হঠাৎ এলে তুমি পর্ব -৯+১০

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_৯
#সুলতানা_পারভীন

-ডোন্ট শাউট ধূসর। এটা বাসা নয় যে তুমি যখন ইচ্ছে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। আর প্রজেক্টের ফিনিশিং পয়েন্টে এসে তুমি কি করে এভাবে ব্যাকআউট করতে পারো? ডোন্ট ইউ নো এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট? আর ক্লাইন্ট যেভাবে ডিল করতে চেয়েছে সেটাতে রাজি না হয়ে আমাদের কি কোনো উপায় আছে ধূসর?

ধূসরের ডেস্কের উপরে ছুঁড়ে ফেলা কাগজগুলোর দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে নিয়ে রাগী গলায় কথাগুলো বললেন ধূসরের বাবা আনিস আহমাদ। ধূসর বাবার কথাগুলো শুনে ডেস্কের উপরে সজোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। সলিড কাঠের ডেস্কে ঘুষিটা কতটা জোরে গিয় লেগেছে সেটা ধূসরের মুখের ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল না। তবে ব্যথায় হাতটা গুঁটিয় নিয়ে সোজা বাবার দিকে তাকালো ধূসর।

-তোমার ক্লাইন্টের সাথে তোমার কি ডিল হয়েছে আমার জানার কোনোই ইন্টারেস্ট নেই বাবা। তোমার সাথে আমার কি ডিল হয়েছিল তোমার সেটা মনে আছে নিশ্চয়ই? আমি তোমার প্রজেক্টটা সাবমিট করে দিবো, বাট এর পর ক্লাইন্টের সাথে তোমরা কিভাবে ডিল করবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। এটাই তো ডিল ছিল আমাদের বাবা? রাইট?

-তখন ক্লাইন্টদের দেশে এসে ডিলটা নিয়ে ডিস্কাস করার কথা ছিল। বাট এখন প্ল্যানে কিছুটা চেইঞ্জ করা হয়েছে ধূসর। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? এই প্রজেক্টটা ক্র্যাক করা আমাদের কোম্পানির জন্য এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি। তুমি আর কতদিন এই জেদ ধরে কোম্পানির প্রত্যেকটা রেসপন্সসিবিলিটি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে ধূসর? এন্ড হোয়াই ধূসর হোয়াই? এটা তোমার নিজের কোম্পানি। আজ বাদে কাল তুমিই এই কোম্পানিটার এম.ডি হবে। তাহলে নিজের কোম্পানিকে এভাবে লসের মুখে ফেলে তোমার নিজের কি লাভ হচ্ছে বলো তো ধূসর?

-সরি বাবা। এটা আমার নিজের কোম্পানি দয়া করে এই হাস্যকর স্টেটমেন্টটা দিও না। প্রজ্ঞাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার সাথে সাথেই তোমার কোম্পানির সাথেও আমার এসব মালিক, বংশধর এসব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। শুধু তোমার আর মায়ের বাংলা সিনেমার মতো নাটকে প্রজ্ঞা গলে যাওয়ার কারণে আমি এখন তোমাদের অফিসের একজন স্টাফের জব করছি।

-ধূসর?

-ডোন্ট শাউট ড্যাড। এটা তোমার বাড়ি নয়, একটা অফিস। তুমি যে অফিসের মালিক, এবং আমি যেখানে সামান্য নাইন টু ফাইভ জব করি। এখন নিজের কাজ কমপ্লিট করছি না বলে, তুমি চাইলেই আমাকে ফায়ার্ড করতে পারো। কয়েক মাসের মধ্যে কাছাকাছি লেভেলের একটা চাকরি জোগাড় করে নিতে পারবো এই ব্যাপারে আমি যথেষ্ট কনফিডেন্ট।

-হ্যাভ ইউ গন ম্যাড ধূসর? আর দশটা দিন সময় আছে হাতে। এই মূহুর্তে তুমি যদি প্রজেক্ট থেকে ব্যাকআউট করো তাহলে আমাদের কোম্পানি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে। ডিলটা না হলে——–।

