হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব -১০+১১

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১০]

সিদাত তরীদের বৈঠকঘরে বসেছে। চারপাশে কতক্ষণ চোখ বুলালো। ঘর মোটামুটি সাধারণভাবেই গোছানো। সাথে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ পাচ্ছে সিদাত। আতরের ঘ্রাণ। কিন্তু এ ঘরে আতর কে দিবে? হয়তো-বা রুম স্প্রে’র ঘ্রাণ। টিভিটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ টিভি দেখতে আগ্রহী না। এজন্যই তো ওটা অবহেলায় পরে আছে।

সিদাতের ভেতরটা তবুও অস্থির লাগছে। একজন বন্ধু অসুস্থ হলে মানুষ যেমন উদ্বিগ্ন হয়, তেমনই উদ্বিগ্ন সিদাতও। তার বারবার ইচ্ছে করছে তরীর কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু মেয়েটা যে ব্যতিক্রমধর্মী। সিদাত একদম-ই চায় না নিকাব রাণীর পর্দা ভঙ্গ হোক। থাকুক না আড়ালে, আবডালে। সিদাতের তাতে কোনো অভিযোগ নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যে অধরে বিনয়ী হাসি ফুটিয়ে ফুপি আসলো। হাতে তার চা এবং বিস্কুট। চায়ের ট্রে-টা সিদাতের সামনের টি-টেবিলে রেখে সিদাতের মুখোমুখি বসলো ফুপি। সিদাত কন্ঠ কিছু নমনীয় করে বললো,
–“এসবের কী প্রয়োজন ছিলো আন্টি?”

ফুপি হাসলো। সাবিয়া সিদাতের ব্যাপারে বলেছে। সিদাত নাকি এমপির ছোটো ছেলে। অথচ তার ব্যবহার, কাজ দেখো। কী সুন্দর। বাবার বিগড়ে যাওয়া ছেলের কাতারে সিদাতকে সে কিছুতেই ফেলতে পারছে না৷ বরং ফুপি ভীষণ সন্তুষ্ট সিদাতের উপর। ফুপি হাসি বজায় রেখে বললো,

–“তুমি যেই উপকার করেছো তাতে এটুকু আপ্যায়ন তো করতেই পারি তাই না?”

সিদাত কিছু বললো না। চুপ করে বসে রইলো। কথা বলতে কেমন আড়ষ্ট অনুভব হচ্ছে। সিদাত বললো,
–“এটা প্রতিবেশি হিসেবে আমার কর্তব্যের মধ্যে পরে আন্টি। প্লিজ এভাবে বলে বারবার লজ্জা দিবেন না।”

–“আচ্ছা, তা না দিলাম। কিন্তু তুমি তো এমপি সাহেবের ছেলে। তুমি পাশের ফ্ল্যাটে কী করছো?”

সিদাত কিছুটা দমে গেলে পরমুহূর্তে হেসে বললো,
–“বন্ধুর বাসা আন্টি। রাতে এখানেই ছিলাম!”

ফুপি এবার সব বুঝতে পারলো। সিদাত চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতেই ফুপি বিনয়ী কন্ঠে বললো,
–“এমপি সাহেব আর যাই করুক, তার ছেলেদের সুন্দর শিক্ষা দিয়েছে।”

সিদাত চায়ে চুমুক দিয়ে চাইলো ফুপির দিকে। ফুপির কথার পিঠে শুধু মুচকি হাসি দিলো। কোথাও নিজের জন্যে বাবা-মায়ের প্রসংশা পাওয়াটা সত্যি-ই হৃদয়ে শান্তি বয়ে আনে। সিদাতও এই মুহূর্তে সেই শান্তি অনুভব করলো। চা শেষ করে আলতো কন্ঠে বললো,
–“আন্টি… আপনার ভাইঝি..?”

