হৃদপিন্ড ২ পর্ব ৪

#হৃদপিন্ড_২
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পার্ট_৪

একজন ধৈর্য্যশীল মানুষ কিভাবে এতোটা ধৈর্য্যহীন হয়ে যেতে পারে বুঝে আসছে না ইমনের৷ এতো ছটফট তাঁর কখনো লাগেনি। মনে হচ্ছে একশত বছরের বেশী সময় ধরে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ মনটা কেমন আকুপাকু করছে তাঁর। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মতোনই তাঁর মনটাও বড্ড বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে আজ।

গেট খুলতেই বেশ তারা নিয়ে ভিতরে ঢুকলো ইমন।এভাবে ঢোকায় মুসকান হকচকিয়ে গিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। ইমন যখন মুসকান কে দেখলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ এক মনে থম মেরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আমতা আমতা করে বললো,
—- কেমন আছিস?
—- ভালো আছি তুমি? মিনমিনিয়ে বললো মুসকান।
—- ভালো তুই কেনো এসেছিস কাকি মা কোথায় একা একা ভয় পেতি যদি?

মুসকানের হাত,পা মৃদু কাঁপছে কোন রকমে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ইমনের থেকে চোখ সড়িয়ে নিলো।গেটের দরজা লাগিয়ে তালা দিতে যাবে তখনি ইমন একটু ঝুকে তাঁর হাত ধরে ফেললো৷ মুসকান যেনো কারেন্টে শখড খেলো এভাবে কেঁপে ওঠে চমকে তাকালো ইমনের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই বুকের ভিতর উথাল-পাতাল শুরু হয়ে গেলো দুজনেরই। তারাতাড়ি চোখ সড়িয়ে নিলো মুসকান। ইমন থতমত খেয়ে গেলো। টের পেলো মুসকান কাঁপছে। সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিলো সে। শীতল দৃষ্টি তে চেয়ে নরম গলায় বললো,
—- আমি তালা দিচ্ছি তুই ভিতরে যা।

মুসকান তালা এগিয়ে দিয়ে চাবিটা হাতের মুঠোয় নিয়ে পিছন ঘুরে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। চোখ বুজে লম্বা এক শ্বাস নিয়ে আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে ভিতরে ঢুকে গেলো। কি হলো কিছু বুঝে আসছে না৷ শুধু বুঝলো ইমনের পাশে কিছু সময় থেকে তাঁর পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছিলো। সেই সাথে কাঁপুনি ধরেছিলো খুব। বুকটাও ধুরুধুরু করছিলো ভীষণ। তাঁর ভিতর বাহির সবটাতেই ধুরুধুরু শুরু হয়ে গেছিলো।
.
মুরাদের রুমে গিয়ে কাঠের চেয়ার টেনে মুরাদের সামনে বসলো ইমন৷ মুরাদ ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
—- কোন সমস্যা?
—- কি সমস্যা হবে? মন চাইলো তাই এলাম তোর কোন সমস্যা? শার্টের হাতা ফোল্ড করে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বললো ইমন।
—- আরেব্বাস রেগে যাস কেনো? আসছিস ভালো হয়েছে আজ থেকে যা নো প্যারা জাষ্ট চিল দোস্ত। মাছ ভাজি মুরগির মাংস, ভাত আছে খাওয়া হয়ে যাবে তিনজনের।
.
মুসকান রুমে আসতেই ইমন আড় চোখে একবার চেয়ে মুরাদ কে বললো,
—- এক গ্লাস পানি খাওয়া এখন। খুব টায়ার্ড লাগছে।
—- মুসু পানি দে তারপর এসে এখানে বোস। বললো মুরাদ।

