হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছি পর্ব ১৩+১৪

#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-13

রৌদ্রময় দিন।সূর্যের তেজ ভালোই। বাড়ির দরজার সামনে এসে একটা বড় শ্বাস নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে কলিংবেলে চাপ দিলো প্রীতি। সাথে সাথে কেউ দৌড়ে দরজার কাছে আসলেন তা বাইরে থেকে স্পষ্ট বুঝা গেলো।মনে হয় প্রীতির অপেক্ষায় তিনি দিনে পর দিন পথ চেয়ে বসে ছিলেন।

দরজা খুলার সাথে সাথে প্রীতিকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরলেন প্রীতির মা। অনেকক্ষন ঝাপটে জড়িয়ে ধরে মেয়ের থেকে সরে এসে সারা মুখে চুমু দিয়ে বললেন,

-আমার কলিজার টুকরা….

প্রীতি তার মায়ের এমন আচরনে মিস্টি হাসলো।এটা প্রথমবার নয়।প্রতিবার তার মা এমন করেন।এ কয়দিন প্রীতি সবচেয়ে বেশি তার মাকে মিস করেছে।বলতে গেলে সে সবার থেকে বেশি তার মাকে ভালোবাসে সম্মান করে একটা কথাও মাটিতে ফেলে না।আর প্রীতির মা তো প্রীতিকে চোখে হারান।তিনি নিজেও মেয়ের মতামতের বিরুদ্ধে যান না।জোর করে কিচ্ছু চাপিয়ে দেন না।তার আত্মা টা যেনো এই মেয়েটার মাঝেই আটকে আছে।এই মেয়েটার কিছু হলে তিনি নিজেই বাচবেন না।আগে থেকেই তার খুব শখ ছিলো একটা মেয়ের কিন্তু প্রথমেই তার ছেলে হয়।এরপর অনেক চেষ্টার পরে ৭ বছর পর তার এই মেয়ে হয়।বলতে গেলে প্রীতির নানাবাড়ি দাদাবাড়ী দু পরিবারের সেই একমাত্র মেয়ে।আর কারোর কোনো মেয়ে নেই।সবার ই ছেলে আছে।ভাই বোন জেঠা-জেঠি কাকা-কাকি মামা-মামী খালা-খালু ফুফা ফুফু সবার একমাত্র কলিজার টুকরা প্রীতি।

মেয়েকে পরম আদরে ঘরে নিয়ে গেলেন রাফিয়া আহসান (প্রীতির মা)।কিন্তু কোনো প্রশ্ন করলেন না।উল্টে বললেন,

-যা মা.. রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয় যাহ। ইসসস..চেহারা টার কি অবস্থা করেছিস?কেমন শুকিয়ে গেছিস এই ২-৩ দিনে?খাস নি ঠিকমতো?আমার এমন সুন্দর মেয়ে টা ২-৩ দিনেই কেমন হয়ে গেছে (আক্ষেপ করে)। যাহ তো হাত মুখ ধুয়ে জলদি খেতে বস।

প্রীতি মায়ের দিকে চেয়ে শুধু মুচকি হাসলো।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই থাকলো সে অনেক্ষন। এই মা টা কে তার সারাজীবন নিজের সাথেই চাই।বিয়ের পর ও চাই।দরকার পড়লে নিজের সাথে নিয়ে যাবে।তবুও ওর মাকে ছাড়া ওর একটা মুহুর্ত চলবে না।

প্রীতির ভাবনার মাঝেই কেউ ওর মাথায় টুকা দিলো।প্রীতি মাথায় হাত দিয়ে বিরক্তির সাথে হালকা আর্তনাদ করে বলে উঠলো,

-উফফফ ভাইয়া….লাগে না বুঝি?

প্রীতির ভাই রাফান রসিকতা করে বলে উঠলো,

-না বাবুজি….

প্রীতি ফিক করে হেসে দিয়ে ওর ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।

রাফানও নিজের বোনকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরলো।এরপর নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলল,

-দেখি দেখি….

