স্রোতধারা পর্ব -১২ ও শেষ

#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
দ্বাদশ_পর্ব
~মিহি

“আচ্ছা যাও, খুনের হাত থেকে তোমাকে রেহাই দিলাম। কিন্তু যদি নিজের স্বামী-সন্তানকে বাঁচাতে চাও তবে নিজেকে পুরোপুরি আমার হাতে সঁপে দিতে হবে তোমার। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও জান। যদি রাজি থাকো তবে আমায় টেক্সট কোরো। আমরা দেখা করবো।”

ধারার এ মুহূর্তে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিভাবে স্রোতকে সবটা বলবে সে? আদৌ বলতে পারবে? রাগে সাইড টেবিলে থাকা ফুলের ভাসটা ছুঁড়ে মারলো ধারা। সেটা সজোরে গিয়ে লাগলো তেহযীবের গিফট করা শো-পিচটার গায়ে। কাচের শো-পিচটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে নিচে পড়লো। ধারার নজর পড়লো শো-পিচের সাথে নিচে পড়ে থাকা ছোট্ট ক্যামেরাটার দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তা দেখে সাথে সাথে ধারা ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিয়ে দেখল ক্যামেরাটা ভেঙে গেছে। মেঝেতে পড়ার কারণে দু টুকরো হয়ে গেছে একেবারে। ধারা কিছুক্ষণের জন্য যেন বাকশক্তি চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলল। এসব কিছু তেহযীবের করা? এত বড় একটা ষড়যন্ত্র কেন করলো তেহযীব? ধারাকে জানতেই হবে। ফোনটা হাতে নিল ধারা। স্রোতকে এখনি কিছু জানানো উচিত না। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে কাঁপা কাঁপা হাতে ঐ নম্বরে টেক্সট করতে নিল ধারা। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না। ফোন রাখতেই স্রোত বাইরে থেকে ডাক দিল। রাতের খাবার ডাইনিংয়ে সাজিয়েছে হায়া। সবাই ধারার জন্য অপেক্ষা করছে। ধারার অবশ্য কিছুটা লজ্জা লাগছে। স্রোত ধারা ঠিক করেছে একসাথে সবাইকে নিজেদের বাবা-মা হওয়ার সুসংবাদ দিবে। এত চিন্তার মাঝেও যখনি ধারা নিজের অনাগত সন্তানের কথা ভাবে তখনি ধারার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

“ধারা এসো। সবাই অপেক্ষা করছে তো।” স্রোত উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলো।

“হুম চলো।” ধারার ঠোঁটে হাসি ঝুলছে।

“এই দাঁড়াও!”

“কী হলো?”

স্রোত ধারাকে কোলে তুলে নিল। ধারা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। ছেলেটা দিন দিন নির্লজ্জের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। নিচে বাবা মা আছে অথচ সে কিনা এখন কোলে করে তার বউকে নিয়ে নিচে নামছে। ধারার লজ্জায় চোখ তুলতে মন চাইছে না। পরক্ষণেই স্রোতের চোখের দিকে তাকায় সে। স্রোতের চোখে অন্যরকম একটা আনন্দ খেলা করছে। বাবা হওয়ার আনন্দ এটা? এতটা খুশি হতে কি আগে ধারা দেখেছিল স্রোতকে?

“বাপরে স্রোত। বাবা আমার। এই না হলে আমার যোগ্য ছেলে!” সায়ান চৌধুরীর কথায় চোখ পাকালো শাহরীন চৌধুরী।

“তুমি বড্ড বেহায়ার মতো কথা বলো সায়ান। মেয়েটা আমার অসুস্থ। স্রোত কোলে করে এনেছে আর তুমি ওদের লজ্জায় ফেলছো।”

“তুমি রাখো তো অসুখ। এসব তুমি বুঝবে না। এসব বাহানা যে স্বামী স্ত্রীরা কত দেয়!”