মুসকান ইমনের দিকে এক পলক চেয়ে দেখলো সাদা শার্ট ঘেমে ভিজে গেছে একদম৷ বসে কেমন হাসফাস করছে। সারাদিন অফিস করে এই গরমে এখানে কেনো আসতে গেলো তাই বুঝে আসছে না মুসকানের। নিজ বাড়ি গিয়ে গোসল করে খেয়ে দেয়ে রেষ্ট না নিয়ে এখানে আসার মানে সত্যি অযৌক্তিক লাগছে। আবার ভাবলো হয়তো মুরাদের সাথে খুব জরুরি কথা বলতে এসেছে। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্যানের পাওয়ার টা বাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

ফ্যানের দিকে চেয়ে আবার পিছন দিক তাকালো ইমন৷ বুঝলো এটা মুসুর কাজ মনে মনে খুব ভালো লাগা কাজ করলো তাঁর। বিরবির করে বললো,’গুড জব ডিয়ার’।

পানি এনে সামনে ধরতেই ইমন পানিটা খেয়ে গ্লাস দিতে গিয়ে তাকালো মুসকানের দিকে। ঠোঁটের কোনায় তিলটা দেখে যেনো তাঁর হৃদস্পন্দন কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেলো। ধীর গলায় বললো,
—- তারাতারি এটা নিয়ে সড় সামনে থেকে।

মুসকান ভ্রু কুঁচকে চেয়ে গ্লাস নিয়ে গটগট করে পা ফেলে টেবিলের ওপর গ্লাস টা বেশ শব্দ করে রেখে মুরাদের সামনে এসে বসলো। মুরাদ বললো,
—- তুই কি বসেই থাকবি? এক কাজ কর বাথরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে সে অবদি আমি মুসুর মাথায় তেলটা দিয়ে নেই তারপর একসাথে খাবো।
—- নাহ তোর সাথে কথা আছে সেগুলো বলে নেই তুই তোর কাজ কর নো প্রবলেম৷ কানটা শুধু আমার দিকে রাখ। মুখে এটা বললেও মনে মনে বললো,
—- বাহ ভাইয়ের ভালোবাসার প্রশংসা না করে পারিনা। তেলও দিয়ে দিতে হয় বোনকে ? ছেলে হয়ে এসব কাজও করিস শালা।

মুরাদ মুসকানের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। চুলে বিলি কেটে কেটে খুব সুন্দর ভাবে তেল দিচ্ছে আর বলছে,
—- মুসু আরাম লাগছে?

মুসকান কেঁপে ওঠলো। কারন ইমন এক ধ্যানে তাঁর দিকে চেয়ে আছে মুরাদ তেল দেওয়ায় মনোযোগ দেওয়ায় খেয়াল করছে না। কিন্তু মুসকান ঠিকি আড় চোখে দেখেছে ইমন পায়ের ওপর পা তুলে বসে হাতে ফোন রেখেছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি স্থির রেখেছে তাঁর দিকেই। মুরাদ যখন মুসকান বলে ডাকলো আর মুসকান কেঁপে ওঠলো ইমন তখন কেমন করে এক যেনো হাসি দিলো। সে হাসি দেখে মুসকানের অস্বস্তি বেড়ে গেলো দ্বিগুণ। বসে থাকাও মষ্কিল হয়ে যাচ্ছে তাঁর। কোন রকমে হুম বললো সে৷

মুরাদ এবার ইমনকে বললো,
—- ঐ তুই সাইলেন্ট হয়ে আছিস কেনো? বল কি বলবি?

ইমন হালকা কেশে ওঠলো। বিরবির করে বললো,
—- বন্ধুর বোন বোন হয় না রে দোস্ত বন্ধুর বোন হলো হার্টবিট মাপার মেশিন।
—- কি বললি? জোরে বল।

ইমন আবারো কেশে ওঠলো। বললো,
—- বলছিলাম কাকি মার বয়স হয়েছে। একটামাএ ছেলে তুই তাঁর। বিয়ে সাদি করবি না নাকি? এবার তো বিয়েটা করাই উচিত।

