স্রোতধারা পর্ব -১১

#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
একাদশ_পর্ব
~মিহি

“তেহযীব রাশিদ!” ধারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এই লোকটাকে তিলে তিলে মেরে ফেলতে হবে তাকে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজায় নক পড়লো। ‘কাম ইন’ বলে উঠলো ধারা।

তেহযীব বেশ দ্রুত প্রবেশ করলো ধারার কেবিনে। চকিতেই সেদিকে তাকালো ধারা।

“স্যরি ড.ধারা। এপয়েন্টমেন্ট দুপুরের ছিল কিন্তু আমার কিছু ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে এখন আসতে বাধ্য হলাম।”

“সমস্যা নেই। এখন আমার কোনো এপয়েন্টমেন্ট নেই। বসুন আপনি।”

“জ্বী ধন্যবাদ। আমার আসলে বেশ কিছুদিন ধরে মানসিক অবস্থা ভালো নেই। প্রায় দেড় মাস ধরে ঘুম হচ্ছে না বললেই চলে।”

“এনজাইটি হচ্ছে কোনরকম?”

“না সেরকম না তবে অস্বস্তিতে আছি খুব। কোনকিছুই ভালো লাগে না। খাবারে অরুচি, ঘুমে অনিয়ম সবকিছুই বদলে গেছে।”

“আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। আমি কিছু ঘুমের ওষুধ সাজেস্ট করছি আপনাকে। এগুলো রাতের খাবারের পর খাবেন।” ধারা প্রেসকিপশন লিখতে লিখতে বললো।

হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ টোন শুনে কেঁপে উঠলো ধারা। কাঁপা হাতে কলম রেখে ফোন চেক করলো।

“আমার বলা ওষুধ সাজেস্ট না হলে তার পরিণতি ভালো হবে না মিসেস ধারা। জানি আপনি তা করবেন না তবুও ওয়ার্ন করলাম।”

ধারা টেক্সটের টাইম চেক করলো। আরো আধঘণ্টা আগে পাঠানো হয়েছে কিন্তু এতক্ষণ নেট কানেকশন অফ থাকার কারণে এতক্ষণ ডেলিভার হয়নি। ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার প্রেসকিপশন লিখতে শুরু করলো। হাসিমুখে তেহযীবের দিকে তা বাড়িয়ে দিতেই তেহযীব নম্রভাবে তা গ্রহণ করলো।

“ধারা! আপনার নামটা খুব সুন্দর। ধারা নামে আমার একসময় একটা প্রেমিকা ছিল।”

“ছিল? ব্রোকেন আপ?”

“আরে নাহ! একতরফা ছিল সবটা। হুট করে মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললাম।”

“একতরফা হলে সে প্রেমিকা হলো কী করে? ও তো বোধহয় জানেই না।”

“গুড পয়েন্ট। আমি শীঘ্রই তাকে মনের কথা জানাবো। আমার জন্য দোয়া করবেন।”

“আচ্ছা বেশ। আপনি মেডিসিনগুলো রেগুলার নিয়েন। ডোজ কমপ্লিট হওয়ার পরও যদি অসুবিধা মনে হয় এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই আসতে পারবেন।”

“থ্যাংকস আ লট।”

“মাই প্লেজার।”

তেহযীব হাসিমুখে কেবিন ছেড়ে বেরোলো। ধারার মাথায় তখনো চিন্তার পাহাড়। তেহযীবকে ভুল ওষুধ প্রেসক্রাইব করেনি সে। এটা যদি কোনভাবে লোকটা জানতে পারে তখন কী বিপদ হবে কে জানে? ধারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল। কিছুক্ষণ বাদেই স্রোত আসলো ধারার কেবিনে। স্রোত আর ধারা একই হাসপাতালে থাকলেও দুজনের কেবিন আলাদা বিল্ডিংয়ে যার কারণে চাইলেই যখন তখন দেখা করা সম্ভব নয়। স্রোতকে দেখেই ধারার সকালের কথা মনে পড়ে গেল। স্রোতকে অবহেলা করে চলে আসার অপরাধবোধে স্রোতের চোখে চোখ রেখে কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না ধারা।

“ধারা, কী হয়েছে তোমার? কী লুকোচ্ছো আমার থেকে?”

