হাওয়ায় ভাসা উড়ো চিঠি পর্ব -০৮

#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (৮)

বেশ কদিন যুদ্ধ চলেছে বাসায়। কেউ বুঝতে পারছিল না উন্মেষ কেন এখনি বিয়ে দিতে চায় উষাকে। প্রেম করেছে, রিং বদল হোক বিয়েটা না হয়ে সময় হলে হবে। তবে বাচ্চা মেয়েটিকে এখনি বিয়ে দিতে চাচ্ছে উন্মেষ। এ বিষয়টা লেখা ও মানতে পারছিল না। অনেক বুঝিয়ে সকলকে রাজিয়ে করিয়েছে ছেলেটা। উষা ভাইয়ের ঘরটা তে এখন আর আসে না। তার ভাইয়ের ঘর মানে তো ঐ লাইব্রেরি। সেখানে দীর্ঘ সময় কাঁটায় উন্মেষ। ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চায় উষা। কত ঝড় সহ্য করতে হলো ওর জন্য। উন্মেষ তখন বড়ো জানালার কাছে বসে ছিল। চাঁদ দেখছিল রোজকার মতো। কখনো বা বই হাতে নিয়ে দীর্ঘ সময় বই পড়ার অভ্যাস। বেশ উসখুস করছে মন। অস্বস্তি ভরা হৃদয়টা কে টেনে হিচড়ে নিয়ে এল উষা। উন্মেষ তখন চোখ বুজে।
“ভাইয়া।”

মেয়েটির কম্পিত কণ্ঠ! উষার কণ্ঠটা কানে যেতেই চোখ মেলল উন্মেষ। দু হাতে ঘুমের ভাবটা মুছে নিয়ে বলল,”কি রে এখন তুই এলি যে। আর বলেছি না এই স্লিপারটা পরে টই টই করে ঘুরবি না। পিচ্ছিল এটা, কখন পড়ে যাবি বলা যায়?”

ভাইয়ের কথায় দু চোখ ভরে উঠে উষার। উন্মেষ প্রায় দু হাতে ষোড়শী বোনটা কে বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলাতে থাকল অনবরত।
“যা হবার হয়েছে। জীবনটা অনেক বড়ো। তুই একা না এখন। আরেকটা প্রাণ আছে তোর মাঝে। ভাইয়া মে রেছি, আবার ভাইয়াই তো আদর করব।”

“সরি ভাইয়া। আমি বুঝতে পারি নি।”

“হয়েছে আমার ক্রন্দন কুমারী। আপনার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে আজ বাদে কাল আর আপনি কি না..”

“কাঁদছি না তো।”

“তাহলে দু চোখে পানি কেন?”

“এমনি এমনিই।”

উন্মেষের প্রশ্বস্ত বুকে লেপ্টে রইল উষা। ভাই নামক মানুষটির সাথে বয়সের ব্যবধান খুব বেশি। তাই হয়ত সখ্যতা গড়ে উঠে নি তেমন। তবে বয়স কখনো ভাই বোনের ভালোবাসায় খাদ জন্মাতে পারে?

কলির মাথাটা ভনভন করছে। লাইব্রেরি পরিষ্কার করছিল সে। ঠিক তখনি ভাই বোনের কথা গুলো শুনতে পেল। কলির হৃদয় এখন ছলাৎ ছলাৎ। হা হয়ে যাওয়া মুখটা মুহূর্তেই বন্ধ করে দেয় আবৃত্তি। টেনে বের করে নিয়ে আসে। কিছুটা ভয় কাজ করে ওর মাঝে। আবৃত্তি বলে,”ওখানে কি করছিলে তুমি?”

“আমি তো বই ঘর পরিষ্কার করতাছিলাম আপা মনি।”

“ওও যাও এখন।”

“ঠিক আছে।”

কলি চলে গেল। আবৃত্তি হতাশ ভাবে পা বাড়াল। কলি কিছু শুনেছে কি না এই নিয়ে একটা দ্বিধা কাজ করছে।

এ বাড়িতে কলির সাথে সব থেকে ভালো স্বক্ষতা লেখার। মেয়েটি কে খুব ভালোবাসে কি না। তাই হয়ত সন্ধ্যায় শুনে আসা কথাটা হজম হয় নি এখনো। লেখাকে বলার জন্য আকুপাকু করছে মন। লেখা বেশ বুঝতে পারছিল বিষয়টা। একটা সময় প্রশ্ন করেই ফেলল, “কি হলো তোর? তখন থেকে দেখছি এমন করছিস।”

