হৃদপিন্ড ২ পর্ব ২৬+২৭+২৮

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৩
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ইমনের নেওয়া হুটহাট সিদ্ধান্ত গুলোর কোন মাথা মুণ্ডু খুঁজে পায় না তার পরিবার এবং বন্ধু বান্ধব’রা। তবুও সকলেই সিদ্ধান্ত গুলো মানতে বাধ্য হয়। কারণ সে যে একরোখা, জেদি, ভীষণ রাগী। তাকে ঘাটাতে গেলে সবকিছুই হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তাই কেউ বাড়তি কোন বাক্য ব্যয় করেনি। সবটা এক কথায় মেনে নিয়েছে। সে হিসেবেই পরেরদিন সকাল থেকে এনগেজমেন্টের তোরজোর চলছে। আত্মীয় স্বজন বলতে দু’পরিবারের সদস্য আর বন্ধু দিহান এবং সায়রী৷ ইতোমধ্যে দু’পরিবারের সকল আত্মীয় স্বজন’কে জানানো হয়ে গেছে আজ এনগেজমেন্ট আর সামনে মাসের আট তারিখ তাদের বিয়ে। সঠিক সময় সকলের কাছে ইনভাইটেশন কার্ড ঠিক পৌঁছে যাবে। মেহেন্দি অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ,বিয়ে, বউভাত থেকে শুরু করে ঘটা করে হানিমুন সবটাই হবে। এতো কল্পনা জল্পনা শেষে বিয়ে, বিয়ের মতো বিয়ে না হলে চলে? তারওপর বন্ধু বান্ধবীদের মধ্যে শেষ সেই বিয়ে করছে। সকলের কাছে অবশ্যই স্মরণীয় একটা বিয়ে হওয়া চাই। ইমন চৌধুরী ম্যারিড উইথ মুসকান জান্নাত। এটা কি সাধারণ কোন বিষয় নাকি? আর কার কাছে বিষয় টা কেমন জানেনা ইমন তবে তার কাছে পুরো পৃথিবী জয় করার চেয়েও কঠিন। কারণ সে যে কারো মনের পৃথিবী জয় করেছে আর কেউ তার মনের! এ পৃথিবী জয় করা কি সহজ কথা নাকি?

মুরাদ’দের বাড়িতে সবাই রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। দিহান সকালে এসে মুরাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব বাজার করে সেই যে বাড়ি গেছে আর একবারো এ বাড়ি মুখো হয়নি৷ মুরাদের কলটা অবদি ধরছে না। বাধ্য হয়ে সায়রীকে কল করলো মুরাদ কিন্তু সে একি কাহিনী রিং হয়েই যাচ্ছে তো হয়েই যাচ্ছে কেউ ধরার নাম নেই। রেগেমেগে ইমন’কে ফোন করে একচোট গালাগাল করলো মুরাদ। ইমন উচ্চস্বরে হেসে বললো,

“এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? নিশ্চয়ই বিজি আছে দুপুরের দিকে ঠিক এসে যাবে। ”

মুরাদ প্রচন্ড ক্ষেপে বললো,

” ঐ শালা আর শালার বউরে আর একটা ফোন দিমু না আমি। বলছিলাম দু’জনই জানি সকাল থেকে এ বাড়ি থাকে বা*রা এখনও আসতে পারলো না। ”

অসহ্য রকমের ক্রুদ্ধ হয়ে ফোন কাটলো মুরাদ৷ ইমন সে মূহুর্তেই দিহান আর সায়রী’কে ফোন করলো কিন্তু কেউই কোন রেসপন্স করলো না।
.
মুসকানের মা আর চাচি মিলেই সব রান্নাবান্না করছে। রিমি টুকটাক সহায়তা করছে। ইমনের আবদার বা আদেশ হিসেবে মুসকান’কে অন্তত পক্ষে একটা আইটেম বানাতে বলেছে। তবে সে টুকু আবদার বা আদেশ করে বেচারা ততোক্ষণ স্বস্তি পায়নি যতোক্ষণ না আইটেম টা রান্না করা শেষ হয়। নিজ হাতে চিকেন রোস্ট তৈরী করেছে মুসকান। সে যতোক্ষণ রান্নাঘরে ছিলো ততোক্ষণই রিমিকে জ্বালিয়ে মেরেছে ইমন৷ এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে রিমি বলেই ফেলে,

” তা ভাইয়া আপনি তিনটা বছর বিদেশে টিকলেন কি করে! ”

সে কথায় কিছুটা লজ্জা পেলেও নিজের স্বভাব স্বরূপ গম্ভীর্য বরণ করে উত্তর দেয়,

” এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আমার থেকে তোমার হাজব্যান্ড ভালো দিতে পারবে। ”

সবটা খুব ভালো মতোনই জানে রিমি তবুও ঠাট্রা করার সম্পর্কে ঠাট্টার সুযোগ টা মিস দেয়নি।
.
বারোটা বাজে মুসকান গোসল শেষ করে বিছানায় বসে ফ্রেন্ডদের ফোন করছে। সবাইকে ফোন করে করে তারা কখন আসবে এখনো এসে পৌঁছালো না কেন সেই অভিযোগই করছে। রিমি তার পিছনে বসে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুলগুলো শুকাচ্ছে। শেষ কলে পূজার সঙ্গে কথা শেষ করে ফোন কাটতেই ইমনের কল এলো। বক্ষঃস্থলে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলো মুসকানের। এক ঢোক গিলে রিসিভ করে কানে দিতেই ইমন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

“একটা মানুষের ফোন এতো ওয়েটিং কিভাবে থাকতে পারে? প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্যও কি তোকে পাওয়া যাবে কি হয়ে গেছিসরে তুই!”

মুখটা ভার করে মুসকান বললো,

“ফ্রেন্ডদের ফোন করছিলাম একজনের সঙ্গে কথা বলেই অপরজনকে কল দিয়েছি তাই টানা ওয়েটিং পেয়েছো। ”

“হ্যাঁ তোর তো আবার ফ্রেন্ডদের লিষ্ট বহুত লম্বা। ”

“টিটকারি দেবে না। ”

“শাট আপ! যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবি, আমার দাদি মানে বাবার ফুপু সে আসবে আমাদের সঙ্গে। মুরুব্বি বলতে বংশের মধ্যে তাকেই আমরা মান্য করি। দাদি যেহেতু কাছে ধীরেই থাকে তাই শুধু তাকে নিয়েই আসছি। ”

চোখ, মুখ শক্ত করে মুসকান জবাব দিলো,

“হুম এটা আমাকে না বলে দাদাভাই কে বললেই হতো। ”

ইমন বুঝলো ধমক খেয়ে মহারানী দারুণ চটে গেছে তাই শান্ত স্বরে বললো,

” বাবা,মায়ের সামনে কমফোর্টেবল থাকবি জানি তোকে না জানিয়ে হুট করে অপরিচিত কাউকে নিয়ে যাবো? আর দাদি তো অবশ্যই ভিতরে গিয়ে তোকে দেখবে নানারকম জিগ্যাসাবাদ করবে তখন যদি আনকমফোর্টেবল ফিল করিস? আমার বউয়ের যেনো কোনো কিছুতে অস্বস্তি বোধ না হয় তা তো আমাকেই দেখতে হবে। নাকি অন্য কেউ এসে দেখে যাবে? ইডিয়ট একটা! রাখছি। ”

ফোন রাখতেই মিশ্রিত অনুভূতি’তে সিক্ত হয়ে গেলো মুসকান। লজ্জায় স্নিগ্ধ গাল দু’টো রক্তিম আভায় ছেয়ে গেলো। রিমি বললো,

“কি রে কি বললো ভাইয়া? ”

মুসকান নিশ্চুপ রইলো। রিমি পিছন থেকে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিগ্যেস করলো,

” কি ব্যাপার হুম?”

