হঠাৎ এলে তুমি পর্ব -১১+১২

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১১
#সুলতানা_পারভীন

গত সাতটা দিন বোধহয় জীবনের সবচেয়ে আনন্দের আর স্মরণীয় হয়ে কেটেছ প্রজ্ঞার। ধূসরের সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ছোটো ছোটো খুনশুটি থেকে শুরু করে বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর ক্লান্তিহীন ঘুরোঘুরি, কখনো শপিং, কখনো রাতের তারা গোনা, প্রত্যেকটা মূহুর্ত প্রজ্ঞার হৃদয়ে সম্ভবত আমৃত্যু গেঁথে থাকবে। এর মধ্যে একদিন অবশ্য শাশুড়ি কল করে অনেক কথাও শুনিয়েছে প্রজ্ঞাকে। সেসবে এবারে আর কান দেয় নি মেয়েটা। শাশুড়ি ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে কলটা কেটে দেয়ার পরই লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে সব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। যে মানুষটার জন্য প্রজ্ঞা নতুন করে বাঁচতে শিখেছে তাকে কেন কষ্ট দিবে বারবার? তাও আবার এমন কারো জন্য যারা কখনোই বিন্দু পরিমাণ সম্মান পর্যন্ত করে নি? এমন কিছু মানুষকে ভালো রাখতে গিয়ে, তাদের কথা মানতে গিয়ে প্রজ্ঞা কেন নিজের শেষ ভালোবাসার আশ্রয়টুকুও হারাবে? এবারে আর ভুলেও কারো ফাঁদে পা দিবে না এই প্রতিজ্ঞা করেই শুধুমাত্র ধূসরের উপরেই ফোকাস করেছে মেয়েটা।

আজও অন্য দিনের মতোই ধূসরের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতেই ভদ্রলোকের কল এসেছে। আজ হুকুম হয়েছে রেডি হয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ির গেইটের সামনে ওয়েট করতে হবে। ধূসর বাড়ির গেইটের কাছ থেকেই পিকআপ করে নিবে প্রজ্ঞাকে। কথাটা বলেই ভদ্রলোক প্রজ্ঞাকে আরেকবার তাড়াতাড়ি রেডি হওয়ার তাড়া দিয়ে কলটা কেটে দিয়েছে। প্রজ্ঞাও ধূসরের এমন পাগলামি আবদারে হেসে ধূসরের পছন্দের কালো রঙের একটা চুমকি বসানো শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নিল। কালো শাড়ির টকটকে লাল পাড়ের সাথে ম্যাচিং করে দু হাতে মুঠো ভর্তি চুড়ি, কপালে রক্ত রাঙা ছোট্ট একটা লাল টিপ। কানে দুল জোড়ার হুঁক লাগাতে লাগাতেই নিজের পার্সটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির মেইন গেইটের দিকে ছুট লাগিয়েছে মেয়েটা। দেখতে দেখতেই পাঁচ, দশ, পনেরো করে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার হয়েছে। প্রজ্ঞা একটু পর পর মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে আর সামনের মেইন রোডের দিকে দু এক কদম গিয়ে আবার গেইটের সামনেই ফিরে এসে দাঁড়াচ্ছে। সময় গড়াতে গড়াতে সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে খেয়াল হতেই কিছুটা বিরক্ত হয়েই ধূসরের নাম্বারে কল করলো প্রজ্ঞা। কলটা প্রায় সাথে সাথে রিসিভও হলো।

-সরি সরি সরি বউপাখি। অনেকক্ষণ ওয়েট করিয়ে রেখেছি না বউটাকে? এই যে ম্যাডাম? রাগ করে আছ? কথাও বলবে না?

-এটা আপনার পাঁচ মিনিট?

-না রে সোনা। বের হবো অফিস থেকে, লাস্ট মিনিটে একটা আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেল। সেটা শেষ করে পাঁচ মিনিট হয় গাড়িতে এসে বসেছি।

-আবার পাঁচ মিনিট?