“হইছে কি ভাবি মনি।”

“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।”

“আসলে….।”

আবৃত্তিকে আসতে দেখে দমে গেল কলি। সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আপ্নের জন্য গরম পানি নিয়া আইতেছি। পায়ের ব্যথা সারব নে।”

“হ্যাঁ নিয়ে আয়।”

কলির সাথে আবৃত্তির চোখাচোখি হলো। আবৃত্তি লক্ষ্য করেছে চোরের মতো লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে কলি। ভেতরটা নিমিষেই উতলা হয়ে এল। একটা সময় পর স্থির হলো চোখ। লেখার পা ভেঙেছিল পাঁচ মাস আগে। আর ঠিক তার এক মাস পরেই ধরা পরে ক্যান্সার। সেই দিন থেকেই পাগল হলো লেখা। আর তারপর আবৃত্তি আর উন্মেষের বিয়েটা ও দিয়ে দিল। কি অদ্ভুত এ দুনিয়া! ভাবুক হয়ে আসা আবৃত্তিকে দেখে লেখা বলল,”ওভাবে দাঁড়িয়ে কেন আসিছ?”

“এমনি আপু। তোর পায়ের জন্য মালিশ নিয়ে এসেছি। এটা খুব কাজে দেয়।”

লেখার জামাটা হাঁটু অবধি তুলে যত্ন নিয়ে মালিশ করতে শুরু করেছে আবৃত্তি। লেখা আলগোছে চুলে বিলি কেঁটে বলল,”আমার জন্য এত মায়া কেন তোর?”

কলির হাবভাব সুবিধার নয়। আবৃত্তি ঠিক ভরসা করতে পারছে না। ওর সন্দেহটা বার বার ঘুরপাক খায়। মেয়েটি বিচলিত ভাবে ব্যলকনিতে পায়চারী করছিল। ঠিক তখনি অপর পাশের বারান্দায় এল উন্মেষ। আবৃত্তি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল,”কিছু কথা ছিল।”

“হ্যাঁ বলো।”

“সেদিন যে উষা আপনার সাথে দেখা করল। লাইব্রেরি তে বসে আপনারা কি এমন কিছু আলোচনা করেছেন যা অন্য কেউ জানলে হিতে বিপরীত কিছু হতে পারে।”

“বুঝি নি তোমার কথাটা। তাছাড়া আমরা তো শুধু স্লিপার নিয়ে কথা বলেছি। উষাকে বললাম যাতে ঐ স্লিপার না পরে।”

“আর কিছু?”

“হ্যাঁ ঐ তো বললাম এখন ও তো একা নয়। ওর সাথে আরেকটি প্রাণ মিশে আছে। নিজের প্রতি যত্নশীল হতে। কেন বলো তো?”

“আসলে সেদিন লাইব্রেরিতে কলি ছিল। পরিষ্কার করছিল কি সব যেন। আমাকে দেখে প্রায় ভরকে গিয়েছিল।”

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা। উন্মেষ পুরো স্থির হয়ে ভাবল কিছু সময়। তারপর ই বলল,”কিছু শুনেছে কি?”

“জানি না তো। জিজ্ঞাসা করাতে অস্বীকার করল। তবে দুদিন ধরেই কেমন ছটফট করতে দেখলাম।”

“ঠিক আছে। আমি ওর সাথে কথা বলে নিব। তুমি চিন্তা করো না।”

“হুম।”

আবৃত্তি ঘরের পথে অগ্রসর হতেই উন্মেষ পিছু ডাকল। “শোনো”

“হুম?”

“থ্যাংকস।”

শুকনো হাসল আবৃত্তি। কিছু বলতে পারছে না মেয়েটি। কিছু সময় গাছ গুলোতে চোখ বুলিয়ে চলে এল স্বীয় ঘরে।

ঠান্ডা লেগেছে লেখার। খ্যাক খ্যাক শব্দ করে কাশছে সে। ইতোমধ্যেই নানান ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত হয়ে এল উন্মেষের মুখ। আলোগোছে মেয়েটির মাথাটা বুকে চেপে নিল। “কি হয়েছে? বুকটা এত অস্থির লাগছে কেন?”

