হৃদমাঝারে পর্ব -০৫

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
( ৫)

ভোর রাতের বৃষ্টিটা খুব আরামদায়ক। অলসতা ভালোভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। সবার মতো শুভ্রতাও বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছে। কিন্ত মসজিদে ইতিমধ্যে নামাজের ঢাক পড়ে গেছে। কিন্ত শুভ্রতার ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই। হঠ্যাৎ হাতে কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে হালকা কেঁপে উঠলো। নড়েচড়ে আবারও শুতে গেলে এবার হালকা ধাক্কা অনুভব করে। ঘুমটা পাতলা হয়ে এলো। কানে মেঘের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
‘শুভ্র! এই শুভ্র ওঠো!’
মেঘের কন্ঠে শুভ্র ডাকটা কেমন নেশালো ঠেকলো শুভ্রতার কাছে। না চাইতেও পিটপিট করে তাকালো। রুমে এখলো ড্রিমলাইট জ্বালানো। শুভ্রতা ছোট ছোট চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে ‘শুভ্র!’ নামের অর্থ বুঝার চেষ্ট করলো। কিন্ত বরাবরের মতো সে ব্যর্থ এই লোকটা বুঝতে।
‘এই উঠো। আজান দিয়েছে। নামাজ পড়!’ মেঘের কথায় শুভ্রতা এবার আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে বসে। মেঘ তা দেখে আলমারি থেকে টুপি নিতে নিতে বলে,,’আমি মসজিদে যাচ্ছি। তুমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে ঘুমাও। দরজা লাগিয়ে দিও আমার কাছে চাবি আছে।’
শুভ্রতা বসে বসে ঝিমুচ্ছে। কিন্ত একটু আলসেমি করলে আর নামাজ হবে না তাই ছটফট উঠে দাঁড়াল।

নামাজ পড়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। মনের মধ্যে কেমন যেনো আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে। সে বরাবরই এইরকম সঙ্গী চেয়েছে যে তাকে নামাজের তাগিদ দেবে। কিন্ত সে প্রথম মানুষটাকে ভূল নির্বাচন করেছিলো। প্রথম মানুষটার চেয়েও মেঘ উত্তম। শুভ্রতার মনে একটা কথা ভেসে উঠে,,’আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। আল্লাহ যে কেড়ে নেয় তার চেয়েও হাজারগুন উত্তম ফিরিয়ে দেয়!’ কিন্ত তাও কোথাও যেনো শূন্যতা কাজ করছে শুভ্রতার মাঝে। মেঘ তার বর্তমান,ভবিষ্যৎ সেটা শুভ্রতা ভালোভাবেই জানে। কিন্ত তাও মেঘের সাথে সহজ হতে পারছে না। নাকি চেষ্টাই করছে না। শুভ্রতা আর কিছু ভাবলো না। দূর আকাশের পাণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
শুভ্রতা মোটামুটি নাস্তা বানাতে জানে। তাই কিচেনের দিকে অগ্রসর হলো। মেঘ এখনো ফিরে নি। কিচেনে গিয়ে শুভ্রতা তেমন কিছুই ফেলো না। কাল মেঘ শুধু দাল,ডাল,মাছ এনেছিলো। আর কিছুই আনে নি। শুভ্রতা সারা রান্নাঘর খুঁজে শুধু চা পাতা,দুধ,চিনি পেয়েছে। আর উপায় না পেয়ে চায়ের পানিই বসিয়ে দিলো। আর কি লাগবে তা দেখতে লাগলো। শুভ্রতা সবসময় বাসার কাজে হেল্প করতো। যার জন্য মোটামুটি একটা আইডিয়া আছে। জোর করে বিয়ে দিয়েছে বলে যে না খেয়ে থাকবে এইরকম বোকামি শুভ্রতা করবে না। তাই যতটুক সম্ভব গুছিয়ে নিবে।