লাজুক হেসে মুসকান বললো,

” তার নাকি কোন দাদি আসবে সেটাই জানালো। ”

“হুম তো বেশ মশলা মাখিয়ে জানিয়েছে বুঝি? ”

মুসকান মুখ ঘুরিয়ে বললো,

” ধুর…সব সময় ইয়ার্কি মারো তুমি। ”
.
মুসকানের বন্ধু’রা ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর বান্ধবী’রা মুসকানের রুমে বসে তার শাড়ি,গহনা গুলো দেখছে। শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে গলায় একটা ওড়না চাপিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে মুসকান। ইমন ব্রাইডাল ভাবে সাজতে নিষেধ করায় একটুও মেকআপ করেনি সে। রিমি তার চুলগুলো আঁচড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ পূজা বলে ওঠলো,

“এই মুসু এনগেজমেন্টে শাড়ি পরবি,মেহেন্দি, গায়ে হলুদ, বিয়ে,বউভাত সব অনুষ্ঠানেই শাড়ি পড়বি এটা কেমন কথা হলো?”

মুসকান কিছু বলার পূর্বেই রিমি বললো,

” ইমন ভাইয়া শাড়িটাই বেশী লাইক করে। আমি বলেছিলাম গর্জিয়াস ল্যাহেঙ্গা বা গাউনের কথা ভাইয়া নাকচ করে দিয়েছে। ”

পূজা কটাক্ষ করে বললো,

“আসলে ভাইয়ার জেনারেশন আর আমাদের জেনারেশন বেশ অনেকটাই গ্যাপ তো তাই উনার পছন্দের সাথে আমাদের মিলবে না। কিন্তু মুসকান’কে যেহেতু বিয়ে করছে সেহেতু ওর দিকটাও চিন্তা করা উচিত ছিলো। ইশ আমাদের মুসুর কপালে ওল্ড ভার্সন জামাইয়ের পাশাপাশি সবই ওল্ড ওল্ড হয়ে যাচ্ছে। ”

স্বর্ণা পূজার পেটে গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

” দোস্ত পঁচাচ্ছিস কেন? মুসু মন খারাপ করবে। ”

পূজা ঠোঁট টিপে হেসে উচ্চকণ্ঠেই বললো,

“তা আমাদের ওল্ড ভার্সন দুলাভাইটি আসবে কখন?”

মুসকান চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললো,

” একদম আন্ডারইস্টিমেট করার ট্রাই করবি না। শাড়ি শুধু তারই পছন্দ নয় শাড়ি আমারও পছন্দ। তাছাড়া বিয়ের জন্য শাড়ির থেকে পারফেক্ট অন্য কিছু হতেই পারেনা। তাই যদি হতো আমার হবু হাজব্যান্ড হাজার টাকার ল্যাহেঙ্গা,গাউন রেখে জার্মান থেকে লাখ টাকার শাড়ি নিয়ে আসতো না। তোর বোধ হয় ইমন চৌধুরী ব্যাপারে জ্ঞান খুবই স্বল্প। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারিস ফলাফল কিন্তু এটাই হবে যে তোদের আপডেট ভার্সন গুলা সব ইমন চৌধুরীর হাঁটুর নিচেই পড়ে থাকে!”

পূজা থমথমে মুখো ভঙ্গিতে জোর পূর্বক হাসির রেখা টানলো,বললো,

“আমি কিন্তু জাষ্ট ফান করছিলাম। বান্ধবী’র সঙ্গে ফান করবো না তো কার সঙ্গে করবো বল। ”

“আমি একদম ফান করিনি রে আমার বান্ধবী মজার ছলেই হোক আর যে ছলেই হোক আমার লাইফ পার্টনার নিয়ে আফসোস করবে আর আমি মেনে নেবো? শোন এতো আফসোস করিস না যে মানুষ টা’কে আমি স্বামী হিসেবে পেতে যাচ্ছি অনেক নারী বহু ত্যাগ, তপস্যা করেও এমন মানুষ’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায় না। আমি অনেক সৌভাগ্যবতী তাই এমন একজন মানুষের বুকভরা ভালোবাসা পাচ্ছি, সারাজীবনের জন্য নিজের করে তাকে পেতে চলেছি। এমন ভাগ্য সত্যি সবার হয় না রে। ”

অবাক হয়ে মুসকানের দিকে তাকিয়ে রইলো পূজা। শুধু সে একা নয় রুমের প্রতিটি সদস্যই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওরা শুধু মুসকানকে দেখছে না। দেখছে মুসকানের চোখে, মুখে ফুটে ওঠা কারো প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস’কে। মুসকানের দৃষ্টি’র প্রগাঢ়তাই যেনো বুঝিয়ে দিচ্ছে ইমন চৌধুরী’র প্রতি তার সমস্ত অনুভূতি’কে। ইমনকে নিয়ে মুখে প্রতিটি বাক্য, শব্দ উচ্চারিত হওয়ার সময় তার চেহেরায় যে উজ্জ্বলতা প্রকাশিত হয় তা কেবল এটুকুই বোঝায় মুসকান ইমন চৌধুরী ব্যাতিত কিছুই নয়৷ আর ইমন মুসকান ব্যাতিত কিছুই নয়।

অমন সিরিয়াস একটা সময় রিমি আচমকাই চিল্লিয়ে ওঠলো,

“আল্লাহ তোদের আলাপে আলাপে কতোটা সময় লস হয়ে গেলো। দেখি মুসু আর কথা নয় এবার মুখটা তুই নিজেই সাজিয়ে নে তারপর আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি। ”

সকলের মাঝেই যেনো স্বস্তি ফিরে এলো। মুসকানও মুচকি হেসে দু’হাতে ফেইস পাওডার ডলে তা আবার মুখে ডলতে লাগলো। পূজা বললো,

” তুলি দিয়ে দে হাত দিয়ে লাগবে না। ”

“ধুর আমি এভাবেই দেই শেষে হালকা ফিনিশিং দিবনি। ”

হালকা পাওডার মেখে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে,চোখে কাজল লাগালো মুসকান। স্বর্ণা বললো,

“তোকে তো এতেই ব্রাইডাল লাগছেরে মুসু। ”

রিমি মাথা দুলিয়ে হেসে বললো,

“হুম এজন্যই তো ভাইয়া ব্রাইডাল সাজতে না করেছে। এইটুকু’তেই সে কুপোকাত হয়ে যাবে!”

