#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
নবম_পর্ব
~মিহি
“আমি ডিভোর্স চাই।”
“কী?”
“আমি মুক্তি চাই! ডিভোর্স চাই আপনার থেকে। আপনার সাথে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমার মুক্তি চাই আপনার থেকে, এ বিয়ের বন্ধন থেকে।” তৎক্ষণাৎ হায়ার মাথা থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল সৌহার্দ্য। সৌহার্দ্যের এ মুহূর্তে ইচ্ছে করছে হায়ার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় লাগাতে। হায়ার প্রতি সৌহার্দ্যের অনুভূতি কি এতদিনে এক ফোঁটাও বোঝাতে পারেনি সে? এতটাই ব্যর্থ সে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য।
“হঠাৎ আমায় ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলো যে? আমি খুব খারাপ তাই না?”
“আমিই খারাপ। আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসার একটা মানুষ আছে যে আপনাকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে। আমি তো তেমন করে কখনো ভালোবাসতে পারবো না আপনাকে। সুতরাং এত ভালোবাসা থেকে আপনাকে বঞ্চিত করার অধিকার আমার নেই। তাই নিজে থেকেই সরে যেতে চাই।” হায়ার কথায় রীতিমতো রাগ চড়ে যাচ্ছে সৌহার্দ্যের মাথায়। একটা মানুষকে ঠিক কতভাবে বোঝালে সে ভালোবাসার কথাটা বুঝবে? অনেক হয়েছে ভালোভাবে বোঝানো, এবার হায়াকেও বুঝতে হবে বিচ্ছেদের দহন যন্ত্রণা।
“বেশ! তুমি যখন মুক্তিই চাইছো, তবে মুক্তি আমি তোমাকে দেব। একটু ধৈর্য ধরো। ডিভোর্সের পেপার আমি রেডি করাচ্ছি।” সৌহার্দ্য গম্ভীরভাবে কথাটুকু বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
হায়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিছানায় বসে রইল। এটা কী হলো? প্ল্যানটা এভাবে বিফলে গেল? হায়া ভেবেছিল সৌহার্দ্যকে এসব বললে সৌহার্দ্য রেগে হলেও নিজের মনের কথা বলে দিবে। অন্তত হায়াকে হারানোর ভয়ে হলেও সৌহার্দ্য নিজের ভালোবাসার কথা সৌহার্দ্যকে বলবে কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না উল্টো সবটা জলে গেল। হায়ার এখন রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। বেশি পাকামো করতে গিয়ে সব শেষ করে দিল!
__________________________
দিনগুলো বেশ এলোমেলো হয়ে আছে। সৌহার্দ্য হায়ার সাথে কথা বলেনা আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল। সৌহার্দ্য আর হায়ার মাঝের এ দূরত্ব স্রোত ধারার চোখেও পড়েছে কিন্তু ওদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হুট করে কিছু বলাটা ঠিক নয়। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খুনসুটি হওয়া স্বাভাবিক সেখানে তাদের কথা বলাটা কেমন দেখায়! ধারার শরীরটাও ভালো নেই কিছুদিন যাবত। ঠিকমতো কিছুই খেতে পারছে না। রাতের খাবার না খেয়েই ঘরে এসে বসেছে ধারা। এরই মধ্যে স্রোত খাবারের প্লেট নিয়ে ধারার পাশে এসে বসলো।
“কী হয়েছে ধারা? খুব অসুস্থ লাগছে? একটু খেয়ে নাও তো সোনা।”
“সরো তো তুমি। তোমার গা থেকে পঁচা আলুর গন্ধ আসছে!”
“কীহ? কী যা তা বলছো ধারা? পঁচা আলুর গন্ধ? এহ ওয়েট। তোমার মাথা ঘুরাচ্ছে?”
“না।”
“বমি পাচ্ছে?”
“হুম। খেতে ইচ্ছে করছে না।”
স্রোত কী বুঝলো কে জানে চট করে এগিয়ে ধারার কপালে চুমু খেল।
“হঠাৎ কী হলো তোমার?”
“কালকেই তুমি গাইনোকলজিস্টের সাথে দেখা করবে।”
“মানে? কেন?”
“ধারা, তুমি না ডাক্তার? এত বোকা ডাক্তার কোথাও হয়? এত সিম্পটমস অথচ তুমি বুঝতে পারছো না কী হয়েছে?”
“স্রোত, আগে আমরা কনফার্ম হই? আগেই এত এক্সাইটেড হয়ে পরে যদি কিছু…”
“শসসস …” ধারাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে ধারার ঠোঁটে আঙুল রাখে স্রোত।
“তুমি কিছু ফিল করতে পারছো না ধারা? আমি কিন্তু ফিল করতে পারছি যে আমি বাবা হতে চলেছি।”
“তুমি বড্ড নির্লজ্জ হয়ে গেছো স্রোত।”
“আর তুমি বড্ড উদাসীন। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।”
“খাইয়ে দিবে না?”
“হুম হা করো ভদ্র বাচ্চার মতো।”
স্রোত এক লোকমা ধারার মুখের কাছে ধরলো। খাবার মুখে নিয়েই স্রোতের হাতে কামড় বসিয়ে দিল ধারা। ব্যথায় ‘উফ’ বলে উঠলো স্রোত আর তা দেখে ধারা হাসতে হাসতে বিছানায় হেলান দিল।
“ধারা! তুমি বড্ড দুষ্টু হয়ে গেছো। বিড়ালের মতো কামড়াচ্ছো কেন?”
“ম্যাঁও।” মেকি সুরে বলে উঠল ধারা।
“এটা কেমন অভ্যাস? ম্যাঁও ম্যাঁও করছো কেন?”