“ওহ আচ্ছা? আমি বুঝবো না? তো তোমার স্ত্রী কী পাশের বাসার রাফা ভাবী?”

“এর মধ্যে আবার রাফা ভাবীকে টানার কী হলো?”

“তোমার তো আবার ওনার জন্য দরদ উতলে পড়ে কিনা।”

“বেশি বলছো শাহরীন।”

স্রোত আর ধারা অবস্থা বেগতিক দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগলো। অতঃপর মুখে একটা সিরিয়াস ভাব আনলো।

“বাবা-মা, আমরা তোমাদের কিছু কথা বলতে চাই।” স্রোতের কণ্ঠস্বর গম্ভীর।

“বলো বাবা। যে মুখ নিয়ে বলতেছো মনে হচ্ছে সংসার ভাগ করতে চাইতেছো। একটু নরম হও।” সায়ান চৌধুরীর কথায় শাহরীন চৌধুরী আবার রক্তচক্ষু মেলে তাকালেন তার দিকে। সায়ান চৌধুরী ঢোক গিললেন।

“মা বাবা! আমরা বাবা-মা আর তোমরা দাদা-দাদী হতে চলেছো।” কথাটা বলেই স্রোত ধারার দিকে তাকালো। ধারা লজ্জায় মাথা নামিয়েছে। সায়ান চৌধুরী খবরটা শোনামাত্র খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলেন। শাহরীন চৌধুরী সবাইকে মিষ্টিমুখ করালেন। ধারা লাজুক ভাবে তাকিয়ে আছে। এখনো শুভ সূচনা হয়নি। একটা অশুভ শক্তিকে খতম করে তবেই সবকিছুর হ্যাপি এন্ডিং হবে।

______________________________

“তো জান, অবশেষে আসলেন। সব ছেড়ে এসেছেন তো নাকি পিছুটান সহ এসেছেন?” লোকটার সারা শরীরে কালো হুডি জড়ানো। তবে ধারা জানে এটা তেহযীব।

“মুখোশ খুলতে পারেন মি.তেহযীব রাশিদ। আপনার মুখোশ আমার সামনে অনেক আগেই উন্মোচন হয়ে গেছে।” ধারার কথায় কিছুটা চমকালো তেহযীব। ধারার থেকে এতটা চালাকি আশা করেনি সে।

“এত বুদ্ধি! অবশ্য তেহযীব রাশিদের বউয়ের এটুকু বুদ্ধি থাকতেই হয়।”

“বউ আর তোর মতো নরকের কীটের? সস্তা পেয়েছিস না? তোকে মেরে পুঁতে রেখে যাবো আজ এখানে। আমার স্রোতের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিস তুই।”

“মানুষ বড্ড অকৃতজ্ঞ ধারা। আমি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম অথচ সেই তুমিই কিনা আমাকে মারতে চাইছো।” বলে শিস বাজাতে লাগল তেহযীব। এ শিসের সুরটা অচেনা নয় ধারার।

“তোকে ধন্যবাদ দেওয়ারও আর রুচি হচ্ছে না আমার। কেন করলি এসব আমার সাথে? কী উদ্দেশ্যে?”