হিহিহি করে হেসে ওঠলো সবাই। মুসকান কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

“আমি কিন্তু শাড়ি পড়বো না। ”

রিমি ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

” আচ্ছা ভাইয়া এসেই পরাবেনি তুই বরং ওয়েটিংয়ে থাক। ”

পুরো রুমে সবাই হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে এমন সময় ইমনের টেক্সট এলো। মুসকানের ফোন স্বর্ণার হাতে ছিলো তাই সে হৈচৈ বাঁধিয়ে বললো,

“এই এই ভাইয়ারা বেরিয়েছে বেরিয়েছে। ”

বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো মুসকানের। নিঃশ্বাস ক্রমশ অস্থির হতে শুরু করলো। কোনরকমে এক ঢোক গিলে মনে মনে বললো,

” আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও এতো নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি কেন আমি? ”
.
মেরুন রঙের জর্জেট শাড়িটা যে মুসকানের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ গায়ে এতো সুন্দর মানাবে ভাবতেই পারেনি কেউ৷ শুধু একজনই ভেবেছিলো সে হলো ইমন। তাই তো প্রেয়সীর জন্য বেছে বেছে প্রতিটা স্পেশাল ডে’র জন্য স্পেশাল স্পেশাল শাড়ি ফিক্সড করেছে। চুলগুলো সব পিছনে ছেড়ে দেওয়া। ঘনকালো পাপড়িতে ভরা মায়াবী আঁখি যুগলে লেপ্টে রয়েছে কৃষ্ণবর্ণীয় কাজল। জর্জেট শাড়িটা গায়ে একদম মুড়িয়ে আছে। গলায় ইমনের দেওয়া ডায়মন্ডের নেকলেস,কানে ডায়মন্ডের ছোট্ট ছোট্ট এয়ার রিং ঝলমলে আকার ধারণ করেছে। দু’হাত ভর্তি মেরুন প্লাস হোয়াইট কালারের ব্রাইডাল চুড়ি যেনো তাকে এবং সাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণাতে পরিণত করেছে। না জানি আজ ইমন চৌধুরী’র কয়বার হার্ট মিস যায়!আর কিছুর জন্য না হলেও তার মুগ্ধময়ীর লাজুকলতা তার হৃৎপিণ্ড’তে কম্পন ধরাতে বাধ্য করবে।
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৪
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ইমন সহ ইমনের পুরো পরিবার বসে আছে বসার ঘরে। তাদের আপ্যায়ন করছে মুরাদ এবং দিহান। ইমন’রা আসার ঠিক পাঁচ মিনিট পূর্বেই এসেছে দিহান। তবে সাথে সায়রী আসেনি। সায়রী কেন আসেনি জিগ্যেস করা হলেও দিহান কোন উত্তর দেয়নি। বড়োসড়ো ঝামেলা যে বাঁধিয়েছে স্বামী-স্ত্রী মিলে তা বেশ বুঝতে পারে মুরাদ। কিন্তু ইমন’রা এসে পড়ায় আর সায়রী’কে ফোন করা হয়নি। ইমনকে ফোন করতে বললেও ইমন ফোন করেনি। এমনকি এ বিষয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। তবে দিহানের দিকে কয়েকবার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দেখেছে। এতেই মুরাদ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে।

দিহান আর মুরাদ’কে মুসকানের ছেলে ফ্রেন্ড’রা হাতে হাতে বেশ সহযোগিতা করছে। মুসকানের চাচা আকরাম চৌধুরী’র সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। ইরাবতী মরিয়ম আক্তারের সঙ্গে কথা বলে সবে এসে বসেছে তখনি তার ফুপু শাশুড়ি ইমনের দাদি বললেন তিনি আগে মেয়ে দেখবে পরে খাওয়া-দাওয়া। কিন্তু আকরাম চৌধুরী তাকে বুঝিয়ে দুপুরের খাবারটা সেরেই নিলেন। আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখেনি মুরাদ। একমাত্র বোন কলিজার টুকরোটার বিয়ে বলে কথা! খাবার শেষে সবাই যখন বসে একটু আরাম করছে তখন ভিতর থেকে রিমি বেরিয়ে সকলকে সালাম দিলো। ইমন নিজেই তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো সকলের। তারপর রিমি চলে গেলো রান্নাঘরে মরিয়ম আক্তারকে জানালো মুসকান একদম খেতে পারছেনা। সে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শেষ হলে তবেই খাবে। আপাতত তার খাওয়ার রুচি একদম নেই। মরিয়ম আক্তার মেয়ের সমস্যা’টা বুঝলেন। শুধু মুসকান নয় প্রতিটি মেয়েরই বোধ হয় এমনটা হয়। বিয়েটা ভালোবাসার মানুষের সাথে হোক বা পরিবারের পছন্দনীয় ছেলের সাথে হোক সকল কার্যক্রমেই প্রতিটা মেয়ে মারাত্মক পর্যায়ে নার্ভাস ফিল করে। সে নার্ভাসনেস থেকে আর কিছু হোক বা না হোক খাওয়ার রুচি একদম চলে যায় এবং বার বার গলা শুকিয়ে ওঠে।

মুসকানের বান্ধবী’রা রুমের ভিতরেই খাবার পর্ব শেষ করেছে। পূজা রুমের জানালা থেকে বসার ঘরে উঁকি দিতেই ইমন’কে দেখে পুরো হা হয়ে গেলো। শুনেছিলো ইমন চৌধুরী নাকি বয়সে তাদের থেকে তেরো, চৌদ্দ বছরের বড়ো কিন্তু একে দেখেতো মনে হচ্ছে পঁচিশ, ছাব্বিশ বছর বয়সী অতি সুদর্শন একজন যুবক। পূজা যখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে যখন ইমনকে পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত স্বর্ণা তখন রুমে হৈচৈ বাঁধিয়ে চিল্লিয়ে বললো,

“ঐ দেখ দেখ দু’লাভাই কে পুরা তামিল হিরো’দের মতো লাগতাছে। মাশাআল্লাহ মুসু একটা জামাই পাবি বটে। এত্তো হ্যান্ডসাম জামাই হ্যান্ডেল করা যে কি মুশকিল হবোরে দোস্ত। ”

লজ্জায় মিইয়ে গেলো মুসকান। নিঃশ্বাস হয়ে ওঠলো ভারী। মেঝেতে পা রেখে বিছানার এক কোণায় চুপটি করে বসে দু’হাত ক্রমশ কচলাতে শুরু করলো সে। পূজা বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললো,

“আসলেই একটা জিনিসই পাইতাছোসরে দোস্ত। হেব্বি দেখতে কিন্তু। যে পোশাকটা পরে আছে মনে হচ্ছে ওটা উনার জন্যই স্পেশাল ভাবে তৈরী। ”

তখনি রুমে এলো রিমি বললো,

“সত্যি তাই…ইমন ভাই মানুষ’টাই এতো ইউনিক যে তার সব কিছু’ই বরাবর ইউনিক হয়। বউ’টাও কিন্তু কম ইউনিক না আজকাল নিজের হবু বর’কে নানাভাই ডাকার সাহস ক’জনের হয় বলোতো? ”

খিলখিল করে হেসে ওঠলো সকলেই স্বর্ণা মুসুর সাপোর্টে গিয়ে বললো,

“নানা যদি নাতনী’কে প্রেমের জালে ফাঁসাইয়া বিয়া করে নাতির আর দোষ কি ভাবি? ”
.
পাশাপাশি বসে আছে ইমন মুসকান। ইমন সোনালী রঙের পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে,পাঞ্জাবির ওপরে পরেছে মেরুন রঙের হাতা কাটা কোট। দুসাইট দুটো পকেট, বোতাম প্লেটে পরপর ছয়টা বোতাম নিপুণ ভাবে সাজানো রয়েছে। অন্যদিনের মতো তার ব্রাউন কালার ছোট ছোট চুলগুলো আজ কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। বরং সামনের চুলগুলো আজ স্পাইক করা। গাল ভর্তি চাপ দাঁড়িগুলো ছোট ছোট করে বেশ সাইজ করে কাটানো হয়েছে বিধায় অন্যদিনের তুলনায় চেহেরার চাকচিক্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার পাশে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে যে নারীটি বসে আছে। সেও কিন্তু কম নয়। আজকে তাদের একে অপরের থেকে চোখ সরানো যেনো দায় হয়ে পড়েছে। ইমনের দাদি তো বলেই ফেললেন,

” মেয়ের উচ্চতা একটু কম তবুও মাশাআল্লাহ দু’টিকে বেশ সুন্দর মানিয়েছে। ”

দাদির কথা শুনে মুসকান আরো বেশী অস্বস্তি’তে পড়ে গেলো। তার উচ্চতা কম এ প্রথম শুনলো। যদিও ইমন একটু বেশীই লম্বা দাদি বলতে পারতো তার নাতির উচ্চতা একটু বেশীই হয়ে গেছে। তা না নিজের নাতিকে বড়ো করে পরের মেয়ে’কে ছোট করে দিলো। ইমন মুসকানের অস্বস্তি বুঝে তার দিকে একটু চেপে বসলো তারপর নিচু স্বরে বললো,

“এনি প্রবলেম?”