প্রীতির মুখটা উপরে তুলে ধরে আবার বলল,

-এমন শুকাইছিস কেন?খাস নি ঠিক মতো?

প্রীতি ঠোঁট টাকে উল্টে ফেলল ছোটো বাচ্চাদের মতো।রাফান বোনের এমন চেহারা দেখে হেসে আবার পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে নিলো। এই বোনটাকে সে খুব ভালোবাসে খুব।এই বোনটার কিছু হয়ে গেলে সে কিছুতেই বাচবে না।শুধু সে কেনো তার পরিবারের কেউ বাচবে না।

বোনের কপালে চুমু দিলো রাফান।প্রীতি বলে উঠলো,

-ভাইয়া আমি মাত্র বাইরে থেকে আসছি।আমাকে ফ্রেস তো হতে দে…

রাফান-হমম…যাহ..

এরই মাঝে কেউ একজন এসে অভীমানী সুরে বলল,

-বাহ!আমাকে তো কারোর মনে নেই।আমি কি পর হয়ে গেছি? সবাই আমাকে ভুলে গেছে বুঝি?

প্রীতি রাফান দুজন দুজনের দিকে একবার তাকালো। সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে ওরা একসাথে বলে উঠলো,

-না বাবুজি…..

পুরো ড্রইংরুম জুড়ে হাসিতে মেতে উঠলো।প্রীতি দৌড়ে গিয়ে সামনের মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-ভাবী + বেস্টু আমার………

স্নেহাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তার ননদীনি কে।এই বাড়িতে প্রীতি একমাত্র ব্যাক্তি যাকে সবাই এতো এতো বেশি ভালোবাসে…. প্রীতি এসেছে তার মানে বাড়ি প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

স্নেহা রাফানের বউ।মাত্র ৪ মাস চলছে তাদের বিয়ের।স্নেহা আর প্রীতি সমবয়সী। সেম ক্লাস।বেস্টু ওরা।বাড়ির সবার মন কেড়ে নিয়েছে স্নেহা। স্নেহা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী বুঝদার মিশুক একটা মেয়ে।সবার সাথে যে কোনো পরিস্থিতিতে ও মানিয়ে নিতে চলতে পারে।

হঠাৎ প্রীতির মা রাফিয়া আহসান চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,

-এই তোর হাতে এটা কি হইছে?ব্যান্ডেজ কেনো?পায়েও তো দেখি ব্যান্ডেজ আবার নতুন করে লাগাইছিস।

প্রীতি মায়ের এমন চিতকার শুনে হকচকিয়ে যায়। ব্যান্ডেজ লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।ওর মা এসে ওর হাত জড়িয়ে ধরেই চোখের পানি ছেড়ে দেয় প্রীতি বার বার বলছে কিছু হয় নাই মা।কিন্তু তার মা কোনো কথাই শুনছে না।বাড়ির কাজের লোক গুলো সহ অস্থির হয়ে পড়লো প্রীতির জন্য।প্রীতির আবার বেশ বিরক্তি লাগছে।সবাই ওকে ঘিরে রেখেছে কেনো?ও কি সার্কাস এর বস্তু?

আচমকা প্রীতি চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

-উফফফফ……আমি ফ্রেস হবো।আমার অসহ্য লাগছে।

প্রীতির এমন চিল্লানিতে কেউ আর কিছু না বলে একদম চুপচাপ শান্ত হয়ে গেলো।পুরো বাড়িতে নিরবতা বিরাজ করছে।

প্রীতি সোফা থেকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

-আমি ফ্রেস হওয়ার পর আম্মু বা স্নেহা কেউ গিয়ে আমার ব্যান্ডেজ টা চেঞ্জ করে দিয়ে এসো।

ওরা মাথা নাড়ালো।

প্রীতি উপরে চলে গেলো।

প্রীতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাফান একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই বোনটার উপর সে একটা কথাও বলতে পারে না।পুরো বাড়ি কাপে তার কথায়।অথচ সে কাপে বোনের কথায়।তার উপরে তার বোন।সকলের চোখের মনি।আদরের মেয়ে।পুরো বংশে একটাই মাত্র বোন তাদের। চাইলেও কেউ কিছু বলতে পারে না।

____________________________________

খুব আদরে মমতা ভরা চাহনি দিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন নীলা চৌধুরী। পরম যত্নে ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন তিনি।এ কটা দিন ছেলেকে খুব মনে পড়েছে তার।একটাই মাত্র ছেলে তার।আর সেই ছেলেকে নিজের থেকে দূরে রাখার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না।

ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে স্নেহ ভরা গলায় বললেন,

-বাবা আর একটু ভাত দেই?