মুরাদ তাকালো ইমনের দিকে। ইমন মুসুর থেকে চট করে চোখ সড়িয়ে নিয়ে মুরাদের দিকে চেয়ে বললো,
—- এদিকে কি যা করছিস মনোযোগ দিয়ে কর আর আমি যা বলি তাই শোন। আর মনে মনে বললো,
—- শালা একটু দেখতে আসছি আর তুই ডিস্টার্ব করছিস? বিরবির করে গালিও দিলো কয়টা। প্রিয় বন্ধু হঠাৎই যেনো ভীষণ অপ্রিয় হয়ে গেলো তাঁর। মনে হতে লাগলো তাঁর জীবনে অনেক বড়সড় ঝামেলা পাকাতে পারে এই মানুষ টা৷ ব্যারিষ্টারি চোখ জহুরি চোখ। চোখ দেখেই বুঝে যায় মানুষ টা কোন লেভেলের। তারওপর মুরাদ হলো তার সেই স্কুল জীবনের বেষ্ট ফ্রেন্ড তাঁর পুরো ব্যাক্তিত্ব বইয়ের মতো করে পড়া শেষ ইমনের।

মুরাদ চুরুনী দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো,
—- আমার মায়ের সমস্যা তোর মায়ের মতো জটিল না। তাঁর ছেলে,মেয়ে ভাতিজি,ভাসুর, জা সব আছে। তোর মায়ের টা আগে ভাব। সে তো একবারেই এতিম।
—- সেটাই তো বলছি তোর জন্য একটা ভালো পাএী যোগার করেই না আমার কথা ভাবতে পারবো। বেষ্ট ফ্রেন্ড কে রেখে বিয়ে করাটা কেমন দেখায় না?

ইমনের কথা শেষ হতে না হতেই মুসকান তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বললো,
—- হ্যাঁ বিয়ে করো বিয়ে তো করতেই হবে৷ যা বয়স আর কদিন পর তো চুলে পাকন ধরবে মানুষ মেয়ে দেবে কিনা সন্দেহ এখুনি করে নাও। আমার ভাইয়ের টা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তাছাড়া তোমার গার্লফ্রেন্ড রা বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করছে সে হিসেবে তুমি এখন এক বাচ্চার বাপই।

মুসকানের কথা শুনে মুরাদ কেশে ওঠলো। ফিসফিস করে বললো,
—- বোন মাফ যা, বোন চুপ যা৷

ইমন দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
—- ঐ কি বললি তুই? এই মুরাদ তোর বোন কি পাল্টাই নিছোস কোথাও থেকে? নাকে টিপি দিলে দুধ বের হবে সেই মেয়ে তড়তড় করে কথা বলে সাহস কতো? বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলে। হাটুর বয়সী মেয়েরা এখনো আমাকে প্রেমপএ পাঠায় তা কি তোরা জানিস না?
—- নাকে টিপি দিলে দুধ বের হয় বলেই তো আমি তোমাকে বুড়ো বলতে সাহস পাচ্ছি নানাভাই। আর যে মেয়েরা তোমায় প্রেমপএ পাঠায় ওদের চোখে রোগ আছে ঠিকঠাক চয়েজ করতে পারেনা।

মুরাদ হাসতে হাসতে শেষ। ইমন শাসানো গলায় বললো,
—- মুসু তুই কিন্তু বেশী বলছিস। আমার সম্পর্কে তোর ধারনা ভুল। তুই কিন্তু নিজেই শাক্ষী আমার নামে মাসে ঠিক কয়টা প্রেম পএ আসে।

মুসকানের রাগ যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়ায় চেঁচিয়ে বললো,
—- দাদাভাই ছাড়ো আমাকে এক সেকেন্ডও এখানে বসবো না আমি।
—- আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো এই তো শেষ বেনুনীটা করে দেই শান্ত হো মুসু মজা করছে। এমন রাগিস না শরীরে ক্ষতি হয়ে যাবে৷ এতো রাগতে নেই।

ইমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। তাঁর যে কি মন চাচ্ছে না নিজে বুঝছে না বোঝাতে পারছে তাই বললো,
—- দেখ মুরাদ কাল থেকেই তোর জন্য পাএী দেখা শুরু করবো।
—- তোর কি মাথায় ভূত চাপলো? নাকি কোন পাগল, ছাগলের কেস ছিলো আজ কোনটা বলতো।

ইমন ওঠে দাঁড়ালো জিগ্যেস করলো,
—- কি রান্না হয়েছে আজ? কাকি মা কোথায়?
—- এমন ছটফট করছিস কেনো? বোস এখানে মুসু খেতে দেবে আম্মার শরীর খারাপ ঘুমাই গেছে।

বেনুনী বেঁধে মুরাদ বললো,
—- মুসু যা আমার খাবার টা এখানেই দিয়ে যা। আর ইমনকে খেতে দে। হুদাই বিষয় নিয়ে রাগ দেখাস না তো৷ খেয়ে দেয়ে ঘুমা গিয়ে কাল ক্লাস আছে তো।

মুসকান কিছু বললো না চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মুরাদ ইমনকে বললো বাথরুম থেকে হাত,পা ধুয়ে আসতে৷ তাদের পুরো বাড়িতে দুটা বাথরুম একটা তারা ইউস করে আরেকটা তাঁর বড় কাকারা করে। ইমন বললো,
—- বিয়ে তো তোকে এবার করতেই হবে। বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পাশেই বাথরুম সেখানে গিয়ে হাত,পা ধুয়ে মুরাদের রুমে না গিয়ে মুসকানের রুমে গিয়ে তয়ালে খুঁজে বের করে হাত,পা, মুখ মুছে নিলো। তারপর বেরিয়ে এসে দেখলো মুসকান খাবার বেড়ে টেবিলে রেখে আরেক প্লেটে খাবার বাড়ছে।

ইমন গিয়ে পাশে দাঁড়ালো পকেটে এক হাত দিয়ে আরেকহাতে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করলো।
মুসকান চমকে ওঠলো ইমনকে দেখে এক ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বললো,
—- খেতে বসো।

ইমন মুসকানের দিকে চেয়েই চেয়ার টেনে বসলো। বললো,
—- না জানি এই বুড়ো লোকটার দায়িত্ব সারাজীবনের জন্য কাউকে নিতে হয়। বলেই চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। মুসকান কথার মানেটা বুঝলো না তবুও যেনো কেমন লাগলো তাঁর।

প্লেটে খাবার নিয়ে মুরাদকে দিয়ে আরেক বাটিতে মাছ ভাজি, আর মুরগির মাংসের তরকারি দিয়ে এলো। এসে দেখলো ইমন বসেই আছে। তাঁর মধ্যে কেমন ছটফট ছটফট ভাব। মুসকানের নিজেরও ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তবুও গিয়ে বসলো। বললো,

—- খাচ্ছো না কেনো?

ইমন চোখ মেলে তাকালো মুসকান চোখ সরিয়ে নিজের প্লেট সামনে নিয়ে তরকারি বেড়ে নিলো। তা দেখে ইমনও খেতে শুরু করলো। আর প্রশ্ন করলো,
—- মাছ নেই আর?
—- আছে।
—- তাহলে শুধু তরকারি দিয়ে খাবি কেনো? সত্যি করে বল তোর টা দিয়ে দিছিস?
—- না আমি মাছ খাইনা।
—- কেনো খাস না? ইমন জানে মুসকান কাটা দেখে খুব ভয় পায়৷ একবার গলায় কাটা ফুটে গেছিলো। তখন থেকেই মাছে তাঁর ভীষণ ভয়। কেউ বেছে না দিলে খেতেই পারেনা তবুও প্রশ্ন করলো।
—- জানিনা৷
—- বল?
—- ধ্যাত এতো প্রশ্ন করো কেনো? বলেই রেগে তাকাতেই ইমনের চাহনী দেখে চুপসে গেলো। কেমন জড়োসড়ো হয়ে বসে ভাত মাখতে শুরু করলো। ইমন বাঁকা হেসে বললো,
—- বেশ রাগতে পারিস এখন। শুনেছি খুব নাকি জেদীও হয়ে গেছিস?