মুসকান শ্বাস রুদ্ধ করে মাথা এদিক সেদিক নাড়িয়ে না বোঝালো। এদিকে দাদির কথা শুনে রিমি বললো,

“কি বলেন দাদি মুসুর হাইট পাঁচ ফুট তিন মেয়ে হিসেবে এই উচ্চতাকে অন্তত কম বলা যায় না। ”

দাদি ঘোর বিরোধিতা করে বললো,

“তা যাই বলো আমার নাতির চেয়ে তো বেশ খাটো। ”

” তা দাদি আপনি কি আপনার নাতির চেয়ে উচ্চতায় বেশী হবে এমন মেয়ে খুঁজছিলেন নাকি? ”

সকলেই এবার মুখ টিপে হেসে দিলো। মুরাদ রিমিকে চোখ রাঙালো,ইমন দাদির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দাদি হকচকিয়ে বললো,

” বউ মা নাকফুল টা পড়াই ফেলি কি বলো? ”

ইরাবতী বললো,

“আগে আংটি বদল হয়ে যাক তারপর নাকফুল পড়ানো হবে। ইমনের বাবা আবার বেরিয়ে যাবে কিছু সময়ের মধ্যেই। ”

রিমি গিয়ে মরিয়ম আক্তার’কে ডেকে আনলেন। একে একে সবাই উপস্থিত হলো। দিহান ক্যামেরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুরাদ এসে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে রিমির পাশে চেপে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বললো,

“বড়োদের মুখে মুখে তর্ক করতে বলছিলাম?”

“চুপ থাকো তুমি এই দাদিটার কথাবার্তার ধরন আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমাদের বাড়ির মেয়ের খুঁত ধরতে আসছে আমি ছেড়ে দিব নাকি হুহ। ”

ট্রি টেবিলের ওপর দু’টো ডায়মন্ডের রিং পাশাপাশি রাখা। একটি ইমনের আরেকটি মুসকানের৷ সকলের উপস্থিতি এবং বাবা,মায়ের আদেশ পাওয়া মাত্রই ইমন ডানহাতে রিং ওঠিয়ে বা হাত মুসকানের দিকে এগিয়ে দিলো। মুসকান নড়েচড়ে বসে এক ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিলো ইমনের দিকে। রিমি অমন অবস্থা দেখে মুসকানের পাশে বসে কাঁধ টা অন্যহাত চেপে ধরলো। ইমন এক পলক মুসকানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে অতি সন্তর্পণে অনামিকায় আংটি পরিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিজোড়া বন্ধ করে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো মুসকান চোয়ালজোড়ায় বেয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রুজল। তা দেখেই আংটি পরানো হাতটি শক্ত করে চেপে ধরলো ইমন৷ ইমনের পাশ থেকে দাদি উঁকি দিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে কিন্তু কোন কিছুই তার বোধগম্য হলো না৷ তবে বাকিরা ঠিক মুসকানের অনুভূতি বুঝতে পারলো। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষ’টাকে পেতে চলেছে সে। এই অশ্রুকণা যে পরম সুখের। সকলের তাগাদা পেয়ে মুসকান নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো তারপর সামনে থেকে আংটি নিয়ে ইমনকে পড়াতে নিবে সে সময়ই দিহান বলে ওঠলো,

“মুসু এবার কিন্তু মুখে হাসি চাই। ”

দিহানের কথা শুনে স্মিথ হেসে ইমনকে আংটি পরিয়ে দিলো মুসকান। পুরো সময়টাই ইমন মুসকানের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টির প্রগাঢ়তাই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো তার অনুভূতিকে। এমন সময় দিহান বললো,

” কিরে ভায়া ক্যামেরা তো এইদিকে। ”

সম্বিত ফিরে পেয়ে আশেপাশে নজর বুলিয়ে দিহানের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইমন। মুরাদ গিয়ে দিহানের পিঠে চাপড় মেরে বললো,

“শালা আমার বোনকে অস্বস্তি’তে ফেলবি না। ”

“শালা ম্যাক্স প্রো মুসু বলেই আসল খেল দেখাতে পারছিনা। নয়তো ঐ শালার জীবন তেজপাতা বানাই ফেলতাম। কিন্তু বিষয় টা ছোট বোনের তাই নিজেকে সামাল দিয়া রাখছি। ”

সকলেই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে কেউ কেউ আবার সেলফি তুলতে ব্যস্ত। এমন সময় আকরাম চৌধুরী ওঠে দাঁড়ালেন। ইমন মুসকানকে ইশারায় ওঠতে বললে মুসকান তৎক্ষনাৎ ওঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমনও ওঠে দাঁড়ালো। আকরাম চৌধুরী সকলের থেকে বিদায় নিয়ে মুসকানের মাথায় হাত রেখে বললো,

“মামনি আজ তাহলে আসি সাবধানে থেকো।”

“জি আংকেল আবার আসবেন। ”

“উহুম আর আংকেল নয় এখন থেকে বাবা বলতে হবে। ”

লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে রইলো মুসকান। আকরাম চৌধুরী বললেন,

“মনে থাকবে তো? ”

মুসকান মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বোঝাতেই সকলেই স্বস্তি পেলো। ইমন আর মুরাদ মিলে আকরাম চৌধুরী’কে গেট অবদি এগিয়ে দিতে গেলেন। এদিকে ইরাবতী নাকফুল বের করে দাদির হাতে দিলো মুসকান’কে পরিয়ে দেওয়ার জন্য। মুসকান ভয়ে এক ঢোক গিলে রিমির দিকে তাকালো। রিমি তাকে আশ্বাস দিয়ে কাছে গিয়ে বসে তার নাকে থাকা ছোট্ট গয়নাটা কৌশলে খুলে দিয়ে দাদির দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

“দেন দাদি আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। ”

ইরাবতী বললো,

” না না ইমনদের বংশে এটা বাড়ির মুরুব্বিরাই পড়ায়। আমাকেও আমার দাদি শাশুড়ি পরিয়েছেন।”

“ওহ তাহলে দাদি ওর নাকের ফোঁটা বেশ চিকন তো একটু সাবধানে কৌশলে ঢোকাবেন। আসলে বেশিদিন হয়নি নাক ফোঁটা করেছে আর এই ছোট্ট ডাল সিস্টেম গয়নাই পড়া ছিলো তবুও বহুকষ্টে ঢোকানো হয়েছে। ”

