#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি
হালকাভাবে ধাক্কা দিতেই বাড়ির দরজা খুলে যায়। সামনের দৃশ্য দেখার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিল না ধারা। চোখের কোণে জল জমা হয় তার। সামনে দাঁড়ানো সবাই চেঁচিয়ে উঠে, “শুভ জন্মদিন।” সারা ঘরে নীল-সাদা বেলুন দিয়ে সাজানো। ড্রয়িংরুমটা বেশ সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে। দেয়ালে সুন্দর করে বাংলায় লেখা, “শুভ জন্মদিন, ধারা।” সত্যি বলতে কাজের চাপ আর মানসিক অশান্তিতে নিজের জন্মদিনের কথা ভুলে গিয়েছিল ধারা কিন্তু স্রোতসহ বাকি সবাই মিলে যে তাকে এভাবে সারপ্রাইজ দেবে তা সে ভাবেনি। স্রোত, সৌহার্দ্য, হায়া, তিতিরসহ ধারার বাবা-মাও এই প্ল্যানে শামিল ছিলেন। ধারার খুশিতে চোখের অশ্রু বাধ মানছে না। হুট করেই অনেকগুলো খুশি এসে সামনে পড়লে যেমন বাঁধভাঙা উল্লাসে মন নেচে উঠে ঠিক তেমন অবস্থা ধারার।
ভ্যানিলা কেকটা কাটা হলো। সবাইকে কেক খাইয়ে স্রোতের কাছে আসতেই ধারা খেয়াল করলো স্রোতের মুখ মলিন। কেক খাওয়ার সময়ও ছেলেটার মুখে হাসি ছিল না অথচ এতসব আয়োজন তারই প্ল্যান করা। ধারা বুঝে উঠতে পারছেনা স্রোতের আসলে হয়েছেটা কী। কেক কাটার পর ছোটরা সব আড্ডা দিতে বসলো।
“আচ্ছা, আড্ডা শুরু করা যায় কী দিয়ে?” সৌহার্দ্য প্রশ্ন করলো।
“অবশ্যই ধারা আপুর গান দিয়ে।” তিতির হালকা হেসে বললো।
তিতিরের কথায় ধারা খানিকটা ম্লান হাসলো। স্রোতের মলিন মুখটা তাকে মন থেকে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। মন ভালো না থাকলে কি আর গান গাওয়া যায়? তবুও সবাই প্রচণ্ড জোর করতে লাগলো ধারাকে গান গাওয়ার জন্য। ধারার কেন যেন আজ স্রোতকে উদ্দেশ্য করে একটা গান গাইতে বড্ড ইচ্ছে করছে। ধীরে ধীরে গাইতে শুরু করলো ধারা,
“কত প্রেম ঝরে গেল এ শীতে,
পাতাঝরা প্লাবনের অযুহাত,
তোমার বাহুডোরের ভার খুব
আমার দুচোখে ঢাকে মাঝরাত।
কত ছোঁয়া দূরে সরে গেল হায়,
প্রেম হাঁটলো না কই মিছিলে?
