#স্রোতধারা
দ্বিতীয়_অধ্যায়
অষ্টম_পর্ব
~মিহি
“ছিঃ! এত জঘন্য কারো রান্না হয়?” বলেই পায়েসের বাটিটা ছুঁড়ে ফেললেন রজনী। বাটিটা সজোরে আঘাত করলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হায়ার পায়ে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে। সৌহার্দ্য ছুটে এলো হায়ার দিকে। কাঁচের বাটির আঘাতে পায়ের পাতা অনেকখানি রক্তাক্ত হয়েছে হায়ার। রজনী উপায় না পেয়ে গলায় মধু ঢেলে বললেন,
“আহারে, এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে কেউ? হুশ জ্ঞান নাই মেয়ের। এত বড় সংসার সামলাবে কী করে?”
“চুপ করুন আপনি!”সৌহার্দ্যের চিৎকারে রজনী কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন।
সৌহার্দ্য বরাবরই শান্ত স্বভাবের। তার এ রণমূর্তি দেখে উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ হায়াকে কোলে তুলে ঘরের দিকে পা বাড়ায় সৌহার্দ্য। ড্রয়িংরুমের থমথমে পরিবেশে একজনের চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকে ক্রমাগত। এক জনম ধরে একতরফা ভালোবেসে যাওয়া মানুষকে অন্য কারো সাথে দেখার যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারছে না। হায়ার রান্না খুব ভালো হয়েছিল তারা জানতো কিন্তু নিজের মায়ের স্বভাবও জানতো সে। ঝামেলা না করলে তার খাবার হজম হয় না। অবশ্য এ ঝামেলা থেকেই তারা বুঝে গেছে সৌহার্দ্যের মনে তার জন্য কখনো কোনো জায়গা ছিল না, আর না কখনো হবে। এত বছর ধরে সৌহার্দ্যের পেছনে পাগলের মতো পড়ে থেকেও সৌহার্দ্যকে পায়নি সে অথচ এ মেয়েটা এত অল্প সময়েই সৌহার্দ্যকে কী বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে যে শান্তশিষ্ট সৌহার্দ্য তার ফুপিকে রক্তচক্ষু দেখাতেও দু’বার ভাবলো না। ভালোবাসার মানুষের আঘাত লাগলে নিজ হৃদয়ে যে কতটা ক্ষরণ হয় তা সৌহার্দ্য বুঝিয়ে দিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ব্যতীত কিছু কি করার আছে হায়ার?
_________________________
দশটার পর ঘুম ভাঙলো হায়ার। পায়ে সযত্নে ব্যান্ডেজ করা, রাতে হায়াকে ওষুধ খাইয়ে সারারাত জেগে ছিল সৌহার্দ্য। হায়া আশেপাশে তাকালো। সৌহার্দ্য পাশে নেই। ফোন চেক করলো হায়া। সৌহার্দ্যের ভয়েস মেসেজ দেখতে পেয়ে তা ওপেন করলো।
‘বাবাও নেই, আমি অফিসে না গেলে চলতো না। তোমার খাবার আমি সাইড টেবিলে রেখে এসেছি। ধারা ভাবীকে বলে এসেছি তোমার ঘুম না ভাঙা অবধি তোমায় না ডাকতে। উঠে ভাবীকে ডাক দিও। একদম একা ওঠার চেষ্টা করবে না। আর স্যরি তোমায় অসুস্থ রেখে আমার অফিসে আসতে হলো। সাবধানে থাকো, বেশি লাফালাফি করবে না।”
এক নিঃশ্বাসে টেক্সটটুকু পড়ে মুচকি হাসলো হায়া। ধারাকে ডাকতে যাবে এমন সময় দরজার দিকে চোখ পড়ল হায়ার। তারা দাঁড়িয়ে আছে।
“আরে আপু আপনি? আসুন না।”
হায়ার সম্মতি পেয়ে ভেতরে ঢুকলো তারা। হায়ার পায়ের কাছে বসে প্রথমেই নতমুখে ক্ষমা চাইলো।
“সমস্যা নেই আপু। এটা শুধুই একটা এক্সিডেন্ট ছিল।”
“তোমায় কিছু কথা বলি? খারাপভাবে নিও না, আচ্ছা?”
