হৃদপিন্ড ২ পর্ব ২

#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_২

ইমনের অমন চাহনীতে মুসকান বেশ অস্বস্তি তে পড়ে গেলো। যদি আগের মুসকান হতো তাহলে এতোক্ষণে নানাভাই,নানাভাই করে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো। আর মাথা খেয়ে ফেলতো ইমনের ৷ কতোশত গল্প জুরে দিতো তাঁর নানাভাইয়ের সাথে হিসেব নেই। সে এসেছে অথচ তাঁর মুসুরানীর জন্য চকলেট নিয়ে আসেনি তা নিয়ে করতো হাজারটা অভিযোগ। কিন্তু সেসবের কিছুই মুসকান আজ করলো না। করলো না বললে ভুল হবে করতে পারলোনা। কিছু ঝাপসা অতিত মনে পড়ে যাওয়াতে সেসবের কিছুই করার আগ্রহ পেলো না সে। শুধু মনে পড়তে গেলো সামনের মানুষ টার নির্দয়তার কথা। তাই নিজের সব দূর্বলতাকে পিষে মেরে ট্রি টেবিলে পানির গ্লাসটা রেখে দ্রুত পায়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

মুসকান চলে যাওয়ায় ধ্যান ভাঙলো ইমনের। ট্রি টেবিলে চেয়ে পানির গ্লাসটা দেখে বসে পড়লো। পানি খেয়ে খানিকটা রিল্যাক্স লাগলো তাঁর। বুকের ভিতর কি অশান্তিই না শুরু হয়েছিলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ভাবতেই ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকালো মুসকানের রুমের দিকে। সে তাকানোতে ছিলো আর একটি বার অসম্ভব মায়াবী মুখশ্রীটা দেখার গভীর আকুলতা।
.
মরিয়ম আক্তারের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলো ইমন৷ তারপর গেলো মুরাদের রুমে। অনেকদিন পর দু বন্ধুর দেখা। ইমনের জব হওয়ার পর হাতেগোনা কয়েকবার দেখা হয়েছে তবুও স্বল্প সময়ের জন্য। দু বন্ধু এবার ভীষণ খুশি মন চাইলেই আড্ডা দিতে পারবে। একে অপরের সাথে দেখা করতে পারবে। অফিস টাইম বাদে অবশ্যই ব্যাচেলর বন্ধু রা সময় পাস করতে পারবে প্রতিদিন৷ মুরাদের বাড়ি থেকে ইমনের বাড়ির দূরত্ব অটোতে জাষ্ট পনেরো মিনিট। তাই খুব একটা অসুবিধা হবে না। মুরাদকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে গেলো ইমন। পনেরোদিন যাবত ঘরেই শোয়া আর বসা আছে সে। বাইরের আলো,বাতাস তেমন পায়নি। তাই ইমন ছাদে নিয়ে এলো রাত অবদি আড্ডা দেবে বলে। কিছুক্ষণ পর দিহানও চলে এলো। সাথে নিয়ে এলো কয়েকটা কোক এর বোতল আর সিগারেট। তা দেখে মুরাদ বললো,

—- কোক টা রেখে সিগারেট বাইরে ফেল। আম্মা বা মুসু দেখলে সমস্যা হবে।

ইমন চুপ হয়ে গেলো। মনে পরে গেলো কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা। দিহান বললো,

—- আরে ইয়ার নো প্যারা জাষ্ট চিল ম্যান। মুসু বাড়িতে নেই সীমার সাথে পুকুর পারে গেছে। কাকি মা রান্নায় ব্যাস্ত ভয় নেই। অনেকদিন পর তিনজন একসাথে হয়েছি এক দুটো টান না দিলে চলে নাকি? সবাই জানে পোলা আমরা ১০০ তে ১০০ মাঝে সাঝে দু এক টান দেই। এটা কোন সমস্যা না গাইস লেটস এনজয়!