নীলাভ-না মা।আমার হয়ে গেছে।

নীলা চৌধুরী-কি খেলি তুই?ঠিকমতো তো কিছুই খেলি না বাবা।

নীলাভ – না মা হয়ে গেছে।আর খাবো না।

নীলা চৌধুরী-আর একটু…

নীলাভ – না করেছি মা।

নীলা চৌধুরী ছেলের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ছেলে না করেছে তার মানে নাই..পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হলেও এই না কে কেউ হ্যা বানাতে পারবে না।ছেলেটা তার প্রচুর ঘাড় ত্যারা।

নীলাভ মায়ের ভাবনা মাখানো মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো।এবার সে বলে উঠলো,

-মা ভাবনা চিন্তা শেষ হলে,উপরে এসো তো একটু।

নীলা চৌধুরি ছেলের কথায় বেশ অবাক হন। বরাবরই তার ছেলে অনেক চুপচাপ। কারোর সাথেই তেমন কথা বলে না।হঠাৎ কি মনে করে ডাক দিলো তাই ভেবে যাচ্ছেন নীলা চৌধুরী। ভাবনার মাঝেই আবার তার ডাক পড়লে তিনি তরিঘরি করে ছেলের ঘরের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান।

নীলাভ রুমে গিয়েই লেপটপ নিয়ে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।নীলা চৌধুরী আস্তে করে খাটে গিয়ে বসলেন।নীলাভ লেপটপ রেখে মায়ের কোলে মুখ গুজে দিলো।নীলা চৌধুরী তো অবাক।

নীলাভ মাকে আরো এক দফা অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,

– মা একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেও অনেক ব্যাথা করছে।

নীলা চৌধুরী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই চিন্তিত স্বরে বলে উঠলেন,

-কেনো কি হয়েছে?হঠাৎ মাথা ব্যাথা কেনো?ঘুরতে গিয়ে উল্টা পাল্টা জিনিস খাইছিলি?

নীলাভ মুখ ফসকে বলে উঠলো,

-না মা..একটা পাগলের জন্য আমার মাথা ব্যাথা।

নীলা চৌধুরী -পাগল?

নীলাভ কথাটা বলে নিজেই থতমত খেয়ে গেলো।কথা কাটাতে বলল,

-কিছু না মা..মাথা টিপে দেও।

নীলা চৌধুরী -তুই কি আমাকে পর করে দিচ্ছিস দিনকে দিন?

নীলা চৌধুরীর গোমড়ামুখের এই কথা শুনে নীলাভ বলল,

-এগুলা আবার কি ধরনের কথা মা?

নীলা চৌধুরী -তাহলে বলছিস না কেনো?তুই তো আগে আমাকে সব বলতি।

নীলাভ -আচ্ছা শুনো তাহলে।

নীলাভ একে একে ওর মাকে সব বলল।ও আর যাই করুক ওর মার সাথে সব শেয়ার করে।

সব শুনে নীলাভের মা হেসে উঠলেন।সে কি হাসি থামানোই যায় না।

______________________________

ডাইনিং রুমের বিশাল জায়গা জুড়ে এক পাশে অনেক বড় ডাইনিং। রান্না ঘরের সাথেই ডাইনিং রুম।

সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছে। আর সবার চোখের ফাকে প্রীতি পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে আসছে।

প্রীতি পিছন থেকে তার দু হাত দিয়ে প্রনয় আহসান এর চোখ দুটো ধরলো।

প্রনয় আহসান মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন,

-কখন এসেছো মা?