চা বানানো শেষ করে শুভ্রতা দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু চা খালি পেটে খেলে পেটে ব্যাথা করবে। কিন্ত ঘরে বিস্কিট বা অন্য কিছুই নেই। শুভ্রতার মাথা গরম হয়ে গেলো। কি বেয়াক্কেলে লোক। নিজে না খেলে নাই বা খাবে। ঘরে তো অন্য একটা মানুষ আছে। তার কি ক্ষিধে লাগে না নাকি। ওই ব্যাটা না হয় রোবট কিন্ত শুভ্রতা! সে তো মানুষ! দাঁত কিড়মিড় করে শুভ্রতা রুমের দিকে চলে গেলো।
_______________
বাসায় এসে শুভ্রতাকে রুমে বসে থাকতে দেখে মেঘ শুভ্রতার কাছে গেলো। মাথা থেকে টুপি রাখতে রাখতে বলে,,’ঘুম শেষ? বসে আছে যে?’
‘বসে থাকবো না কি অলিম্পিকে দৌড় দিবো? আপনি কি বাজার করেছেন কালকে? চাল,ডাল এগুলো কি এমনি এমনি খাওয়া যায়? এই আপনি না চাকরি করেন? এতো কিপ্টেমি করেন কেন? পুরো ঢাকা শহরে বিস্কিট, চানাচুর ছিলো না? চালের বস্তা,ডালের বস্তাই ছিলো?’ শুভ্রতা বেশ ঝাঁঝাল গলায় বসে।
‘বউ আমার ভীষণ শুকনো যাতে তাজা হয়ে উঠে তার জন্য শুধু চাল,ডাল এনেছি। সকাল,বিকাল এগুলো খাবে আর মোটা হবে!’ মেঘ হালকা রসিকতার সুরে বলে।
শুভ্রতা মেঘের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। দ্রুত পায়ে খাট থেকে নেমে মেঘের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলে,,’এই আপনি আমার সাথে মশকরা করছেন? আমার সাথে আপনার মশকরার সম্পর্ক?’
‘আমার সাথে তোমার কিসের রিলেশন সেটা দেখাতে গেলে ভালো লাগবে না তোমার!’ মেঘ শুভ্রতার দিকে দুপা এগিয়ে কানের কাছে বলে। মেঘের কথার ইঙ্গিতে শুভ্রতা ছিটকে সরে যায়। ইনিবিনিয়ে বলে,,’ক্ষিধে পেয়েছে আমার। শুধু চা খেতে পারবো না।’
‘চলো আমি নাস্তা এনেছি বাইরে থেকে। আমি জানি তুমি বাইরের রুটি,পরটা খেতে পারো না। আজকের দিনটা মেনেজ করো কাল থেকে বাসায় বানিয়ে খেও!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা মাথা নেড়ে হাটা দেয়। কিন্ত দু’পা এগিয়ে পেছন ফিরে সন্দিহান গলায় বলে,,’আপনি কি করে জানলেন আমি বাইরের খাবার খেতে পারি না?’
‘আমার বউ আমি জানবো না তো কে জানবে?’
মেঘের কথার বিপরীতে শুভ্রতা কিছু বললো না। এই লোকের পেটে বোম ফাটালেও কথা বের হবে না। একে খুঁচিয়ে লাভ নেই। শুভ্রতা খেতে চলে যায়।