মুরাদ দাঁত বের করে হেসে বললো,

—- ইমন ফোনটা বের করে সায়রীকে ভিডিও কল দে তো। ওর এনজয়টা কিলজয় করে দেই।

সাথে সাথে দিহান ছিটকে সিগারেট ফেলে দিলো। যেনো হাতে বিছচ্ছা বসেছিলো। আর ঢং করে বললো,

—- ও মা গো এসব কি? মুরাদ আমি তো এসব খাইনা। তাহলে এসব আমার হাতে কেনো? নিশ্চয়ই কোন মেয়ে টুকটাক করেছে আমাকে এসব খাওয়ার জম্য। যাতে আমার আর সায়রীর সংসারটা ভেঙে যায়। একবার পাই শালীরে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ুম হুহ! আমার সায়রীর থেকে আমাকে আলাদা করতে চায় কতোবড় খেলোয়াড় ভাবা যায়।

—- শালা বাটপার! বললো মুরাদ।

ইমন মৃদু হাসলো কিন্তু মন তাঁর অন্যদিকে ছাদ থেকে পুকুর পাড় স্পষ্ট দেখা যায়। ইমনের নজর ঠিক পুকুরপাড়ের শেষ সিঁড়িতে বসে পা ভিজিয়ে রাখা মেয়েটার দিকে পড়েছে। দিহান আর মুরাদ হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠেছে ইমনের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ছাদের বর্ডারে বসে চেয়ে আছে পুকুর পাড়ে।

লম্বা চুলগুলো উপরের সিঁড়িতে বিছিয়ে আছে।একহাতে হাতে বাঁশের চিকন কুইঞ্চা দিয়ে পানিতে হালকা বাড়ি দিচ্ছে মুসকান। পাশের মেয়েটার সাথে বসে গল্প করছে ঠিকি কিন্তু মন তাঁর ভীষণ আনমনে হয়ে আছে। ইমন কিছুতেই মেলাতে পারছেনা তিন বছর আগের সেই মুসকানকে। তিনবছরের ব্যবধাবে একটা মেয়ের মাঝে এতো পরিবর্তন আসতে পারে জানা ছিলো না তাঁর। খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে এ আসলেই মুসুরানী তো? এই সেই মুরাদের গুলুমুলু হাবলু, গাবলু বোন টা তো?

মুরাদ হঠাৎই বলে ওঠলো,

—- ব্যারিষ্টার সাহেবের কি হলো হঠাৎ? ওদিকে কি? তোর মিলি তো এখন সারাদিন বাচ্চার ওয়া ওয়া সামলায়। শশুড় বাড়ি এ এলাকায় মিলির ম ও তো নাই তাহলে ওদিকে কি দেখোস?

হোহো করে হেসে ওঠলো দিহান। ইমন বিরক্তি ভরা চোখে তাকালো মুরাদের দিকে। বললো,

—- এতো ফাউল বকস কেন? মিলি কবে আমার ছিলো? বলেই দিহানকে ইশারা করলো সিগারেট দিতে। দিহান এগিয়ে দিতেই ইমন সিগারেট ধরালো। বাজে কোন নেশা না থাকলেও বন্ধু দের সাথে মাঝে মাঝে সিগারেট টা খায় সে।

—- উরে আমার সাধু রে। তুই কি ভাবোস সব ভুলে গেছি। ঐ মিলি ফকিন্নির জন্য কি ধমকগুলোই না তুই আমার মুসুকে দিয়েছিলি। সেদিন সারারাত বোনটা আমার জ্বরে ভুগেছে। শুধুমাত্র বন্ধু বলে ছাড় পাইছিস নয়তো মেরে পুঁতে দিতাম৷ ঐ খান বাড়ির মেয়ের জন্য আমার বোনকে ধমক? বললো মুরাদ।

দিহান হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে নিয়েও যেনো পড়লো না। ইমন আছে তাঁর ভাবনার জগতে। সত্যি বছর খানেক আগের ঘটনা ভুলে গেছিলো সে। তাই চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

—- জ্বর ছিলো? এমন দূর্বল হার্টের বোন পালিস লজ্জা করে না? এক ধমকেই কপোকাত।

শুরু হয়ে গেলো দু বন্ধুর ঝগরা৷ ঝগরার সাবজেক্ট ছিলো শুধুই মুসকান। সাথে দু একটা কিল,ঘুষিও দিলো একে অপরকে। ইমন একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা ধরিয়ে আড় চোখে পুকুরপাড়ের দিকে তাকালো। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। বর্ডার দু হাতে ধরে এদিক সেদিক চেয়েও আর দেখা পেলোনা মুসকানের৷ হঠাৎই বুকের ভিতর শুরু হয়ে গেলো অসম্ভব পরিমাণের অস্থিরতা। কেমন যেনো অন্যরকম এক যন্ত্রণা হচ্ছে যে যন্ত্রণা তে না আছে সুখ না আছে দুঃখ৷ কি যে আছে তাই বুঝছে না সে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলো বারে বার কোথায় গেলো? একটু আগেই তো ছিলো? চলে গেলো কেনো? কেনো চলে গেলো? আরেকটু থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? পাজি মেয়ে কোথাকার! এখনো জ্বালানো ছাড়লি না।
.
মাগরিবের আজান পড়েছে প্রায় দশমিনিট। মুসকান ছাদে এসে যেই বলেছে, ‘দাদাভাই আম্মু সবাইকে নিচে যেতে বললো’। সাথে সাথে দিহান সিগারেট টা দিলো ছাদের বাইরে ঢিল, মুরাদ ঢিল দিতে না পেরে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। যেনো এই ধোঁয়া বোনের নাক অবদি না পৌঁছায়। কিন্তু ইমন একমনে সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। মুসকান এসেছে দেখেও সে খাচ্ছে। বরং মুরাদ আর দিহানের বিহেভ দেখে বিরক্ত হলো৷ এতো ভয় পাওয়ার কি আছে তাই বুঝছে না সে। দের ইঞ্চি মেয়েকে দেখে এদের এতো ভয় ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

