সে দিন দেখা হয়েছিলো পর্ব -০৪+৫

পর্বঃ০৪
গল্পঃ #সে_দিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ ঈশিতা ইশা
(কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি নিষেধ।)

সন্ধ্যা নামতেই বাজারের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠে। অনেকে দোকান সাময়িক বন্ধ রেখে নামাজ আদায় করতে মসজিদে ছুটছে।আরাফ ও গিয়ে নামাজ আদায় করে নেয়।

‘এই রাকিব ঠিক মতো সব ভিডিও করেছিস তো?’,চোখের চশমা ঠিক করে পড়ে রাকিবের হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘চুড়ির দোকানের ভিডিওর কথা কইতাছেন আপা? এক্কেরে বলিউডের ক্যামেরাম্যানের লাহান ভিডিও করছি।’ রাকিব জবাব দেয়।

‘মোরে যদি ভিডিও তে সুন্দর না লাগে তেইলে তোর খবর আছে।’,মারিয়া রাকিবের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে।

‘মারু রাস্তার মধ্যে কান মলা না খেতে চাইলে ভদ্র মেয়ের মতো আচরণ কর।এই মনি দেখ তো সব কিনেছি কিনা লিস্ট মতোন। ‘, মারিয়ার দিকে চোখ গরম করল বলে রাইদা।

‘আমি লিস্ট চেক করছি সব কিনা শ্যাষ রাই আপা কিন্তু মিষ্টিটা কেনা হয় নায়।’, মনি হাতের লিস্ট দেখে বলে।

‘চল তাহলে মিষ্টি কিনেই বাড়ি ফিরি সন্ধ্যা নামছে জলদি ফিরতে হবে।’
রাই মিস্টির দোকানের দিকে হাঁটা দেয় পিছন পিছন মারিয়া,মনি,রাকিব আসে।

‘কিরে মামাহ তোরা কি মরছিলি? একজন কান থেকে ফোন নামায় না আরেকজনে রাস্তার মধ্যে চোখ বন্ধ কইরা ঘুমায় ঐদিকে শ্রেয়ু আর যোমিনের কোনো খবর নাই সাথে জাহিদ বেচারাও ফেঁসে গেছে ওদের সাথে।’,রুবেল বিরক্ত হয়ে বলে।

‘আমার গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছিলো তাই কথা বলতে একটু সাইডে গিয়েছিলাম।আরাফ তুই কোথায় ছিলি?’,সায়ন ফোনটা পকেটে ভরে আরাফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

‘তোকে খুঁজতে গিয়েছিলাম আর আজান দিলো তাই নামাজ আদায় করে আসলাম।’,আমতা আমতা করে আরাফ জবাব দেয়।

‘হাতে কি তোর?’, আরাফের হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো প্রশ্ন করে সায়ন।

‘আরে তেমন কিছু না বাড়ি ফিরে দেখাবো।’, প্যাকেটটা পিছনে লুকিয়ে বলে আরাফ।

‘বন্ধু খাবারদাবার নাকি? আমার কিন্তু ব্যাগ টানতে টানতে খিদা লাইগ্গা গেছে।চারিদিকে এতো খাবার চল না এক জায়গায় বসে কিছু খেয়ে নেই।’,রুবেল অসহায় মুখ করে বলে।

‘এই পাশে গোপাল দাদার মিষ্টির দোকান চলেন সেই খানে যাই।অনেক কিছু আছে খাওনের।’,আঙ্গুল দিয়ে এক পাশে দেখিয়ে বলে সানজিদা।

‘চলো যাই আমরা এরা থাকুক।’,রুবেল তাড়া দিয়ে বলে।

‘হ্যা চল যাই কিন্তু জাহিদকে কল দিয়ে ডাকা দরকার।’,আরাফ সায়নের দিকে তাকিয়ে বলে।

‘আমার কাছে জাহিদের নাম্বার নেই।’,সায়ন জবাব দেয়।

‘আমার কাছে আছে আমি কল দিচ্ছি।’,কথাটা বলে আরাফ ফোন বের করে জাহিদকে কল দেয়।

রুবেল,সানজিদা,শিমু এসে মিষ্টির দোকানে বসে। সায়ন দোকানের বাহিরে দাঁড়িয়ে আরাফের অপেক্ষা করতে থাকে।আরাফ ফোনে কথা বলতে বলতে পিছনে পরে যায়।

‘আজকে কিন্তু তেমন ভিডিও করার সময়,সুযোগ পাইনি। আগামীকালকে তো শুক্রবার ভাবছি সারাদিন ভিডিও শুট করবো।তোরা দু’জন তো কালকে ফ্রি আছিস তাই না?’,মনি আর রাকিবের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রাইদা।

‘হ রাই আপা মোর কোনো কাম নাই।’,রাকিব উত্তর দেয়।

‘সক্কাল সক্কাল কাম সাইরা মুই আসুম চিন্তা কইরেন না আপা।’,মনি রাইকে আশ্বস্ত করে বলে।

‘মাতারি মানুষের কামের শ্যাষ নাই।কি এমন কাম করিস সারাদিন বুঝি না।স্কুলও ফাঁকি দেস।’,রাকিব মনিকে উদ্দেশ্য করে বলে।

‘তুই যে কেন স্কুলে প্রেতেকদিন যাস এইডা মনে করছিস মুই জানি না?’,মনি ভেংচি মেরে বলে রাকিবকে।

‘হ ক্লাস এইটের সামনে ঘুরাঘুরি করস মাছির মতো এইডা পুরা স্কুল জানে।’,হুট করে মারিয়া কথাটা বলে মুখে হাত দেয়।

রাইদা ওদের কথা শুনে পিছনে ঘুরে তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁসে দেয়। তিনজন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। রাইয়ের হাসিমুখ দেখে ওরাও হেঁসে দেয়।
হাসতে হাসতে রাইদা সামনে মিষ্টের দোকানের দিকে তাকিয়ে মানুষ গুলোকে পরখ করার চেষ্টা করে।বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে পরিচিত মুখ দেখেছে ভেবে চোখের চশমাটা ঠিক করে ভালো করে দোকানের দিকে তাকায়। দোকানের ঝলমলে আলোতে সায়নের ফর্সা মুখটা স্পষ্ট হয়ে যায়। দোকানে সায়ন দাঁড়িয়ে আছে এদিকে মুখ করে তবে তার দৃষ্টি ফোনে। ব্যস এই টুকু দেখেই রাইদার হাসি মুখ মিলিয়ে যায়, এক সেকেন্ডও দাড়াঁয়নি আর উল্টো ঘুরে হাঁটা দেয়।

‘আপা মিষ্টি কিনবেন না কি হইলো? আপা?’,মারিয়া,রাকিব,মনি এক সাথে বলতে থাকে আর রাইদার পিছন পিছন যেতে থাকে।

চিল্লাপাল্লা শুনে সায়ন সামনে তাকায় দেখতে পায় একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে দ্রুত আর তার পিছন পিছন তিনজন যাচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখে এর মধ্যে আরাফের ডাকে মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। আরাফ ইশারায় কিছু বলছে কিন্তু সায়ন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আবার সামনে তাকায় কিন্তু ততক্ষণে আর কাউকে দেখতে পায় না।

‘কি হলো কিছু বললাম তোকে জবাব দিলি না কেনো?’,সায়নের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে আরাফ।

‘শুনতে পাইনি বল এখন।’, সায়ন সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে।

‘জাহিদ বললো বাজারের বাহিরের দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়াকে আর যামিনীকে একা রেখে আসতে চাইছে না।আর কিছু কিনবি না হলে ফিরতাম।’

‘এক কাজ কর তুই সকলকে নিয়ে ফিরে যা আমি একটু ঘুরে আসতেছি।ছোট্ট একটা কাজ আছে আমার।’

‘কি কাজ তোর? আমিও থেকে যাই সমস্যা আছে?’

