পর্বঃ০৭
গল্পঃ #সেদিন_দেখা_হয়েছিলো
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(কার্টেসি ছাড়া গল্প কপি নিষেধ।)
…
চেয়ারম্যান বাড়ির উঠানে বাড়ির সকল মহিলারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আশে পাশের বাড়ির মহিলা মুরব্বিরাও এসেছে।তাদের কেন্দ্রবিন্দু রাইদাকে ঘিরে। চেয়ারে রাইদাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এক প্রকার বলা যায় জোর করেই, সাবিনা আর আলেয়া বেগম তাকে বসিয়ে রেখেছে। সাবিনা আর আলেয়া বেগম দু’জনে গল্পে মেতে উঠেছে পাশেই বসে রাইদা গ্রুপ চ্যাট করছে। মারিয়া সাবিনার ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আর বারবার বাড়ির ভেতরের দিক তাকাচ্ছে।
‘এই তোমরা সরো তো মাইয়াটারে সরবতটা খাইতে দাও।’,ট্রে ভর্তি সরবতের গ্লাস এনে টুলের উপর রাখেন মনিরা। একটা গ্লাস তুলে রাইদার হাতে দেয়। বাকিরাও সরবতের গ্লাস তুলে খেতে থাকে।
‘আরে চাচী এসবের আবার কি দরকার ছিলো?’,রাইদা অনিচ্ছা সত্বেও গ্লাসটা হাতে নেয়। ট্যাংয়ের সরবত তার মোটেও পছন্দ না।
‘কতক্ষণ ধইরা বইয়া আছো তাও বুড়া মাতারিগো মইদ্যে। তুমি সানজিদার খালার লগে ঘরে গিয়া আলাপ করো।আমরা এইহানে বইয়াই গপ্প করুম।’
কথাগুলো বলে মনিরা বেগম হাসিমুখে রাইদার দিকে তাকায়। গ্লাস হাতে নিয়েই সানজিদার খালা সোনিয়ার পিছন পিছন বসার ঘরে যায়।
‘তুমি এইহানে বহো মুই একটু বাথরুম থেইকা আহি। আর সরবতটা খাও।’, সোনিয়া রাইদাকে বলে।
রাইদা এক চুমুক সরবত খায় ততক্ষণে সোনিয়া চলে গেছে।সোনিয়া যেতেই সরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।
‘আই হেট অরেঞ্জ ফ্লেভার ট্যাং।এইগুলা মানুষ কীভাবে যে খায় কে জানে।’,ট্যাংয়ের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলে রাইদা।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই এই সুযোগে গ্লাসের সরবত কোথাও ফেলে দেওয়ার মতলব করে কারণ গ্লাস খালি না দেখলে সবাই বুঝে যাবে সে খায়নি। পরে দেখা যাবে এই কারণে মনিরা বেগম রাগ করেছে।নানুর কাছ থেকে শুনেছে মনিরা বেগম এইসব বিষয়ে অনেক বেশি খুতখুতে মানুষ।
গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরের ভেতরে পা বাড়ায়। উঠানে সবাই থাকায় ঘর বলা যায় একেবারে ফাঁকা। যেহেতু সে এ বাড়ির কিছুই চিনে না তাই রান্নাঘর খুঁজে পেতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।চোরের মতো হাঁটতে হাটতে সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। ডান বামে তাকিয়ে ভেবে নেয় আগে ডান দিকে দেখবে রান্নাঘরটা এখানে কিনা তারপর না পেলে বামে দেখবে।
ডান পাশে গিয়ে দেখে দু’টো দরজা।প্রথম দরজাটা বাহির থেকে লাগানো।ছিটকানি খুলে উঁকি মারে সে। রান্নাঘর না পেয়ে হতাশ হয়ে পাশের রুমের দরজা খুলে উঁকি দেয়। কারো পায়ের শব্দ পেয়ে তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।আস্তে আস্তে পায়ের শব্দ বাড়তে থাকে ভয়ে রাইদা সরবতের গ্লাসটা রুমের মধ্যে থাকা ছোট টেবিলের উপর রেখে পুরো রুমে চোখ বুলায়।শেষে উপায় না পেয়ে খাটের নিচে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করলেই ধরা পরে যেতো সে।খাটের নিচে ঢোকার পরই কে জানি দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। চোখমুখ খিঁচে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকে রাইদা যাতে ধরা না পরে। মেহমান হয়ে এসে শেষে কিনা এক গ্লাস সরবত ফেলতে গিয়ে চোরের মতো এভাবে কারো খাটের তলায় বসে আছে এটা ভেবেই নিজেকে নিজে তিরস্কার করতে শুরু করে রাইদা।