আনিস আহমেদ কি বলছে সেসব চুপচাপ শুনে ধূসর কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একটা কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে গেল। কেবিনের দরজার সামনে শুভ্রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনিস সাহেবের দিকেই আবার ফিরে তাকালো ধূসর। ততক্ষণে শুভ্রার মুখ দিয়ে খই ফুটছে বলা চলে। এই মেয়েটা দিন দিন নিলর্জ্জের চেয়েও যেন কয়েক গুণ বেশি বাচাল হয়ে যাচ্ছে।

-আঙ্কেল ধূসরকে কোম্পানির কথা চিন্তা করতে বলছ? নিজের বউয়ের কথা ছাড়া দুনিয়ায় আর কারো কথা ভাবার সময় আছে নাকি ধূসরের? এই যে দেখছ না বউকে রেখে যেতে হবে বলে কোম্পানির এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা ডিলটাকেও কমপ্লিট করবে না বলে জেদ ধরে বসে আছে?

-আর এই মেয়েটা এখানে কেন বাবা? ওর ইন্টার্নশিপের কথা সত্যি কি তোমাদের বানানো গল্প আমার সেটা জানার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তোমার এই কোম্পানিতে শত শত ট্রেইন্ড অফিসার আছে যাদের কাছ থেকে তোমাদের আদরের শুভ্রা অফিস ম্যানেজমেন্ট শিখতে পারবে। সো প্লিজ? আমাকে মাফ করো।

-ধূসর এটা কেন বলছো না যে তোমার বিলাভেড ওয়াইফ তোমাকে এতোটাই অবিশ্বাস করে যে সোজা তোমার অফিসেই চলে এসেছে? তা বউকে কেবিনে বসিয়ে রেখে এসে এখন আঙ্কেলকে বলছ প্রজেক্টের কাজে দেশের বাইরে যেতে পারবে না? তা ধূসর? প্রজ্ঞা ভাবি কি তোমার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটা মানছে না?

-জাস্ট শাট ইওর ব্লাডি মাউথ শুভ্রা। এন্ড গেট লস্ট। আমি কোনো প্রজেক্টে কাজ করবো, কোন কাজে দেশের বাইরে যাবো কি যাবো না সেটার কৈফিয়ত আমি তোকে দিতে যাবো কেন হ্যাঁ? আর সেকেন্ড টাইম তুই এই অফিসে আমার সামনে পড়লে আমি আর অফিসেই আসবো না, কথাটা মাথায় রাখিস। নাউ গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।

ধূসর বিরক্ত হয়ে শুভ্রার একটা হাত ধরে টানতে টানতে কেবিনের বাইরে নিয়ে এসে আরেকবার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল শুভ্রাকে। শুভ্রার ম্লান মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে হাতের ইশারায় ‘বিদায়’ জানাতেই ধূসর ঠাস করে কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে আবার আনিস আহমাদের দিকে ফিরলো।

-শুভ্রাকে তো চুপ করিয়ে দিতে পারবি। কিন্তু ওর প্রশ্নটা তো রাইট। ওই মেয়েটার কারণেই তো তুই প্রজেক্টটা ইনকমপ্লিট রেখে আমাদের বিজনেসের এতো বড় ক্ষতিটা করতে চাইছিস?