রোদ্দুর জানে এক বসন্তে তুমি আমায় প্রেমিকা ডেকেছিলে। ”
________________
রাতের শেষ ভাগ। আড্ডা শেষ হয়েছে আধঘণ্টা আগে। তিতির গেস্টরুমে ঘুমিয়েছে। সৌহার্দ্য ও হায়া দুজনে একটা রুম আর স্রোত-ধারা ধারার রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্রোতের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। বালিশে হেলান দিয়েছিল মাত্র সে। ধারা হঠাৎ করে স্রোতের বুকে এসে মাথা রাখলো। স্রোতের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। বুকে চলতে থাকা ঝড়টা যেন মাত্র থামলো, শান্ত হলো বক্ষপিঞ্জরের অস্থিরতা। একটু বাদেই স্রোত অনুভব করলো তার শার্ট বুকের কাছে ভিজে উঠছে।
“ধারা, তুমি কাঁদছো?” ধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে স্রোত।
“তুমি প্রচণ্ড খারাপ স্রোত। তুমি কষ্ট দিচ্ছো আমাকে।”
“তিতিরের সাথে মিলে যে ড্রামাটা তুমি করেছিলে সেটা আমি তোমার মুখ থেকে জানতে পারলে খুশি হতাম।”
“আসলে বিষয়টা এমনভাবে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যে আমি নতুন করে আর বলে উঠতে পারিনি।”
“তোমায় কিছু কথা বলি ধারা। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলো জানার অধিকার তোমার আছে। ঠিক একইভাবে তোমার সাথে কখন কী হচ্ছে তা জানার অধিকার কী আমার নেই? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যতটুকু দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সম্পর্কে ফাটলটার সূচনা সেখানেই। আমরা হলাম পরস্পরের আবরণস্বরূপ। একে অপরকে আমাদের সবচেয়ে ভালোভাবে জানা উচিত।” কথা শেষ করে ধারার কপালে আলতো করে চুম্বন করলো স্রোত।
“এত ভালোবাসা আমার ভাগ্যে সইবে তো স্রোত?”
“সইবে না কেন?”
ধারা চুপ হয়ে যায়। বিবাহ নামক বন্ধনটার জোর বুঝি এতটাই! স্বল্প পরিচিত দুজন মানুষকেও কী সুন্দর এক অটুট বন্ধনে বেঁধে ফেলে চিরতরে।
_______________
হায়া আর সৌহার্দ্য যে রুমে ঘুমিয়েছে সে ঘরের বিছানাটা একটু ছোট। তিতিরকে এ রুম দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু তিতির আগেভাগেই গেস্টরুমে শুয়ে পড়েছে। হায়াকে না চাইতেও সৌহার্দ্যের অনেকটা কাছাকাছি আসতে হয়েছে। এলোমেলো চুলগুলো সৌহার্দ্যের মুখের উপর বাড়ি খাচ্ছে। সৌহার্দ্যের নাকে এসে ধাক্কা লাগছে হায়ার চুলের মোহনীয় ঘ্রাণ। অবশ্য চুলের নিজস্ব ঘ্রাণ থাকে না, এটা নিশ্চয়ই শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। এটা কী শ্যাম্পু যার এত মোহনীয় ঘ্রাণ। একবার হায়াকে কি জিজ্ঞাসা করে দেখবে সৌহার্দ্য?
“তুমি কি শ্যাম্পু ইউজ করো?”
“রাত তিনটা বাজে। আর আপনি শ্যাম্পুর খোঁজ নিচ্ছেন?”
“উম..রাত তিনটায় কিসের খোঁজ নেওয়া উচিত তাহলে?”
“আপনার মাথার! চুপচাপ ঘুমান।”
ছোট বিছানায় ঠিকমতো ঘুমাতে না পেরে মোচড়ামুচড়ি করতে লাগল হায়া। সৌহার্দ্যও ঘুমাতে পারছে না এসবের জন্য। সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে হায়ার দু’হাত নিজের এক হাতে চেপে ধরে। হাত ছাড়ানোর জন্য হায়ার ছটফটানি আরো বেড়ে যায়।
“আমার হাত ছাড়েন।”
“কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করলে ঘুমাবো কীভাবে?”
“আপনি নিচে ঘুমান যান।”
“আপনি নিচে ঘুমালে তুমি শান্তিতে ঘুমাবে?”
“হ্যাঁ।”
সৌহার্দ্য কিছু বললো না। একটা চাদর, বালিশ আর কম্বল নিয়ে মেঝেতে বিছানা করলো। হায়া বোধহয় এবার একটু শান্তি পেল। সম্পূর্ণ বিছানা দখল করে নিল সে। একটু পর হায়া অনুভব করলো কিছু একটা নেই নেই লাগছে। অদ্ভুত একটা শূন্যতা অনুভব করলো সে। বিছানায় থেকেই সৌহার্দ্যকে ডাকলো হায়া।
“এই যে শুনছেন?”