-আমার কিন্তু এবার দোষ নেই ম্যাডাম। আর আমি কি জানি আমার বউটা সত্যি সত্যিই পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে গিয়ে গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে?

-হ্যাঁ, পাঁচ ঘন্টা ধরে বসে বসে সাজবো। বিয়ে করতে যাচ্ছি তো আমি।

-এই রে! বউটা দেখি ভিষণ ক্ষেপেছে। সরি তো লক্ষী বউটা। এভাবে রাগ করে থেকো না প্লিজ? আচ্ছা যাও, এতোক্ষণ ওয়েট করিয়েছি তো? এসেই সব শোধবোধ করে দিবো, পাক্কা প্রমিস।

-আমি কি এখন গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবো? নাকি ভিতরে চলে যাবো?

-হায়রে পাগলিটা! আমি আসতে দেরি করছি দেখেও গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছ?

-আমি তো জানতাম না কারো পাঁচ মিনিট পঞ্চাশ মিনিটে হয়। তাই ভেবেছিলাম এসে যদি গেইটের সামনে না দেখে কেউ রাগ করে?

-আচ্ছা বাবা সরি। এইতো চলে এসেছি। আর জাস্ট দুই মিনিট লাগবে আমার। তুমি ওখানেই থাকো।

-ঠিক আছে। আসো। রাখছি তাহলে এখন।

-ওফ! বিয়ের পরে এই মেয়েটা এতো পানসা হয়ে গেল কেন গো? সবার বউয়েরা শুনি ঘন্টায় ঘন্টায় কল করে বিরক্ত করে ফেলে, কথা বলো না, সময় দাও না বলে কানের পোকা সব মেরে ফেলে। আর এদিকে আমার ম্যাডামের সাথে আমি কথা বলতে চাইছি, আর উনি আছেন ঠিক আছে, রাখছি তাহলে। এটা কেমন কথা বলো তো প্রজ্ঞা?

-তুমি তো ড্রাইভিং করছ এখন। জানো না ড্রাইভিং করার সময় কথা বলা ঠিক না?

-আরে বাবা, কিছু হবে না। এই প্রজ্ঞা? তুমি কালো।শাড়িটা পড়েছ আজকে? উফ! এখন বাকি রাস্তাটা আমি ড্রাইভিং করবো, নাকি আমার ব্ল্যাক বিউটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখবো বলো তো?

-তুমি চলে এসেছ?

-রাস্তার মোড়ে এতো দূর থেকেও কালো শাড়িতে তোমাকে চিনতে ভুল হবে না আমার। ভাবছি আজকে বাকি প্ল্যান বাদ দিয়ে তোমাকে নিয়ে স্বপ্নকুটিরে চলে যাবো। যেখানে আমাদেরকে বিরক্ত করার জন্য কেউ আসবে না। কি বলো বউটা?

-ধূসর?

ধূসরের সাথে কথা বলতে বলতেই রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলোর উজ্জ্বল আলোয় পুরো রাস্তাটা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠলো। ধূসরের কথা শুনে রাস্তার মোড়ের দিকে চোখ পড়তেই বেশ কিছুটা দূরেই ধূসরের গাড়িটা দেখতে পেল প্রজ্ঞা। এতোক্ষণ কথা বলতে বলতেই রাগ ভুলে মিষ্টি একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল প্রজ্ঞার ঠোঁটের কোণে। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে প্রজ্ঞার মুখ থেকে নিমিষেই হাসিটা মিলিয়ে গেল। মেইন রোডের দিক থেকে একটা গাড়ি শা শা করে ধূসরের গাড়িটার দিকেই এগিয়ে আসছিল। প্রজ্ঞা ধূসরের নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে ধূসরকে সতর্ক করার সময়টুকুও পেল না। ততক্ষণে কালো গাড়িটার ধাক্কায় ধূসরের গাড়িটা বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েছে। বিকট আওয়াজে ধূসরের গাড়িটার দিকে আশেপাশের বেশ কয়েকজন মানুষের ছুটে যাওয়ার দৃশ্যটাও এক সময় চোখের সামনে আবছা অন্ধকারে হারিয়ে গেল প্রজ্ঞার। ধূসরের গাড়িটাকে ঘিরে একটা বৃত্তের মতো করে ভিড় জড় হতে হতেই প্রজ্ঞাও পিচ ঢালা রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে ছুটিয়ে পড়েছে।