“বলুন।”
“সৌহার্দ্যকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। কিন্তু সে কখনো আমায় ভালোবাসেনি। ওর সাথে আমার বিয়ের কথাও ছিল কিন্তু সৌহার্দ্য বলেছিল সে বিয়ের বন্ধনে জড়াতে ইচ্ছুক নয়। তোমার মধ্যে অবশ্যই বিশেষ কিছু আছে যার জন্য বিয়ে থেকে পালিয়ে বেড়ানো ছেলেটা শেষমেশ বিয়ে করেই ফেললো।”
তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হায়ার চোখ গেল তারার হাতের দিকে। কব্জিতে অজস্র কাঁটা দাগ। হায়া ভ্রু কুঁচকাল। হায়ার দৃষ্টি লক্ষ করে খানিকটা ম্লান ভঙ্গিতে হেসে উঠলো তারা।
“এসব পাগলামি। সৌহার্দ্যকে পাওয়ার জন্য কতশত পাগলামি করেছি! বাদ দাও। ও তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসে। ওর ভালোবাসার মান রেখো। আমি আসছি। একেবারে চলে যাচ্ছি তোমার সৌহার্দ্যের জীবন থেকে। ওকে ভালো রেখো।”
সেদিন সকালেই তারা এবং তার মা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কেবল হায়ার মনে রেখে গেল এক অসীম অপরাধবোধ। সৌহার্দ্যকে এমন করে ভালোবাসে একজন অথচ সে কিনা উড়ে এসে জুড়ে বসলো। সে না থাকলে এই দুজনের জীবন এতটা এলোমেলো হতো না। না তারা ভালো থাকতে পারছে আর না সৌহার্দ্য ভালো আছে। হায়ার সাথে তো একরকম কমপ্রাইজ করে বেঁচে আছে অথচ তারা থাকলে তার জীবন কত সুন্দর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকতো।
___________________
অফিসের ব্যস্ততার মধ্যে হায়ার খোঁজ নেওয়ার সময় পাচ্ছে না। দুপুরের পর একটু ফ্রি হয়ে হায়াকে কল দিল সৌহার্দ্য। ফোন সুইচড অফ বলছে। টানা পাঁচ-ছয়বার কল করার পর কিছুটা চিন্তিত হলো সৌহার্দ্য। লাঞ্চ টাইম শেষে একটা মিটিং ছিল তার। হায়াকে টেক্সট করে মিটিংয়ের জন্য চলে গেল সৌহার্দ্য। ঘণ্টা দুয়েক চললো মিটিং। শেষ করতে করতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। তখনো মেসেজ ডেলিভার হয়নি। এবার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে সৌহার্দ্যের। ধারার নম্বর ডায়াল করলো সৌহার্দ্য। ধারা কল রিসিভ করছে না। সৌহার্দ্যের কপালের ভাঁজ আরো প্রস্ফুটিত হলো। অফিসের কাজ দ্রুত শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলো।
সারা ঘর অন্ধকার। সৌহার্দ্য পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকলো। হায়ার পায়ের ব্যথার কারণে মেয়েটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ফোনটা তো অন রাখতে পারে! তাও রাখবে না। এত জেদী কেন এই মেয়ে?
“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।” হায়ার গম্ভীর গলা শুনে সৌহার্দ্যের পা জোড়া থেমে আসলো। সৌহার্দ্য ঘরের বাতি জ্বালাতে গেলে নিষেধ করে হায়া। অন্ধকারেই আন্দাজ করে হায়ার পাশে এসে বসে। ক্লান্ত শরীর, ফ্রেশ হওয়ার সময়টুকুও দিল না হায়া।
“বলো কী বলবে।”
“বিয়ের আগে আপনি একটা কথা বলেছিলেন। আমার যখন ইচ্ছে আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে পারবো। মনে আছে কথাটা?” হায়ার কথায় সৌহার্দ্যের ভেতরটা কেঁপে উঠে। তবুও নিজেকে সামলে বলে,
“হুম। মনে আছে। কিন্তু এমন সুযোগ কখনো আসবে না। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না কখনো।”
“বেশি কনফিডেন্স দেখিয়ে ফেলছেন না?”
“কবুল শব্দটার অনেক জোর হায়া। এটা শুধুমাত্র একটা শব্দ নাই, দুটি আত্মার একত্র হওয়ার স্বীকৃতি। আত্মার বাঁধন ছেঁড়া কি এতই সহজ? তুমি আমার দায়িত্ব ছিলে একসময় কিন্তু এখন তুমি শুধুই আমার দায়িত্ব নও।”
“আমি কী তাহলে?”
“সময় হোক বলবো।” রহস্যময় হাসি হেসে বললো সৌহার্দ্য। সে মূলত সবকিছু হায়ার বাচ্চামি হিসেবে নিচ্ছিল কিন্তু হায়া যে কতটা গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলেছে তা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি সে।
“আমি আপনার কাছে কিছু চাইলে আপনি আমাকে ফেরাবেন না, তাই না?”
“আবার বাচ্চা? উফ! কী শুরু করেছো তুমি? বাচ্চা নেওয়ার বয়স না এটা!”
“আমি বাচ্চা চাইবো না।”
“আমি ফ্রেশ হয়ে এসে শুনবো তোমার কী চাই।”
“এখনি। শুনে তারপর ফ্রেশ হতে যান।”
“এত জেদী কেন আমার বউটা?”বলতে বলতে হায়ার কোলে মাথা রাখে সৌহার্দ্য।
হায়া এ মুহূর্তে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তারার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তারার মতো নিঃস্বার্থভাবে সৌহার্দ্যকে কেউ ভালোবাসতে পারবে আদৌ? সে নিজে তো পারবে না। তারার জীবনে সৌহার্দ্যই প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু তার জীবনে তো ধ্রুব নামক একটা মরীচিকার উপস্থিতি ছিল। এ মরীচিকা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারবে আদৌ?
“বললে না তো কী চাই তোমার?” সৌহার্দ্যের কথায় হায়ার ঘোর কাটলো।
“হুম। আগে বলেন আমি যা চাইবো তাই দিবেন?”
“আগে বলবে তো। তোমার আবদার তো আর অপূর্ণ রাখছি না আমি। বলেই দেখো।”
“আপনি আমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করুন আমি যা চাইবো, আমাকে তাই দিবেন।”
“অদ্ভুত তো। এরকম করার কী আছে?”
সৌহার্দ্যের মুখের কথায় যেন বিশ্বাস হলো না হায়ার। সৌহার্দ্যের হাত নিজের মাথায় রেখে বললো,
“বলেন আমি যা চাইবো আপনি তাই দিবেন।”
“আমি ডিভোর্স চাই।”
“কী?”
“আমি মুক্তি চাই! ডিভোর্স চাই আপনার থেকে। আপনার সাথে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমার মুক্তি চাই আপনার থেকে, এ বিয়ের বন্ধন থেকে।” তৎক্ষণাৎ হায়ার মাথা থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল সৌহার্দ্য।
চলবে …