‘টাকা বের করবো বিকাশ থেকে আর ছোট্ট একটা কাজ আছে যেটা সারতে হবে।তুই যা ওরা একা যেতে পারবে না এতো কিছু নিয়ে আর রুবেলকে চিনিসই কোনো দায়িত্ব জ্ঞান নেই ওর।আমার যদি তোকে প্রয়োজন হয় ডেকে নিবো।’,সায়ন ব্যস্ত গলায় উত্তর দেয়।

‘সায়ন তুই আমার থেকে কিন্তু লুকাচ্ছিস?’,আরাফ আবারো প্রশ্ন করে।

‘আলতু ফালতু কথা বলে আমার মাথা খাওয়ার চেষ্টা করিস না আরাফ। প্লিজ আমাকে প্রাইভেসি দে একটু।কথা দিচ্ছি সময় হলে সব জানাবো।’, বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বলে সায়ন।

‘ঠিক আছে তোর সুবিধা মতো বলিস। এই রুবেল চল রাত হচ্ছে।’

‘আরে খাইতে তো দিবি নাকি!তোদের যন্ত্রণায় তো না খেয়ে আমার ম*রা লাগবে।দূর!’

‘প্যাকেট করে নিয়ে নে বাকিটা গিয়ে খাবি। মেয়েদের রেখে আমরা আবার আসবো সমস্যা নেই।’,সায়নের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে আরাফ।

সায়ন শুনেও না শোনার ভান করে বাজারের আরো ভিতরের দিকে হাঁটা দেয়।

‘তোর কি মনে হয় সায়নের মাথার স্ক্রু গেছে?’, বাম হাতের আঙ্গুল নিজের মাথায় স্ক্রু এর ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে বলে রুবেল।

‘জানি না তবে এখানে আসার আগ পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু আসার পরই ওরে কেমন উদাস লাগছে।কি হয়েছে বলছেও না কিছু।’, আরাফ হতাশ গলায় বলে।

‘সায়ন বড্ড চাপা স্বভাবের। মন খুলে কিছু বলতে পারে না এটাই ওর বড় সমস্যা।’,রুবেলও আরাফের সাথে তাল মিলিয়ে বলে।

দুই বন্ধু হতাশ হয়ে সানজিদা, শিমুকে নিয়ে রওনা দেয় যেখানে জাহিদ শ্রেয়া,যামিনীকে নিয়ে আছে।
..

‘আপা কি হইছে আপনের? ‘, রাকিব দৌড়ে গিয়ে রাইদার সামনে দাঁড়ায়।

‘কিছু না বাসায় ফিরতে হবে। দেখছিস রাত হয়ে গেছে যে? মিষ্টি কালকে নিবনি সমস্যা নেই।’,কথাগুলো বলে রাইদা পিছনে ফিরে তাকায়।

সেই যে হাঁটা দিয়েছিলো তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।বাজার পেরিয়ে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছে ওরা। মিনিট দশেক হাঁটলেই বাড়ি পৌঁছে যাবে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাইদা ওদের তিনজনকে ইশারা করে সামনে হাঁটতে বলে।
মনি,রাকিব,মারিয়া কিছু না বুঝেই রাইদার নির্দেশ মতো হাঁটা শুরু করে। ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে রাইদা পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করে।

বাড়ির গেটে এসে দেখে উঠানে আলো। মারিয়া ব্যাগ সহোই দৌড় দেয় উঠানের দিকে। রাইদা চিৎকার করে মারিয়াকে নিষেধ করে দৌড়াতে কিন্তু মারিয়া সেদিকে কান দেয় না।
মারিয়া উঠানে এসে নিজের খালাতো ভাইকে কোলে নিয়ে চুমু দিতে শুরু করে। রাইদা ততক্ষণে দ্রুত হেঁটে চলে এসেছে উঠানে।

‘আরে আম্মা কেমন আছো?মেলা ডাঙ্গর হইয়া গেছো।কত বছর পর দেখতাছি।আহো খালার বুকে আহো।’, কথাগুলো বলে রাইদার খালা সাবিনা হাত বাড়িয়ে দেয় রাইদার দিকে।

‘খালামনি তুমি তো ভুলেই গেছো আমাকে। এসেছি পাঁচ দিন হলো অথচ তুমি আজকে আসলা আমার সাথে দেখা করতে।’,অভিমানী সুরে বলে রাইদা।

‘আরে আম্মা কি হইছে তোমারে কইতাছি তার আগে খালামনির বুকে আসো।’

রাইদাও অভিমান ভেঙে সাবিনার বুকে চলে যায়। কথা বার্তার শব্দ শুনে ঘর থেকে আলেয়া বেগম বের হয়। উঠানে চেয়ার পিঁড়ি এনে সকলে বসে যায় আড্ডা দিতে। সাবিনা এসেছে সাথে তার সাত বছরের ছেলেকে এনেছে।

‘খালা মনি খালু এলো না কেনো?’, সাবিনার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে রাইদা।

‘আরে হের তো কামের শ্যাষ নাই।কইলো কাইল পরশু কাম সাইরা আইবো সেইজন্য মুই তোমার ভাইরে নিয়াই আইয়া পরছি। আর তর সয়নায় মোর। তুমি আইছো পর থেইকাই মুই কইতাছিলাম মোরে যেনো দিয়া যায় এ বাইত্তে কিন্তু হেয় তো খালি কইলো আইজ না কালই, এমন কইরা পাঁচটা দিন ঘুরাইলো। শ্যাষমেশ মুই একলাই আইলাম পোলাডা নিয়া।’

‘আহা খালামনি খালু কাজটা ঠিক করেনি।আমি কল দিয়ে জলদি আসতে বলবো তাকে। ‘

‘বইন এতো কিছু আনবার গেছো কেন তুমি? এত্তডি টাকা নষ্ট করার দরকার আছিলো না।ঢাকার থেইক্কা আইছে তখন কত কিছু আনছে বুঝলি সাবিনা। মাইয়াডায় মায়ের মতোন হয় নায়।’, আলেয়া বেগম ব্যাগের জিনিসপত্র বের করেন আর কথাগুলো বলতে থাকেন।

‘এসব তোমার মেয়ে কিংবা মেয়ে জামাইয়ের পয়সায় কিনে আনিনি সব আমার নিজের ইনকামের পয়সায় কেনা। মুরগী দু’টো কালকে রান্না করবা আর পিঠা বানাতে যা যা এনেছি সব দিয়ে কালকে পিঠা বানিয়ে আমাদের খাওয়াবা।ইলিশ মাছটা খালু আসলে রান্না করবা। বুঝছো স*তি*ন?’, শেষের কথাটা বলে হেঁসে দেয় রাইদা।

রাইদার কথা শুনে সকলে হেঁসে দেয়।

‘বিয়াডা করো খালি এরপরে তোমারে স*তি*ন হওয়ার মজা বুঝামু।’,আলেয়া বেগম মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বলে।

‘আপা খালু আর খালাম্মারে কল দেন।ওনাগো আইতে কন।ওনারা আইলে মেলা মজা হইলো।ঠিক কইছি না নানী?’, মারিয়া সকলের কথার মধ্যে বলে উঠে।

মারিয়ার কথা শুনে রাইদার হাসিমুখ মিলিয়ে যায়।

‘মারু, মনি,রাকিব হাতমুখ ধুয়ে বই নিয়ে আয়।বাকি বাচ্চাদের ডাক দে জলদি।’,কথাটা বলে রাইদা পুকুরের দিকে পা বাড়ায়।

মারিয়াকে আলেয়া বেগম আর সাবিনা বকাঝকা করে অনেক।মারিয়া কারণ খুঁজে পায় না বকা খাওয়ার।

আরাফ,রুবেল,জাহিদ,শ্রেয়া,সানজিদা,যামিনী আর শিমু মাস্টার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে। আরাফ কি জানি ভেবে মাস্টার বাড়ির দিকে তাকায়। চেয়ারম্যান বাড়িতে যেতে হলে এ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হয়।উঠানে ঘর থেকে আসা আবছা আলোতে দেখতে পায় কয়েকজন বসে আছে। তাদের মধ্যে থেকে এক তরুণীর উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। চোখ সরিয়ে সকলের সাথে তাল মিলিয়ে আরাফ গন্তব্যের দিকে চলতে থাকে।
..