প্রজ্ঞা চোখ মেলে তাকাতেই হসপিটালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো। হাতে লাগানো স্যালাইনের নলটা টেনে টুনে ছুঁড়ে ফেলার আগেই কোথা থেকে ছুটে এসে প্রজ্ঞাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। প্রজ্ঞা নার্সকে দেখে স্যালাইনের নল খোলার চেষ্টা বাদ দিয়ে নার্সের গায়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেঁদে ফেললো। বারবার নার্সকে ধূসরের কথা জিজ্ঞেস করলেও মহিলা কিছুই বলতে পারছে না দেখে প্রজ্ঞা এক্সিডেন্টের কথাটা বললো। নার্সের পরের কথাটা শুনে প্রজ্ঞা যেন মূর্তির মতো জমে গেল। নার্স ভদ্রমহিলা প্রজ্ঞার হাতের স্যালাইনের নলটা আবার সেট করে দিয়ে ব্যান্ড এইড লাগাতে লাগাতে আফসোস করছে এবারে।

-ওই এক্সিডেন্ট কেইসটার কথা বলছেন ম্যাডাম? ক্রিটিক্যাল কেইস, মনে হয় না বাঁচবে বলে। রাস্তার বেশ কিছু লোক মিলে হসপিটালে নিয়ে এসেছিল ছেলেটাকে। নইলে এতোক্ষণে হয়তো মরে পড়ে থাকতো ওখানেই।

-নাআআআ।

-এদের গাড়ি আছে বলে এতো বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় মনে হয় যেন রাস্তাটা ওদের বাপ চাচার সম্পত্তি। প্রতিদিন এই এক্সিডেন্টেই কত যে মানুষ মরে সেটার হিসেব বোধহয় সরকারের খাতাতেও নেই।

-আমি—আমি—-আমি যাবো প্লিজ? আমাকে একবার ধূসরের কাছে একবাস নিয়ে চলুন না প্লিজ? আমি–আমি জানি ওর–ওর কিচ্ছু হয়নি। বিশ্বাস করুন, ও আমার ডাক শুনে চুপ করে থাকতে পারবেই না। আমি রাগ দেখিয়েছি না ওকে, তাই ও এমন করছে। ওর কিচ্ছু হয়নি বিশ্বাস করুন, প্লিজ সিস্টার? প্লিজ প্লিজ প্লিজ?

-ও আচ্ছা, ওই ছেলের ফ্যামেলি আপনি? আমরা এদিকে ফ্যামেলির কাউকে পাচ্ছি না বলে ট্রিটমেন্টও স্টার্ট করতে পারছিলাম না। তবু ডাক্তাররা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছে। একটা মানুষকে চোখের সামনে মরতেও তো ফেলে রাখতে পারে না তাই না?