প্রীতি চোখ টা ছেড়ে দিয়ে বলল,

-তুমি আমাকে চিনে ফেলো কীভাবে বলো তো বাবা?

প্রনয় আহসান মেয়েকে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে বললেন,

-আমার সাত টা না পাচটা না একটা মাত্র মেয়ে। আমার বংশের প্রদীপ আর তাকে কি না আমি চিনতে পারবো না?

প্রীতি বাবার কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার এই কথা গুলো শুনলেই হাসি পায়।সব পরিবারের বংশের প্রদীপ ছেলে হয় আর সেখানে তার বাবা বলে সে না কি বংশের প্রদীপ।

প্রীতি প্লেট নিলো।

প্রনয় আহসান নিজের মেয়েকে যত্নের সহিত ভাত বেড়ে দিলেন।সবার জন্য তিনি কঠিন কিন্তু মেয়ের জন্য তিনি একদমই নরম।একদম গলে যান।

প্রীতি অনেক্ষন যাবত ভাত নাড়াচাড়া করছে কিছুই খাচ্ছে না।রাফিয়া আহসান এবার ধমক দিয়ে বললেন,

-খাচ্ছিস না কেনো?তাড়াতাড়ি খা….

প্রীতি ঠোঁট উল্টে বলল,

-খেতে ইচ্ছে করছে না মা।এসব কি মাছ মাংস রান্না করছো ?

রাফিয়া আহসান চোখ রাঙিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-কি খেতে ইচ্ছে করে তোর?সবসময় শুধু বাহানা।

প্রীতি -আমি আলু ভর্তা আর লেবু পাতা ভর্তা খাবো।

সবার মাঝে রাফান হু হা করে হেসে বলল,

-বাবা তোমার বংশের প্রদীপ। যে ঘরে যাবে সে ঘররে বড়লোক করে ছাড়বে।এতো এতো আইটেম রেখে সে আলু ভর্তা আর লেবু পাতা ভর্তা খেতে চায়।ফকিন্নি একটা….

প্রীতি রাফান এর দিকে চোখ রাঙিয়ে চিতকার করে বলল,

-ভাইয়ার বাচ্চা……

প্রনয় আহসান এবার গম্ভির ভাবে বলে উঠলেন,

-খাওয়ার টেবিলে কথা কম বলো।

সাথে সাথে প্রীতি আর রাফান চুপ হয়ে গেলো।আর কাউকে ভয় পাক বা না পাক তাদের বাবাকে তারা ভয় পায়।ভালো ও বাসে অনেক।

স্নেহা রান্না ঘর থেকে এসে বলল,

-ধরেন আমার ননদিনী আপনার আলু ভর্তা আর লেবু পাতা ভর্তা।আমি জানতাম আপনি এই গুলাই করবেন।এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।

প্রীতি টেবিল থেকে উঠে স্নেহা কে জড়িয়ে ধরে বলল,

-উফফফ..এর জন্যই তো তোরে এতো ভালোবাসি রে…

রাফিয়া আহসান বলে উঠলেন,

-কিছুদিন পর নিজের বিয়ে হবে আর তাকে কি না এখনো সব কাজ করে দিতে হয়।

প্রীতি -আমি এখনো ছোটোই আছি।

স্নেহা প্রীতির কান ধরে বলল,

-এহহহ….আপনি আর আমি কিন্তু একই সাথে পড়ি আর আমার বিয়ে হয়ে গেছে ৪ মাস হলো আর আপনি এখনো ছোট তাই না?