গ্রামে রাত আটটা মানে গভীর রাত সেখানে এখন বাজে রাত দশটা। মনি, রাকিব আরো বাকি বাচ্চাদের পড়ানো শেষ করে রাইদা ছুটি দিয়ে দেয়। মারিয়া যেহেতু ফাঁকিবাজ তাই ওকে ছুটি দেয়নি। মারিয়া,মনি,রাকিব সকলেই এসএসসি পরীক্ষার্থী,কিছুদিন পর টেস্ট পরীক্ষা।

‘শোন কালকে সকাল সকাল কাজ সেরে দু’জনে চলে আসবি একেবারে রাতে ফিরবি তাই বাসায় বুঝিয়ে বলে আসবি। আর বাচ্চারা তোমরা বিকালে আসবা। ‘,রাকিব আর মনিকে কথাগুলো বলে রাইদা।

‘আপা আপনের নাম নিলে বাইত্তে আর কিছু জিগায় না।আব্বায় আর মায়ে চিন্তা করে না কোনো।তাইনা রে মনি?’,রাকিব মনিকে গুঁতা মেরে বলে।

‘হ ঠিক কইছিস।’,মনি জবাব দেয়।

‘বুঝলাম তোদের কথা এখন চল এগিয়ে দিয়ে আসি এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।’,টর্চ হাতে রাইদা বের হয় ঘর থেকে।

বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত আসার পর রাকিব বারণ করে আর আসতে কিন্তু তারপরও রাইদা আরো কিছুপথ এগিয়ে দেয়।শেষে মনি আর রাকিব জোর করে রাইদাকে ফেরত পাঠায়। বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে রাইদা ঘাড় ঘুরিয়ে আশে পাশে দেখে রাস্তায় কোনো মানুষ জন নেই।টর্চটা রাকিবকে দিয়ে দিয়েছে যাতে যেতে কোনো সমস্যা না হয় অথচ এখন নিজে অন্ধকারে হাঁটছে। দমকা হাওয়ার রাইদার হঠাৎ করেই গা ছমছম করতে থাকে।

‘একা একা এই রাতের বেলা বাহিরে কি করছো? জানো না রাতের বেলা শেয়ালরা ওত পেতে থাকে? ‘

আচমকা চোখে আলো পড়ায় রাইদা চোখ বন্ধ করে দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করেল।

‘উফ আলোটা চোখের সামনে থেকে সরান।আলো চোখে পড়লে আমার চোখ জ্বলে।’

সায়ন ফোনের ফ্লাশ নামিয়ে রাইদার দিকে এগিয়ে আসে।

‘কি হয়েছে দেখি। চশমাটা খুলো।’, ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করে সায়ন।

‘চোখে আলো পড়লে আমি একদম সহ্য করতে পারি না।’,চশমা খুলে চোখ ডলতে ডলতে বলে রাইদা।

‘চোখ ডললে কি চোখ ভালো হবে নাকি স্টুপিড। চোখ ডলা বন্ধ করো, পানি দিতে হবে চোখে।চলো বাসার দিকে।’, ধমক দিয়ে রাইদাকে বাসার দিকে যেতে ইশারা করে সায়ন।

‘আমি ঠিক আছি।আপনি দূরে সরুন। ‘, সায়নের কাছ থেকে দু পা পিছিয়ে বলে রাইদা।

চোখ দেখতে সায়ন রাইদার একদম সামনে চলে আসে যার কারণে রাইদা সরে যায়।

‘এখানে কি করছো জবাব দিলা না যে?’,সায়ন ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে।

কেনো জানি রাইদার কাছে সায়নের ঠান্ডা গলা ভয়ঙ্কর লাগে।একটু আগে ধমক শুনেও এমন লাগেনি। রাইদা মনে শক্তি সঞ্চয় করে জবাব না দিয়েই হাঁটতে শুরু করে।

‘কি হলো জবাব না দিয়েই চলে যাচ্ছো কেনো চোরের মতোন? ‘

‘আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই আর আমাকে এরপর তুমি করে বললে অনেক খারাপি হবে বলে দিলাম কিন্তু।’,হাঁটা থামিয়ে সায়নের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে কথাগুলো বলে রাইদা।

রাইদার কথা শুনে সায়ন হেঁসে দেয়।ফোনের ফ্লাশের আলো মাটির দিকে তাক করা তারপরও আলোর প্রতিফলনে সায়নের হাসি দেখতে অসুবিধা হয় না তার।সায়নের হাসি দেখে রাইদা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এই ছেলেকে যতবার দেখেছে গম্ভীর মুখ করে থাকে হাসে না অথচ হাসলে অন্যরকম সুন্দর লাগে।
রাইদা বিরক্ত হয়ে দ্রুত হেঁটে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে উঠানের দিকে যেতে থাকে।

সায়ন এদিক ওদিক তাকিয়ে রাইদার পিছুপিছু গিয়ে সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না রাইদা ঘরে প্রবেশ করে। রাইদা অবশ্য দু’বার পিছনে তাকিয়ে দেখেছে সায়নকে, ইশারায় চলে যেতে বলেছে কিন্তু কে শুনে কার কথা। রাইদা ঘরে চলে গেলে সায়ন অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সিগারেট ধরিয়ে ঘরের বন্ধ দরজার পানে চেয়ে থাকে।

‘কিরে তুই এখানে কি করিস?’
হঠাৎ আরাফের কন্ঠ পেয়ে সায়ন কাশতে থাকে।

‘আরে দেখিস না বিড়ি টানতাছে দাঁড়াইয়া তারপরও প্রশ্ন করিস।এদিকে দে আমি একটা টান দেই। ‘,কথাগুলো বলে সায়নের হাত থেকে সিগারেট কেঁড়ে নেয় সায়ন।

‘তোরা ভুতের মতো কই থেকে বের হলি?’, সায়ন প্রশ্ন করে।

‘বাজারে যাইতেছিলাম পরে দেখলাম তুই এইখানে টানতাছিস তাই চুপচাপ আইসা তোরে সারপ্রাইজ দিলাম।’,রুবেল জবাব দেয়।

‘চল যাই তাহলে বাজারের দিকে।’, সায়ন কথাটা বলেই হাঁটা দেয়।

আরাফ সায়নের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। সায়নের সাথে সাথে রুবেলও হাঁটতে থাকে। মাস্টার বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আরাফও হাঁটতে শুরু করে।