“আরে এই সামান্য বিষয়ে এতো চিন্তার কি আছে। আমার কতোগুলা নাতনীরে নাক বিন্ধানি থেকে শুরু করে গয়না পরানি সব আমিই করছি। তোমাদের থেকে কৌশল আমি কম জানিনা।”

বলেই দাদি মুসকান’কে নিজের দিকে ঘুরতে বললো।মুসকান তার দিকে ঘুরে এগিয়ে বসতেই সে নাক ফুলটা মুসকানের নাকের ফোঁটা বরাবর ধরে চাপ দিলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে ‘আহ’ সূচক শব্দ করলো মুসকান। চোখ দিয়ে দুফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়লো। নাকফুলের আগা একটু ঢুকেছে মাত্র পুরোপুরি ঢোকেইনি। রিমি দাদির দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,

“দাদি ব্যাথা পাচ্ছে একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢোকান। ”

“আহ এই অল্প ব্যাথায়ই এমন করলে এই মেয়ে সংসার করবো কিভাবে। সামান্য নাকফুল পরানো হচ্ছে তাই চোখের পানিতে বন্যা বানাই ফেলছে। এইটা কোন ব্যাপার হলো দেখি আগাও।”

মুসকান আবারো আগালো। ইরাবতী বললো,

“ফুপুমা আপনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেষ্টা করেন। চোখ,মুখ লাল হয়ে গেছে মেয়েটার বেশ ব্যাথা পাচ্ছে মনে হয়।”

দাদি আবারো ঢোকানোর চেষ্টা করলো এবার একটু শব্দ করেই আর্তনাদ করে ওঠলো মুসকান। রিমি কাঁধ চেপে ধরলো। ইরাবতী চমকে ওঠে বললো,

” থাক থাক এতো কষ্ট করে ঢোকাতে হবে না। ”

দিহান মুসকানের ফ্রেন্ডদের ছবি তুলার জন্য ছাদে নিয়ে গেছে। মরিয়ম আক্তার রান্নাঘরে কাজ করছেন। ইমন আর মুরাদ আকরাম চৌধুরী’কে গাড়িতে ওঠিয়ে দিয়ে বসার ঘরে উপস্থিত হতেই দেখলো পরিবেশ অনেকটা থমথমে আকার ধারণ করেছে। ইমন ভ্রু কুঁচকে সোফার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মুসকানের বিক্ষিপ্ত চেহেরা দেখতে পেলো। ইরাবতী আতঙ্কিত হয়ে একবার ছেলের দিকে আরেকবার মুসকানের দিকে তাকাচ্ছে। মুরাদও অবুঝের মতো চেয়ে আছে বোনের কান্নামিশ্রিত চেহেরার দিকে। দাদি আরেকবার চাপ দিতেই মুসকান একহাতে শাড়ি অপরহাতে রিমির হাত চেপে ধরলো। ইমন আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে যেতে যেতে উচ্চ কন্ঠে বললো,

“এটা কি হচ্ছে দাদি এভাবে জোর প্রয়োগ করছো কেন? ”

রিমি দ্রুত মুসকানের পাশ থেকে সরে দাঁড়ালো। আর ইমনও উদগ্রীব হয়ে মুসকানের পাশে বসে এক হাতে মুসকানের একহাত চেপে ধরে অপরহাতে মুসকানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“কিছু হয়নি আমি দেখছি শান্ত হো। ”

দাদি কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই ইমন কঠিন চাহনী দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো। তারপর মুসকানকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রক্তিম হয়ে ওঠা নাকটায় নজর বুলালো। ইরাবতী’কে বললো,

“এমন কি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এটা যে এভাবে ধস্তাধস্তি করে আঘাত দিয়ে পরাতে হবে! ”

দাদি বললো,

“আরে দাদুভাই কি বলো এটাই তো মূল্যবান জিনিস স্বামীর দেওয়া চিহ্ন এটা। ”

“ননসেন্সের মতো কথা বলবেনা দাদি কিসের চিহ্ন আমার জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে কোন চিহ্ন পরতে হবেনা ওর। আমার জন্য, আমাকে ভালোবেসে যে চিহ্ন অন্তঃকোণে নিয়ে বেড়াচ্ছে এই অনেক। ”

কথাগুলো বলতে বলতেই নাকের ফুলটা আলতো করে টান দিলো ইমন। এতেও ব্যাথায় চোখ,মুখ শক্ত করে রইলো মুসকান। মাথাটা যেনো অবশ হয়ে আসছে তার। ঝিমঝিম করছে কেমন নাক টেনে চোখ খুলতেই ইমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুসকানের কান্না যেনো এবার বাঁধ ভাঙা হয়ে গেলো। ইমন ঠোঁট কামড়ে বিচলিত হয়ে বললো,

“সরি আমার জন্য এটা হলো আমি থাকলে এতোটুকু হতে দিতাম না। পরতে হবেনা এইসব নাকফুল, তোকে এমনিতেই সুন্দর লাগে। ”

পরোক্ষণেই কি যেনো ভেবে স্মিত হেসে বললো,

” তোকে হবে না তোমায় এমনিতেই সুন্দর লাগে এসব সং ঢংয়ের কোন প্রয়োজন নেই। ”

এতোকিছুর মাঝেও লজ্জায় মিইয়ে গেলো মুসকান। মাথা নিচু করে মৃদু হেসে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সে। ইমনও তার হাতটি চেপে ধরে ছোট করে শ্বাস ছাড়লো। কিন্তু রিমি বললো,

“সমস্যা নেই ভাইয়া নাকফুল থাকুক আমরা ইজি ভাবে ওকে পরিয়ে দেবো। প্রথম পড়তে একটু সমস্যা হয়ই আমারো হয়েছে তাই জোর প্রয়োগ না করে সেভাবেই পরাতে হবে। ”

দাদি ওদের হাবভাব দেখে বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বসা থেকে ওঠে ইরাবতী’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“সামনে খুব বিপদ আছে তোমার বউয়ের প্রতি এতো আহ্লাদপানা ভালো না বুঝছো, বিয়ে তো হয়েই সারেনাই। আর এই মেয়ে সামান্য ব্যাথায় এমন করতেছে মনে তো হয় না জীবনে নাতী-নাতনীর মুখ দেখতে পারবা!”

কথাগুলো ইরাবতী ছাড়াও রিমি স্পষ্ট শুনতে পেলো। মনে মনে কয়েকটা গালাগালও করলো দাদিকে। তারপর ইমন’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আমার মনে হয় তোমাদের এখন একান্তে সময় কাটানো উচিৎ।”

“হুম রিমি এক কাজ করো ওকে ভিতরে নিয়ে যাও। আমি মা আর দাদিকে বাসায় রেখে আবার ব্যাক করছি। বাসায় একজন আছে তাই মা’কে খুব দ্রুত ফিরতে হবে এখন। ”

রিমিকে কথাগুলো বলেই মুসকানের দিকে তাকালো ইমন। তার দৃষ্টির প্রগাঢ়তায় মাথা নুইয়ে ফেললো মুসকান। ইমন শান্ত গলায় বললো,

“রুমে গিয়ে রেষ্ট করো অতিরিক্ত ব্যাথা হলে রিমিকে বলো মেডিসিন দিতে। আর হ্যাঁ শাড়ি যেনো না খোলা হয় আমি এসে যেনো ঠিক এভাবেই পাই। ”
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ইমনের রুমের মেঝেতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সায়রী৷ ইমন রুমে এসে লাইট অন করতেই সায়রী’কে এক পাশে ওভাবে বসে থাকতে দেখে অধর কামড়ে বিরক্ত হয়ে বললো,