-ও রিয়েলি বাবা? তুমি, মা, শুভ্রা যত নাটকই করো না কেন প্রজ্ঞাকে একা রেখে আমি কোথায় যাচ্ছি না। আমার কাছে তোমার কোম্পানির চেয়েও আমার প্রজ্ঞার সেইফটি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।

-ওই মেয়ের কি হবে? বাবা মা দুজন গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এই মেয়ের কিছু হয়েছে? নোপ।

-বাবা প্লিজ? নিজেদেরকে এতোটাও নিচে নামিয়ে নিও না যে তোমাদেরকে নিজের জন্মদাতা পিতা মাতা বলতেই লজ্জা হয় আমার। আমি ছাড়া এই মূহুর্তে প্রজ্ঞাকে সাপোর্ট দেয়ার মতো, ওর বিপদে পাশে থাকার মতো কেউই নেই। থাকলেও আমার জানা নেই।

-এতো সেইফটি নিয়ে চিন্তা হলে সারাদিন একা একটা বাড়িতে রেখেছিস কেন ওই মেয়েকে? ওই মেয়ে তো বাড়িতে থাকবে না, নইলে এতো ঝামেলাই হতো না।

-কোন পরিস্থিতিতে আমি প্রজ্ঞাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি সেটা তুমিও ভালো করে জানো বাবা। এখন যদি তোমার মনে হয় বাড়ি ছাড়ার পিছনেও প্রজ্ঞাই দায়ি তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আর তোমার গিফ্ট করা বাড়িটায় মেয়েটা তো একা নয়, যে কয়জন মানুষ আছে তাদেরকে আমি তোমাদের থেকে বেশি ভরসা করি। ওরা আর যাই করুক অন্তত আমার প্রজ্ঞাকে খুন করে ফেলবে না, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে আসতে পারি।

-ধূসর?

-সত্য কথাগুলো শুনতে একটু তেঁতোই হয় বাবা। আমি দেশের বাইরে কোথাও যাচ্ছি না। এটাই ফাইনাল। তার জন্য যদি আমাকে তোমার জবটা ছাড়তে হয় তবে সেটাই হোক।

-শুধু ওই মেয়েটারই তোর উপরে অধিকার আছে? আর আমরা? আমরা তোর বাবা মা। আমাদের কি তোর উপরে কোনো অধিকার নেই? কোনো স্বপ্ন নেই আমাদের তোকে নিয়ে ধূসর? বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের যে একট কর্তব্য আছে সেটাও কি ভুলে গেছিস তুই? এই শিক্ষা দিয়ে তোকে মানুষ করেছি আমরা? তিলে তিলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোকে মানুষের মতো মানুষ করেছিলাম এই দিনটা দেখার জন্য ধূসর? আমার এতোদিনের কষ্ট, রক্ত, ঘাম এক করে দাঁড় করানো কোম্পানিটাকে এভাবে শেষ করে দিবি জানলে তোকে এতো বড় দায়িত্বটা আমি জীবনেও দিতাম না। কখনোই না।

-অবশ্যই তোমাদের আমার উপরে অধিকার আছে বাবা। তাই তো আমার স্ত্রীকে এতোটা অসম্মান করা স্বত্বেও আমি সময় বের করে মায়ের সাথে দেখা করে আসি, তোমার সাথে একই অফিসে, একই ছাদের তলায় কাজ করছি। যদি এই বাবা মা আর সন্তানের ব্যাপারটা ভুলে যেতাম না বাবা, তাহলে আমার স্ত্রীকে বিনা অপরাধে বারবার সবার সামনে, আড়ালে অপমান করা মানুষগুলোকে কখনোই নিজের চোখের সামনে আসতে দিতাম না। তোমাদেরকে আজও নিজের বাবা মা বলে সম্মান করি বলেই বিবাহবার্ষিকীর মতো একটা দিনে নিজের সোর্সদেরকে দিয়ে প্রজ্ঞাকে নানাভাবে বডি শেইমিং করার পরও তোমার অফিসে এসে প্রজেক্টের কাজ সামলাচ্ছি। এর চেয়ে বেশি আর কি চাও বাবা?