এদিকে মুসকান তীক্ষ্ণ চোখে ইমনকে একবার দেখে নিয়ে রাগি গলায় বললো,

—- দাদাভাই তারাতাড়ি আসো। বলেই গটগট করে চলে গেলো নিচে।

মুসকানের তীক্ষ্ণ চোখ,রাগি গলা চোখ এড়ালো না ইমনের। তাই ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো তাঁর যাওয়ার পানে।

মুরাদ সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বললো,

—- ঐ শালা তুই এটা ফালাবি নাকি তোকে ধাক্কা মেরে ফালাই দিবো৷ তুই জানিস তোর এই ধোঁয়ায় আমার বোনের কতোটুকু ক্ষতি হয়ে গেলো?

ইমন অবাক না হয়ে পারলো না। অবাক ভঙ্গিতেই বললো,

—- বাজে বকিস কেনো পায়ের সাথে মাথাটাও গেছে নাকি?

—- এক ঘুষিতে নাক ফাটাই দিবো। সিগারেট তুই আমি খেয়ে তুই আমিই মরি। আমার বোনটাকে কেনো মারতে চাস। নেক্সট ওর সামনে এসব খাবিনা। আমার আর দিহানের টেকনিক টা শিখে নে।

ইমন এতোক্ষণে বুঝলো কলিজার বোনের কতো সূক্ষ্ণভাবে প্রটেক্ট করার চিন্তা।
_______________________
একসাথে খেতে বসেছে সকলেই। কিন্তু ইমনের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ইমন, মুরাদ আর দিহান টেবিলে বসেছে। মুসকান সোফায় বসে টিভি দেখছে আর ভাত খাচ্ছে। মুসকানের খাওয়ার ধরন দেখে ইমনের খাওয়ার শখ এ মূহুর্তে মিটে গেছে। ইচ্ছে করছে কানের নিচে গিয়ে কয়টা লাগাতে। পুরো সোফায় ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টিভির দিক থেকে চোখ সড়াচ্ছেই না৷ টিভিতে চেয়েই ভাত মাখছে টিভিতে চেয়েই ভাত মুখে দিচ্ছে। যার ফলে খাবার জামায়, সোফায় পড়ে বিশ্রি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ইমন আর চুপ থাকতো পারলো না। সিদ্ধান্ত নিলো এই মেয়েকে এবার এক ধমক দেবেই মুরাদ কিছু বললে চরম অপমান করবে। দু,তিন বছরের বাচ্চার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাত খাচ্ছে। অন্ন খাচ্ছে কম ধ্বংস করছে বেশী। একজন ব্যারিষ্টারের সামনে এসব ধ্বংসকারী ধ্বংস লীলা করে পাড় পেয়ে যেতে পারে না। তাহলে নিজের শিক্ষা কে নিজের প্রফেশনকে অপমান করা হবে। তাই পানিটা খেয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলো। কিছু বলতে যাবে তখনি মুসকান ওঠে এসে অর্ধেক খাবার সহ প্লেট টেবিলে ইমনের সামনে রেখে এক গ্লাস পানি ভরে খেয়ে গ্লাসটা রেখে দিলো। যতোক্ষণ মুসকান এসব করলো ঠিক ততোক্ষণই ইমন চেয়েছিলো মুসকানের নিচের ঠোঁটের কোনায় কালো তীলটার দিকে। যা তাঁর ভিতরের সবটুকু চিন্তা ভাবনা দূর করে দিয়ে তাঁকে নিয়ে চললো অচেনা এক ঘোরপুরীতে। যে ঘোর থেকে বেঁচে থাকতে আর বের হতে পারবে কিনা সন্দেহ।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here