“ম্যাঁও! ম্যাঁও!” আবারো বলে উঠলো ধারা।
“আই ম্যাঁও ইউ।”
“আই ম্যাঁও ইউ টু।” বেড়াল ছানার মতোই স্রোতের বুকে লেপ্টে যেতে চাইলো ধারা। স্রোত তা দেখে হালকা হাসলো। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছে তার। এই তো কদিন আগেই ধারাকে নিজের করে পেল সে। এখন তাদের জীবনে ছোট্ট একটা অতিথি আসবে যার ছোট্ট ছোট্ট পায়ের পদচারণায় মেতে থাকবে তাদের সংসার। চোখ বন্ধ করতেই কোণ বেয়ে জল গড়ালো স্রোতের।
“স্রোত তুমি কাঁদছো?”
“উহু!”
“আমি খুব ভালোবাসি তোমাকে।”
“হুহ।” স্রোত চোখের জল আটকাতে পারছে না কিছুতেই। ধারাকে এভাবেই বুকের গহীনে চিরতরে আবদ্ধ করে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
___________________
সৌহার্দ্যের ঘরে আলো জ্বলছে। ইদানিং সে গেস্টরুমেই থাকে। হায়ার সাথে কথাবার্তা একরকম বন্ধ বলা চলে। এতে সে কষ্ট পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু হায়াকেও তার মনের অবস্থাটা বোঝাতে হবে।
“আসবো?” হায়ার ডাকে ঘোর কাটলো সৌহার্দ্যের। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না সৌহার্দ্যের তাই চুপ রইল।
“আমি কী আসবো?” সৌহার্দ্যের থেকে উত্তর না পেয়ে আবারো প্রশ্ন করে বসে হায়া।
“এসো।” সৌহার্দ্যের গম্ভীর গলার উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করে হায়া।
“বসতে পারি কিছুক্ষণের জন্য?”
“এমনভাবে বলছো যেন সব কাজেই তুমি আমার অনুমতি নেও!” তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো সৌহার্দ্য। সৌহার্দ্যের বলা এ কথাটার ইঙ্গিতটা ঠিকই ধরতে পেরেছে হায়া।
“আমি কি ক্ষমার অযোগ্য?”
“ক্ষমা চাওয়ার মতো কিছু কী করেছো তুমি?”
“আমি জানি আপনি রেগে আছেন কিন্তু প্লিজ এভাবে আমাকে আর কষ্ট দিয়েন না। আমি সহ্য করতে পারছিনা আপনার রাগ, এ দূরত্ব।”
“ডিভোর্স হয়ে গেলে তো দূরত্বটা চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। তখন মানিয়ে নিতেই হবে। তেমন করে এখনি মানিয়ে নাও।”
“আপনি সত্যিই আমাকে ডিভোর্স দিবেন?”
“তুমিই তো চেয়েছো। কোনো চাওয়া তো অপূর্ণ রাখতে চাইনি তোমার তবে এ চাওয়া কেন অপূর্ণ থাকবে?”
“আমি তো বাচ্চাও চেয়েছিলাম। সে চাওয়াটাও তো অপূর্ণ রেখেছেন আপনি?” বলে করুণ দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো হায়া।
হায়ার করুণ দৃষ্টির সমুখে কথা বন্ধ হয়ে আসলো সৌহার্দ্যের। বুকের কাছে কোথাও একটা ব্যথায় চিনচিন করছে। সৌহার্দ্য অনুভব করতে পারছে হায়ার প্রতি নিজের মনের দুর্বলতার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা। মোম যেমন আগুনের সংস্পর্শে আসলে গলতে শুরু করে তেমন করে সৌহার্দ্যের রাগটাও গলতে শুরু করেছে কিন্তু হায়াকে এত সহজে সে ক্ষমা করবে না। আরেকটু জ্বালাতে হবে মেয়েটাকে।
“ঘর থেকে বের হও হায়া। আমি জাস্ট সহ্য করতে পারছি না তোমাকে।”
“এতটা রাগ আমার প্রতি? কেন সৌহার্দ্য? তারা আপু এসে আমাকে যখন তোমার ভালোবাসার কথা বললো আমার কতটা কষ্ট হচ্ছিল তা আপনি বুঝতে পেরেছিলেন? আমি আপনাকে রাগিয়েছিলাম যেন আপনি নিজের মনের কথাটা আমাকে বলে দেন। কিন্তু আপনি তা করলেন না উল্টো রেগে সত্যিই ডিভোর্স দিতে চাইলেন। এটা আমি কখনোই চাইনি সৌহার্দ্য! আমি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে। আপনিও আমাকে ভালোবাসেন এটা জানার জন্যই এতকিছু করেছিলাম।” কান্নায় ভেঙে পড়লো হায়া। সৌহার্দ্যের একইসাথে ভালো-খারাপ উভয় অনুভূতি হচ্ছে। এ অনুভূতিকে কী নামে ডাকা যায় বুঝে উঠতে পারছে না সে।
________________________
ফোনের মেসেজ টোনে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল ধারার। পাশেই স্রোত গভীর ঘুমে। স্রোতের এক হাত ধারার পিঠে। হালকা হেসে স্রোতের বুক থেকে মাথা তুললো ধারা। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোন নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে হোয়াটসঅ্যাপে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে মেসেজটা ওপেন করলো ধারা। একটা ভিডিও এবং সাথে একটা শর্ট টেক্সট এসেছে।
ভিডিওটা ওপেন করতেই ধারার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। নিচের টেক্সটটাতে চোখ পড়ে তার।
“এখন এই ভিডিওটা শুধু আমার আর তোমার কাছে আছে কিন্তু আমার কথামতো না চললে এ ভিডিওটা সারা বিশ্ব দেখবে।”
চলবে…