দরজা লাগিয়ে ছেলেটা রুমে পায়চারী করতে থাকে। ধপ করে এসে বসে পরে বিছানার উপর। গায়ের শার্টটা খুলে বিছানায় ফেলে দেয়। সদ্য কিনে আনা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায়। মূহুর্তের মধ্যেই পুরো ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়।বদ্ধ ঘরে সিগারেটর গন্ধ নাকে আসতেই চোখ খুলে তাকায় রাইদা। মুখে হাত দিয়ে কাশি আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। ছেলেটা বসা থেকে দাঁড়িয়ে রুমের মধ্যে পায়চারী করতে থাকে আর সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে থাকে। একটা সিগারেট শেষ হওয়ার পূর্বেই আরেকটায় আগুন ধরায়।এবার আর সহ্য না করতে পেরে কাশতে কাশতে হুড়মুড়িয়ে খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে রাইদা। উঠে দাঁড়িয়ে সায়নের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে রুমের জানালা খুলে সেটা বাহিরে ফেলে দেয়। আকস্মিক ঘটনায় সায়ন পুরো বোকা বনে যায়।
‘বদ্ধ ঘরে কেউ সিগারেট খায়? কাশি আটকাতে গিয়ে তো আরেকটু হলে আমি মরেই যেতাম।’, কাশতে কাশতে বলে রাইদা।
টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল এনে সায়ন খেতে দেয় তাকে। বিছানায় বসে বোতল হাতে নিয়ে পানি খেতে শুরু করে রাইদা। পানি খেয়ে হাঁপাতে শুরু করে সে। সায়ন এখনো রোবটের মতো দাঁড়িয়ে রাইদাকে পযর্বেক্ষণ করছে।তার যেনো বিস্ময় এখনো কাটছে না।
‘আমার হাতে একটা চিমটি কাটো কুইক।’,ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে সায়ন।
মাথা তুলে সায়নের দিকে তাকিয়ে রাইদা বলে,’মাথা যতটুকু ভালো ছিলো সেটুকু মনে হয়ে গেছে আপনার? আপনাকে আমি চিমটি কাটতে যাবো কোন দুঃখে?’
‘তুমি না কাটলে আমি কাটছি।’,কথাটা বলেই এক হাত দিয়ে রাইদার মুখ চেপে আরেক হাত দিয়ে রাইদার বাহুতে চিমটি কাটে সায়ন।
‘তাহলে স্বপ্ন না সত্যি সত্যি তুমি এসেছো।এখন বলো তো এ রুমে লুকিয়ে লুকিয়ে কি করতে এসেছিলে? ওয়েট তুমি কি আমার উপর নজর দিয়েছো নাকি? ছি ছি রাই এভাবে কেউ অন্যের স্বামীকে লুকিয়ে দেখে?’,রাইকে ছেড়ে দিয়ে বলে সায়ন।
‘আপনার সাহস তো কম না আমাকে চিমটি কেটেছেন আবার বলছেন আপনার দিকে নজর দিয়েছি।শুনুন রাইয়ের এতো খারাপ দিন আসেনি যে আপনার মতো অসভ্য লোকের দিকে নজর দিবে।’,কথাগুলো বলে সায়নের হাতে জোরে চিমটি কাটে রাইদা। সায়ন কোনো রিয়াকশন না দিয়ে হাসতে থাকে।
চিমটি কেটে যখন সায়নকে জব্দ করতে পারে না তখন বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার পরে আছে। সেগুলো নিজের কব্জায় করে সায়নকে ভেংচি মেরে রুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় রাইদা। সায়ন হাসতে হাসতে উন্মুক্ত শরীরে দরজার সামনে গিয়ে দু’হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়িয়ে রাইদার যাওয়ার পানে তাকায়।
একবার পিছনে ফিরে সায়নকে দেখে আবারো ভেংচি কাটে রাইদা এরপর বসার ঘরের দিকে যায় সে। সায়ন সেখানেই দাঁড়িয়ে দু’হাতে দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি থামানোর চেষ্টা করে।মিনিট খানেক বাদে মুখ থেকে হাত সরালে দেখে কয়েক হাত দূরে মারিয়া দাঁড়িয়ে তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মুখে গম্ভীর ভাব এনে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় সায়ন।