-আপনি বুঝতে পারছেন না আমার কথা? ধূসরের কিচ্ছু হয়নি। ওর কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু হয়নি। আমাকে এক্ষুণি ওর কাছে নিয়ে চলুন, এক্ষুণি, এক্ষুণি, এক্ষুণি।

নার্সের কথাগুলো শুনে রাগ লাল হয়ে গেছে প্রজ্ঞার।মুখটা। রাগের চোটেই নার্সকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল বেড থেকে নিচে পা রাখলো মেয়েটা। নার্স রীতিমতো ‘হায়, হায়’ করে উঠে প্রজ্ঞাকে আটকানোর চেষ্টা করলো।

-আরে মেয়ে করছে কি? ম্যাডাম? আপনি নিজেই অসুস্থ। লাস্ট দুই ঘন্টা সেন্সলেস ছিলেন। কতোগুলো টেস্ট করা হয়েছে জানেন আপনি? ডাক্তার বারবার তাড়া দিয়েছে যাতে আপনার রিপোর্টগুলো আজই দেয়া হয়। আর আপনাকে আপনার হাজবেন্ডের কাছে নিয়ে যাওয়াও পসিবল না। ওনাকে ওটিতে নেয়া হয়েছে। এই মূহুর্তে আর কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।

-প্লিজ? আমি একটুও বিরক্ত করবো না আপনাদেরকে। একটা সাউন্ডও করবো না। আমি জাস্ট দুটো মিনিটের জন্য ওকে দেখবো প্লিজ? প্লিজ? প্লিজ?

-সরি ম্যাম। রুলস আর রুলস। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওপরওয়ালার উপরে ভরসা রাখুন। এর বেশি আপনাকে শান্তনা দেয়ার মতো ভাষা আমার নেই।

-প্লিজ আমি তাহলে ওটির বাইরে থেকে একবার শুধু একবার ধূসরকে দেখবো। প্লিজ? প্লিজ প্লিজ?

-ম্যাডাম, আপনার নিজেরই শরীর ভালো না। এই মূহুর্তে আপনি ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারবেন না। নয়তো আবার সেন্সলেস হয়ে পড়বেন। আপনি বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা। হসপিটাল কমিটি জানতে পারলে আমার চাকরিটাও চলে যাবে।

-আপনাদের রুলস রেগুলেশন আপনাদের হসপিটালের ম্যাগাজিনেই রাখুন। আমি আমার হাজবেন্ডকে দেখতে চাই, এই মূহুর্তেই দেখতে চাই। আর আপনি একটু আগে বলছিলেন না কিসব ফর্মালিটি আছে, সেগুলোও তো করা লাগবে। দেখুন আমার কিচ্ছু হয়নি, আ’ম এবসুলুটলি ফাইন।

-ওকে। ওকে। এজ ইওর উইশ। বাট ডাক্তার কিছু বললে আমি জানি না।

-আপনি আমাকে ধূসরের কাছে নিয়ে যাবেন? নাকি আমি একাই খুঁজে নিবো আমার ধূসরকে?

-না না না ম্যাডাম প্লিজ। আমিই নিয়ে যাচ্ছি চলুন। আমার হাতটা ধরে ধরে আসুন। আস্তে আস্তে?

নার্স ভদ্রমহিলা ধরে ধরে প্রজ্ঞাকে ওপারেশন থিয়েটারের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। বন্ধ দরজাটার ছোট্ট কাঁচের জানলা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই চোখ মুখ কেমন অন্ধকার হয়ে আসলো প্রজ্ঞার। বেশ কয়েকজন সাদা এপ্রোন পড়া লোক ধূসরকে ঘিরে আছে। এতো এতো যন্ত্র, নল, মাস্কের ভিতরে ধূসরকে চেনা রীতিমতো দুঃসাধ্যই মনে হচ্ছে প্রজ্ঞার। দৃশ্যটা এতোটাই অসহনীয় লাগছে প্রজ্ঞার কাছে যে মেয়েটা ধপ করে ওটির সামনেই ফ্লোরে বসে পড়েছে। নার্স মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে প্রজ্ঞার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো।

-দেখেছেন আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম পেশেন্ট কতোটা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে। আপনিই তো শুনলেন না আমার কথা।