ধূসরের কথাগুলো শুনে আনিস আহমাদের নিরবতাই ধূসরের প্রত্যেকটা কথা যে সত্য তার প্রমাণ দিচ্ছে। ধূসর এবারে সোজা কেবিনের দরজার দিকেই এগিয়ে গেল। কয়েকটা কথা বলেই বাবার কেবিনটা থেকে বেরিয়ে গেল ধূসর। আর পিছনে নিজের চেয়ারে বসে চুপচাপ ধূসরের চলে যাওয়া দেখলেন আনিস আহমাদ। মনের কোণে একটা সন্দেহই খচখচ করছে তার। ধূসর কিছু আন্দাজ করতে পারলো নাকি? নাকি সবটাই নিছক ওর অভিমান? না সন্দেহ করলে এভাবে রিএক্ট করলোই বা কেন? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আনিস সাহেবের কানে তখনো ধূসরের শেষ কথাগুলোই বাজছিল।

-প্রজেক্টের বাদ বাকি কাজগুলো আমি কমপ্লিট করে দিবো না সেটা তো একবারও বলি নি বাবা। আমি শুধু বলছি কাজগুলো আমি করবো, বাট ওদের শর্ত মেনে নিয়ে প্রেজেন্টেশন যদি দিতেই হয় তাহলে অন্য কাউকে পাঠাতে হবে। প্রজ্ঞার জন্য হোক বা না হোক, আমি যাচ্ছি না কোথাও। এবার এর জন্য তুমি যদি আমার নামে কেইস করতে চাও তাও করতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। বাট আমার কাজটা তোমার প্রজেক্টের আউটার সারফেসটা রেডি করে দেয়া পর্যন্তই। এর বেশি আমার কাছে কিছুই আশা করো না। আর বাকি রইলো শুভ্রার কথা? ও যদি আর একবারও আমার লাইফে দখল দিতে আসে তাহলে কাল সকালেই আমার রেজিগনেশন লেটারটা তোমার ফাইলের উপরেই পাবে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকিটা আমাকে জানও। কিভাবে কি করতে চাও। ওকে বায়।
#হঠাৎ_তুমি_এলে
#পর্ব_১০
#সুলতানা_পারভীন

-আরে ধূসর! কি করছ কি তুমি? এতো স্পিডে ড্রাইডিং করছো কেন? আস্তে চালাও গাড়ি! ধূসর! সামনে থেকে গাড়ি আসছে! আআআআআআআ। ধূসর? প্লিজ স্টপ দা কার।

আনিস আহমাদের কেবিন থেকে বেরিয়ে ধূসর সোজা নিজের কেবিনে এসেই প্রজ্ঞাকে সোফা থেকে একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। ধূসর কিছু না বলেই গাড়ি ফুল স্পিডে চালানো শুরু করায় প্রজ্ঞা নিজের সিটবেল্টটা বেঁধে নিয়ে ধূসরের দিকে তাকালো। ধূসর চোয়াল শক্ত করে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে প্রজ্ঞা ধূসরের বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কথাগুলো বললো। ধূসরদের গাড়ির অপজিট থেকে আরেকটা গাড়ি আসছে দেখে প্রজ্ঞা এতোটা ভয় পেয়ে গেছে যে কখন ধূসরের হাতটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। একটু পরেই ওদের গাড়িটা হুট করে ব্রেক করায় প্রজ্ঞা ভয়ে আরো শক্ত করে চোখ বুজে মনে মনে যত দোয়া দূরুদ আছে সব পড়তে শুরু করেছে। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও কিছুই ঘটে নি দেখে প্রজ্ঞা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো ধূসর ম্লান মুখে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রজ্ঞা বড় বড় চোখ করে ধূসরের দিকে তাকাতেই ধূসর হাত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।

-পাগলি মেয়েটা এতো ভয় পেয়েছ কেন বলো তো? আমি থাকতে তোমার শরীরের একটা চুলও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না বুঝলেন ম্যাডাম? এভাবে শক্ত করে হাতটা চেপে ধরেছে যে হাতটাই ভেঙ্গে গেল আমার। উফ! প্রজ্ঞা আমার হাত!

-কি হয়েছে তোমার হাতে? আমি মোটেও এতো শক্ত করে ধরি নি ধূসর। দেখাও দেখাও? কি হয়েছে হাতে দেখি?