প্রীতি -স্নেহার বাচ্চা ছাড়…

স্নেহা -আমার এখনো বাচ্চা হয় নাই।😒
#হঠাৎ_ভালোবেসে_ফেলেছি💕
The_unexpected_love
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
Part-14

ও মা…উপরে আসো তো।

মেয়ের কথা শুনে রাফিয়া আহসান চোখ তুলে তাকালেন।প্রীতি হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো। রাফিয়া আহসান মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে সায় দিলেন।

হাতের কিছু টুকটাক সব কাজ গুছিয়ে রাফিয়া আহসান ছুটলেন মেয়ের রুমের দিকে।

,
,

মেয়েকে বুকে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন।মেয়ের চুলে হাতিয়ে দিচ্ছেন রাফিয়া আহসান ।আর প্রীতি একে একে বান্দরবানের সব ঘটনা বলছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে।রাফিয়া আহসান মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতেই গলা পরিষ্কার করে বলে উঠলেন,

-তুমি এখন বড় হয়েছো প্রীতি। তোমার সব কিছু বুঝতে হবে।তুমি কীভাবে একটা অপরিচিত অজানা ছেলের সাথে ৩-৪ দিন আর রাত কাটালে?

এবার একটু রেগে তিনি মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

-আর কখনো যেনো এভাবে বাড়ির বাইরে যেতে না দেখি?বুঝেছো?যদি কোনো অঘটন ঘটতো তখন?তখন কি হতো একবার ভেবে দেখেছো?ছেলেটা যদি ভালো না হতো?

প্রীতি মায়ের মুখের দিকে তাকালো।ঠোঁট উল্টে বলল,

-আমিও এই কথা গুলো ভেবেছি মা।কিন্তু পরে ভেবেছি।আগে মাথায় ই আসে নি এই কথাগুলো।আসলে মা ছেলেটা অনেক ভালো ছিলো। কেয়ারিং ছিলো।আমাকে অনেক বার বাচিয়েছে বিপদ থেকে।কিন্তু ছেলেটাকে আমার একটু ও ভালো লাগে না।ছেলেটা সবসময় গোমড়া মুখে থাকে আর কথা কম বলে রাগ বেশি। কথায় কথায় আমাকে ধমক দেয়। গাধী,পাগল, ছাগল,কেয়ারলেস,ঝামেলা এগুলো বলে।তোমার এই পিচ্চি কিউট মেয়েটাকে যে এতো গুলো বাজে কথা বলতে পারে সে কখনোই ভালো হতে পারে না, কখনোই না।

মেয়ের এমন গাল ফুলানো ছোটো বাচ্চাদের মতো কথা শুনে রাফিয়া আহসান হেসে দিলেন।তার মেয়েটা আসলেই একদম বাচ্চা।এই মেয়ে সব দিক থেকে বড় হয়েছে ঠিক ই। কিন্তু স্বভাব টা একদম বাচ্চা।রাফিয়া আহসান যখনি একটু রেগে কথা বলতে যান তার মেয়ে এতো কিউট করে ঘুরিয়ে ফেলে কথা টা যে তিনি রাগ করে কোনো কথাই বলতে পারেন না।মেয়েকে আরো গভীর ভাবে বুকের মাঝে নিয়ে। কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

-হম..আমার মেয়ে টা তো আসলেই অনেক কিউট। ভালো একটা মেয়ে।আর আমার বাচ্চা মেয়েটাকে না কি সেই ছেলে এতো এতো বকা দিয়েছে?নাহ..সে খুব খারাপ কাজ করেছে।আচ্ছা মা…তোমার কাছে সেই ছেলের কোনো ছবি আছে?তাহলে একটু দেখতাম যে কে এই ছেলে যে আমার মেয়েকে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে পারে।মানতে হবে ছেলের ক্ষমতা আছে।

মায়ের কথায় প্রীতি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,

-ওর নামে সুনাম করলা না কি আমাকে অপমান করলা?

রাফিয়া আহসান হেসে বললেন,
-ছবি দেখা তো পেচাল বাদ দিয়ে।

প্রীতির কাছে একটা ছবি ই আছে।শৈলপ্রপাতে যে ছবি তুলেছিলো সেটাই।এতো কিছুর মধ্যে ওর আর নীলাভের ছবি ই তুলা হয় নি।আর এই ছবিটাও স্পষ্ট করে মুখটা বুঝা যাচ্ছে না।রাফিয়া আহসানকে ছবি দেখানোর পর তিনি মুখে হাত দিয়ে বললেন,

-ছেলেটা তো মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর দেখতে….।যদিও তেমন বুঝা যাচ্ছে না।