-আমি ডক্টরের সাথে কথা বলবো প্লিজ? প্লিজ আমার ধূসরকে ভালো করে তুলুন প্লিজ? যত টাকা লাগবে আমি এরেঞ্জ করে দিবো, প্লিজ? এই এক্সিডেন্টে বাবা মাকে হারিয়ে এতিম হয়েছি, এবার স্বামীকে হারাতে হলে বাঁচবো না আমি। প্লিজ ডাকুন না ডাক্তারকে? আমি —-।

-দেখুন ম্যাডাম, ডাক্তারদের হাতেও তো সবসময় সবকিছু থাকে না। উনারা নিজেদের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। টাকাটা মেইন ফ্যাক্ট না। তবে আমার মনে হয় আপনাদের ফ্যামেলির বয়স্ক কাউকে খবর দেয়া উচিত। যে কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। আর আপনি নিজেও স্টেবল কন্ডিশনে নেই।

-ফ্যামেলি? আমি—আমার শ্বশুরবাড়িতে একবার খবর দিতে হবে। বাবা মাকে জানাতে হবে। আমার–আমার মোবাইল?

-আপনার সাথে তো কোনো মোসবাইলে ছিল না ম্যাডাম। আমমমম। আপনি চাইলে হসপিটালের রিসেপশানের ফোন থেকে কল করতে পারেন। চলুন আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।

-কিন্তু–কিন্তু ধূসর?

-ম্যাডাম ডাক্তাররা তো চেষ্টা করছে। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আপনার হাজবেন্ড সুস্থ হয়ে যাবেন না। তাছাড়া ডাক্তাররা বের হলেই বাকিটা জানা যাবে। তার জন্যও তো আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে নাকি?

-হ্যাঁ? হ্যাঁ তাই তো। চলুন চলুন প্লিজ?

নার্স মহিলাটি এবারে প্রজ্ঞাকে নিয়ে রিসেপশনে আসতেই প্রজ্ঞা দ্রুত হাতে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ধূসরের বাড়ির নাম্বারটা ডায়েল করলো। এদিকে চোখ চোখের অশ্রু বন্যা গাল বেয়ে সেই যে ঝরছে, বন্ধ হওয়ার নামই নেই। কান্নার দমকে কথাগুলোও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার। তবু কান্নার সাথে নিজের কষ্টগুলোকে হজম করে নিয়ে কথাগুলো এক নিমিষেই বলে ফেললো প্রজ্ঞা।

-হ্যালো হ্যালো হ্যালো মা? মা আমি—-আমি প্রজ্ঞা বলছি। মা ধূসর—–।#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১২
#সুলতানা_পারভীন

-মিসেস ধূসর? দেয়ার ইজ এ প্রবলেম। মিস্টার ধূসরের কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। আমরা নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। বাট পেশেন্টের অবস্থার কোনো উন্নতিই হয়নি। অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার আগে একটা শেষ চেষ্টা করতে চাইছি আমরা। এ জন্য আপনাকে বন্ডে সাইন করতে হবে। আপনি প্লিজ বন্ডে সাইন করে ক্যাশ কাউন্টারে ২৫ লক্ষ টাকা জমা করে দিন। এডভান্স পেমেন্ট করার পর আমরাও অপারেশনের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবো। বন্ডে সাইন করার আগে দয়া করে একবার পুরোটা পড়ে দেখবেন।