“শুয়ে থাকো এভাবেই। ভালো লাগে।”

“কাল যখন থাকব না তখন কি করবে?”

“না থাকার কথা কেন আসছে এখানে?”

“এটা তো সত্য যখন তখন আমার মৃ ত্যু হতে পারে।”

“সে তো আমার ও হতে পারে।”

“আমার টা নিশ্চিত।”

“সকলের মৃত্যুই নিশ্চিত।”

“তুমি আমায় বুঝলে না কখনো।”

“বুঝতে চাইছি ও না। শুধু এভাবেই থেকে যাও লেখা। আমার সবটা জুড়ে থেকে যাও প্লিজ।”

থেকে গেল লেখা। বুকের ভেতরে থাকা শব্দ গুলো কত রকমের আন্দোলন ই না শুরু করেছে। এদিকে লেখার কর্ণধার সচকিত হলো। মনে হলো হৃদয়ের কোথাও ঝড় উঠেছে। তবে সেটা স্বীয় হৃদয় নাকি সামনে থাকা ব্যক্তিটির হৃদয় ঠিক ঠাওর হচ্ছে না।

মৃ ত্যু কামনা অত সহজ নয়। লেখা এখন ঘুমিয়ে আছে। উন্মেষের বুক বরাবর মাথা রেখে ডুবে আছে এক ঘোরের মধ্যিখানে। এই ঘোরের মধ্যে ও মৃত্যু হতে পারে তার। জীবন বড়ো অনিশ্চিত,সেখানে লেখার জীবনটা একটু বেশিই ছন্নছাড়া। বুকের মধ্য স্থলে থাকা প্রজাপতিটা কখন না বেড়িয়ে আসে। উন্মেষের হৃদয় কম্পমান। ঐ তো কয়েক বছর আগে লেখার সাথে প্রথম দেখা। পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা হলো। উন্মেষ তখন সবে পড়াশোনা শেষ করে নিজের বিজনেসে হাত রেখেছে। বিয়ের প্রথম রাত্রি তে খুব একটা কথা হলো না। দুজন দু মুখী হয়ে শুয়ে রইল কেবল। পরদিন ই কাজের চাপ এল। বাবা বললেন, ‘এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
তবে উন্মেষের মন শুনল না। ছেলেটি দমে থাকার পাত্র নয়। সে জানাল,”যাব আমি।” লেখা সেদিন নির্বাক ছিল। প্রয়োজন মনে করে নি কেউ ই ওর মতামত গ্রহণের। এমন কি উন্মেষ যখন ব্যাগ গুছায় লেখা তখন বলেছিল, “ফিরে আসবেন কবে?”
অদ্ভুত ভাবে উন্মেষ বলেছে “যেদিন সময় হবে।”

ঐ টুকুই। তারপর মন খারাপ করে বসল লেখা। কেউ দেখল না সেসব। একদিন পর পাঠানো হলো বাবার বাড়ি। আবৃত্তি তখন ভীষণ ব্যস্ত। পড়াশোনায় বরাবর ই বেশ সিরিয়াস। রাত জেগে পড়াতে চোখ ডেবে গেছে। এত সব কিছুর মাঝে ও লেখার জন্য সময় বের করল মেয়েটি। পুরো দু রাত্রি নিয়ে শুনল লেখার মনের কথা। একটা মানুষকে ক্ষণিকেই কত খানি ভালোবেসে ফেলেছে। জীবনের সব প্রাপ্তি যার নামে লিখে দিতে চায়। সর্বশেষ একটি দুঃখ জানাল, “ও আমায় কেন কল করল না।”

সাত টা দিন পর এল উন্মেষ। সেদিন ও কথা হলো না লেখার সাথে। ঠিক তার পরের দিন ই নিজ ভালোবাসায় সিক্ত করে দিয়েছিল লেখা কে। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এনে দিয়েছিল হাতের মুঠোতে। লেখা অচিরেই বুঝে ছিল মানুষটা ওকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। এত ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। লেখা ঘুমের মধ্যেই ডুকরে উঠল। উন্মেষ আকড়ে ধরল মেয়েটি কে। চুমু তে ভরিয়ে দিল মুখশ্রী। হাত বুলাতে বুলাতে যেন আওড়াল, “চলে যেও না প্লিজ। আমি বড়ো একা।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here