উদ্দেশ্যহীন কথা পর্ব -৩৬ ও শেষ

#উদ্দেশ্যহীন_কথা
Part_36(শেষ পর্ব)
#Writer_Fatema_Khan

ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রুহা। শিলা তার পেছনে ছুটে গেলো।
—আম্মু এভাবে কই যাও ওইদিকে সবাই তো বরের কাছে চলে গেলো।

—মাম্মাম আমিতো রোজা ফুপ্পিকে দেখতে যাই, কি সুন্দর বউ সেজেছে ফুপ্পি।

— হুম ফুপ্পিকে তো খুব সুন্দর লাগছে ফুপ্পির বরকেও খুব সুন্দর লাগছে চলো তাকে দেখে নেই।

শিলা রুহাকে কোলে নিয়ে নিচে চলে গেলো। রুহা রিয়ান আর শিলার মেয়ে। যার বয়স এখন ৪ বছর। আজ রোজা আর তূর্যের বিয়ে। কাব্য আর কথার বিয়ের পর থেকেই তূর্য আর রোজার ভেতর ভালোবাসার শুরু হয়। সবাই আয়ানের বাড়িতেই আছে। আয়ান আর কনকের বিয়ে হয়েছে ৩ বছর হলো। কাব্য আর কথার ২ বছরের মাথায় আয়ান আর কনকের বিয়ে হয়েছে। আরাফও তার বউকে নিয়ে তূর্যের কাছে বসে আছে। ৬মাস আগেই মিলির বিয়ে হলো অয়নের সাথে। নিবিরের জন্য এতটা বছর অপেক্ষা করার পর পরিবারের কথা মত অয়নকে বিয়ে করে নিলো মিলি। অয়ন তাকে খুব ভালোবাসে আর সম্মান করে। নিবির আর কখনোই দেশে ফিরে আসেনি। মিলিও তাই নিবিরকে ভুলে অয়নকে নিয়ে নিজের জীবন সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে।
__________
কাজি তূর্য আর রোজার বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। স্টেজে তূর্য আর রোজাকে পাশাপাশি বসানো হলো। তূর্য খুব যত্নসহকারে রোজার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।
—খুব ভালোবাসি রোজা তোমায়। সেই প্রথম দিন থেকেই খুব ভালো লাগে তা তো জানোই। আজ যেনো নতুন করে আবার প্রেমে পরে গেলাম তোমার। স্বাগতম আমার এই অগোছালো জীবনে।

—তোমাকেও খুব খুব খুব ভালোবাসি। এভাবেই সারাজীবন তোমার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে চাই। রাখবে না আমার হাত দুটো ধরে।

—একবার যখন ধরেছি আর ছাড়াছাড়ি নেই।

দূর থেকে তাদেরকে দেখছিলো কাব্য আর কথা। কাব্য কথার দিকে তাকিয়ে বললো,
—আমাদের বিয়ের দিনের কথা মনে পরে গেলো তাই না?

— হুম। তবে আমাদের বিয়েটা আরও ভালো হতে পারতো। শুধুমাত্র আমার বাচ্চামোর জন্য সবাইকে ভোগান্তির মাঝে পরতে হয়েছিলো।

—আরে ওইসব কথা বাদ দেও। আমাদের বিয়ের সময় টার কথা মনে করো। আমি আর তুমি পাশাপাশি বসে ছিলাম। তোমার একটা হাত আমার হাতের মুঠোয় ছিলো। আর কাজী বিয়ে পড়াচ্ছিলো। আমি কবুল বলার পর তোমাকে বলতে বললে তুমি আমার হাত চেপে চোখ দুটো খিচে কবুল বলেছিলে। মনে হচ্ছিলো যুদ্ধ জয় করেছিলে সেদিন।

— আমার কাছে যুদ্ধের মতোই ছিলো সেদিন। নিজের সাথে যুদ্ধ। সব অতীত ভুলে সেদিন শুধু আমার আপনাকেই প্রয়োজন ছিলো। তাই আমার সব অতীত পেছনে ফেলে আপনার হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছিলাম।

—তাই যদি হয় তাহলে এত কেঁদেছিলে কেনো?