“তো..তোমার থেকে আমি কেন কিছু লুকোবো স্রোত? আর তাছাড়া তুমি এ সময় এখানে কেন? তোমার কেবিন ফাঁকা? সবাই বিরক্ত করবে এটা সেটা বলে। তুমি প্লিজ এখন যাও।”

“তুমি শিওর আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছো।”

“তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে? তুমি আমাকে সন্দেহ করছো স্রোত?”

“না রে বাবা। সন্দেহের কথা আসছে কেন? তুমিও না একটু বেশিই বোঝো। আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝতে পারছি তোমার মনে কিছু একটা চলছে।”

“আসলে স্রোত আমার…”

“ড.স্রোত। আপনার একজন পেশেন্ট মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি চলুন।”

“ধারা, আমি এসে শুনছি, একসাথে লাঞ্চ করবো।” ধারার কপালে চুমু খেয়ে দ্রুত চলে গেল স্রোত। ধারা নিজের চেয়ারটাতে বসলো। দুপুর থেকেই পেশেন্টের আনাগোনা ক্রমশ বেড়ে গেছে। ধারার ব্যস্ততা ফুরাচ্ছেই না। লাঞ্চ টাইমে ক্যান্টিনে যাওয়ারও সময় পায়নি। স্রোতও আসেনি তাই ধারাও ভেবেছে স্রোতও হয়তো ব্যস্ত। তবে ধারা ঠিক করেছে স্রোতকে সব বলে দিবে। সন্ধ্যা নাগাদ পেশেন্ট কমে আসলো। ফোন হাতে নিতেই ধারা দেখলো একটা আনরিড মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপে। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেখলেই ধারার অন্তঃরাত্মা কেঁপে উঠে।

“খুব সাহস বেড়েছে জান? প্রথমে আমার কথা অমান্য করে ঐ তেহযীবের বাচ্চাকে ঠিক ওষুধ দিলি এখন আবার স্রোতকে সব বলতে যাচ্ছিলি? বড্ড সাহস বেড়েছে না? এখন তোর স্রোতকে কে বাঁচাবে বল তো। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার শখে উড়ছিস তো। এবার বুঝবি আমি কী জিনিস!” ধারার হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। ডিসপ্লে ফেটে গেল তৎক্ষণাৎ। ধারা ছুটে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে স্রোতের কেবিনের দিকে ছুটলো।

স্রোত নিজের কেবিনে নেই। ধারার ফোনটাও ভেঙে গেছে। ধারা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্রোতের কেবিনের ল্যান্ডলাইন থেকে ধারা স্রোতের নম্বর ডায়াল করলো। নম্বর বন্ধ বলছে। ধারার হাত পা কাঁপছে। এনজাইটি এট্যাক হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো ধারার।

___________________________

চোখ খুলে ধারা নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো। ধারার ঠিক পাশে স্রোত বসে আছে। ধারা স্রোতের কপালে ব্যান্ডেজ দেখেই আঁতকে উঠলো।

“তোমার কপালে ব্যান্ডেজ কেন স্রোত? কী হয়েছে তোমার?”

“নিজে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে যে আমার কী হয়েছে? তুমি পাগল ধারা?”

“উফ! কী হয়েছে তোমার সেটা বলো। কী করে লাগলো? আর কোথাও লাগেনি তো? চেক আপ করিয়েছো তুমি?”