শুক্রবার সকাল হতেই চেয়ারম্যান বাড়িতে হৈচৈ পড়ে যায় মানুষের আনাগোনায়। মহিউদ্দিন সকাল সকাল বাজারে গিয়েছিলো সাথে আরাফ,জাহিদ আর রুবেলও গিয়েছিলো। মহিউদ্দিনের ব্যবসার দেখাশোনা তার শালা করে যার কারণে সায়নদের আগমনে উনি কিছুদিন বাড়িতে থাকবেন বলে চিন্তা করেছেন।
বসার ঘরে বসে মহিউদ্দিন, তার বাবা সহ আরাফ,রুবেল আড্ডায় মেতে উঠে।জাহিদকে তার মা দোকানে পাঠিয়েছে। শ্রেয়া আর যামিনী উঠানে পুকুর পাড়ে বসে আছে। শ্রেয়া ফোনের দিকে তাকাচ্ছে আর একটু পরপর হাই তুলছে। যামিনী জমিয়ে গল্প করছে সানজিদার সাথে।
কিছুক্ষণ পর শ্রেয়ার ফোন বেজে উঠলে সে বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে নিজের চুল ঠিক করে ভিডিও কল রিসিভ করে কথা বলতে থাকে।

সানজিদা আশ্চর্য কিছু দেখার মতো চোখ করে তাকিয়ে থাকে।

‘আরে ওর বয়ফ্রেন্ড কল দিয়েছে। সিডনিতে থাকে তো তাই আমাদের সময়ের সাথে ওর সময় মিলে না।এই সময় ফ্রি থাকে তাই শ্রেয়া জেগে ওর কলের অপেক্ষা করে।’, সানজিদাকে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে যামিনী।

‘কিহ! কিডনি আবার কোন দ্যাশ? আমি তো জীবনেও শুনি নাই।’

সানজিদার বোকা বোকা কথা শুনে যামিনী হেঁসে দেয়।

‘আরে কিডনি না সিডনি। আচ্ছা বাদ দাও।’

নিজের ভুল বুঝতে পেরে সানজিদা লজ্জা পায়।

‘কোন ক্লাসে পড় তুমি?’, হাসি থামিয়ে যামিনী প্রশ্ন করে।

‘কেলাস টেনে পড়ি। সামনে এসএসসি দিমু।’

‘এইবার পরীক্ষা দিবা?’

সানজিদা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।

‘আপা আপনে কিসে পড়েন?’,যামিনীকে প্রশ্ন করে সানজিদা।

‘আমি? আমার তো পড়াশোনা শেষ। আমরা সকলে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি এখনো রেজাল্ট বের হয়নি।’, যামিনী হাসিমুখে উত্তর দেয়।

‘ঐ ভাইয়াদেরও লেখাপড়া শ্যাষ?’, আশ্চর্য হয়ে সানজিদা প্রশ্ন করে।

‘হ্যা আরাফ, রুবেল, সায়ন, শ্রেয়া সবাই আমরা একসাথে পড়তাম।’

সানজিদা কি বুঝলো কে জানে সে পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছের দিকে তাকিয়ে রইলো।

..

‘সায়ন কই?’, সায়নের নানা প্রশ্ন করে।

‘ও তো ঘুমাচ্ছে।বারোটার আগে উঠবে না।’আরাফ জবাব দেয়।

‘আহা পোলাটারে ডাক দাও। সকাল নয়টা বাজে এখনো ঘুমে।ওর মা ও এমন বেলা করে ঘুম থেকে উঠতো।’,সায়নের নানা আফসোস করে বলে।

‘ওরে ডাকতে গেলে থাবড় মাইরা চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুলাই দিবে।ঘুমে বিরক্ত একদম পছন্দ করে না ও।’,রুবেল বলে।

‘থাক আব্বা ও আরেকটু ঘুমাক।নামাজের সময় হওয়ার আগে ডাক দিতে বলবো।’,মহিউদ্দিন তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।

‘এই সবাই খাইতে আসো।’, মহিউদ্দিনের স্ত্রী মনিরা বেগম সকলকে খেতে ডাকে।

‘এই না চা বিস্কুট খাইলাম এখন আবার কি?’,রুবেল মহিউদ্দিনকে প্রশ্ন করে।

‘নাশতা খেতে ডাকছে,চলো।’,মহিউদ্দিন তাড়া দিয়ে বলে।

‘শ্রেয়া আর যামিনীকে ডেকে আনি।’, কথাটা বলে উঠানের দিকে পা বাড়ায় আরাফ।

বাকিরা খাবারের ঘরের দিকে যেতে থাকে।

..

একটা মেয়ে দরজা কিছুটা ফাঁকা করে উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে।তার অর্ধেক চেহারা আর চুল দেখা যাচ্ছে। অপরিচিত কাউকে দেখে চোখে মুখে আতংক বুঝাই যাচ্ছে। চুল থেকে তার টপাটপ পানি পরে মাটি ভিজে যাচ্ছে।

ছেলেটা আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো মেয়েটা মাত্র গোসল সেরে এসেছে।

‘কাকে চাই?’,মেয়েটা প্রশ্ন করে।

‘নানু বাসায় আছে?’, ছেলেটা পাল্টা প্রশ্ন করে।

‘কেউ নেই যান এখান থেকে।বাসায় কেউ নেই তাই আপনাকে ওয়েলকাম করতে পারছি না।’

কথাটা বলে মেয়েটা মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়।

ছেলেটার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
‘সময় হোক তারপর বলবো কাকে চাই।’,বিরবির করে কথাগুলো বলে দরজার পানে চেয়ে থাকে ছেলেটা।

‘রিহ!’, ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে তাকায় সায়ন।

যখন বুঝতে পারে সব স্বপ্ন ছিলো তখন পাশের বালিশটা ছুঁড়ে মারে। বিছানা থেকে উঠে কক্ষের জানালার পাশের দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। মিনিটের মধ্যেই সিগারেটের ধোঁয়ায় পুরো কক্ষ অন্ধকার হয়ে যায়।

‘রি তুমি ধরা দাও না কেনো আমায়? কতগুলো বছর ধরে তোমার দেওয়া যন্ত্রণা ভোগ করছি। একটা ভুলের এতো বড় শাস্তি হয় বলো রি?’

বিরবির করে কথাগুলো বলতে থাকে সায়ন।
পর্বঃ০৫
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ ঈশিতা ইশা
(কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি নিষেধ।)

উঠানের মাঝে বসে মারিয়ার লম্বা চুলগুলো তেল দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে আলেয়া বেগম। হাঁটু পর্যন্ত চুলগুলো সবসময় খোঁপা করেই রাখে। অলসতায় মোটেও চুলের যত্ন করেনা সে। আলেয়া বেগম ধরে সবসময় চুলগুলো তেল দিয়ে আঁচড়ে দেন আর বিনুনি করে দেন।
মুরগী দু’টো জ*বা*ই করে দেওয়া হয়েছে, উঠানের এক পাশে বসে সাবিনা মুরগীর মাংস কা*ট*ছে। আরে একপাশে ল্যাপটপে ইয়ারফোন লাগিয়ে বন্ধুদের সাথে ভিডিও কলে আড্ডায় ব্যস্ত রাইদা।

‘ব্রো গ্রামে কিন্তু সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে যাদের বলা হয় ন্যাচারাল বিউটি নট মেকআপ বিউটি বুঝছিস? আমার জন্য একটা পিওর ন্যাচারাল বিউটি ওয়ালা মেয়ে খুঁজে দে।’,গালে হাত দিয়ে কথাগুলো বলে বাপ্পি।

‘নিজের চেহারা আয়নায় দেখছিস? এই চেহারায় খুঁজে ন্যাচারাল বিউটি।আমাদের বাসায় যে কাজ করে সেই আপুও তোরে পাত্তা দিবে না।’, বাপ্পিকে ভেঙ্গিয়ে বলে পায়েল।

‘এই জরিনা তোরে কয়টা ছেলে পাত্তা দেয়? মেকআপ করে চেহারা বানাতে চাস ক্যাটরিনা হয়ে যাস জরিনা। এ্যাহ আসছে আবার আমাকে বলতে।’,বাপ্পি পায়েলকে ব্যাঙ্গ করে বলে।