প্রীতি মায়ের হাত থেকে ক্যামেরা টা নিয়ে ছবি টা দেখতে দেখতে বলল,

-হ্যা…সবচেয়ে বেশি সুন্দর তার পারসোনালিটি আর ওই নীলাভ দুই চোখ..উফফফ অস্থির…

মেয়েকে কোনো ছেলের নামে এভাবে প্রশংসা করতে দেখে রাফিয়া আহসান চরম অবাক।তার মেয়ে তো সব ছেলের নামে শুধু বদনাম ই করে।তার মতে কোনো ছেলেই পৃথিবীতে পারফেক্ট নেই।এর নাক বোচা তো ওর চোখ ছোটো আরেকজন খাটো তো আরেকজন বেশি লম্বা।সেই অনুযায়ী তার মেয়ে যেভাবে তৃপ্তির সহীত বলল, উফফ অস্থির।ব্যাপারটা মেনে নিতে রাফিয়া আহসান এর বেশ কষ্ট হচ্ছে।মেয়ের দিকে সন্দেহ চোখে তাকাতেই প্রীতি বলে উঠলো,

-এভাবে কেনো তাকাও?তুমি কি ভাবতাছো আমি প্রেমে পড়ছি?তাহলে আগেই বলতাছি আমি কোনো প্রেমে ট্রেমে পড়ি নাই।প্রথমে এটা আমিও ভাবছিলাম যে আমি ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছি।কিন্তু না…আসলে ছেলেটা অনেক কেয়ারিং ছিলো তো তাই একটু মায়ায় পরে গেছিলাম এই যাহ…নাথিং ইলস..আর সুন্দর জিনিসের প্রশংসা করতে হয়।কার্পণ্যতা করতে নেই।তাই আমিও করছি। এতে সমস্যা কি?তুমি যদি….

মেয়েকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই রাফিয়া আহসান নিজের মাথা ধরে বললেন,

-বাপরে বাপ আমার মাথা ধরায় ফেলছিস?এতো কথা কিভাবে বলতে পারিস?আমি কি প্রশ্ন করবো না করবো তুই আগে থেকেই জানিস?আন্তাজেই হুদেই এতো পেচাল পাইরে আমার মাথা ব্যাথা ধরায় দিলি।আর আমি জানি আমার এই মেয়ে জীবনে প্রেমে পড়বোও না।আর আমার ডাইনি মেয়েকে কেউ সামলায় রাখতেও পারবো না।

প্রীতি চিল্লিয়ে বলল,

-মা….আমি তোমার নিজের মেয়ে না কি কুড়িয়ে আনছো?

রাফিয়া আহসান চোখ ঘুরিয়ে বলে উঠলো,

-যদি কুড়িয়েই আনতাম তাহলে একপিস ভালো দেখে আনতাম।তোরে হুদেই আনতাম।

এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলেন।কারন এখন প্রীতির পাশে বসে থাকা মানেই চিল্লানিতে তার কানের বারোটা বাজানো।

___________________________

নীলা চৌধুরী -একটু ছবি দেখা তো মেয়েটার।

নীলাভ -নেই।

নীলা চৌধুরী -আন্তাজেই, দেখা ফাজিল।

নীলাভ -নেই মা….

নীলা চৌধুরী -তাহলে মেয়ে টা দেখতে কেমন একটু বর্ণনা দে।

নীলাভ-পারবো না।

নীলা চৌধুরী ছেলের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললেন,

-বলবি না কি?

নীলাভ – আচ্ছা শুনো তাহলে ,পাগল টাইপের ছাগল আর গাধী মার্কা বুদ্ধি, স্বভাব টোটালি একটা ৫ বছরের বাচ্চা আর কেয়ারলেস,ঝগড়ুটে নাম্বার ওয়ান আর হচ্ছে এক নাম্বারের ঝামেলা।।

নীলা চৌধুরী ছেলের কাধে একটা থাপ্পড় মেরে বললেন,

-আমি বলেছি যে মেয়েটা দেখতে কেমন?আর তুই ওর স্বভাবের সার্টিফিকেট কেনো দিচ্ছিস?