“তোদের মেয়েদের এই স্বভাব টা সবচেয়ে জঘন্য লাগে আমার। আরে বাবা হাজব্যান্ডের সাথে যাই হোক না কেন এভাবে ঘরের এক কোণে থম মেরে বসে থেকে কোন লাভ আছে? কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে মন,মস্তিষ্কে জঘন্য প্রকার চাপ প্রয়োগ করার কোন মানে হয়? ”

কথাগুলো বলতে বলতে সায়রীর দিকে এগিয়ে গেলো ইমন৷ সম্মুখে গিয়ে এক হাঁটু মাটিতে গেঁড়ে আরেক হাঁটু ভাজ করে তার ওপর এক হাত রেখে অন্যহাত সায়রীর মাথায় রাখলো। হুহু করে কেঁদে ওঠলো সায়রী। দুহাঁটু জড়িয়ে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। ইমন ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

“তুই কাঁদছিস কেন? কাঁদবে তো দিহান তোর কাঁদার মতো তো কিছু হয়নি। ”

কিছুটা শান্ত হলো সায়রী। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া মেঝেতে স্থির রেখে ভাঙা আওয়াজে বললো,

“আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স দিহান, প্লিজ হেল্প মি ইমন প্লিজ। ”

অবাক হয়ে গেলো ইমন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সায়রীর দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। সায়রী দিহান কে ডিভোর্স দিতে চাইছে এও সম্ভব! যে মেয়েটা নিজের পরিবার, পরিজনের কথা না ভেবে সব কিছু ছেড়ে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দিহানের কাছে চলে এসেছিলো। সেই মেয়েটা আজ দিহান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে! এতোগুলা বছরের ভালোবাসা এতোগুলো বছরের বৈবাহিক সম্পর্ককে ছিন্ন করতে চাইছে? এর আগেও অসংখ্যবার তাদের ঝগরা হয়েছে, শাশুড়ির কটূক্তিও কম শুনেনি সায়রী কই তখনতো এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেনি। তাহলে আজ কেন? সায়রীর মাথায় রাখা হাতটি অতি সন্তর্পণে সরিয়ে নিলো ইমন তবে তার সম্মুখ থেকে সরলো না। শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

“ওকে ছাড়া থাকতে পারবি? ”

সায়রী মাথা নাড়ালো ইমন বললো,

“ঝগরা থেকে ডিরেক্ট ডিভোর্স? ”

ক্রন্দনরত কন্ঠে সায়রী বললো,

“তুই সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না তাই তো তাহলে দেখ এসব দেখে নিশ্চয়ই সিরিয়াস নিবি? ”

নিজের গাল দু’টো মেলে ধরলো সায়রী। ইমন স্পষ্ট দেখতে পেলো দুগালে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট যা লালচে কালো বর্ণ হয়ে আছে। সায়রী কিছু সেকেণ্ডের মধ্যেই নিজের হাতের কনুয়ের উপরে ইশারা করলো সেখানেও কালচে হয়ে আছে। প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করে মুচড়ে ধরার কারণেই এমনটি হয়েছে বুঝতে পারলো ইমন৷ বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার আঘাত প্রাপ্ত জায়গা আরেকবার সায়রীর দিকে তাকাচ্ছে ইমন। একসময় ক্রোধে তার চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে ওঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে বললো,

“খুন করে ফেলবো ওকে আমি। ”

আঁতকে ওঠলো সায়রী ত্বরিৎ বেগে ওঠে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললো,

“তুই কিছু করবি না যদি কিছু করতেই হয় তাহলে কালকের মধ্যে ডিভোর্স পেপার রেডি কর। ”

তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে ইমন বললো,

“একদম চুপ! ওর প্রতি একদম দরদ দেখাবিনা। ওর গায়ে জোর কতোখানি হয়েছে তাতো আজ আমি দেখেই ছাড়বো। ”

কথাগুলো বলেই রুম ছাড়তে উদ্যত হয় ইমন৷ কিন্তু তার পূর্বেই সায়রী ইমনের পা দু’টো জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে,

“তুই কিছু করবি না ইমন আমাদের বন্ধুত্বের দোহাই তুই ওকে কিছু করবিনা। শুধু ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দে নয়তো আমি পাগল হয়ে যাবো মরে যাবো আমি।”

থেমে গেলো ইমন ক্রোধান্বিত স্বরে বললো,

“ওকে কিছু করবো না তবে দু’টো শর্ত রয়েছে এক যা ঘটেছে পুরোটা খুলে বলবি। দুই কোন প্রকার কান্নাকাটি করতে পারবিনা,নিজেকে কোনভাবে কষ্ট দিতে পারবিনা। ”

সায়রী মাথা নাড়িয়ে পা ছেড়ে দিলো দু’চোখের পানি দু-হাতে মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ইমন ইশারায় বিছানায় বসতে বললো। সায়রী তাই করলো ইমনও গিয়ে তার পাশে বসলো। আর কোন প্রশ্ন করতে হলো না পুরো ঘটনা সায়রী নিজেই বলতে শুরু করলো,

“ওকে কি বলবি তুই ইমন দোষ তো আমার আমিই ওকে একটা সন্তান সুখ দিতে পারছিনা৷ ওর পরিবারেরও কোন দোষ নেই তারা শুরু থেকেই আমাকে পছন্দ করেন না, এখন একটা নাতী বা নাতনী চাইছে তাও দিতে পারছিনা দোষ আমার ইমন। ”

“ফাইজলামি পাইছোস! আরো কয়েকটা থাপ্পড় আমি লাগাবো এখন? তোর দোষ মানে দোষ কারোরি না আল্লাহ যখন চাইবে তখনি তোরা সন্তান পাবি তার আগে না৷ তাছাড়া তোরা ডক্টর দেখাচ্ছিস না কেন তাই তো বুঝতে পারছিনা। ”