ধূসরের বুকের কাছ থেকে সরে এসে প্রজ্ঞা ব্যস্ত হাতেই ধূসরের বাম হাতটা ধরে হাতটা অনেকটা ফুলে গেছে ধূসরের দিকে তাকালো। ধূসর একটু হাসার চেষ্টা করে প্রজ্ঞার মাথাটা টেনে নিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আবার স্টিয়ারিংয়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করতেই প্রজ্ঞা ধূসরের বাম হাতে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ধূসর ব্যথা পেয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু অবাক বিস্ময়েই তাকাতেই প্রজ্ঞা নিজের জ্বিভ কামড়ে ধূসরের হাতটা আবার টেনে নিল।

-সরি সরি সরি সরি। বেশি ব্যথা পেয়েছ? হাতটা কেমন ফুলে গেছ দেখেছ? এভাবে লাগলো কি করে হাতে?

-আরে তেমন কিছু না। একটু টেবিলের সাথে লেগে ব্যথা পেয়েছি। কিচ্ছু হয় নি তো বাবা। আর ব্যথাও পাই নি ম্যাডাম।

-এটাকে একটুখানি ব্যথা বলে? হাতটা ফুলে গেছে বুঝতে পারছ না? এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে যাবে তুমি। আর টেবিলের সাথে লেগে কি করে ব্যথা পায় একটা মানুষ আমি বুঝলাম না। আর গিয়েছিলে তো বাবার কেবিনে তাহলে———।

-উফ! এই মেয়েটা এখন পুলিশের মতো জেরা শুরু করে দিবে। বলছি ম্যাডাম একটু থামুন। কোনো।ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না। হালকা ব্যথা পেয়েছিলাম, তার উপরে আপনি যেভাবে ভয় পেয়ে হাতটা চেপে ধরেছেন, মনে হয় হাতটা ভেঙ্গেই গেছে। বাট সেই কথাটা তো ডাক্তারকে বলা যাবে না বলো? ডাক্তার কি ভাববে বলো তো? আজীবন শুনেছি জামাই বউকে পিটায়, আমার বেলায় দেখি উল্টা কেইস। বউ পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে দিবে কোনদিন কে জানে।

-ধূসর? ফাইজলামি হচ্ছে? আর একটাও আজাইরা কথা বললে তোমার কিন্তু খবর আছে। আমি হাত ধরেছি বলে এমন হয়েছে বোঝাতে চাইছ তুমি? আমি দেখতে পাচ্ছি না চোখে কিছুতে জোরে লেগে ব্যথা পেয়েছ যে হাতে?

-আরে বাবা, বেশি ব্যথা পাই নি।

-তুমি ডাক্তারের কাছে যাবে আমার সাথে ধূসর? জাস্ট ইয়েস অর নো?

-এই মেয়েটাকে নিয়ে এই এক মুশকিল। একবার জেদ ধরলে তাকে বোঝানোর সাধ্য কারো আছে? ওকে তোমার সব কথাই মানবো, যার কাছে নিয়ে যেতে চাও, যাবো। বাট আমার একটা শর্ত আছে। সেটা যদি মানো তাহলে এখন এই মূহুর্তে যেদিকে যেতে বলবে সেদিকেই যাবো। আজ যদি বলো হসপিটালে থেকে যাবো আমরা, তাতেও রাজি আমি।

-ধূসর? আবার তোমার ইয়ার্কি শুরু হয়ে গেল না? তোমাকে বলছি না ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা এখন? কথা না বলে হসপিটালের দিকে ড্রাইভিং করবে তুমি? নাকি আমিই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরবো?

-আরে বাবা। তুমি নিজেই তো দেরি করছ এবারে? বলছি না দুজনে মিলে একটা ডিল করি এসো? তুমি রাজি হয়ে গেলেই আমাদের গাড়ি সোজা ছুটবে হসপিটালের দিকে। আর রাজি না হলে আমরা যাবো—উমমমম? রেস্টুরেন্টে? কি বলো?