মারিয়া কিছু না বুঝে লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
রুমে এসে টেবিলের উপর থাকা সরবতের গ্লাসের দিকে নজর গেলে সায়ন সেটা হাতে তুলে নেয়।গ্লাসে লিপস্টিকের রঙ দেখে বুঝে যায় এ গ্লাসে কে সরবত খেয়েছে। একটানে সরবতটা খেয়ে গ্লাসটা টিস্যুতে মুড়িয়ে নিজের লাগেজে ভরে রাখে।
বসার ঘরে যেতেই রাইদা দেখে যামিনী আর শ্রেয়া প্রবেশ করছে।ওদের সাজসজ্জা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাহির থেকে এসেছে।
‘তোমাকে চেনা চেনা লাগছে।তোমার সাথে পূর্বে আমাদের দেখা হয়েছে?’,রাইদার সামনে এগিয়ে এসে যামিনী প্রশ্ন করে।
‘আপনারা যেদিন প্রথম গ্রামে এসে শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখেছিলেন সে আমিই।’,হাসিমুখে জবাব দেয় রাইদা।
রাইদার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যামিনী বলে,’ হ্যা তাই তো তুমিই সেই মেয়েটা।ভালো করে না দেখলে চেনাই যাবে না স্পেশালি তোমার চশমার কারণে।’
‘না চেনার কি আছে? শাড়ি ছেড়ে থ্রি পিস পড়েছে অবাক হওয়ার কিছু তো দেখছিনা।’,শ্রেয়া বিরক্ত মুখে বলে।
‘ভালো আছেন আপু? গ্রাম কেমন ঘুরছেন?’,হেঁসে শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে রাইদা।
‘এর মধ্যে শুদ্ধ ভাষাও রপ্ত করে ফেলেছো? আজকাল গ্রামের মেয়েগুলো ও আল্টা মর্ডান হওয়ার চেষ্টা করছে।’,শ্রেয়া তাচ্ছিল্য স্বরে বলে।
মারিয়া বসার ঘরে প্রবেশ করছিলো তখন শ্রেয়ার কথা কানে আসতেই জবাব দিতে নেয় কিন্তু চোখ রাঙিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় রাইদা।
‘শ্রেয়া থাম তো তুই।যা রুমে যা চেঞ্জ কর আমি আসছি।’,যামিনী শ্রেয়াকে বলে।
শ্রেয়া রাইদার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি ফেলে রুমে চলে যায়।
‘ওর কথা কিছু মনে করো না তুমি।ও একটু এমনই তবে মনের দিক থেকে অনেক ভালো।’, কথাগুলো বলে পরিস্থিতি ঠিক করার চেষ্টা করে যামিনী।
‘আরে না আপু আমি কিছু মনে করিনি।আপনারা বোধহয় বাহির থেকে এসেছেন।গিয়ে জামা পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নেন পরে কথা হবে।’,রাইদা যামিনীকে বলে।
যামিনীও হাসিমুখে রুমের দিকে যায়।
সন্ধ্যার পর সকলে ঘরের ভেতর চলে আসে।সাবিনা,আলেয়া বেগম রান্নাঘরে বসে মনিরার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। এদিকে বসার ঘরে মারিয়া গল্প করছে সানজিদা আর সোনিয়ার সাথে।রাইদা ফোন হাতে গ্রুপ চ্যাটে ব্যস্ত। যামিনীও সেখানে বসে আছে।যামিনী মনোযোগ দিয়ে মারিয়ার বলা ঘটনা শুনছে আর হাসছে।শ্রেয়া নিজের রুমেই আছে।
ফোনে কল এলে রাইদা বসার ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে যেতে নিলেই কারো সঙ্গে ধাক্কা খায় খায় অবস্থা। বিব্রতকর চেহারা করে সামনে তাকায় সে।
‘সরি আপা আমি দেখিনি।আপনি কিছু মনে করবেন না।আসলে আমি রাতকান চোখে কম দেখি।সেইজন্যই আন্ধার নামলে পেঁচার মতো নিড়ে ফিরে আসি।’,দাঁত কেলিয়ে বলে রুবেল।
‘পেঁচা দিনে দেখতে পায় না তবে রাতে সব পরিষ্কার দেখতে পায়।আপনার অবস্থা দেখছি পুরো উল্টো।’,হাসতে হাসতে বলে রাইদা। ফোন আবারো বেজে উঠতেই স্থান ত্যাগ করে সে।
রাইদার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবনায় পড়ে যায় রুবেল।বসার ঘরে ঢুকেই যামিনীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
‘এই যোমিন পেঁচা নাকি দিনকানা হয়?’