“আমার শাশুড়ি’র ধারণা তার ছেলে বয়স্ক মেয়ে বিয়ে করেছে তাই সন্তানের মুখ দেখতে পারছে না। সর্বক্ষণ আড়ালে আমাকে নিয়ে কানাঘুষা করে। বয়স বেশি বেশি করে হায় হুতাশ করে। আমি এসব নিয়ে কোনদিন দিহানকে কিছু বলিনি। কিন্তু কয়েকমাস আগে যখন মা তার বোনকে ফোনে বললো তার সন্দেহ হয় আমি বন্ধ্যা কিনা। জানিস ইমন এই একটা কথা আমার সমস্ত সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দিছে সহ্য করতে পারিনি। তাই দিহানকে বলি যাতে আমার সাথে ডক্টরের কাছে যায়৷ দু’জনই একবার ডাক্তার দেখাবো। কিন্তু আমার কথা শুনেই দিহান রেগে যায়। বলে এসব ভূত মাথা থেকে নামাতে। আর যদি এতোই প্রয়োজন হয় তাহলে যেনো আমি নিজেই গিয়ে ডক্টর দেখাই ওর মাথা না খাই। তারপরও আমি অসংখ্য বার বলেছি ও রাজি হয়নি। গতমাসে ডক্টর দেখাই পরীক্ষা, নিরিক্ষা করি কিন্তু এতে আমার কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। সব রিপোর্ট দিহানকে দেখাই আর বলি ওকেও পরীক্ষা নিরিক্ষা করাতে। এতেই যা হওয়ার হয় আমার কি ভুল হলো জানিনা। তারপর থেকেই আমার সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করে। আচরণ বিধি দেখে মনে হয় একঘরে থাকতেও ওর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। তারপর থেকেই অশান্তি শুরু হয়৷ বিশ্বাস করবিনা আমি ওকে টাচ করলেই যেনো ওর শরীরে আগুন ধরে যায়। মানুষের সামনে যতোপ্রকার অভিনয় আছে সব করে কিন্তু ভিতরে আমার ছায়াও মারাতে চায় না। চৌদ্দ,পনেরো দিন আগে কি করেছে শুনলে তুই বিশ্বাস করবিনা এসব দিহান করতে পারে! বাইরে থেকে মদ কিনে এনে আমার সামনে বসে দু’বোতল মদ গিলেছে সে রাতটা আমার জন্য কি ভয়ানক ছিলো তোকে বলে বেঝাতে পারবোনা। একটা মানুষ’কে ভালোবেসেছিলাম আমি কোন পশুকে নয়। সেদিন সকাল বেলা ওঠে কি বলে জানিস, ‘আমার পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ করিস পুরুষত্ব কাকে বলে বুঝেছিস? আর কোন সন্দেহ আছে? ‘ বিশ্বাস কর মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো তখন আমার। গতকাল রাতে মা আমাকে নিরালায় ডেকে নিয়ে কি জিগ্যাস করে জানিস, আমার সমস্যা কি বাচ্চা ধরে না কেন? আমি বললাম কোন সমস্যা নেই কিন্তু ওনি তা শুনতে নারাজ জোর করেই আমাকে দিয়ে স্বীকার করাবে সমস্যা আমারই। আমি কি অবলা নারী নাকি কচি খুকি যে ওনি যা বলবে সব মেনে নিবো? দু’একটা কথা-কাটাকাটি হলো দিহান পুরোটা সময় চুপ ছিলো। রুমে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,’সমস্যা কি মা’কে অন্তত আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে নিষেধ করো’ ও সোজা উত্তর দিলো কিছু বলতে পারবে না। আমারও রাগ ওঠে যায় জামা কাপড় গোছাতে শুরু করি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো বলে। পিছন থেকে হাত মুচড়ে ধরে বিছানায় ফেলে দরজা আঁটকে যা ইচ্ছে তাই গালাগাল করলো। পুরো রুমে ভাঙচুর করলো তবু রাগ কমলো না শেষে সমস্ত রাগ আমার শরীরের ওপর মিটালো। সকালে যখন মুরাদ ফোন করলো নিজে রেডি হলো অথচ আমাকে রেডি হতে দেবেনা৷ আমি জোর করলাম ধস্তাধস্তি করলাম শেষে গায়ের জোর খাটিয়ে থাপ্পড় মারলো। আর কতো সহ্য করবো বল না পেরে আমিও ওর গায়ে হাত তুলে ফেলি। চিৎকার করে বলি, ‘সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে আমার, তোর সাথে একসঙ্গে থাকা সম্ভব না তোকে আমি ডিভোর্স দেবো দিহান। আমি তোর সাথে সংসার করবো না!’ তারপরই একটু চুপ করে ও আর বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। আর আমিও সব কিছু গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমাকে ওরা সস্তা ভেবে যা তা করবে আর আমি সহ্য করবো? কখনোই না। আমি তোর কাছে আসছি ডিভোর্সের ব্যপারে কথা বলতে। অলরেডি বাসা দেখা হয়ে গেছে বিকালেই ভাড়া বাসায় ওঠবো। ”

সমস্ত ঘটনা শুনে স্থির হয়ে গেলো ইমন। গম্ভীর কন্ঠে বললো,

“এ বাড়ি থেকে এক পা নড়ে দেখ পা কেটে সদর দরজার সামনে ঝুলিয়ে রাখবো। ”

“আমাকে একা ছেড়ে দে ইমন। আমার একা থাকাটা প্রয়োজন। ”

“হুম থাক যে পর্যন্ত বিয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু না হচ্ছে সে পর্যন্ত যতোখুশি একা থাকবি তবে এ বাড়িতেই৷ ”

সায়রী অমত পোষণ করে কিছু বলতে নিতেই ইমন বললো,

“কোন কথা নয় সামনে তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড প্লাস ছোট বোনটার বিয়ে সে উপলক্ষে একমাস আগে থেকেই কিন্তু দু বাড়িতে থাকার কথা তোর। তাই পাকনামি না করে তুই এখানেই থাকবি ব্যস। ”

“আর ডিভোর্সের ব্যাপারে তোর পরিচিত উকিলের সঙ্গে কথা বলবিতো? ”

চিন্তান্বিত হয়ে কেবলমাত্র স্বান্তনা দেওয়ার জন্য ইমন মিথ্যা বললো,

“হুম বলবো। ”

সায়রীর সঙ্গে কথা বলা শেষে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো ইমন৷ পারুলকে বললো সায়রীর জন্য উপরে খাবার পাঠাতে আর ইরাবতী’কে বললো সায়রী যেনো খাবারটা খায় তা দেখতে। আর না খেতে চাইলে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে শুনিয়ে খাওয়াতে। বাবা,মায়ের অবাধ্য হয়ে দিহানকে বিয়ে করেছে সায়রী। শ্বশুর বাড়ির কোন সমস্যা বা স্বামীর সাথে হওয়া কোন সমস্যার কথা বাবা,মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেনা। বন্ধু হিসেবে ইমন এবং মুরাদকেই বিপদে,আপদে ডাকে। ইরাবতীর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের খাতিরে চৌধুরী বাড়িতে বেশ আসা যাওয়াও করে। তাই এ সময়টা বন্ধু হিসেবে ইমন এবং মা হিসেবে ইরাবতী’র থেকে বেষ্ট কেউ হতেই পারেনা।
____________________
শুধুমাত্র চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো মুসকান। তারপর ইমনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারেনি। বাড়ির সবাই তখন মাগরিবের নামাজরত অবস্থায় রয়েছে। পেটের ভিতর দুমড়েমুচড়ে ওঠতেই আচমকা ঘুম ভেঙে যায় মুসকানের। একহাতে পেট চেপে ধরে তাড়াতাড়ি রুমের বাইরে যেয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে বমি করে দেয়। পানি ব্যতীত আর কিছুই বের হলোনা গলা দিয়ে। কিন্তু ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল মুসকানের। চোখ,মুখের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করেছে তখনি ঘরে ঢুকলো ইমন। গেট খোলা থাকায় সরাসরি বসার ঘরেই ঢুকেছে সে। আর এক কোণায় মুসকানকে ওভাবে দেখতেও পেয়েছে। বিচলিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে মুসকানকে ধরতেই মুসকান বললো,

“আমার খুব মাথা ঘুরাচ্ছে, অস্থির লাগছে, বমি পাচ্ছে। ”

অস্থির হয়ে পড়লো ইমনও। টেপ জুরে বললো,

“কুলি করো ফার্স্ট। ”

কথাটি বলেই ডায়নিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ভরে নিয়ে মুসকানকে দিলো। মুসকান অসুস্থ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ইমন চোখ রাঙিয়ে বললো,

“খেতে দিয়েছি। ”