—কত বছর পর সবাইকে ফিরে পেয়েছিলাম বলুন তো, তাদের ছেড়ে আবার চলে যেতে হলো।

—এখন কি কেঁদে দিবে নাকি তুমি? এই একদম কান্নাকাটি না বুঝলে

—কান্না করছি না। এখন সরুন তো কাব্য একদম বিরক্তিকর আপনি বুঝলেন।

কথা চলে গেলো সেখান থেকে কনকের কাছে। এদিকে মিলি কাব্য আর কথার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের কথা শুনে মিলির চোখ দিয়ে পানি চলে আসে।
—কাব্য আর কথার বিয়ের দিন আপনি চলে গিয়েছিলেন। আপনার শেষ কথা ছিলো “ভালো থেকো”। জানেন তো আমি ভালো থাকার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। তবে বারবার আমার পাশে আমি আপনাকে না পেলেও অয়নকে আমি সবসময় ছায়ার মত আমার পাশে পেয়েছি। অতঃপর আমি বুঝতে পারলাম আমার ভালো থাকার মাধ্যম কি। আমার ভালো থাকার মাধ্যম ছিলো যে আমাকে এতটা ভালোবাসে তার ভালোবাসাকে সম্মান দেওয়া। আর আমি তাই দিয়েছি। অয়নকে আমি নিজের জীবন সাথী হিসেবে বেছে নিয়েছি। সবাইকে যে তার ভালোবাসা পেতে হবে এমনটা নাও হতে পারে তাই না। আপনিও তো কথাকে পান নি কিন্তু আপনি কথাকে অনেক ভালোবেসেছেন তা আমি জানি। কিন্তু আপনি নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন তখনি। আর তেমনি আমিও আপনাকে অনেক ভালোবেসেছি। কিন্তু আমার মেনে নিতে মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। তবে আমি ভালো আছি নিবির, অয়ন আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে যা হয়তো আপনার কাছ থেকে আমি কখনোই পেতাম না। থাক না কিছু অসম্পূর্ণ। সব ভালোবাসা যে পূর্ণতা পাবে সেটা তো কোথাও লেখা নেই তাই না।
—এই মিলি এখানে আসো ওইখানে একা কি করো?

অয়নের ডাকে হুশ ফিরলো মিলির। পেছনে তাকিয়ে দেখলো অয়ন তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মিলি অয়নের দিকে এগিয়ে গেলো।
—রোজা আর তূর্য ভাইয়াকে দেখছিলাম, কত ভালো লাগছে দুইজনকে একসাথে তাই না অয়ন।

— হুম খুব ভালো লাগছে তবে আমার বউয়ের কাছে সবকিছুই ফিকে।

—তুমি একটু বাড়িয়েই বলো। আর যাই হোক আজ রোজা আর তূর্য ভাইয়ার দিন। ওদের দেখতেই অন্যরকম লাগছে।

—রোজাকে তো বরাবরই ভালো লাগে আর আমার ওই বান্দর বন্ধুকে বান্দরই লাগছে।

—সাবধান আমার ভাইয়াকে একদম বান্দর বলবে না।

—রাজপুত্র তোমার ভাই, এবার হয়েছে?

—যাও তো তোমার সাথে কথাই নেই আমার।

—এই মিলি কই যাও আমিও আসছি দাড়াও।

অয়ন আর মিলি সেখান থেকে কিছুটা দূরে চলে গেলো।
_________
রোজার বিদায়ের সময় রোজা আয়ানকে জড়িয়ে ধরে। আয়ানও নিজের চোখের জল ছেড়ে দেয়। তারপর রোজা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে কেঁদে দেয়। একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে পরে তূর্য আর রোজা। মিলি, অয়ন আর কথা, কাব্য একসাথে এক গাড়িতে যাবে। আরাফ আর ওর স্ত্রী বেড়িয়ে পরেছে। তারাও সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছে। কথার মা বাবা, রিয়ান আর শিলা এখন বেড়িয়ে পরবে কথাদের পর। কথার মা বললো,
—আজ তোরা থেকে গেলেই কি হত বল মা? সেই সকাল থেকেই বলছিলি তোর শরীরটা ভালো লাগছে না আর এই খারাপ শরীর নিয়েই তোদের এখন যেতে হবে।

মিলি বললো,
—আন্টি আপনি একদম চিন্তা করবেন না আমি তো সাথে আছি কথার। কিছুই হবে না আপনি চিন্তা করবেন না। আর বাসায় গিয়েই কথা আপনাকে কল দিবে।

—ঠিক আছে তাহলে যাও।

তারা চারজন গাড়িতে উঠে গেলো। কাব্য ড্রাইভ করছে তার পাশে কথা। পেছনে অয়ন আর মিলি। তারা তিনজন বিভিন্ন কথা বলছে কিন্তু কথা চুপ করে বসে আছে। এর মধ্যে তারা ঢাকায় প্রবেশ করেছে তবে তূর্যদের বাড়ি এখনো দূর আছে। হঠাৎ কথা নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সিট বেল্ট বাধা না থাকায় কথা কাব্যের উপর ঢলে পরলো। কাব্য তাড়াতাড়ি ব্রেক করে গাড়ি থামালো আর কথাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর অয়ন সামনে এসে ড্রাইভ করতে লাগলো কাব্য আর কথাকে পেছনে দিয়ে। একটা হসপিটালের সামনে গাড়ি থামালে তারা ডক্টরের কাছে নিয়ে যায়। তারা কিছু টেস্ট করে কথার। সবাই বাইরে অপেক্ষা করছিলো রিপোর্টের জন্য। তখনই কারো পরিচিত কন্ঠে মিলি পেছনের দিকে তাকালো।
—মিলি তুমি এখানে এত রাতে?