‘এক কার্টুন আরেক কার্টুনকে রোস্ট করতে গিয়ে নিজেরাই রোস্ট হয়।’,বিরক্ত হয়ে বলে অর্ক।

‘রোস্ট করে ঠিকাছে কিন্তু সেই রোস্টে মশলা নাই।পুরা রোস্টিং বোরিং প্রচন্ড।এদের রোস্টিং দেখলে আমার ঘুম পায়।’,ঘুমের অভিনয় করে বলে রাইদা।

‘ওদের কথা বাদ দে তুই কেমন এনজয় করছিস সেটা বল।’,রুহি জিজ্ঞেস করে।

‘আর এনজয় কই ভাই।তোদের মিস করছি।একা একা ব্লগ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছি।তোরা কেউ এলি না আমার সাথে এটা ঠিক করিসনি।’,অভিমানী সুরে বলে রাইদা।

‘কীভাবে আসতাম বল আম্মা নিয়ে আসছে খালার বাসায়।কতবার বললাম রাই একা ওর সাথে যাই বলে পরে যাইস এখন গেলে তোর খালা মাইন্ড করবে।’,বাপ্পি উত্তর দেয়।

‘আমার তো জানিসই চাকরির কাহিনী।পরীক্ষার সময় ছুটি কাটিয়েছি তাই এখন ছুটি চাইলে আমাকেই চাকরি থেকে বের করে দিবে।’,রুহি মন খারাপ করে বলে।

‘আমার কাজিনগুলো লন্ডন থেকে এসেছে বেড়াতে ওদের ছেড়ে কীভাবে আসতাম বল রাই? মম রাগ করতো পরে আমার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যেতো।’,চোখ মুখ কাচুমাচু করে বলে পায়েল।

‘অর্ক তুই বাদ গেলি কেনো তোর এক্সকিউজ টাও বল শুনি। আর আরেকজন তো লাইনেই নেই তা স্যার কি ঘুমাচ্ছে নাকি নিজের বউয়ের সাথে ব্যস্ত? কেউ একটু খবর নে তো।’, রাইদা গালে হাত দিয়ে বলে।

‘আমি কল দিয়েছিলাম রিসিভ করে না।রাই তুই কল দে তোর কল রিসিভ করবে।’, পায়েল জবাব দেয়।

‘আসলে রাই তুই তো বলেছিলি একা ট্রিপে যেতে চাস তাই আমরা ভাবলাম তোকে স্পেস দেওয়া উচিত।’,অর্ক কথাগুলো বলে জোর পূর্বক হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে।

‘তার মানে তোরা ইচ্ছে করে আমার সাথে আসিসনি।ঢাকা ফিরি তোদের দেখে নিবো আমি।’,ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে রাইদা।

‘আরে ব্রো এক মাসের লম্বা সেমিস্টার ব্রেক। তুই বরিশাল থেকে ফিরলে আমরা কোথাও ছোট একটা টুর দিয়ে আসবো সমস্যা নেই।’, পরিস্থিতি সামলাতে বাপ্পি বলে।

পায়েল,অর্ক,রুহি, বাপ্পির কথার সাথে একমত পোষণ করে বলে।

‘সালা অর্ক নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারিস না?সবসময় রাইকে সত্যি বলে ঝামেলা পাকিয়ে দেস।’,অর্ককে ঝারি মেরে বলে বাপ্পি।

‘চুপ কর বাপি।’,নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বাপ্পিকে চুপ করতে ইশারা করে পায়েল।

‘এই তুই বাপি বললি কেন আবার? জরিনা তোর কিন্তু বিয়ে হবে না।’,বাপ্পি পায়েলকে উল্টো ঝারি মেরে বলে।

‘সব চুপ ফাহিমকে কল দিয়েছি।’,ফোন কানে বিরক্ত হয়ে বলে রাইদা।
চার বার ফোন রিং হওয়ার পর পঞ্চম বার কলটা যখন রিসিভ হয় না রাইদা রেগে যায়। ল্যাপটপের স্কিনে সকলে রাইয়ের রাগান্বিত চেহারা দেখে বুঝে যায় আজকে ফাহিম শেষ।

ফাহিমের মাকে কল দেয় রাইদা।

‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম আন্টি।আমাদের স্যারকে ফোনটা একটু দেন তো।’,ফোন কানে দিয়ে ফাহিমের আম্মুকে বলে রাইদা।

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম মা।আর বইলো না তোমরা বেড়াতে গেলা আর ফাহিম দেখো আরো বেশি বদমাইশ হয়ে গেছে।সারাদিন রুমের মধ্যে গেমস খেলতে থাকে।খাওয়ার সময় ডাকতে ডাকতে গলা শুকিয়ে যায় আমার। এই ফাহিম দরজা খোল রাই কল দিয়েছে। ফাহিম!’,তৃতীয় ডাক দিতে নিলেই ফাহিম চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে।

‘যাও তুমি ওরে আমি আমার ফোন দিয়ে কল দিচ্ছি।’,ঘুম ঘুম চোখে বলে ফাহিম।

‘একদম না আন্টি।আপনি ওর কানে ফোন দিয়ে রুমে যান বাকিটা আমি বুঝতেছি। ‘, ফোনের অপরপাশ থেকে রাই বলে উঠে।

রাইদার কন্ঠ পেয়ে ফাহিম হেঁসে দেয়। ফাহিমের মা ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। দরজা লাগিয়ে ফোনটা কানে দেয় ফাহিম।

‘বল শুনছি।’,ফাহিম বলে।

‘তোর ফোন থেকে এক্ষুণি ভিডিও কলে জয়েন হ।’,রাগান্বিত স্বরে বলে রাইদা।

‘রাই আমি ফ্রেশ হয়ে কল দিচ্ছি।’,ফাহিম কথা শেষ করার পূর্বেই রাইদা ঝারি মারে।

‘তোর হাতে এক মিনিট সময় আছে জলদি কর।’,ফাহিমকে বলে রাইদা।

ফোন হাতে নিয়ে রাইয়ের কথা মতো ফাহিম কলে জয়েন হয়। খালি গায়ে, এলোমেলো চুল,এক হাতে ফোন ধরে আছে আর আরেক হাতে চোখ ডলতে থাকে ফাহিম। রাই কল কেটে কান থেকে ফোন নামিয়ে ল্যাপটপের স্কিনের দিকে তাকায়।

‘সারা রাত নিশ্চয়ই গেম খেলেছিস?’,ফাহিমকে প্রশ্ন করে রাইদা।

ফাহিম কোনো জবাব দেয় না।

‘বাপ্পি তুই আজকেই ওর বাসায় গিয়ে পুরো গেমিং সেটাপ তুলে নিয়ে যাবি যদি ও ঝামেলা করে তাহলে ওর হাত পা বেঁধে ফেলবি।’,ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বলে রাইদা।

‘ব্রো গেমিং সেটাপ না ঐইটা ওর বউ।ওর বউকে স্পর্শ করলে আমার হাত ভেঙে দিবে ফাহিম।’,বাপ্পি ঢোক গিলে বলে।

‘কেমন আছিস রাই?’,হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে ফাহিম।

‘দেখ ফাহিম আন্টিকে একদম জ্বালাবি না।গোসল সেরে জুম্মার নামাজ আদায় করতে যাবি।’,রাগ দমিয়ে ফাহিমকে বলে রাইদা।

‘ঠিক আছে ম্যাডাম আপনার কথাই শেষ কথা।’,হাসতে হাসতে বলে ফাহিম।

‘রাই তুই আমাদের সকলকে যেভাবে কন্ট্রোল করিস সেভাবে আমাদের বাবা মা ও পারে না।’,পায়েল বলে।