মরিয়ম আক্তার নামাজ পড়ে বসার ঘরে আসতেই ওদের দেখে বললো,

“আব্বা আসছো দাঁড়িয়ে কেন বসো। ”

“কাকি মা মুসুর তো শরীর খারাপ করছে সারাদিন না খেয়ে মেবি গ্যাস হয়েছে। ”

“মুসু তোর শরীর খারাপ করছে কতোবার বললাম অল্প করে খেয়ে নে সারাদিন না খাওয়া। মেয়েটা আমাকে এই খাওয়া নিয়ে জ্বালায় আমিতো সোজা করতে পারলাম না এবার যদি তুমি পারো। ”

বলতে বলতে দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে গ্যাসট্রিকের ওষুধ নিয়ে এলেন তারপর মুসকানকে ওষুধ দিয়ে বললেন,

“ধর এটা খা খাবার বাড়ছি দশমিনিট পর খেয়ে নিবি। ”

মরিয়ম আক্তার খাবার বাড়তে নিবে এমন সময় রিমি এসে বললো তার বাবা ওনাকে ডাকছে। তাই রিমিকে খাবার বাড়তে বলে মরিয়ম আক্তার রিমিদের পাশে চলে গেলেন। ইমনও কিছুটা স্বস্তি পেয়ে রিমিকে ইশারায় খাবার মুসকানের রুমে দিতে বলে সে নিজেই মুসকানের রুমে চলে গেলো। মুসকান হাতে থাকা গ্লাসটি ঠাশশ করে টেবিলের ওপর রেখে রিমিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আম্মুর ওপর এই জিনিসটাই আমার বিরক্ত লাগে। আমি তাকে খাবার নিয়ে জ্বালাই এই কথাটা তার আব্বার সামনেই শুধু বলতে হবে? আর কোন মানুষ নাই অসহ্যকর!”

রিমি মিটিমিটি হাসতে লাগলো আর বললো,

“তুই মা’কে জ্বালাস তাই প্রতিশোধ নিলো বুঝলি যাতে ইমন ভাই তোকে জ্বালায়। ”

মুসকান অধরপল্লব ফুলিয়ে ছোট ছোট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দুর্বল শরীরটা কেবলই চেয়ারে বসিয়েছে অমনি রিমি বললো,

“রুমে আয় খাবি চল। ”

“আমি ওখানে আরো খেতে পারবো না, তখন আরো কথা শুনতে হবে প্লিজ। ”

“বইন ইমন ভাইয়ের কথা অমান্য করার সাধ্য আমার নাই ঝামেলা না করে চুপচাপ চলে আয়। ”

গুণগুণিয়ে কান্নার ভঙ্গি করে অগত্যা রুমে গেলো মুসকান। রিমি খাবার গুলো বিছানায় সাজিয়ে রেখে সেন্টার টেবিলে জগ গ্লাস রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ইমন মোড়া টেনে বিছানার সামনে বসলো। মুসকানকে ইশারা করলো তার সম্মুখে বিছানায় বসতে। মুসকান বাধ্য মেয়ের মতো গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসলো। ইমন পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে খাবার প্লেট হাতে নিয়ে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” আজ থেকে বিয়ের পর পর্যন্ত আমার ফার্স্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাকে খাওয়া শেখানো। এই শরীর নিয়ে বাইরে বের হতে তো লজ্জা হওয়া উচিৎ! ”

চমকে ওঠলো মুসকান নাক ফুলিয়ে কেবল রাগ ঝাড়তে থাকলো। তা দেখে বাঁকা হেসে ইমন বললো,

“নাগিনদের মতো ফুঁসে কোন লাভ নেই লজ্জা করেনা! অনার্স পড়ুয়া কোন মেয়ের ওজন মাত্র ৪২কেজি হুহ্? ”

“ইনসাল্ট করবেনা আমার অনেক বান্ধবীদের ওজন আমার থেকেও কম। ”

“চুপ ঐসব বান্ধবী টান্ধবী বুঝিনা আমার ওয়াইফের ওজন এতো অল্প থাকলে চলবে না। তাছাড়া খাওয়া শিখতে হবে নয়তো দেখা যাবে মা বাঁশ কাঠি আর বাচ্চা কাচ্চা সব পাট কাঠি হবে!”

মুসকান হা করতেই ইমন মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দিলো। খাবার মুখে দিতে না দিতেই পানি খেলো মুসকান। ইমন বিরক্ত হয়ে বললো,

“এজন্যই স্বাস্থ্য এমন খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি খেতে হবে? ”

“গলায় খাবার আঁটকে যায়। ”

“ধীরে সুস্থে খেলেই কিছু হবেনা ” বলেই আরেক লোকমা মুখে দিয়ে বললো,

” সেবাশুশ্রূষা সব তোলা রইলো আগে শরীরের কাহিলতা দূর করে নেই তারপর সব শুধে আসলে মিটিয়ে নেবো। ”

রক্তিম আভায় ভরে গেলো মুসকানের চোয়ালজোড়া নত মুখে খাবার চিবুতে থাকলো সে। ইমন বুঝলো সে এমন টপিকে কথা বললে লজ্জাবতী আর খাবারটা শেষ করতে পারবে না। তাই টপিক চেঞ্জ করে দিহান আর সায়রীর বিষয়টা শেয়ার করলো। পাশাপাশি পুরো খাবারটাই খাওয়ালো। খাবার শেষে ইমন হাত ধুতে বাইরে চলে গেলো। মুসকান থম মেরে বসে রইলো। যদিও দিহান সায়রীর ভিতরকার সব কথা বলেনি ইমন তবুও যেটুকু শুনেছে এতেই মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার। আর সবচেয়ে বেশি রাগ হয়েছে দিহানের ওপর।
.
মুরাদের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথাবার্তা শেষ করে সেখান থেকেই চিল্লিয়ে মুসকানকে ডাকলো ইমন। মুরাদ বললো,

“চলে যাবি এখন? ”

“না আজ থেকে যাবো। ”

মুরাদ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাতেই ইমন বললো,

“সামনে থেকে সর বউকে গিয়ে সময় দে যাহ আমার পিছে লেগে থাকিস না ঠিক সময় চলে যাবো। ”

ছোট বোনের স্বামী হতে চলেছে বেশি কিছু বলতেও পারলো না মুরাদ সীমিত ভাবে কিছু গালি দিতে দিতে নিজ রুমে চলে গেলো। এদিকে মুসকান রুম থেকে বের হতেই ইমন সোজা ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ভ্রু কুঁচকে মুসকানও তাকে অনুসরণ করতে থাকলো। তবে যতো পা আগাতে থাকলো ততোই বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হলো। কেবল ইমনের জন্য না রাতের বেলা ঘর ছাড়া একা একা অন্যত্র চলাফেরাতেও ভীষণ ভয় তার। এ ভয়ের জন্যই এখনো চন্দ্র বিলাস বা জোৎস্নার রাত উপভোগ করা হয়ে ওঠলো না তার। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরেতোই ইমন সামনে পা না বাড়িয়ে পিছনে বাড়াতে থাকলো। তা দেখে বুকের ভিতর প্রচণ্ড জোর প্রয়োগ করে ধক করে ওঠলো তার। স্থির হয়ে গেলো পা’জোড়াও কিন্তু ইমন যখন তার পাশে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে তার একটি হাত নিজের বলিষ্ঠ উষ্ণময় হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো তখন স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছেড়ে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন ইশারায় পা এগোতে বলতেই ইমনের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে ওঠে গেলো উপরে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here