“হুহ।”
“ঠাণ্ডা লাগবে, উপরে আসেন।”
“তুমি আসলে চাচ্ছো আমি আজ না ঘুমিয়ে থাকি? সকালে আশ্রমের বাচ্চাদের কাছে যেতে হবে হায়া। ঘুমাও প্লিজ।”
বাচ্চাদের কথা শুনে হায়া লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে সৌহার্দ্যের পাশে এসে বসলো। সৌহার্দ্যের হাত ধরে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো।
“কী করছো টা কী?” বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো সৌহার্দ্য।
“আপনার আমাকে বাচ্চা দেওয়ার কথা ছিল!”
“আবার শুরু করলে তুমি? হায়া, প্লিজ বাচ্চামি করে না সোনা। ঘুমাও।”
“আমার ঘুম আসতেছে না।”
সৌহার্দ্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এ বাচ্চাই বড় হচ্ছে না আর সে কিনা আরেকটা বাচ্চা চাচ্ছে।
“উঠেন।”
“কেন? কই যাবো?”
“ছাদে উঠবো।”
“এই অসময়ে ছাদে গেলে ভূত ঘাড় মটকাবে তোমার।”
“আপনি থাকেন, আমি গেলাম।”
বলতে দেরি, হায়ার উঠতে দেরি নেই। সৌহার্দ্য বেচারা আর কী করবে। চুপচাপ হায়ার পেছন পেছন ছাদে উঠলো। ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই পুরোনো স্মৃতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এ ছাদেই প্রথম দেখেছিল হায়া ধ্রুবকে। ঐ সুদর্শন ছেলেটার সাথে প্রথম দেখাটাই ছিল একটা দুর্ঘটনা। কিশোরী মনে বেড়ে উঠা আবেগগুলোর সাক্ষী এ ছাদ। চোখ ছলছল করে উঠে হায়ার। সৌহার্দ্য তাকে কখনো ধ্রুবর কথা জিজ্ঞাসা করেনি। কখনো হায়ার অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্নই করেনি ছেলেটা। এত ভালো কেন সে? তবে হায়ার আজ ইচ্ছে করছে সৌহার্দ্যকে সবটা জানিয়ে দিতে।
“আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই আমার অতীত সম্পর্কে।”
“তোমার অতীত সম্পর্কে আমি জানতে চাইনি কখনো। তবে তোমার যদি মনে হয় সেসব বললে তোমার হালকা অনুভব হবে তবে তুমি বলতে পারো।”
“আমি একজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম। জানিনা সেটা আদৌ ভালোবাসা ছিল কিনা বয়সের দোষ। আপুর বিয়ের রাতে তাকে আমি নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে যায়। এতটাই খারাপ আমি? আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?”
“কে বলেছে তোমাকে ভালোবাসা যায় না? ও ভালোবাসতে পারেনি কারণ ও তোমার জন্য জন্মায়নি।”
“আপনিও আমার জন্য জন্মাননি। আমিই আপনার গলায় ঝুলে পড়েছি। আপনি অনেক বেটার কাউকে ডিসার্ভ করেন।”
“আমি না, তুমি বেটার ডিসার্ভ করো। একে তো আমি বয়সে তোমার চেয়ে এত বড়, তার উপর তোমার মনের কথা বুঝতেও ব্যর্থ। তুমি চাইলে আমাকে ছেড়ে যেতে পারো।”
হায়া সৌহার্দ্যের মুখের দিকে তাকায়। জোৎস্নার আলোতে সৌহার্দ্যের মুখে যেন মায়া ঝরে পড়ছে। এমন একটা মানুষকে কি কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারে? হায়ার একটা ভয়ানক ইচ্ছে হলো। সে রাতের অসম্পূর্ণ কার্য সম্পন্ন করার ইচ্ছে। চোখের পলকে সে পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে সৌহার্দ্যের ওষ্ঠাধর আঁকড়ে ধরলো।
চলবে…