হঠাৎ বৃষ্টিতে পর্ব -০১

—শেষ বারের মতো আপনাকে একটু স্পর্শ করতে দিবেন হিমেল? বিশ্বাস করেন আমি শুধু আপনার হাতটা আলতো করে ধরে একটা চুমু খাবো। আর কিছু করবো না। আজকের পর থেকে তো আপনি অন্য কারোর হয়ে যাবেন।চাইলেও আপনাকে স্পর্শ করতে পারবো না। কি হলো দিবেন না একবার স্পর্শ করতে?

কান্না ভেজা কন্ঠে থেমে থেমে কথাগুলো বললো ত্রিবু। হিমেল শক্ত কন্ঠে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো ত্রিবুর মুখের দিকে তাকিয়ে। কতশত আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে মেয়েটার মুখে। শুধু তাকে একটিবার স্পর্শ করার অনুমতি চাইতে। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও হাতটা বাড়িয়ে দিলো হিমেল৷ ত্রিবু ঝড়ের বেগে তা লুফে নিয়ে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পরলো। আলতো করে হাতে ঠোঁট ছুঁয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। ভেতর থেকে আসা আর্ত চিৎকারগুলো গলায় এসে জোরো হলো। না চাইতেও হেঁচকি উঠে গেলো কাঁদতে কাঁদতে। হিমেল তাতে বেশ বিরক্ত হলো। কিছু সময় পর তার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। তার মধ্যে ত্রিবু শুরু করেছেটা কি? তার হবু বউ এখনে চলে এলে কি বিপদটা হবে তা কি ত্রিবু জানে না। হিমেল এক ঝাটকায় ত্রিবুর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বললো,

— এসব নাটক না অন্য কোথাও করিস ত্রিবু! আমার সাথে নয়। যাস্ট বিরক্ত লাগছে তোর এসব ন্যাকামি দেখতে। আমার সহ্য হচ্ছে না।

ত্রিবু কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
— এসব আপনার ন্যাকামি মনে হচ্ছে হিমেল?

—একদম! ডিজগাস্টিং, সর তো সামনে থেকে।

— সরেই যাবো। শুধু দূর থেকে চাইবো আপনি ভালো থাকেন। অনেক বেশি ভালোবাসতাম আপনাকে। কিন্তু এমন অভিনয় না করলেও পারতেন। সাত মাস আমার সাথে সম্পর্কে থেকে এখন অন্য একটা মেয়ে কে বিয়ে করতে একবারো বুক কাঁপলো না আপনার? কিভাবে পারছেন এমনটা করতে?

— দেখ তোর এসব ফালতু বকবকানি আমাকে শুনাতে আসবি না। ঐসব ভালো টালো আমি তোকে জীবনেও বাসিনি। যতটুকু ছিলো তা টাইম পাস। তোর মতো কালো মেয়ে এই হিমেলের সাথে যায় না। নিজের স্ট্যাটাস দেখ আর আমারটা দেখ। কোথায় তুই আর কোথায় আমি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াস না।তোর সাথে যে গত সাত মাস আমি টাইম পাস করছি তাই অনেক।

হিমেলের কথা শুনে ত্রিবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। যদিও জানতো সে এমনটাই হবে। তবুও কেন যে সে এই মানুষরূপি অমানুষের পাল্লায় পরলো। তাতেই ঘৃণা লাগছে তার। ত্রিবু কিছু বলার আগে হিমেল আবারো বলে উঠলো,

— তাছাড়া যার মা চরিত্রহীন সেও তো চরিত্রহীনই হবে। তোর বাবাকে ছেড়ে আরোকটা বিয়ে করতে যার কোন সমস্যা হয়নি তার মেয়ে কেমন হবে তা আমার জানা আছে।

হিমেলের কথা শুনে এবার ত্রিবুর মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। তাকে নিয়ে বলছে বলুক তাই বলে তার মা কে নিয়েও নোংরা কথা বলবে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। মাটি থেকে উঠে হিমেলের পাঞ্জাবীর কলার ধরে ক্ষিপ্ত গলায় চেচিয়ে বললো,