নীলাভ-ওহ আচ্ছা…..মেয়েটা লম্বা প্রায় ৫.৫ হবে একদম শুকনো বলতে গেলে শরীরে কিছুই নাই।লাল ফর্সা, গাঢ় বাদামী চোখ,লম্বা স্ট্রেট চুল,লাল গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট। ব্যস..

নীলা চৌধুরী-মেয়েটা মনে হয় অনেক সুন্দর তাহলে।

নীলাভ -বলতে পারো।

নীলা চৌধুরি আক্ষেপের সুরে বলল,

-ইসসসস..মেয়েটাকে যদি একবার দেখতে পারতাম তাহলে আজ ই আমার ছেলের বউ বানিয়ে আনতাম।

মায়ের এমন আক্ষেপের সুরে দুঃখ মাখানো কথা শুনে নীলাভ বিরবির করে বলল,

-এর জন্যেই তো ছবি দেখাই নাই।বর্ণনা শুইনেই বলতাছে যে আজ ই বিয়ে করায় নিয়ে আসতো।আর ছবি দেখাইলে বলবা যে, আমি কিছু জানি না নীলাভ তুই যেখান থেকে পাস এক্ষুনি মেয়েটাকে বিয়ে করে আমার ঘরের বউ করে নিয়ে আয়।

ছেলের এমন বিরবির করা কথা শুনে নীলা চৌধুরী আশ্চর্য হয়ে বললেন,

-তুই বিরবির করেও কথা বলতে পারিস?কবে থেকে?

নীলাভ-আরে ওই মেয়ের কাছে থেকে শিখছি।

নীলা চৌধুরি বেশ উল্লাসিত হয়ে বলল,

-বাহ!৩-৪ দিনেই আমার ছেলেটাকে এতো চেঞ্জ করে দিছে সারাজীবন থাকলে তো আমার ছেলেটা পুরোপুরি মানুষ হয়ে যাবে।

মায়ের এমন কথা শুনে নীলাভ বড় বড় চোখ করে তাকালো মায়ের দিকে।নীলা চৌধুরী আর কিছু না বলে ছেলের ভয়ে উঠে সেখান থেকে চলে গেলেন।

মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো নীলাভ।নীলা চৌধুরীর এক সমস্যা ছেলেকে বিয়ে করাবেন বিয়ে করাবেন।তার না কি এই একা একা এতো বড় বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না।দম আটকে আসে।এ পর্যন্ত ৩৬ টা মেয়ে তিনি ছেলের জন্য দেখেছে। কিন্তু প্রত্যেক বার তার ছেলে এই বিষয় গুলো নিয়ে রাগারাগি করেছে।বিভিন্ন ভাবে বিয়ে ভেঙেছে। কিন্তু এবার যেহেতু ছেলের মুখ থেকেই কোনো মেয়ের কথা শুনেছেন তো এবার মেয়েটাকে খুজে বের করবেন ই করবেন।

_______________________________

কেটে গেছে প্রায় দেড় মাস।

ডিসেম্বর পড়েছে এখন।এ সময়ে শীত টা বেশ জমজমাট ভাবে ঝেকে বসে।প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে যায়।গাছে পাতা থাকে না ফুল থাকে না।চারিদিকে শুধু কুয়াশায় আচ্ছন্ন।