টলমলে পায়ে বহু কষ্টে রিসেপশানের টেলিফোন থেকে শাশুড়িকে যতটুকু বলতে পারলো সেটুকুই বলে হসপিটালে আসার কথাটা বলেছে প্রজ্ঞা। কোন হসপিটাল, কোথায় আছে ওরা, ধূসরের কি অবস্থা, এসব কোনো প্রশ্ন না করেই কলটা কেটে দিয়েছে ভদ্রমহিলা। কলটা কেটে যেতেই প্রজ্ঞা রিসেপশানের সামনেই বসে পড়লো। পাশের নার্স ভদ্রমহিলা সামাল দেয়ার আগেই প্রজ্ঞা কেঁদে ফেললো। কান্নার দমকে খেয়াল করেনি নার্স আর প্রজ্ঞাকে ঘিরে ছোটোখাটো একটা ভিড় জড়ো হয়েছে রিসেপশানের সামনে। নার্সের বারবার পীড়াপীড়ির পর ফ্লোর থেকে উঠে ধূসরের ওটির বাইরে এসে দাঁড়াতেই ভিতর থেকে একজন ডাক্তার বেরিয়ে এসে কথাগুলো বললো প্রজ্ঞাকে। একে তো ডাক্তারের মুখে ধূসরের এমন অবস্থার কথা, তার উপরে এতোগুলো টাকা ক্যাশ পেমেন্ট করা লাগবে! আবার বন্ডে সাইন করার কথা বলছে! কিসের বন্ড! কেন সাইন করা লাগবে?

-পঁচিশ লক্ষ টাকা! এতো টাকা এই মূহুর্তে কি করো জোগাড় করবো আমি? আনিসও তো প্রজেক্টের কাজে দেশের বাইরে গেছে আজই। এই মূহুর্তে ফ্লাইটে আছে লোকটা, তাকে জানানোর সুযোগ থাকলে হয়তো সে কোনো না কোনোভাবে টাকাটা ম্যানেজ করে দিতে পারতো। কিন্তু——।

ডাক্তারের কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজ্ঞার হুঁশ ফিরলো পিছন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা শুনে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটে এসে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে ফেললো মেয়েটা। ওপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসা সেই ডাক্তার ভদ্রলোক নিজের হাতের গ্লাভ দুটো খুলতে খুলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যেন ধূসরের মায়ের কথাগুলো শুনে হতাশই হয়েছেন ভদ্রলোক।

-আমরা নিজেদের মতো চেষ্টা করেছি। মারাত্মক একটা এক্সিডেন্টের পরও আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি পেশেন্টকে বাঁচানোর। পেশেন্টও যথেষ্ট ফাইট করছে কামব্যাম করার। বাট এর বেশি কিছু করা আমাদের পক্ষে আর পসিবে না। দু ঘন্টার মধ্যে অপারেশনটা শুরু করা না গেলে আর কোনো মিথ্যে আশা নিয়ে বসে থেকেও কোনো লাভ হবে না। আমাদেরও কিছু ল্যাকিংস আছে ম্যাডাম। তাছাড়া উনার ব্রেইনে ব্লাড ক্লটিং শুরু হয়েছে এক্সিডেন্টের পর। সেটা সময়ের মধ্যে বের করে না আনা গেলে পেশেন্টকে বাঁচানো ইম্পসিবল। আপনারা পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করতে না পারলে প্লিজ পরে আমাদেরকে দোষারোপ করবেন না।

-ডক্টর ডক্টর ডক্টর? মা? ধূসর? ধূসরের কিছু হবে ন। তো মা বলুন না? ওরা এমন কেন বলছে? আমি–আমি জানি ধূসরের কিচ্ছু হয়নি। ও এভাবে আমাকে একা ফেলে যেতে পারে না। কিছুতেই পারে না।

ডাক্তার নিজের কথাগুলো শেষ করেই একটা কেবিনের দিকে চলে গেল। নার্স ভদ্রমহিলাও কিছুটা ইতস্তত করে সেখান থেকে বিদায় নিল। প্রজ্ঞা শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে অপারেশন থিয়েটারের কাঁচে ঢাকা জানালার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলার ফাঁকেই কারো সজোরে ধাক্কায় প্রজ্ঞা ছিটকে একটা ওয়েটিং চেয়ারের উপরে পড়লো। স্টিলের চেয়ারের খুঁটিতে মাথাতে বেশ ভালোই আঘাত লাগার পরও সেই ব্যথার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয়ে নিজেকে সামলে সামনের দিকে তাকিয়েছে প্রজ্ঞা। ততক্ষণে ধূসরের মায়ের সমস্ত মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। প্রজ্ঞা কিছু বলার আগেই শাশুড়ির শক্ত হাতের একটা চড় এসে পড়লো প্রজ্ঞার গালে। ঘটনাগুলো এতো কম সময়ের ব্যবধানে ঘটলো যে প্রজ্ঞা রিএক্ট করার সময়টুকুও পেল না। আধো কি রিএক্ট করবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা।