—আপনি এত বছর পর

কথাও নিবিরকে সামনে দেখে অবাক পুরাই। নিবিরের হাতে ব্যান্ডেজ করা।
—আসলে আমি আজ দেশে ফিরলাম। কিছু কাজ আছে দেশে তাই। আর এসেই দেখো এক্সিডেন্ট। তা কথা কেমন আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

—যেমন দেখছো আর কি। কাব্য কেমন আছেন আপনি?

কাব্যের দিকে হাত বাড়িয়ে। কাব্যও হাত মিলিয়ে উত্তর দিলো। তারপর মিলির উদ্দেশ্যে বললো,
—মিলি ওনাকে তো ঠিক চিনলাম না

—আমার হাসব্যান্ড স্যার।

অয়নের সাথেও কুশল বিনিময় করে নিলো। সেই সময় একজন নার্স এসে কাব্য আর কথাকে ভেতরে আসতে বললো। তারা দুইজন ভেতরে চলে গেলো। নিবির চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—কি হয়েছে কোনো সমস্যা? তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে কোনো ফাংশন থেকে আসছো তাহলে হসপিটাল কেনো?

—আসলে আজ তূর্য ভাইয়ার বিয়ে ছিলো। আর এদিকে সকাল হতেই কথার শরীর ভালো না। এখন আসার পথে অজ্ঞান হয়ে যায় তাই হসপিটালে নিয়ে এলাম।

কাব্য আর কথা বেড়িয়ে এলে মিলি বলে,
—কাব্য ভাইয়া সব ঠিক আছে তো?

—আর বলিস না মিলি এই কথা কি করেছে?

—কিহ্! সিরিয়াস কিছু নাকি?

—অনেক সিরিয়াস। তুই ফুপ্পি হবি বুঝলি।

—এটা তো খুব খুশির কথা ভাইয়া। তোমরা আর আমাদের বাসায় যাওয়ার দরকার নেই কাল যেও। আজ ওইখানে রেস্ট নেওয়া সম্ভব না। আজ বরং তোমরা তোমাদের বাসায় চলে যাও। কথার রেস্টের দরকার।

কথার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে নিবিরের মুখটা চুপসে গেলো। আর সে কথার লজ্জা মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে নিজের উপর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তারপর বললো,
—কথা আর কাব্য দুইজনকে অনেক অভিনন্দন নতুন সদস্যের জন্য।

—ধন্যবাদ স্যার। স্যার একটা কথা বলব যদি কিছু মনে না করেন?

— হুম বলো কিছু মনে করব কেনো?

—স্যার আপনি বিয়ে করেন নি?

—সবাই সবকিছু পায় না কথা। ঠিক আমিও বিয়ে নামক জিনিসে জড়াতে চাই না বলতে পারো। এভাবেই ভালো আছি। আচ্ছা তাহলে তুমি সাবধানে থেকো, নিজের যত্ন নিও। আমি আসছি। আর মিলি তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না তুমি এটা বুঝতে শিখেছো আর আমি তোমার শিক্ষক হয়েও হয়তো সেটা রপ্ত করতে পারি নি। আসছি তাহলে।

নিবির বিদায় নিয়ে চলে গেলো। চারজনই নিবিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মিলির চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো যা সবার আড়ালেই মুছে ফেললো সে।
__________
রুমের বারান্দায় দোলনায় কথা বসে আছে। আর তার কোলে মাথা রেখে ফ্লোরে বসে আছে কাব্য।
—আচ্ছা কথা তুমি আজ খুশি তো, আমার না কেমন যেনো লাগছে। নিজেকে অন্যরকম লাগছে। আমার নিজের বেবি তুমি ভাবতে পারো। আমাকে পাপ্পা বলে ডাকবে আর তোমাকে মাম্মাম। ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার আঙ্গুল ধরবে। আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন হয়ে আমাদের মাঝে আসবে সে।

— হুম কাব্য। সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। আপনি না থাকলে হয়তো আমি এত সুখ কখনোই পেতাম না। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

—কি সব বলছো তুমি। আমাদের দুইজনের জন্যই সবকিছু। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে এই উপহার দেওয়ার জন্য। অনেক অনেক ভালোবাসা তোমাকে।

কাব্য উঠে কথার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে দেয়। আর কথাকে জড়িয়ে ধরে। কথাও পরম আবেশে কাব্যের পিঠে হাত রাখে।
________
ভালো থাকুক সব ভালোবাসার মানুষগুলো। ভালোবাসা পূর্ণতা পাক বা অপূর্ণতা ভালোবাসার মানুষেরা যেনো অসুখী না থাকে। যেভাবেই থাকুক না কেনো তারা যেনো ভালো থাকে। কিছু ভালোবাসা অপূর্ণতা তেই সুন্দর। আর পূর্ণতা পাওয়া ভালোবাসা গুলো আরও ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা পাক।

___________________সমাপ্ত___________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here