“উদ্দেশ্য? আচ্ছা যেহেতু এখান থেকে তুমি আর ফিরে যেতে পারবেনা তোমায় সবটা বলাই যায়। ভেবোনা তোমার প্রেমে পড়ে এসব করছি। কখনোই না। তবে তোমার শরীর দেখার পর একবার কাছে পাওয়ার ইচ্ছা ছিল। যাক সেসব কথা, স্রোত তোমাকে কয়েকটা কথা বলেনি। স্রোত হসপিটালের একটা গোপন সত্য জেনে গিয়েছিল। সে সত্যটা হলো আমার বাবা মি.তাইমুম রাশিদ নিজের ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট বানিয়েছেন। তিনি মারা যাননি। নিজের জায়গায় অন্য একজনের লাশ তিনি নিজের নামে চালিয়েছেন। এটাই স্রোত জানতে পেরে সিনিয়র ডাক্তার আলফাজকে প্রশ্ন করে। আলফাজ বিষয়টা আমাকে জানায়। বাবা যে মারা যাননি এ সত্যিটা বাইরে বের হলে ইনস্যুরেন্সের প্রায় সাড়ে ত্রিশ কোটি টাকা আমরা হাতছাড়া করে ফেলতাম। এছাড়া বাবার কিছু অবৈধ ব্যবসার কারণে তাকে পুলিশ এরেস্ট করতে চলেছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম ইনস্যুরেন্সের টাকা নিয়ে সপরিবারে বিদেশে চলে যাবো পরিচয় বদলে কিন্তু সব গড়বড় করলো তোমার গুণধর স্বামী। ও অবশ্য জানতো না যে আমিই তাইমুম রাশিদের ছেলে। গাধা তোমার বর! প্রুফ কালেক্ট করতে করতে বউয়ের দিকেই নজর দিল না আর। এখন তোমার জীবনের বিনিময়ে আমি সওদা করবো ওর সাথে। প্রুফগুলো ওর থেকে নিয়ে তোমাকে মেরে উড়ে যাবো।” উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তেহযীব। কিছুক্ষণ পরেই তেহযীবের সাথে সাথে ধারাও উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তেহযীব বুঝে উঠতে পারলো না কী হচ্ছে।

“ইউ আর আন্ডার এরেস্ট তেহযীব রাশিদ।” পুলিশ ইতিমধ্যে ঘিরে ধরেছে তাকে। পুলিশদের সাথে স্রোতও দাঁড়িয়ে। ধারা হালকা হাসলো।

“তোমার নিজের মুখ থেকে স্বীকার করালাম। এখন জেলে বসে চিল করো তেহযীব রাশিদ।” ধারার হাসিটা যেন কাঁটার মতো বাঁধছে তেহযীবের। এতটুকুন একটা মেয়ে তাকে ঘোল খাওয়ালো!

________________________

“ধারা, এসব তুমি আরো আগে বলে দিতে পারতে।”

“তুমিও তো তাইমুম রাশিদের ঝামেলার ব্যাপারে বলোনি আমায়।”

“আচ্ছা স্যরি।”

“আমিও।”

স্রোত বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ধারাকে। ধারাও স্রোতের বুকের সমস্তটুকু দখল করে নিল।

“তোমায় খুব বেশি ভালোবাসি ধারা। সবসময় আমার পাশে থেকো। কখনো ছেড়ে যেও না আমায়। ভুলে যেও না কখনো। সবসময় আমার বুকের মধ্যেখানে এমন করে রাজরানি হয়ে রাজত্ব করতে থাকো।”

“আমিও তোমাকে ভালোবাসি, সায়রের আব্বু।”

“এই না! আমাদের মেয়ে হবে আর আমরা নাম রাখবো নাজিয়াত।”

“ছেলে!”

“মেয়ে!”

খুনশুটিতে মেতে ঠলো দুজন। এমন করেই ওদের দাম্পত্য জীবনের অবশিষ্ট বছরগুলো সুখে-শান্তিতে পেরোক।

বিশ্বাস শব্দটা বেশ সূক্ষ্ম তবে এই সূক্ষ্ম জিনিসটাতে একবার আঁচড় লাগলে তা সহজে স্বাভাবিক হয়না। বিশেষ করে দাম্পত্য জীবনে যদি একবার অবিশ্বাস নামক বস্তুটা একবার ঢুকে গেলে সে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগে। তবে দুজন মানুষের মাঝে বোঝাপড়া ভালো হলে হাজারো ভুল বোঝাবুঝিও তাদের মাঝে ফাটল ধরাতে অক্ষম। ভালোবাসা সুন্দর।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here