— আমার মায়ের নামে আরেকটা বাজে শব্দ আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই না।

— উচিত কথা শুনতে সবারি খারাপ লাগে।

ত্রিবু এক হাতে নিজের কান চেপে ধরে বললো,
— আল্লাহর দোহাই লাগি থামুন আপনি।

— আমার মুখ আছে আমি বলবোই।

— উনি যেমনি হোক উনি আমার মা। উনাকে অপমান করার কোন অধিকার আপনার নেই।একজন মা কে নিয়ে এসব কথা বলতে হয় না।

হিমেল গা ঝাড়া দিয়ে শক্ত করে ত্রিবুর হাত ওর কলারের থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,

— উনি আমার জন্য শুধুমাত্র একজন চরিত্রহীন মহিলা। আর তুই তার মেয়ে যেহেতু তাই তুইও চরিত্রহীন।

ত্রিবু হাত মুঠ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু হিমেলের কথা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলো হিমেলের গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— এই চড়টা আমার আরো আগে মারা উচিত ছিলো। তাতে তুই আমার জীবন নিয়ে খেলার সাহস করতে পারতি না। সাথে আমার মা-কে নিয়ে এসব কথা বলতে পারতি না।

হিমেল গালে হাত দিয়ে উত্তপ্ত চোখে ত্রিবুর দিকে তাকালো। তারপর এগিয়ে এসে নিজেও ঠাটিয়ে ত্রিবুর গালে দুটো চড় বসিয়ে দিলো। ত্রিবু টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে গেল। হিমেল এক আঙুল দিয়ে শাসিয়ে বললো,

— এই চড়ের কথা মনে থাকলে আমার সামনে আসিস না। বাই চান্স যদিন তোর মুখ আমি দেখবো সেদিনই তোকে খুন করে ফেলবো। মনে রাখিস কথাটা।

হিমেল হনহন করে ভেতর দিকে চলে গেল। ত্রিবু উঠলো না। মাটিতে লুটিয়ে পরে হু হু করে কেঁদে উঠলো। আজ কালো বলে কি তার এতো অনাদর?আচ্ছা, তাকে কি আল্লাহ সৃষ্টি করেনি? আল্লাহর সৃষ্টি কি কখনো অসুন্দর হতে পারে? সে যদি নিজেকে সৃষ্টি করতে পারতো তাহলে কি এত কালো রঙ দিতো! আর তার মায়ের কলঙ্কের দাগ সে কেন বয়ে বেরাবে? তার মা, বাবাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছে বলে কি সে চরিত্রহীন? এটাও বা কোথাকার নিয়ম? এমন কেন আমাদের সমাজটা? একজনের করা অন্যায় অন্য জনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।

আড়াল থেকে এসব কিছুই দেখছিলো মারিয়া। সে নাক, মুখ সিটকিয়ে তীব্র ঘৃণা নিয়ে বললো,

— ছিঃ এতটা নিচ মন-মানসিকতাও কোন মানুষের হয়! আমার নিজেরি ঘৃণা হচ্ছে। এমন একটা মানুষকে আমি…. না আর ভাবতে পারছি না। ছিঃ!

মারিয়া ধীর পায়ে ত্রিবুর দিকে এগিয়ে আসছিলো। বাসার পেছন দিক হওয়ায় এদিকটা পুরোই ফাঁকা। সবাই হলুদের স্টেজের দিকে আছে। ফাঁকা জায়গায় ত্রিবুর কান্না এসে বারি খাচ্ছে মারিয়ার কানে। মারিয়া ত্রিবুর সামনে যাওয়ার আগেই ত্রিবু উঠে দাঁড়ালো। তারপর দিকপাশ না তাকিয়ে পূর্ব দিকের মেইন রোডের দিকে দৌড় লাগালো। বিরবির করে শুধু এতটুকু বললো,

— এ জীবন আমি রাখবো না। দোষ না করেও যখন আমাকে কথা শুনতে হয়, অপমান পেতে হয়, ধোকা খেতে হয় তাহলে এ জীবন রেখে কি লাভ! আমি মরবো, হ্যাঁ আমি মরবো।

ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে অপর মারিয়ার বুঝতে একটু সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারলো ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ত্রিবু তার চোখের আড়াল হয়ে গেছে। সে বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে স্টেজের দিকে চলে গেলো।তবে মনে মনে বললো আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।

☔☔☔

ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। থেকে থেকে বিজলিও চমকাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। আষাঢ় মাসে এসব কিছু না। এই ভালো তো এই মন্দ। বৃষ্টি আসারও কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। এই ধরুন একটু আগেও আকাশটা কত ঝকঝকে ছিলো। চাঁদও উঠেছিলো। সেই চাঁদ কালো মেঘে আড়াল হয়ে গেছে। দূর থেকে শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে।ঝড়ের আলামত নয় তো?

বড় ব্রীজের রেলিঙের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ত্রিবু। নিচে টলমলে নদীর পানি। এখান থেকে লাফ দিলে বাঁচার চান্স খুব কম। কারণ নদী বেশ গভীর।ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। এতখন মরবো মরবো বললেও এখন তার খুব ভয় করছে। নিজের জীবনকে কে না ভালোবাসে বলুন তো! যে ভালোবাসে না তার থেকে বেকুব এই পৃথিবীতে দুটো নেই। ত্রিবু এক পা বাড়াতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে। সারা শরীর কাঁপছে তার। বেশ কিছু সময় লাফ দিবে নাকি দিবে না এসব ভাবছে। মন বলছে লাফ দিতে, মস্তিষ্ক বলছে দিতে না। কার কথা শুনবে তা ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্কের কথায় সায় দিলো ত্রিবু। ব্যর্থ হয়ে নিচে নেমে গেল। ব্রীজ থেকে কিছুটা দূরে একটা পরিত্যক্ত বাস স্টেপ আছে। গুটি গুটি পায়ে সেখানে এসে ধপ করে এক বেঞ্চে বসে পরলো। বসে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। বিরবির করে আপনমনে শুধু একটা কথাই আওড়াতে লাগলো,

—কেনো কেনো আমার সাথেই শুধু এমন হয় কেনো?আল্লাহ তুমি আমাকে এমন জীবন কেনো দিলে?

কে জানে আল্লাহ ওর কথা শুনতে পেলো কিনা। হঠাৎ করে রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি পরতে আরম্ভ করলো। সে কি বৃষ্টি! একেবারে ঝুম বৃষ্টি যাকে বলে। ওপরে ছাউনি জাতীয় কোন কিছু না থাকায় ত্রিবু জবজবে ভিজে যাচ্ছে। তবুও সে নরছে না।দুই হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। রিমঝিম তালের বৃষ্টির সাথে তার চোখের পানিগুলোও ধুয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে ত্রিবুর শীত করছে তাও সে সেখান থেকে সরার নাম নিচ্ছে না।

আচমকা ত্রিবুর মনে হলো তার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে না। কান্না থামিয়ে মাথার দিকে তাকাতেই বিজলি চমকানোর আলোয় দেখতে পেলো তার মাথায় ছাতার মতো কিছু একটা আছে। কেউ সেটা ধরে রেখেছে। ত্রিবু কিছুটা ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। এই রাতের বেলায় জনমানবহীন, নির্জন, পরিত্যক্ত বাস স্টেপে কেউ আসে না। লোকমুখে শোনা যায় এখানে নাকি ভুত আছে।ত্রিবু ছোটবেলা থেকে ভূত ভীষণ ভয় পায়।সে এখনো ভুতের ভয় পেয়ে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো। কি অদ্ভুত কথা! যে কিনা মরতে এসেছিলো সে এখন ভূত ভয় পাচ্ছে। ভূতের থেকে বাচার জন্য মনে মনে দোয়া-দুরুদ পরতে লাগলো। কিন্তু ভয়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।যেই মুহুর্তে ত্রিবু ভাবলো সে একটা দৌড় দিয়ে এখান থেকে পালাবে তখুনি কেউ নরম গলায় বললো,

— কি হয়েছে আপনার?

#চলবে

~~~~দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, সমাজ বদলে যাবে😊।

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_01
#Writer_NOVA

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here