“আমার কিচ্ছু হয়নি। নার্স যে পেশেন্টের কথা বলেছিল সে হঠাৎ পাগলের মতো বিহেভ করতে শুরু করেছিল। আমাকে ধাক্কা দিচ্ছিল। শেষে কান্না করতে করতে বলে আমাকে নিয়ে এক জায়গায় যেতে চায়। মেন্টাল পেশেন্টদের জ্বালা তো বোঝোই। বাইরে রাস্তায় বের হতেই ও দৌড়াতে শুরু করলো। আমি রাস্তায় নামতেই একটা ট্রাক একদম আমার উপর দিয়ে যেতে নিছিল। সেই সময় তেহযীব রাশিদ আছে না? পলিটিশিয়ান সাহেব? উনিই আমাকে সেভ করেন। পড়ে গিয়ে কপালে খানিকটা লেগেছে। এখন তুমি কেন অজ্ঞান হলে? প্যানিক করছিলে শুনলাম। এখন আগে টেস্ট করাও তুমি।”

“স্রোত। শান্ত হও।” স্রোতকে চুপ করানোর চেষ্টা করার মুহূর্তেই ড.রেহানা ভেতরে আসলো। হাসি হাসি মুখে স্রোত ধারার দিকে তাকালো।

“তো মি.স্রোত এবং মিসেস.ধারা, তলে তলে এতকিছু? মিষ্টি কবে খাওয়াচ্ছেন?” ড.রেহানা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো।

“মানে?” বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি ধারা।

“আপনারা বাবা-মা হতে চলেছেন। ধারা, তুমি কনসিভ করেছো।”

কথাটা শোনামাত্র স্রোত আর স্থান কালের চিন্তা করলো না। ধারাকে কোলে তুলে সারা রুমে ঘোরাতে লাগল। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখটুকু যেন সে ধরণীর বুক নিংড়ে অর্জন করতে পেরেছে।

বাবা-মা হওয়ার অনুভূতিটা নিঃসন্দেহে মানবজীবনের সেরা অনুভূতি। একজন মা যখন তার মাতৃত্বের স্বাদ পায় তখন দৈবভাবেই তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়া বাবার মাঝে বাড়তে থাকে দায়িত্ববোধ। নতুন একটা জীবনকে এ ধরণীর বুকে নিরাপদে পদার্পণের চেষ্টায় দুটো প্রাণ একাত্মভাবে নিবেদিত হয়ে পড়ে। পিতা-মাতার এ ত্যাগ, এ বিসর্জনের তখন কেবল শুরু। অতঃপর সারাজীবন সন্তানের জন্য তারা ত্যাগ-বিসর্জন করেই যান।

“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখটুকু আমার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ ধারা।”

ধারা কাঁদছে। স্রোতের কথায় তার কান্নার গতি বাড়ছে। গত রাতেও স্রোত প্রেগন্যান্সির কথা তুলেছিল। ধারা ভেবেছিল দুর্বলাত জন্য মাথা ঘুরছে। কিন্তু এখন স্রোতের কথাটাই সত্যি বুঝতে পেরে তার যেন আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। ইচ্ছে করছে স্রোতের বুকের সাথেই মিশে থাকতে।

ধারার খুশিতে ভাটা পড়লো। নার্স এসে একটা ফোন ধরিয়ে দিল ধারার হাতে।

“ম্যাম, আপনার ফোনটা।” ধারা জানে ফোনটা তার নয় কিন্তু ফোনটা কে পাঠিয়েছে তাও নিশ্চিতভাবে জানে।

ধারা ফোনটা নিয়ে দেখলো তারই সিম ফোনে লাগানো। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে লগইনও করা তবে আগের সব টেক্সট ডিলিট করে ফেলা হয়েছে। নতুন একটা নম্বর থেকে টেক্সট এসেছে ধারার ফোনে,

“স্রোতের ক্ষতি হয়নি দেখে খুশিতে লাফিও না জান। তেহযীব রাশিদ নামের কাঁটাটা বড্ড পীড়া দিচ্ছে। তুমি উপড়ে ফেলবে নাকি তোমার স্বামী আর পেটের বাচ্চাটাকে উপড়ে ফেলার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here