-কি করতে হবে জনাব এখন আমাকে? আগে বলুন শুনি। তারপর ভাববো ডিল ওকে নাকি বাতিল।

-ওকে। শুনুন ম্যাডাম। আমি না বললে যে আপনি জানতে পারবেন না তেমনটা নয়। আর আমিও চাই না তোমার আমার মধ্যে আড়াল থাকুক। আর এটাও চাই না যে তুমি আবার অন্য কারো কথার জালে আটকে আমাদের সম্পর্কটায় তিক্ততা আনো। বুঝতে পারছ কি বললাম?

-কি বলছ আগামাথা নেই। আমি আবার কার কথায় তোমার সাথে ঝামেলা করবো হ্যাঁ?

-ঝামেলা করার কথা বলছি না। বাবার রিসেন্ট প্রজেক্টটার কথা তো জানোই। যেটা কমপ্লিট করার জন্য আমাকে বাবা বাড়ি ছাড়া সহ্য করতে পারলেও কোম্পানি ছাড়া করতে সাহস পায়নি।

-আবার? ধূসর তোমার সমস্যাটা কি? বাবা মায়ের সম্পর্কে কেউ এভাবে কথা বলে? আজব! আর মানছি আমিই তোমাকে জোর করেছি বাবার কোম্পানিটা না ছাড়তে, তাই বলে সবসময় এই এক কথা কেন টেনে আনো?

-আবার নতুন করে আপনি যেন আরেকটা এক্সামপল দাঁড় করাতে না পারেন তারজন্যই বারবার মনে করিয়ে দিই।

-আর একবারও এই ফালতু জোক করলে দেখবে তোমার কি আর আমি। যা বলবে বলো। আমি আর জীবনেও তোমাকে কিছু করতে বলবো না। দেখে নিও।

-তোমার নিজের মনের যত ইচ্ছে আমার সাথে শেয়ার করো, রাগ হলে চিৎকার করো, বকো, ঝগড়াঝাটি, যা ইচ্ছা করো, বাট ওই দুটো মানুষের কথার ফাঁদে পড়ে তাদের বুলি আওড়িও না কখনো। ওকে?

-তার মানে আবার কি একটা হয়েছে? আমার তোমাকে কনভেন্স করা লাগবে এমন কিছু করেছ নাকি আবার?

-প্রজ্ঞা? মজা নাও না তুমি? আমি কিন্তু সিরিয়াস। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি দেখবে আজ কালের মধ্যে কল করে বলবে, আমার প্রজেক্টের কাজে বিদেশে যাওয়ার দরকার, নইলে ডিলটা আমাদের কোম্পানি পাবে না, অনেক লস হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো কত কিছু বলবে তার হিসেব নেই।

-মানে কি? তুমি দেশের বাইরে যাবে? কবে? আগে বলো নি তো কিছু।

-আমি কোথাও যাচ্ছি না সোনাময়নাপাখি। আমার প্রজেক্টটা কমপ্লিট করে বাবাকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল, আমি সেটুকুই করবো। এর বেশি কিছু না। ওকে? তোমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর শাশুড়ি এই ব্যাপারে যা ই বলুক না কেন আমি না কোথাও যাবো, আর না তাদের এই প্রজেক্টের বাকি আর কোনো দায়িত্ব নিব। ওকে? আর ম্যাডাম আপনি। আপনি দয়া করে আমাকে এই বিষয়ে কোনো রকম জ্ঞান, বুদ্ধি, পরামর্শ কিছুই দিতে আসবেন না। ওকে? ডিল ডান?

-আমমমমমম। কিন্তু ধূসর?

-এই ব্যাপারে আর কোনো ডিস্কাশন হবে না ম্যাডাম। আপনি জাস্ট হ্যাঁ বা না তে আনসার দিন। দুনিয়ার যে যাই বলুক এই বিষয়ে আর কোনো কথা হবে না আমাদের। অন্তত যাওয়ার ব্যাপারে কনভেন্স করার জন্য তো মরে গেলেও নয়। ডিল ওকে? অর নট?