পায়েলের কথা শুনে রাইদা হেঁসে দেয়।

‘কে বলবে এই মেয়েটা একটু আগে অনেক রেগে ফাহিমকে বকাঝকা করছিলো আর এখন হাসছে।তোর জামাইয়ের কথা ভেবেই আমার আফসোস লাগছে, লোকটার কপালে শেষমেশ এই বজ্জাত বউ জুটবে।’,বাপ্পি দাঁত কেলিয়ে বলে।

‘তুই আগে নিজের চিন্তা কর ফাজিল।আচ্ছা রাখছি এখন পরে কথা হবে।অর্ক তোকে ভিডিও গুলো মেইল করেছি চেক করে জানাস আমাকে।’,রাইদা সকলকে বিদায় জানিয়ে ভিডিও কল থেকে বেরিয়ে যায়।

ল্যাপটপ বন্ধ করে সামনে তাকিয়ে দেখে আলেয়া বেগম মশলা বাটছে আর সাবিনা মুরগী কাটা শেষ করে তরকারি কাটছে।

‘মারু কই নানু?’,আশেপাশে তাকিয়ে আলেয়া বেগমকে প্রশ্ন করে রাইদা।

‘নুন আর গরম মশলা নাই তাই সামনের দোকানে পাডাইছি।’,আলেয়া বেগম জবাব দেয়।

প্রশ্নের উত্তর পেয়ে রাইদা ফোন নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।

‘আম্মা শুনলাম মালেকার মাইয়ার নাকি বিয়া?’,সাবিনা আলেয়াকে প্রশ্ন করে।

‘হ সামনের শুক্কুরবার। মহিউদ্দিনের বইন পুত আইছে বুঝলি সাবু।পোলাডা মেলা ডাঙ্গর হইয়া গেছে।প্রেথথমে আমি তো চিনবারই পারি নাই পরে যখন ও কইলে ওয় রিনার পোলা তখন অবাক হইয়া গেছি।’

আলেয়া বেগমের কথা শুনে রাইদা ফোন থেকে মুখ তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘রিনার না আরেকটা ছোড মাইয়া আছে? ‘,সাবিনা প্রশ্ন করে।

‘হ এক মাইয়া আর এক পোলা। পোলাডা যা সুন্দর তার উপর বিলাইয়ের মতো চোখ দুইডা।মাইয়াডারে ছোড কালে দেখছিলাম মেলা সুন্দর। এক্কেরে পুতুলের লাহান।’, আলেয়া বেগম বলে।

‘ওয়েট নানু। গতকালকে যে সায়ন নামক ছেলেটা এসেছিলো সে মহিউদ্দিন চাচার বোনের ছেলে?’,রাইদা প্রশ্ন করে।

‘হ ঐ পোলাডাই গত কালকে আইছিলো সক্কাল বেলা। তুমি নাম জানলা কেমনে?’,আলেয়া বেগম প্রশ্ন করে।

রাইদা ল্যাপটপ হাতে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। কথার জবাব না দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। মাথা ভর্তি এলোমেলো চিন্তা বিরাজ করছে।একে একে পুরনো ঘটনা গুলো মনে পরছে আর গলা শুঁকিয়ে আসছে। রুমে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে খেতে থাকে তাও মনে হলো তৃষ্ণা যেনো মিটছে না। বিছানার উপর বসে হাত পা গুটিয়ে নেয়।

‘মাইয়াডার আবার কি হইলো?’,আলেয়া বেগম রাইদা যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে।

‘আহা আম্মা পোলাপান মানুষ নিশ্চয়ই কোনো বিষয় নিয়া চিন্তায় আছে।আমি ওর সাথে পরে কথা কমুনি আপনে কিছু জিগাইতে যাইয়েন না এমনেও বাপ মা দুইডার লইগ্গা মাইয়াডার জীবন নরক হইয়া গেছে।’,সাবিনা আলেয়া বেগমকে থামিয়ে বলে।

মারিয়া দৌড়াতে দৌড়াতে লবণ আর গরম মশলার নিয়ে হাজির হয়।আলেয়া বেগম আর সাবিনা গিয়ে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে যায়।

পুকুর পাড়ে বসে চোখ বন্ধ করে আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষছে সায়ন। সকালে স্বপ্ন দেখে সেই যে ঘুম ভেঙেছে তারপর আর ঘুমাতে পারেনি। শেষে বিরক্ত হয়ে পুকুর পাড়ে এসে বসেছে।

‘কিরে নায়ক এখানে বসে কি নায়িকার কথা ভাবছিস?’,রুবেল ঠাট্টার স্বরে জিজ্ঞেস করে।

‘নায়িকার কথা ভেবে কি হবে বল সে তো আমাকে ধরাই দেয় না।’,চোখ বন্ধ অবস্থান জবাব দেয় সায়ন।

সায়নের কাছ থেকে এমন জবাব পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খায় রুবেল। সায়নের পাশে বসে ধাক্কা মারে রুবেল।

‘কি কইলি তুই?দোস্ত সত্যি বল তুই কি প্রেমে পরছিস? আমাকে বল মাইয়াটা কে আমি নাম্বার জোগাড় কইরা দিমু।’,রুবেল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে।

‘সর তো না হলে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দিবো তোকে।’,বিরক্ত হয়ে বলে সায়ন।

‘তোর ধাক্কা মারতে হবে না এখন আমি পুকুরে নামবো দ্যাখ তৈরি হয়ে আসছি।’,রুবেল বসা থেকে আবার দাঁড়িয়ে বলে।

সায়ন চোখ খুলে রুবেলের দিকে তাকায় তবে আশ্চর্য হয় না।রুবেল উদ্ভট কাজকর্মে সে অভস্ত্য।

লুঙ্গি পরেছে সাথে সেন্ডো গেঞ্জি আর মাথায় গামছা বেঁধেছে রুবেল তার উপর চোখে কালো চশমা।যামিনী, সানজিদা জোরে জোরে হাসতে থাকে রুবেলকে দেখে।

‘কিরে যোমিনের বাচ্চা হাসিস কেন? এই সাজে কালা চশমা গানে নাচুম তাও তোর বিয়াতে।’, মাথার গামছা ঠিক করতে করতে বলে রুবেল।

‘উল্টাপাল্টা নামে ডাকবিনা একদম।এই সানজিদা চলো তো কলপাড়ে এই বেয়াদবের সাথে তর্ক করাই বৃথা।’,সানজিদাকে নিয়ে যামিনী চলে যায়।

‘যামিনী! শোন তো এদিকে।’,আরাফ যামিনীকে ডাক দেয়।

‘কি বল জলদি।’,যামিনী তাড়া দিয়ে বলে।

পিছন পিছন সানজিদাও এসে দাঁড়ায় আরাফের সামনে।

‘বিকালে গ্রাম দেখতে বের হবো।শ্রেয়া আর তুই যদি যাস তাহলে রেডি হয়ে থাকবি।’, ফোনের দিকে তাকিয়ে আরাফ বলে।

‘শ্রেয়া তো ঘুমে এখনো।যদি ও যায় তাহলে আমি যাবো না হলে ওরে রেখে যাবো না।’,যামিনী জবাব দেয়।

‘ঠিক আছে সেটা তোদের ব্যপার আমার বলা বললাম। ‘,কথাটা বলে আরাফ পুকুরের দিকে হাঁটা দেয়।

যামিনী ও সানজিদাকে নিয়ে কল পাড়ে চলে যায়।

পুকুরে নেমে ইচ্ছে মতো রুবেল ডুবাচ্ছে আর শিমুর হাতে ফোন দিয়ে বলেছে তার ছবি তুলতে।