মুসকান কিছু বললো না ওঠে দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো বাম হাতে রিমুট নিয়ে টিভি অন করলো। ইমনও প্লেট নিয়ে গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো এক হাতের ওপর প্লেট রেখে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। গা ঘেঁষে বসায় মুসকান খানিকটা সড়ে গিয়ে ওঠতে নিবে তখনি ইমন কঠোর গলায় বললো,
—- বেশী তিড়িং বিরিং করছিস তুই। খুব বেশী বড় মনে করছিস নিজেকে ব্যাপার না। এইসব ভাবের ধার আমি ধারিনা৷ চুপচাপ বসে খাবি আর যদি কথা না শুনিস আজ রাতে এখানেই আছি দেখিস কি করি।

মুসকান আগুন চোখে তাকালো ইমনের দিকে।

—- ওভাবে তাকাস কেনো? চোখ দিয়েই মেরে ফেলবি নাকি?

চোখ ফিরিয়ে নিলো মুসকান। পাশে থাকতে ভালোই লাগছে কিন্তু বুঝতে দিলো না। খুব, লজ্জা আর অস্বস্তি কাজ করছে তাঁর। হাত,পায়ে কেমন কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভিতর ডিপডিপ শব্দ টা যেনো ইমনও শুনে যাবে।

টিভিতে চোখ রেখে ভাত অল্প মুখে দিয়ে বসে আছে। কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছে না৷ ইমন মাছ বেছে বেছে মুসকানের প্লেটে দিচ্ছে আর নিজে খাচ্ছে। মুসকান সেদিকে খেয়াল না করে অল্প অল্প করে খেয়ে যাচ্ছে। যখন খেয়াল হলো চমকে তাকালো ইমনের দিকে। ইমনও তাকালো চোখে চোখ পড়তেই মুসকান চোখ সড়িয়ে নিলো। ইমন বললো,
—- তুই যখন ছোট ছিলি তখনও তো এভাবেই মাছ বেছে দিতাম ভুলে গেছিস? মুরাদের থেকে তো আমার কাছেই বেশী থাকতি। একসাথে খাওয়া,একসাথে গোসল করা সেসব আজ ভুলে বড়লোক হয়ে গেছিস না? বাড় লোকের বোন৷

ইমনের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলো মুসকান। তাঁর সে লজ্জা পাওয়া দেখে ইমন ওঠে দাঁড়ালো। ধমকে বললো,
—- ফাইজলামি কম করে করবি৷ এতো লজ্জা পেতে কে বলেছে তোকে? আমি বলছি? ফাজিল কোথাকার খাওয়াটাই নষ্ট করে দিলি। বলেই খুব রাগ নিয়ে টেবিলে প্লেট রেখে হাত ধূয়ে ফেললো।

মুসকানের চোখ দুটো টলমল করছে। ছোট থেকেই সে একটু ধমকও সহ্য করতে পারেনা। ইমন ভালো করেই জানে তবুও ধমকায়৷ ভালো লাগে না তাঁর। চোখের পানি টপটপ করে প্লেটে পড়তে লাগলো।

ইমন হাত ধুয়ে মুরাদের রুমে যেতে নিয়েও থেমে গেলো৷ নাক টানার শব্দ শুনে। ভ্রু কুঁচকে বাম দিকে তাকাতেই দেখলো মুসকানের চোখের জলে নাকের জলে একাকার অবস্থা। ট্রি টেবিলের ওপর ভাতের থালা রেখে মহারানী কান্নায় ব্যাস্ত।