প্রীতির এ সময়টা একটু ভালো লাগে না।তার মতে এতো শীত এতো কুয়াশা পড়ার কি দরকার যে কুয়াশায় প্রকৃতি ঢেকে যায়।যদি প্রকৃতি ই না দেখা যায় তাহলে এগুলো ঋতু দিয়ে কি হবে?প্রীতির কাছে তো বসন্ত ভালো লাগে।বসন্ত মানে হালকা হালকা শীত থাকবে। চারিপাশে পাখির কিচিরমিচির থাকবে। গাছপালা সতেজ থাকবে নতুন ফুল পাতা গজাবে।খুব ভোরে কুয়াশা থাকবে আর খুব রাতে কুয়াশা থাকবে।আর সারাদিন শুধু ফুরফুরে হাওয়া বইবে।গরম লাগবে না একদম।ওর কাছে গ্রীষ্ম মানে আরেক প্যারা।এতো গরম কেনো পড়তে হবে?ওর মতে এতো জিনিসটাই খারাপ।কোনো কিছু বেশি হতে নেই।ও ভাবে, ইসসস..যদি সারাটাবছরই বসন্ত থাকতো না শীত না গ্রীষ্ম।মাঝে মাঝে হঠাৎ কোনো সতর্কবার্তা না দিয়েই ঝুম ধরে বৃষ্টি নামতো। আবার হঠাৎ থেমে যেতো তাহলে বেশ হতো।

নীলাভের ক্ষেত্রে তা আবার উল্টো তার মতে প্রচন্ড শীতে কুয়াশায় আচ্ছন্ন আবার প্রচন্ড গরমে রোদের উত্তাপ ই বেস্ট।হাড় কাপানো শীতে যখন মানুষ বের হয় কাজের দায়ে তখন বুঝা যায় জীবন কতোটা কঠিন।কতটা বিষাদময় জীবন।মনে হয়,ইসস..এতো সুন্দর শীতের সকাল যদি আরেকটু ঘুমাতে পারতাম।প্রিয়মানুষ টার সাথে আরেকটু সময় কাটাতে পারতাম।

আবার প্রচন্ড গরমে রোদে গরমের উত্তাপে শরীরের চামড়া পুরিয়ে যখন কাজ করে বউ বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেবে তার চেয়ে তৃপ্তির কিছু নেই।গামের গন্ধে দূর্গন্ধ যুক্ত শরীরে নিজের প্রেয়সী বুকে ঝাপিয়ে পড়ে বলবে, “তোমাকে সারাদিন বড্ড মিস করেছি গো।” কপালে বেয়ে পড়া ঘামের পানি গুলো আলতো হাতে নিজের শাড়ির আচল দিয়ে মুছিয়ে দেবে আর বলবে, বাইরে ভিষণ গরম তাই না?তোমার খুব কষ্ট হয় বুঝি?২-৩ দিন কাজ অফ দিতে পারো না।অফিসে না গেলে হয় না?

তখন মুচকি হেসে নিজের প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে বলবে,” না গো হয় না।কাজে না গেলে অনেক মূল্যবান জিনিস মিস করবো।তোমার এই আদর গুলোকে যে মিস করে যাবো গো।তাই তো প্রতিদিন কাজে যাই।”

প্রেয়সী তখন খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে।তার সেই হাসিতেই যেনো প্রকৃতির হাড় কাপানো শীত, উত্তাপ গ্রীষ্ম সব মারা পড়ে যাবে।

শীতের চারিপাশের সাদা কুয়াশায় নীলাভ নিজের মতো করে প্রকৃতিকে আকতে চায় নিজের মতো রঙ দিতে চায়।গ্রীষ্মের রোদাজ্জ্বল গরমে যখন সূর্যের ঝিলিকে চারপাশে সাদা আলো দেখা যাবে তাতে সে প্রকৃতিকে আকতে চায়।হোক না শীত গ্রীষ্ম তাতে কি?মানুষ যেমন বলে,’দুঃখ বিনা সুখ হয় কি মহীতে’। ‘জীবনে দুঃখ না আসলে সুখ বুঝা যায় না’।ঠিক তেমনি সব জিনিসেই তেমন।সারাবছর যদি বসন্তই থাকে,একই ঋতু থাকে তাহলে সেটার ও মূল্য বুঝা যায় না।একটা সময় সেটা দামহীন হয়ে পড়বে।

তখন মানুষ আবার চাইবে,এই বসন্তকাল যায় না কেনো?একটু শীত গ্রীষ্ম শরত হেমন্ত আসলে কি হয়?

মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রানী।আর আমরা বাঙালি রা তো আরো বেশি অদ্ভুত। আমরা নিজেরা কি চাই তা নিজেরাই জানি না।

চলবে🙂
চলবে🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here