‘আবার শুরু করলি তোর এই ভংচং প্রশ্ন।চুপ করে বস না হলে জানালা দিয়ে তোরে বাগানে ঢিল দিবো।’,রেগে বলে যামিনী।
‘এই টুকু জানালা দিয়ে আমাকে কীভাবে ঢিল দিবি? জানালা তো কাটতে হবে।তাছাড়া আমাকে তুলতে পারবি?আমার ওজন সত্তর কেজি তোর মতো বাঁশের সাইজের মেয়ে আমায় তুলতে পারবে না।’
রুবেল কথা শুনে বাকিরা হাসতে থাকে আর যামিনী চোখ গরম করে তাকায় রুবেলের দিকে।
..
পুকুর পাড়ে এসে ফোন কানে দিয়ে কথা বলতে থাকে রাইদা।
‘কিরে গতকালকে বকা খেয়ে এখন আবার কল দিলি কি মনে করে?’,রাইদা প্রশ্ন করে ফাহিমকে।
‘আম্মু তোকে মিস করতেছে বুঝলি? তুই নাই তাই পাশের ফ্লাটের আন্টির সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে কবে ফিরবি সে নাকি তোর জন্য কাকে দিয়ে আমসত্ত্ব আর আচার বানিয়ে এনেছে।’, কম্পিউটারের সামনে বসে ফোনে কথা বলতে থাকে ফাহিম।
‘আরে কি বলিস আমসত্ত্ব সাথে আবার আচার! আন্টিকে বল জলদি আসবো তবে পায়েল আর রুহিকে যেনো না বলে তাহলে আমাকে রেখে ওরা শেষ করে ফেলবে সব।আন্টির সেই আমসত্ত্ব এতো মজা জিভে জল চলে আসে।’,উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে রাইদা।
‘ঠিক আছে বলবো না। ফিরবি কবে বললিনা তো।বাপ্পি বলেছিলো ছোট একটা টুরের প্লান করেছে।’
‘আর হয়তো একসপ্তাহ থাকবো বেশি দেরি করবো না।’
‘তুই না বলেছিলি পুরো ছুটি কাটিয়ে আসবি?’
‘বলেছিলাম কিন্তু এখন পরিকল্পনা পাল্টেছি। কয়েক জায়গায় গিয়ে ব্লগ করার ইচ্ছে আছে সেগুলো শেষ হলেই এক মিনিটও অপেক্ষা করবো না ঢাকা ফিরে যাবো।’
‘কোনো সমস্যা হলে দরকার হলে কল দিস।রাখছি এখন।’
‘তুই তোর বউ গেমিং সেটাপের থেকে দূরে থাক আগে।আর শোন তোকে ভিডিও মেইল করেছি, দেখেছিস?’