‘সায়ন!’,আরাফের ডাকে সায়ন মাথা তুলে তাকায়।

‘তোকে মামি খেতে ডেকেছে সকাল থেকে না খেয়ে আছিস।খেয়ে আয় এরপর এক সাথে গোসল সেরে নামাজে যাবনি।’,আবারো আরাফ বলে।

মাথা নাড়িয়ে সায়ন উঠে ঘরের দিকে যায়।

আরাফও নেমে যায় পুকুরে সাঁতার কাটতে। দুই বন্ধু পুকুরের মধ্যেই সাঁতার প্রতিযোগিতা করে অবশ্য আরাফ রুবেলের কাছে হার মানে।

‘ইয়েস জিতে গেছি বন্ধু। ‘,দু-হাত উপরে তুলে রুবেল বলে।

‘কিন্তু বন্ধু জিতেও তুমি হারলা।’,কথাটা বলেই আরাফ রুবেলের লুঙ্গি নিয়ে তীরে উঠে যায়।

ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে রুবেলের বুঝতে মিনিট খানেক লাগে। পাড়ে দাঁড়িয়ে পেট চেপে আরাফ হাসতে থাকে। ডান হাতে রুবেলের লুঙ্গি আর গামছা উচিয়ে দেখায়।

‘তুই আমার বন্ধু নামের শত্রু।এই কাজটা করতে পারলি সালা? দে আমার লুঙ্গি ফেরত দে।’,রুবেল কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে।

‘আমার তো বোন নাই তাহলে সালা বানাবি কীভাবে? এটা কিন্তু বড় চিন্তার বিষয় বুঝলি রুবেল?’,চিন্তা করার ভং ধরে বলে আরাফ।

‘সুযোগ পেলে কিন্তু সুদে আসলে বদলা নিমু মনে রাখিস।তোর বউকে বিয়ার আসর থেকে ভাগাইয়া নিয়া যামু তখন কানতে কানতে চোখের পানি আর নাকের পানি এক করবি।’

‘ঠিক আছে বন্ধু রুপি না হওয়া দুলাভাই যা ইচ্ছা করিস।এই যে লুঙ্গি রাখলাম এখানে নিয়ে নে।আমি যাই টাটা।’,হাসতে হাসতে লুঙ্গিটা বসার জায়গায় রেখে গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে কল পাড়ে পা বাড়ায় আরাফ।

রুবেল অসহায়ের মতো লুঙ্গির দিকে তাকিয়ে থাকে।শিমুও এখানে নেই যে সাহায্য করতে বলবে। পানিতে বসেই চিন্তা করতে থাকে কীভাবে এখানে থেকে বের হবে।

কল পাড়ে গিয়ে আরাফ দেখে সানজিদা মাত্র গোসল সেরে বের হয়েছে। আরাফকে দেখে সানজিদা লজ্জা পেতে থাকে।সানজিদাকে দেখে আরাফের মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয় না উল্টো সে বিরক্ত হয় এ অবস্থায় কারো সামনে পরার কারণে। সানজিদার দিকে না তাকিয়েই আরাফ কলপাড়ে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।সানজিদা মুখটা আমাবস্যার মতো করে স্থান ত্যাগ করে।

‘এই সানজু লুঙ্গিটা এদিকে ফিক্কা মারো প্লিজ না হলে মান ইজ্জত নিয়ে এখানেই বসে দিন পার করতে হবে।’
পুকুরের সামনে দিয়ে সানজিদা যাচ্ছিলো তখন ডাক দিয়ে বলে রুবেল।

সানজিদা বোকার মতো কিছু না বুঝেই লুঙ্গিটা পুকুরে ঢিল দেয়।যতক্ষণে ব্যপারটা বুঝতে পারে ততক্ষণে রুবেলের হাতে লুঙ্গি পৌঁছে যায়।মুখ চেপে হাসতে হাসতে ঘরে যায় সানজিদা।
..

জুম্মার নামাজ আদায় করে মহিউদ্দিন একটা দরকারী কাজে বের হয়ে যায় খাওয়ার সময় টুকুও পায় না।সকালে খাওয়ার কারণে সায়ন আর দুপুরে খেতে চায় না,না খেয়েই রুমে গিয়ে ঘুম দেয়। বাকিরা খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম করতে থাকে।

‘এই যামিনী বের হবি?’,যামিনীকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে আরাফ।

‘না রে শ্রেয়া খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে আর আমারো ঘুম পাচ্ছে।’,হাই তুলে যামিনী জবাব দেয়।

আরাফ কল কেটে রুবেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘সায়ন ও ঘুমে। তুই আর আমি যাই সাথে জাহিদকে নেওয়া যায়।’,রুবেল আরাফকে বলে।

আরাফ ঘড়িতে সময় দেখে বলে,’চল যাই ঘুরে আসি।দাঁড়া ক্যামেরাটা বের করে আনি,এখানে এসেছি পর থেকে বেচারা ক্যামেরা অসহায় অবস্থায় আছে।’

জাহিদকে ঘুম থেকে তুলে জোর করে নিয়ে বের হয় আরাফ আর রুবেল।

..

প্রায় ১ঘন্টা ধরে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির ছবি তুলছে আরাফ। প্রকৃতি তাকে ভীষণ টানে। সময় পেলেই ক্যামেরা নিয়ে প্রকৃতির ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায় সে।

‘এখনকার গ্রাম ও মর্ডান হয়ে গেছে কি এক অবস্থা।’,রুবেল হতাশ গলায় বলে।

‘ঠিক বলছেন ভাই।’,জাহিদও রুবেলের সাথে তাল মিলিয়ে বলে।

আরাফ ক্যামেরা তাক করে আশে পাশের ছবি তুলছে। পিছনে ঘুরে ক্যামেরা দিয়ে দেখে একদল বাচ্চারা ছুটে আসছে। ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি সেদিকে তাকায়।

‘বাচ্চারা দাঁড়াও তোমাদের ছবি তুলি।’,বাচ্চাদের দিকে ক্যামেরা তাক করে বলে আরাফ।

‘আরে দেরি হইয়া যাইবো তো।জলদি ছবি তুলেন।’,একটা বাচ্চা বলে উঠে।

‘এতো তাড়া তোমাদের? যাচ্ছো কোথায়?’,ছবি তুলে প্রশ্ন করে আরাফ।

‘মাস্টার বাড়িতে যাই শহুরে আপায় ডাকছে।’
কথাটা বলে বাচ্চারা চলে যায়।

ক্যামেরা থেকে মুখ তুলে আরাফ বাচ্চাদের যাওয়ার পানে তাকায়।

‘মাস্টার বাড়ি!’