-এই সবকিছুর জন্য দায়ী তুই, অপয়া অলক্ষী মেয়ে। যেদিন থেকে আমার ছেলেটার জীবনে এসেছিস সেদিন থেকেই আমার ছেলেটার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিস। যে ছেলে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো, যে ছেলে নিজের বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো জোরে একটা কথা পর্যন্ত বলে নি, সেই ছেলেটাই তোর জন্য বাড়ি ছেড়েছে, নিজের বাবার চোখে চোখ রেখে বলে সে আর নিজের অফিসে আসবে না? আরে রূপ, গুণ তো দূর সামান্য স্বামীভাগ্য পর্যন্ত নেই তোর? আজ তুই অপয়াকে বিয়ে করে আমার ছেলেটা মরতে বসেছে।

-মা? কি বলছেন?

-চুপ! একদম চুপ হতভাগি মেয়ে! নিজের বাবা মাকে তো খেয়েছিস, আমার ছেলেটাও মৃত্যুশয্যায়, এবার কি আমাদেরকেও মারতে চাস? এতোগুলো দিন ছেলেটা চোখের আড়াল ছিল, তবু অন্তত বেঁচে তো ছিল! আজ? আজ কি করলি তুই রাক্ষসী? আমার ছেলেটাকেও কেড়ে নিতে চাস তুই?

-এসব কুসংস্কারের কথা বলবেন না মা প্লিজ। মানছি ভুল আমারও হয়েছে। আমার আগেই উচিত ছিল ধূসর ড্রাইভিং করছে শোনার পর কলটা কেটে দেওয়া। কিন্তু এসবে আমার ভাগ্যকে জড়াবেন না।

-তোর অপয়া ভাগ্যের জন্যই আমার ছেলেটা অকালে মরতে বসেছে। তবু তোর ভাগ্যের দোষ নয়? তোর কারণে আমার ছেলেটা আজ এই এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। অথচ ধূসরের আজ ওর বাবার সাথে বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। শুধু তোর কথায় ছেলেটা নিজের বাবার মুখের উপর দিয়ে বলে দিয়েছে যাবে না। কোম্পানির কোনো দায়িত্বের কখনো অবহেলা করে নি আমার ছেলেটা। এই প্রথমবার, নিজেদের কোম্পানির লস হবে জানার পরও ছেলেটা সেটাকেও ইগনোর করেছে, শুধুমাত্র তোর কথায়।

-মা? এসব এখন বন্ধ করুন প্লিজ। ধূসরের অপারেশনের জন্য পঁচিশ লাখ টাকা জোগাড় করতে হবে। এখন এতোগুলো টাকা কোথা থেকে পাবো সেটাই ভাবতে হবে আমাদেরকে। বাকিটা নাহয় ধূসর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার দেখা যাবে।

-আমার ছেলেটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এখন নাটক করতে এসেছিস? নাটক? আমার ছেলের যদি কিছু হয় প্রজ্ঞা, তাহলে তোকেও আমি ছাড়বো না বলে দিলাম। দেখে নিস।

-ঠিক আছে মা। আমি আপনাকে বলছি শুনে রাখুন, আমার ধূসরের কিচ্ছু হবে না। এটা আমার বিশ্বাস। উনাকে সুস্থ করে আপনার সামনে এনে দাঁড় করাবো আমি। সেদিন আপনি বলবেন এই অপয়া মেয়েটার কারণে আপনার ছেলেটার কোনো ক্ষতি কখনো হয়েছে কি না। ডাক্তার যত যা ই বলুক না কেন, আমার মন বলছে ধূসর সুস্থ হয়ে উঠবেই।