রাইদার কথা শুনে ফাহিম হেঁসে দেয়।
‘হ্যা দেখেছি।কাজ হয়ে যাবে তুই নিশ্চিন্তে এনজয় কর।’
‘আচ্ছা রাইখি তাহলে।’,কথাটা বলে রাইদা কল কেটে দেয়।
কল কাটার পর ফাহিম গেম খেলতে বসে যায়।
ফোন লক করে রাইদা পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে।চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে যেটুকু আলো আসছে তা দিয়ে পুকুরের পানি দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না।কিছুক্ষণ পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
রাইদা বসার ঘরে এসে দেখে সকলে আড্ডা দিচ্ছে।যেই চেয়ারে সে বসে ছিলো সেখানে আরাফ বসে ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখছে।
‘তুমি তো মনে হয় আমাদের ছোট হবে।ছোট আপু আসো এখানে বসো।তোমাকে চেনাচেনা লাগতেছে।’,রুবেল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে রাইকে দেখে।
‘আরে ঐ মেয়েটা প্রথমদিন যে দেখা হয়েছিলো।’,রুবেলকে বলে যামিনী।
‘কোন মেয়ে?আমার তো মনে পড়ে না এমন কারো সাথে দেখা হইছে।’,রুবেল আবারো চিন্তা করতে থাকে।
‘থাক ভাইয়া ছোট্ট মাথায় প্রেসার দিতে হবে না তাহলে মাথাটা ব্লাস্ট হয়ে যাবে।’,হেঁসে রুবেলকে বলে রাইদা।
রাইদার কন্ঠ পেয়ে ক্যামেরা থেকে মুখ তুলে পাশে তাকায় আরাফ।এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি রাইদাকে। রাইদা আঁড়চোখে আরাফকে দেখে রুবেলের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে।
আরাফ মাথা চুলকে রাইদার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়।রাইদা ভ্রু উঁচিয়ে হাসার কারন জানতে চায় ইশারায়। আরাফ ইশারা ক্যামেরা দেখায়।রাই বুঝে যায় ক্যামেরায় কিছু দেখে আরাফ হাসছে। সকলের সাথে আড্ডায় বসে থাকলেও রাইদার চোখ জোড়া বারবার আরাফের দিকে যেতে থাকে।আরাফও ক্যামেরা উঁচিয়ে ছবি দেখার বাহানায় রাইদার দিকে তাকিয়ে আছে।
..
‘ভাই মেলা ভালা মানু আছিলো।মোরা এক লগে চায়ের দোকানে কত যে গপ্প করছি হিসাব নাই গা।যহন চেয়ারম্যান আছিলাম না তহন হেয় মোরে মেলা সাহায্য করছে।’,মহিউদ্দিনের বাবা খাবারের টেবিলে বসে কথাগুলো বলছিলো।
‘চাচাজান আসলেই ভালো মানুষ ছিলেন।কীভাবে যে কী হলো বুঝতেই পারলাম না।’,মহিউদ্দিন আফসোসের স্বরে বলে।
‘কার কথা বলতেছেন?’,রুবেল প্রশ্ন করে।
‘সাবিনার বাপের কথা।’,মহিউদ্দিনের বাবা জবাব দেয়।
‘আরে ও কি সাবিনাকে চিনে নাকি।রাইদার নানার কথা বলছি।আমার বাবা আর রাইদার নানা চাচাতো ভাই।’,মহিউদ্দিন রুবেলের প্রশ্নের জবাব দেয়।
এমন আশ্চর্য তথ্য পেয়ে রুবেল রাইদার দিকে তাকায়।রাইদার ভাবভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয় না।সে আগে থেকেই এসব জানতো।
রাইদার মন এখানে একদম টিকছে না দম বন্ধ হয়ে আসছে তারউপর একম সামনাসামনি বসেছে আরাফ। আরাফ বুঝতে পারে রাইদা বিব্রতবোধ করছে তাই সে রাইদার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সায়ন এসে রাইদার পাশ থেকে মারিয়াকে উঠিয়ে সেখানে বসে।বিষয়টা কেউ আমলে না নিলেও রাইদা খুব বিরক্ত হয়।মারিয়া গিয়ে আরাফের পাশে ফাঁকা থাকা চেয়ারে বসে।