‘কিছু বললি আরাফ?’,রুবেল প্রশ্ন করে।

‘ভাইজান চলেন ফিরি।কালকে সক্কাল সক্কাল আপনাগো নিয়ে বের হমুনি এখন বাড়ি চলেন সন্ধ্যা নামনো একটু পরে,আমার কাম আছে বাইত্তে।’,জাহিদ তাড়া দিয়ে বলে।

‘আমি একটু পরে ফিরবো তুমি চলে যাও।’,আরাফ জবাব দেয়।

‘আমার দুই নাম্বার ধরছে ইমারজেন্সি অনেক। বন্ধু তুই থাক গেলাম।চলো জাহিদ জলদি।’,রুবেল চোখ মুখ খিচে বলে।

‘চলেন চলেন।’,জাহিদ রুবেলকে নিয়ে চলে যায়।

আরাফ মাস্টার বাড়ির রাস্তার দিকে এগুতে থাকে। যত কাছাকাছি যায় গানের শব্দ তত স্পষ্ট হতে থাকে। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে পুরো উঠোন ভর্তি বাচ্চারা সেখান থেকেই গানের শব্দ আসছে। বাচ্চারা গোল হয়ে কাউকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে গিয়ে দেখবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পরে যায় সে।
সকল দ্বিধা পিছনে ফেলে আরাফ উঠানের দিকে যেতে থাকে।

সাউন্ড বক্সে রবীন্দ্র সঙ্গীত চলছে সেই সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেয়েটা নৃত্য করছে। ছোট বেলা থেকেই নৃত্যের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ।

ভীড় ঠেলে মাথা উঁচিয়ে আরাফ ধীরে ধীরে সামনে চলে আসে যেখানে মেয়েটা নৃত্য করছিলো।
মেয়েটাকে দেখে আরাফ বোকা বনে যায়।সম্পূর্ণ সাদা রঙের ফুল হাতার গোল জামা পড়েছে সাথে সাদা চুড়িদার,ওড়নাটা এক পাশে বেঁধে রেখেছে। খোলা চুলগুলো বাতাসের সাথে দুলছে।চুলের সাথে পাল্লা দিয়ে কানের দুলগুলোও সমান তালে দুলছে।

‘শুভ্র রঙের মায়াবিনী!’

গানের আর বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় শব্দে আরাফের বলা কথাটা কেউ শুনতে পায় না।

ক্যামেরার কথা মনে হতেই ক্যামেরা তাক করে মেয়েটার ছবি তুলতে থাকে আরাফ। আরাফকে খেয়াল করলেও মেয়েটা নিজের নৃত্য চালিয়ে যায়।
ছবি তুলতে তুলতে আরাফ খেয়াল করে মেয়েটার সাথে সাথে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে রাকিব। যার কারণে বাচ্চাদের পুরো সার্কেলটা ভিডিওতে ফুটে উঠছে।

গান শেষ হতেই মেয়েটা হাঁপাতে থাকে। মনি পানির বোতল এনে দিলে পানি খেতে শুরু করে সেখান থেকে। মেয়েটা পানি খেয়ে ঘরে চলে যায়। মেয়েটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আরাফ মন খারাপ করে। কথা বলার কোনো সুযোগই সে পায়নি।
সন্ধ্যা নেমে আসে মাগরিবের আজান দেয়। আরাফ মাস্টার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়ায়।

নামাজ শেষ করে মাসজিদের বিপরীতে থাকা চায়ের দোকানে গিয়ে বসে আরাফ।কয়েকজন কাস্টমার ছিলো দোকানে তারা বিল পরিশোধ করে চলে গেছে।এখন দোকানে আরাফ রয়েছে শুধু। বৃদ্ধ দোকানদারকে চা বানাতে বলে সে ক্যামেরা নিয়ে ছবিগুলো আবারো দেখতে থাকে। রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। রাস্তায় মানুষের আনাগোনাও কমতে শুরু করেছে।

‘কারো অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা আইনত অপরাধ জানেন না?এই অপরাধের জন্য আপনার জে*লও হতে পারে।’, দু’হাত নিজের কোমড়ে রেখে বলে মেয়েটা।

কারো কথায় ধ্যান ভাঙে আরাফের।মেয়েটা কখন এসে সামনে দাঁড়িয়েছে আরাফ খেয়াল করেনি সে ব্যস্ত ছিলো ক্যামেরায় সদ্য তোলা তরুণীর ছবি দেখতে। হলুদ বাতির আলোতে মেয়েটার সাদা জামা এখন হলুদ লাগছে এতে অবশ্য আরাফের কাছে মেয়েটার সৌন্দর্য অন্য রকম লাগছে।

‘এতো সুন্দর দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে যদি জে*লে যেতে হয় তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই ম্যাডাম।’,আরাফ হাসি দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে।

‘কার অনুমতি নিয়ে ছবি তুলেছেন?’,মেয়েটা আবারো প্রশ্ন করে।

‘অনুমতি লাগে?আমি ভাবলাম ওপেন শো চলছে। বাচ্চাদের দেখাদেখিই গিয়েছিলাম আমি।’,মাথা চুলকে বলে আরাফ।

‘ওদের আমি ডেকে এনেছি কিন্তু আপনাকে তো ডাকা হয় নি।বিনা দাওয়াতে গিয়েছিলেন আবার ছবিও তুলেছেন। ছবিগুলো ডিলিট করে দিবেন।’,কথাগুলো বলেই মেয়েটা হাঁটা দেয়।

‘আরে মায়াবিনী! ‘, চা শেষ না করেই দোকানদারকে একশো টাকার নোট দিয়ে সেদিকে ছুটে আরাফ।

‘আরে ভাই বাকি টাকা ফেরত নিয়ে যান।’,দোকানদার আরাফকে বলতে থাকে কিন্তু আরাফ সেদিকে পাত্তা দেয় না।

মেয়েটার সামনে এসে হাঁপাতে থাকে আরাফ।

‘কি চাই আপনার?’,মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে মেয়েটা জিজ্ঞেস করে।

‘বেশি কিছু না আপনার নাম জানতে চাই।’, হাসি দিয়ে বলে আরাফ।

‘আপনি কি শুধু নাম জানতেই আমাকে ফলো করছেন?’,মেয়েটা চমকে জিজ্ঞেস করে।

‘মোটেও না।যেখানে যাই আপনি উপস্থিত হয়ে যাচ্ছেন।’

‘আপনি বললেন আর আমি বিশ্বাস করলাম? সরুন বাসায় যাবো।’

‘নামটা বলে যান।’

‘গাছ থেকে আম পেরে এনেছেন? ‘

আরাফ মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়।

‘তাহলে নাম কেনো বলবো? আগে আম পেরে আনেন।’

কথাটা বলে মেয়েটা যেতে নিলেই আরাফ হাত বাড়িয়ে পথ আঁটকে বাঁধা দেয়।

‘এটা বাদে অন্য যা করতে বলবেন করবো কথা দিচ্ছি।’

মেয়েটা একটু ভেবে বলে, ‘নিশ্চিত তো আপনি?’

‘একদম শতভাগ নিশ্চিত আমি।’

‘ঠিকাছে সেদিন সকালে যেখানে দেখা হয়েছিলো সেখানে ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হবেন তখন বলবো কি করতে হবে।’

‘ঠিকাছে আমি উপস্থিত হবো।’

আরাফের জবাব শুনে হাসতে হাসতে মেয়েটা বলে,’মশাই আপনি বড্ড বোকা।’

আরাফ কি বলবে ভেবে পায় না। এর মধ্যে মেয়েটা বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে।

‘মিস আপনার নামটা এখন বলেন প্লিজ।এই যে মিস চশমিশ আরে দূর মিস সাদা জামা।’,ব্যস্ত গলায় আরাফ ডাকতে থাকে।

ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটা হাসিমুখে জবাব দেয়,’রাইদা নাম আমার তবে সবাই ডাকে রাই।রিমেম্বার ইট আই এম রাই।’

রাইদার শেষে বলা রাই শব্দটা একটু জোরে বলার কারণে সেটা আরাফের কানে প্রতিধ্বনি হতে থাকে।

হাসতে হাসতে রাই চলে যায় আর আরাফ সেখানেই বুকের বা পাশে হাত রেখে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয় রাইয়ের হাসিমুখ দেখে।

‘আরাফ তুই তো শেষ!এখন এই রাইয়ের জাল থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না।’,নিজের মাথায় নিজে থাপ্পড় মেরে বলে আরাফ।

(চলবে..)

(বিশাল পর্ব দিয়েছি পড়ে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন কেমন লাগলো।)

চলবে..

(কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন কেমন লাগলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here