস যত্নে রাখতে হয়। না হয় হারিয়ে ফেলে মানুষ। যেমন দামী গহনা সিন্দুকে রাখতে হয়৷ তেমনি ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়।

নুপুর নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে
‘ হুম মা।

শব্দহীন পায়ে নুপুর রুমে প্রবেশ করে দেখে, দিবস জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে রাতের আকাশে। ভাবনায় মগ্ন থাকায় নুপুরের উপস্থিতি টের পায়নি দিবস৷ নুপুর দিবসের পাশে দাঁড়িয়ে
‘ আকাশ আমারও ভালো লাগে। কিন্তু আপনি কি ভাবছেন আকাশে তাকিয়ে?

দিবস ভিন্ন মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে
‘ ভাবছি এতো বড় আকাশ কি রব এমনি বানিয়ে রেখেছে? এতো জায়গা জুড়ে তার অস্তিত্ব। তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এতো এতো নক্ষত্রমালা আর চাঁদ বানিয়ে রেখেছে। সব কিছুই কোন না কোন কারণে তৈরি। সব কিছু কোন না কোন উদ্দেশ্য ঘটে। পৃথিবীতে কোন কিছুই এমনি হয়না। তাই না?

নুপুর স্বল্পভাষীর মতো
‘ হয়তো।

দিবস বাহির থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকায় নুপুরের দিকে
‘ তোমার প্রতি আমার টান আর এতো অনুভুতিও নিশ্চয় এমনি নয়। তার পিছনেও কারণ আছে।

নুপুর চমকে গিয়ে
‘ কি সে কারণ?

দিবস নুপুরের হাত ধরে আস্তে করে
‘ ভালোবাসা। ভালোবাসি তোমায়।

নুপুরের চোখে কোনায় পানি চলে আসে দিবসের কথায়। তবুও শক্ত গলায়
‘ আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছুই নেই।

দিবস অল্প হেসে
‘ শুধু তুমি থাকলেই হবে।

নুপুর নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তবে তার ভিতরে আনন্দ অনুভব হচ্ছে। এটাই কি চেয়েছিলো নুপুরও?

দিবস নুপুরের কপালে তার ঠোঁঠ ছুঁয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে নুপুরকে। বাধা দিলো না সেও।ঘনঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে নুপুরও দুহাতে জড়িয়ে ধরে দিবসকে। কোন কিছুই এমনি ঘটে না সব কিছুর পিছনে রয়েছে উপরওয়ালার সুন্দরতম ষড়যন্ত্র। আর সেই ষড়যন্ত্রে নিজেকে মিশিয়ে নেওয়ায় বুদ্ধিমানের কাজ।

সকাল প্রায় নয়টা বাজে। সবেমাত্র নুপুরের ঘুম ভেঙেছে। আজকেও সে দিবসের বুকে কিন্তু আজ অবাক হয়নি নুপুর। বরং শক্ত করে নিজের জায়গা ধরে রেখেছে সে। দিবস মুচকি হেসে
‘ আরেকটু জোরে ধরলে কিন্তু একবারে জান্নাতে দেখা হবে।

দিবসের কথা শুনে লজ্জা নিয়ে নুপুর উঠে যেতে নিলেই দিবস আটকে ফেলে নুপুরকে। জড়িয়ে ধরে
‘ ওই দিন বর্ডার আস্তে করে সরিয়ে রেখে তোমায় বুকে নিয়ে এসেছিলাম। তারপর আবার বর্ডার ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকে নিজের ইচ্ছেতে এসেও চলে যাচ্ছো কেন?

নুপুর হতভম্ব হয়ে
‘ তারমানে? তারমানে আপনি ইচ্ছে করে এমন করতেন আর আমায় লজ্জায় ফেলতেন?

দিবস হো হো করে হেসে উঠে। নুপুর উঠে বসে ডজন খানেক কিল-ঘুষি মারে দিবসকে। দিবস নুপুরের এলোমেলো কিল-ঘুষি হাসতে হাসতে আটকাচ্ছে। নুপুর চোখ রাঙিয়ে
‘ হাসবেন না। ভেজাল মিশ্রিত হাসি সব।

হঠাৎ দিবসের ফোন বেজে উঠতেই দিবস হাসতে হাসতে নুপুরের দু-হাত একহাতে চেপে ধরে আরেক হাতে ফোন রিসিভ করে। নুপুর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
দিবস ফোনে কথা শেষ করে
‘ নুপুর জলদি রেডি হও, এখনি বাসায় যেতে হবে। আব্বুর ফোন ছিলো।

নুপুর বুঝতে পেরেছে কোন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু হবে তাই কথা বাড়ালো না। যদিও আর একদিন থাকার কথা ছিলো এখানে।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে নুপুর আর দিবস তারাতাড়ি বাড়ি ফিরে। বাড়ির ভিতরে পা দিয়েই নুপুর চমকে উঠে……

চলবে…………

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকের পার্ট অনেক বড় হয়েছে। আবার কেউ বলবেন না এতো ছোট কেন। আগামী পর্বে শেষ করে দেবো ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here