‘আসলে আমি চাচ্চুর পাশে বসতে চাচ্ছিলাম তাই মারিয়াকে উঠিয়ে দিয়েছি।কেউ আবার মাইন্ডে নিয়েন না।’,সায়ন কথাগুলো বলে ফোন টিপতে থাকে।
রাইদার মনে হয় কথাগুলো সায়ন তাকেই বলেছে।তার ইচ্ছে করে সামনে রাখা কাচের গ্লাস সায়নের মাথায় মারতে।
‘তা তোমরা কি প্লান করলা কোথায় ঘুরবা?’,মহিউদ্দিন সায়নকে জিজ্ঞেস করে।
‘কুয়াকাটা যাবো আগামীকালকে সকালে।তোমাকে খাবারের টেবিলে বলবো ভেবেছিলাম।’,সায়ন জবাব দেয়।
‘রাই আপুও তো কুয়াকাটা যাইবে পরশু।’,সায়নের কথার মধ্যে বলে উঠে মারিয়া।
রাইদা মাথা ঘুরিয়ে মারিয়াকে খেয়ে ফেলবো মূলক লুক দেয়।ভয়ে মারিয়া মুখে আঙুল দেয়।
‘একলা কেন যাবা আমাদের সাথে চলো।’,রুবেল বলে।
‘হ্যা ঠিক কথা তো মেয়ে মানুষ একা ট্রিপ দেওয়া একদম সেফ না।রাই তুমি আমাদের সাথে চলো।’,যামিনী বলে।
‘রাইদা তুমি তাই করো ওদের সাথে যাও।তোমার ঘুরাও হবে আবার সবাই চিন্তা মুক্ত ও থাকবে।’,এবার মহিউদ্দিন রুবেল আর যামিনীর কথার সাথে একমত পোষণ করে।
‘আরে না মামা আমার অভ্যাস আছে সমস্যা হবে না।আমি প্রায় একাই টুর দেই।’,রাইদা তড়িঘড়ি করে বলে।
‘সে কি কথা রাইদা তুমি এখনো ছোট একা একা ঘুরা তোমার জন্য বিপদজনক। ‘,যামিনী বলে।
যামিনীর মুখে এমন কথা শুনে রাইদা কেশে উঠে।সানজিদা পানি এগিয়ে দেয় খেতে।রাইদা পানিটা খায় না।
‘ছোট বাচ্চা! বিয়ে হলে এতদিনে ফুটবল টিমের মা হতো।’,বিরবির করে বলতে থাকে সায়ন।
কেউ না শুনলেও পাশে বসা রাইদা ঠিকই শুনে কথাটা।
‘সাবিনা শোন তো।’,মহিউদ্দিন সাবিনাকে ডাক দেয়।
‘জি মিয়া ভাই কন।’,রান্নাঘর থেকে এসে বলে সাবিনা।
‘সায়নরা কুয়াকাটা যাবে শুনলাম রাইদাও যেতে চাচ্ছে।তো আমি ভাবছিলাম মেয়ে মানুষ একা না পাঠিয়ে ওদের সাথে পাঠা।দিন কালের যা অবস্থা একা যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।’,মহিউদ্দিন বলে সাবিনাকে।
সাবিনা রাইদার দিকে তাকায়।রাইদা ইশারায় না করতে বলে।
‘মামু কেনো জোর করছো বলো তো? কেউ নিজে বিপদে পড়তে চাইলে তুমি তো আটকাতে পারবা না।’,সায়ন হুট করে বলে।
রাইদা সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে সায়নের দিকে তাকায়,সায়ন তার মামার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘রাইদা ওগো লগেই যাইবো সমস্যা নাই।মাইয়া মানুষের একা যাওয়া বিপদজনক। ‘,সাবিনা উত্তর দেয়।
রাইদা অসহায় ভাবে সাবিনার দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু সাবিনা তা অগ্রাহ্য করে রান্নাঘরে যায়।
‘ব্যস তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেলো রাইদা তোমাদের সাথে যাচ্ছে।’,মহিউদ্দিন সায়নকে বলে।
‘কিন্তু মামা..’,রাইদা কিছু বলতে নিলেই মহিউদ্দিনের কথায় থেমে যায়।
‘কোনো কিন্তু না বড়দের কথা শুনতে হয় মামনি।তোমার ভালোর জন্যই বললাম।’,রাইদাকে থামিয়ে দিয়ে বলে মহিউদ্দিন।
মনিরা টেবিলে একে একে খাবার এনে রাখতে শুরু করে। সকলে খাবার নিয়ে খেতে থাকে।
অসহায় দৃষ্টিতে রাইদা খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকে এরপর আরাফের দিকে তাকায়।দেখে আরাফ ইশারায় জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে। বাম হাতের আঙুল মাথায় দেখিয়ে রাইদা বুঝায় আপনার মাথা। রাইদার কাছ থেকে ইশারায় উত্তর পেয়ে আরাফ হাসতে থাকে।