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। একমনে কি যেনো ভাবছে। মেঘ একটু আগেই অফিস চলে গেছে। এখন পুরো বাসায় শুভ্রতা একা। অনেকক্ষণ ফোন ক্রল করেছিলো কিন্ত আর ভালো লাগছে না। হঠ্যাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গে শুভ্রতার। ফোন হাতে নিয়ে দেখে রুহির কল। শুভ্রতা ছট জলদি ফোন রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে রুহির আওয়াজ ভেসে আসে,,’কিরে শুভ্রা? কি অবস্থা? জামাই পাই এই অবলা বইরে ভুইলা গেলি?’
শুভ্রতা রুহির কথায় হেসে বলে,,’ভুলবো কেনো? তোরে ভুলা যায়?’
‘হইছে ফাম দিস না। কি অবস্থা? কি করিস?’
‘এইতো ভালো? দাঁড়াই আছি। তোর কি খবর?’
রুহি বেশ মন খারাপ করে,,’তোরে অনেক মিস করি শুভ্রা! আমি একা হয়ে গেছি। তুই তো আমাদের ফ্যামিলি জানিসই। মন খুলে কিছু করবো তাও সম্ভব না। তুই থাকতে কিছটা একাকিত্ব কাটতো?’
রুহির মন খারাপ বুঝে শুভ্রতা হেসে বলে,,’তুইও বিয়ে করে নেহ!’
রুহি শুভ্রতার কথায় হালকা ঢং করে বলে,,’যাহ আমার লজ্জা করে।’ শুভ্রতা হেসে উঠে। এভাবে অনেকক্ষণ দু’বোন কথা বলে হালকা হয়।
রুহির ফোন রাখতেই শুভ্রতার ফোন আবার বেজে উঠে। শুভ্রতা রুহির ফোন ভেবে না দেখে রিসিভ করে বলে,,’কিরে আবার কি হলো?’
‘আমি মেঘ!’ হঠ্যাৎ মেঘের গলা শুনে শুভ্রতা কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখলো আসলেই মেঘের নাম্বার। শুভ্রতা নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,’ওহ সরি। একটু আগে রুহিপু কল দিয়েছিলো। আমি ভেবেছি ওই।’
‘ইটস ওকে। আমি যেটার জন্য কল দিয়েছিলাম। একটু পরে বুয়া আসবে। যা যা প্রয়োজন করিয়ে নিও। আর আজাইরা বসে না থেকে বাসায় প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট বানাও!’
মেঘের কথায় শুভ্রতা হালকা রেগে বলে,,’কি আমি আজাইরা?’
‘এনি ডাউট?’ মেঘের কথায় শুভ্রতা রেগে ধুম করে ফোন কেটে দিলো। ফোন কাটের কয়েক সেকেন্ড পরে টিং করে মেসেজ ভেসে উঠে,,”আজাইরা।’ শুভ্রতা রিপিট রিপ্লাই দিলো না। ফোন খাটে ছুড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর মেঘের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো।
_________________
দুপুরে শুভ্রতা একাই খেয়ে নিয়েছে। কারণ মেঘের অফিসে ইমারজেন্সি পড়ায় সে আসতে পারে নি। খেয়ে আবারও ঘুম দেয়। আসরের নামাজ পড়ে আবারও শুয়ে থাকে। শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে গেছে যেনো। কিছু করার নেই আর। আট’টার দিকে কলিংবেলের শব্দে শুভ্রতা ছুটে যায়। যেনো মেঘেরই প্রতিক্ষায় ছিলো। দরজা খুলে দেখে মেঘ হাস্যজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে। না চাইতেও শুভ্রতার মুখে হাসি ফুটে উঠে। মেঘ বাসায় ডুকতে ডুকতে বলে,,’আজকের দিন কেমন গেলো?’
শুভ্রতা শুকনো মুখে বলে,,’জঘন্য। ‘
মেঘ টেবিলের উপর কয়েকটা প্যাকেট রেখে বলে,,’তাও ভালো। আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’ কথাটা বলে মেঘ দাঁড়ায় না। পা চালিয়ে রুমে যায়। শুভ্রতা টেবিলে থাকা প্যাকেট গুলোর দিকে এগিয়ে যায়। প্যাকেট খুলে দেখে তিনটে কোন আইসক্রিম আর দুটো বেলী ফুলের মালা। মুহুর্তেই শুভ্রতার সারাদিনের অবসাদ কেটে যায়। শুভ্রতা মালা দুটো নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়। তারপর আপনমনে বলে,,’লোকটা কি ম্যাজিক জানে? আমার ভালো লাগা খারাপ লাগা এতো নিখুঁত ভাবে কিভাবে জানে?’ শুভ্রতার মনে মেঘের প্রতি ভালো লাগা ছড়িয়ে গেলো। মেঘ কি তা জানে?

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here