ধূসর সরাসরি প্রজ্ঞার চোখে চোখ করে প্রশ্নগুলো করছিল। প্রজ্ঞা থতমত খেয়ে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ধূসর বিদেশে যাক এটা তো প্রজ্ঞা ভাবতেও পারে না, কিন্তু ধূসর না গেলে কাজটাই যদি নাহয়? প্রজ্ঞা আরো কিছু ভাবার আগেই ধূসর প্রজ্ঞার চোখের সামনে আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতেই প্রজ্ঞা চমকে তাকালো ধূসরের দিকে।

-ম্যাডাম মাঝরাস্তায় এতোক্ষণ গাড়িতে বসে থাকলে একটু পরেই আশেপাশে ভিড় জমে যাবে। বুঝলেন? একদল আসবে গাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেল কিনা এটা দেখতে, আরেক দল আসবে ভিতরে কোনো রোমান্টিক সিন চলছে কিনা সেটা দেখে মজা নিতে, বা ফায়দা নিতে।

-উফ! ধূসর চুপ করো তো।

-তা আপনার ওভার থিংকিং শেষ হলে দয়া করে বলবেন কি ম্যাডাম আমরা এখন কোনদিকে যাচ্ছি? হসপিটাল নাকি রেস্টুরেন্ট?

-হসপিটাল।

-তার মানে কি আমি ধরে নিব আমাদের ডিলটা ফাইনাল?

-আমার মুড চেইঞ্জ হওয়ার আগে আপনি কি গাড়ি স্টার্ট দিবেন প্লিজ ধূসর? নাকি আমি এখানেই নেমে যাবো?

-ওকে ওকে। বাট পরে যদি কোনো গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করো মেয়ে তাহলে তোমার খবর আছে।

-ওকে দেখা যাবে। এখন চলো?

হসপিটাল থেকে ধূসর আর প্রজ্ঞা এসেছে রেস্টুরেন্টে। সেখানে লাঞ্চ সেরে সারাদিনই দুজনে একসাথে ঘুরোঘুরি, শপিং আর খাওয়া দাওয়া করে শেষে বেশ রাত করেই বাসায় ফিরছে। সারাদিনের ছুটোছুটির শেষে প্রজ্ঞা টায়ার্ড হয়ে সিটে একেবারে গা এলিয়ে দিয়েছে দেখে ধূসর হাসলো। বাইরের একটার পর একটা জায়গায় শাঁ শাঁ করে ওদের গাড়ির উল্টোদিকে ছুটে যাচ্ছে, বাতাসের তোড়ে প্রজ্ঞার চুলগুলো লাগামহীন উড়োউড়ি করেও আজ বিরক্ত করতে পারছে না প্রজ্ঞাকে। রাতের শহরের সৌন্দর্যের সাথে আরো গভীর একটা আকর্ষণে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে আবেশেই চোখ বুজে আসছে মেয়েটার। তেমন কিছুুই না, সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতের আদরে হুটহাট প্রজ্ঞাকে ছুঁয়ে দেয়ার মাঝেই গাড়ি চালাতে চালাতেই খালি গলায় গান ধরেছে মানুষটা। তারই সুরের লহরিই যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে এসে বাজছে প্রজ্ঞার।

“তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো,
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো,
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়,

তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

তোমার আবেগ মাখা খামখেয়ালী
হাঁটছে আমার পিছু,
আমার আসা যাওয়ার পথের বাঁকে
পাইনি অন্য কিছু।

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়।

তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো

আমার হৃদয় যেন বানভাসি হয়
তোমার স্রোতের টাণে
আমি তোমার কাছে যাবোই যাবো
একলা থাকার দিনে

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়

তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো
তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো….।”

চলবে, ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here