‘কিরে মামা জোক্স মনে পড়ছে? আমাদের সাথে শেয়ার কর আমরাও হাহা হিহি করে হাসি।’,রুবেল বলে আরাফকে।
‘এই জোক্স কারো সাথে শেয়ার করতে পারবো না। ‘,আরাফ রুবেলকে বলে।
আরাফের থেকে এমন উত্তর পেয়ে রুবেল মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে ফেলে।
মহিউদ্দিন,মহিউদ্দিনের বাবা,শিমু,,সায়ন,মারিয়া,আরাফ,রাইদা,রুবেল,যামিনী, শ্রেয়া আর মহিউদ্দিনের শালক টেবিলে খাচ্ছে।
মনিরা,আলেয়া বেগম,সাবিনা,সোনিয়া আর সানজিদা ঠিক করেছে সকলের খাওয়া হলে তারা ধীরে সুস্থে খাবে।সাবিনা অবশ্য তার ছেলেকে রান্নাঘরে বসিয়েই খাইয়েছে।
খাওয়া শেষ করে মহিউদ্দিন বসার ঘরে গিয়ে সকলকে ডেকে পাঠায়।সায়ন,রুবেল,যামিনী, রাইদা,আরাফ সেখানে উপস্থিত হয়।শ্রেয়া রুমে চলে গেছে এসব বিষয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।
‘কালকে সকালে কখন বের হইবা তোমরা?’,সায়নকে প্রশ্ন করে মহিউদ্দিন।
‘ভোরে বের হবো দেরি করা যাবে না একদম।’,সায়ন জবাব দেয়।
‘তোমরা এই কয়জনই তো যাবা? গাড়ির চাকা আমি ঠিক করিয়ে দিয়েছি সমস্যা হবে না আশা করি।’,মহিউদ্দিন বলে।
‘আব্বা আমিও যাইবার চাই।’,দরজায় দাঁড়িয়ে বলে সানজিদা।
‘চল সমস্যা নেই কোনো।মামু সানজিদাকেও নিয়ে যাই।’,সায়ন বলে।
‘আরে না ওর পড়া বাদ দিয়ে এখন ঘুরাঘুরি করা উচিত হবে না।স্কুল,প্রাইভেট এগুলো আছে না।’,মহিউদ্দিন না করে দেয়।
‘চিন্তা করো না মামু কয়েকদিনের ব্যপারই তো।’,সায়ন বলে।
‘তোমরা সব প্রাপ্ত বয়স্করা ঘুরতে যাচ্ছো সেখানে বাচ্চাদের গিয়ে কাজ নেই।তোমরা ঘুরে আসো তারপর না হয় বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও যাবে।’,মহিউদ্দিন বলে।
মহিউদ্দিন তার সিদ্ধান্তে অটুল থাকে কেউ রাজি করাতে পারে না।
‘এই রাই বাড়ি চল অনেক রাইত হইয়া গেছে। তোর তো আবার আইতে হইবো।’,সাবিনা বসার ঘরে এসে বলে।
‘মানে?’,রাইদা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘ওরা তো ভোর বেলা বাইর হইবো তো ওতো সকালে তুই যদি না উঠতে পারস তাই রাইতটা এই বাইত্তেই কাডাবি।চল তোর জামা কাপড় নিয়া আবি।’,সাবিনা বলে।
‘অসম্ভব খালামনি এটা আমি পারবো না।’,রাইদা বলে উঠে।
‘আরে সমস্যা কি সাবিনা ঠিকই বলেছে যাও তোমার জামা কাপড় নিয়ে আসো।এই কেউ ওদের এগিয়ে দে আর রাই তো একা ফিরতে পারবে না ওকে সঙ্গে করে আনার জন্য কাউকে দরকার।’,মহিউদ্দিন বলে।
‘আমি যাচ্ছি মামু তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।’,সায়ন বলে।
‘হ যা তুই আমরা ঘুমাইতে গেলাম।’,রুবেল হাই তুলতে থাকে।
রাইদা মুখ কালো করে আরাফের দিকে তাকায়।আরাফ কি বুঝলো কে জানে সে ভাবনায় পড়ে যায়।
‘আমিও যাই তোর সঙ্গে চল।’,আরাফ বলে।
‘ভোরে উঠতে হবে তুই ঘুমাতে যা আর এখন আমি বেড়াতে যাচ্ছি না যে তোর সাথে যেতে হবে। আমরা যাবো আর আসবো।’,আরাফকে সরাসরি না করে দেয় সায়ন।
আরাফ চোখের পলক ফেলে রাইদাকে আশ্বাস দেয়।রাইদা বিরক্ত হয়ে বিরবির করতে থাকে।
…
চলবে…
(কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন কেমন লাগলো।)