—- হয়ে গেলো। আল্লাহ এই একটুতে এভাবে কাঁদার কি হলো? মুরাদ জানলে নিশ্চিত বাঁশ দেবে। দ্রুত পায়ে মুসকানের কাছে গিয়ে পাশে বসলো। চোখে পানি,কান্নার মৃদু শব্দ বুকের ভিতর কেমন তীরের মতো বিধলো তাঁর। কথা বলতে যেয়ে বুঝলো গলা কাঁপছে। কি অদ্ভুত কাঁদছে মুসকান আর বুকে ব্যাথা হচ্ছে তাঁর। ধরা গলায় বললো,
—- মুসু ছোটবেলায় শুধু তুই কাঁদতি আর আমরা কান্না থামাতাম৷ আর বড় বেলা তুই কাঁদিস আর সাথে অন্যজনকেও কাঁদাস কেনো মুসু?

মুসকান চুপ হয়ে গেলো কান্নামিশ্রিত চোখে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন অসহায় চোখ, মুখে চেয়ে বললো,
—- প্লিজ কাঁদিস না। এখানটায় কেমন ব্যাথা লাগে৷ (বুকের বাম পাশে দেখিয়ে)

মুসকান হা হয়ে গেলো ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো ইমনের অসহায় মুখের দিকে। এটা কি শুনছে সে তাঁর সামনে তাঁর নানাভাই রয়েছে নাকি অন্য কেউ। ভাবনায় ছেদ পড়লো যখন ইমন তাঁর হাতের আলতো পরশ দিলো। পরম যত্নে চোখের পানি মুছে দিচ্ছে ইমন৷ মুসকান যেনো একদম স্থির হয়ে গেছে। পুরো শরীর তাঁর আবারো অবশ হয়ে আসছে। এদিকে ইমনের হাতও কাঁপছে খুব তবুও চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুুস্বরে বললো,’সরি মুসু’ তারপর মুসকানের বাম হাত উপরে ওঠিয়ে হাতের পিঠে আলতো করে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো আর বললো,’সেদিনের জন্যও আমি খুব সরি মুসু আমার ভবিষ্যৎ যদি আমি জানতাম তাহলে ঐদিন ঐ ভুলটা আমি করতাম না’।

অসম্ভব পরিমাণে কাঁপতে শুরু করেছে মুসকান। মাথাটাও কেমন ঘুরছে তাঁর। যেখানে ইমন এতো স্ট্রং পার্সোনালিটির একজন মানুষ, প্রাপ্ত বয়স্ক একজন পুরুষ হয়ে বাচ্চা মেয়েটার কাছাকাছি এলেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে সেখানে মুসকানের এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। মুসকানের অমন অবস্থা দেখে ইমন দ্রুত সরে গেলো। চোখে মুখে ভীষণ অস্থিরতা তাঁর নিঃশ্বাস হয়ে গেলো খুব এলোমেলো। তবুও মুসকান কে শান্ত করার জন্য নরম কন্ঠে বললো,

—- এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো? দেখ সরে গেছি শান্ত হো প্লিজ। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
— এই দেখ চলে যাচ্ছি আরে দেখ তাকা চলে যাচ্ছিতো বাবা। ধ্যাত দেখ চলেই গেলাম আমি। বলতে বলতেই দ্রুত মুরাদের রুমে ঢুকে গেলো।

এমন ভয়ংকর অনুভূতির মাঝেও হেসে ফেললো মুসকান। সে ভাবতেও পারছে না এতোক্ষণ তাঁর সামনে ইমন ছিলো। আগের সেই মানুষ টার সাথে যেনো রাত দিন তফাৎ।

দুজনই দুজনকে নতুনভাবে চিনছে,দেখছে আর নতুন ভাবে বুঝছে। তাঁদের এই বুঝাবুঝির শেষ টা কোথায় আছে জানা নেই কারো। কিছু সময়, কিছু মূহুর্ত কিছু অনুভূতি যেনো হঠাৎ করেই এসে যায়। কিন্তু এই সময়,মূহুর্ত আর অনুভূতি ক্ষনস্থায়ী না দীর্ঘস্থায়ী তা নির্ভর করে সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর।

চলবে।
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন৷ ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here