প্রজ্ঞার কথাগুলো শুনে ধূসরের মা বিরক্তি নিয়ে তাকালেও আর সেখানে এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না প্রজ্ঞা। নিজের সমস্ত ভয়, ব্যথা, কষ্ট ভুলে ছুটলো বাড়ির দিকে। যে করেই হোক ধূসরের অপারেশনের টাকাটা তো জোগাড় করতে হবে প্রজ্ঞাকে। হাতে মাত্র দুটো ঘন্টা সময় বাকি। দুই ঘন্টা পর প্রজ্ঞা যখন ফিরে এসেছে তখন মেয়েটার হাতে একটা ব্যাগ। পঁচিশ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি মেয়েটার পক্ষে। বাড়িতে ক্যাশ কিছু টাকা, মায়ের রেখে যাওয়া সব গয়না, নিজের বিয়ের গয়না, পরিচিত বন্ধু বান্ধব সবার কাছে কাকুতি মিনতি করে শেষ পর্যন্ত পনেরো লাখ টাকার মতোই জোগাড় করতে পেরেছে প্রজ্ঞা। তবু শেষ আশা নিয়ে রিসেপশনে টাকাগুলো জমা দিতে এসেছে মেয়েটা। বাকি টাকা সকাল হলেই ব্যবস্থা করে ফেলা সম্ভব। রাতটা বেশ গভীর হয়েছে, আর সব ব্যাংকগুলোও বন্ধ। এতো রাতে এর বেশি টাকা জোগাড় করা কি করে সম্ভব?

টাকার ব্যাগ হাতে বেশ অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে নিজের নিজের সিরিয়াল আসার পরও টাকা দিতে না পারায় মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো প্রজ্ঞার। রিসেপশান থেকে সোজা জানিয়ে দিল, এই পেশেন্টের পেমেন্ট হয়ে গেছে। এর বেশি তারা কিছু জানে না। প্রজ্ঞা পড়িমড়ি করে হাতের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে রিসেপশান থেকে ছুটে ওটির সামনে এসে শাশুড়িকে দেখে ছুটে এলো। প্রজ্ঞার শাশুড়ি প্রজ্ঞার দিক থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালে ঝুলানো।ঘড়িটার দিকে এক নজর তাকিয়ে ভদ্রমহিলার ঠোঁটের কোণে একটা তাচ্ছিল্যভরা ম্লান হাসি ফুটে উঠলো। একটু পরেই শাশুড়ির বলা কথাগুলো সোজা প্রজ্ঞার একেবারে কলিজায় গিয়ে লাগলো। প্রজ্ঞার হাতের ব্যাগটা ততক্ষণে ফ্লোরে পড়ে গেছে। মেয়েটাও ততক্ষণে ছলছলে চোখে শাশুড়ি আর তাস পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে পাথরের মতো ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আর এই স্তব্ধতার মধ্যেও মেয়েটার কানের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে শাশুড়ির বলা কথাগুলো।

-আমি জানতাম তোমার অপেক্ষায় বসে থাকলে আমার ছেলেটাকে হারাতে হবেই আজকে। তোমার উপরে ভরসা করে নিজের ছেলের জীবন নিয়ে বাজি ধরি নি, এটা ভেবেই শুকরিয়া করছি ওপরওয়ালার কাছে। যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে তার কারণেই মরতে বসেছিল ছেলেটা, আর যাকে এতোদিন তুচ্ছ করেছে, অপমান করেছে, সেই সেই সময়ে জীবন বাঁচাতে ছুটে এসেছে। একেই বলে ভাগ্য! ভাগ্যের পরিহাস।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here