–“খাবার এবং ওষুধ খাইয়েছি। এখন ঘুমোচ্ছে।”

সিদাত আড়ালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ফুপির সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে সিদাত বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। ফুপি সিদাতের আন্তরিকতায় বরাবরই মুগ্ধ। আজ তরীর উছিলায় এই চমৎকার চরিত্রের ছেলেটাকে স্ব-চক্ষে দেখতে পেয়ে ভেতরটা প্রফুল্লতায় ভরে যাচ্ছে।

সাবিয়া এতক্ষণ দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখলো এবং শুনলো। সিদাতের মিষ্টিভাষী কথাবার্তায় সাবিয়া ভীষণ চমকে গেছে। সেদিন সিদাতকে নিয়ে যা ধারণা ছিলো, আজ তো তা একদমই বদলে গেলো। বড়োলোকের ছেলেরাও বুঝি এতটা নম্র, ভদ্র হয়? তাহলে সেদিনের মাতাল হওয়ার ঘটনা কী?

বিকাল অবধি ঝড়-বৃষ্টি চললো। আছরের পর থেকে মেঘলা আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। বৃষ্টিতে নিমজ্জিত শহর আবার নতুন করে ব্যস্ত জীবনে ফিরছে। বৃষ্টির পরে সারা শহরে অদ্ভুত, স্নিগ্ধ একটা গন্ধ ছড়িয়েছে। কিন্তু আফসোস, বেশিরভাগ যান্ত্রিক মানবের নাকে সেই গন্ধ নাকে লাগছে না। সিদাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বুজে সেই ঘ্রাণ নিলো। ক্ষণে ক্ষণে খুব লম্বা নিঃশ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করলো। হাত দুটো ব্যস্ত সিদাতের শার্টের বোতাম লাগাতে। অফিসের জন্যে রেডি হচ্ছে সিদাত। বোতাম লাগাতে লাগাতে ভেতরে এসে চুল ঠিক করে কালো ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

তালা লাগাতে লাগাতে তরীর কথা ভাবলো সিদাত। তালা লাগিয়ে তরীর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলো। কিছু একটা ভবতে ব্যস্ত সে। কিছু একটা জানতে চাচ্ছে। হয়তো-বা তরী কেমন আছে তা জানতে চাইছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সদর দরজায় নক করে তাদের বিরক্ত করতে চাইছে না। তার ওপর অফিসেও যেতে হবে। তাড়া আছে। এজন্য সিদাত দরজায় চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আপনমনে আওড়ালো,
–“সুস্থ হয়ে যাও নিকাব রাণী!”

——————–
বিকালের দিকে তরীর জ্বর কিছুটা কমেছে। গা জুড়ে ঘাম দিয়েছে। জ্বরটা নেমে গেলেও মাথা প্রচন্ড ভার, খাবারে অরুচি, ঠান্ডায় গলা খুঁশখুঁশ করে। তাতেও বিশেষ সুস্থ লাগছে না তরীকে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে চোখ জোড়া অবশ, হালকা লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে ভাঁজ পরেছে। সাথে ডার্ক সার্কেল তো আছেই। মুখটাও শুকিয়ে ছোটো হয়ে গিয়েছে। বড়ো বোনের এমন অবস্থা দেখে সাবিয়ার চোখ জোড়া বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাবিয়া নিজেকে সামলে নিচ্ছে। যতটা পারছে বোনের সেবা করছে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। তরী শোয়া থেকে উঠে বসেছে।

পিটপিট করে সাবিয়ার দৌড়াদৌড়ি নীরবে দেখলো সে। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। জ্বরে কাবু হয়ে নিজেকে রোগী করে ফেলেছে সে। তরী তাও বহু কষ্টে সাবিয়াকে ডাকলো। ডাকতে গিয়ে বুঝলো গলায় বিদঘুটে খশখশ করছে যেন। গলার স্বরটাও কেমন বদলে গিয়েছে। তরীর নিজের কন্ঠ চিনতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও পরমুহূর্তে বুঝলো এটা তারই গলা।

তরীর ডাক শুনে সাবিয়া ছুটে এলো বোনের কাছে। হাতের উলটোপিঠে তরীর গাল, গলা, কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা চেক করতে করতে বললো,
–“বলো আপু!”

তরী ঘোলা চোখে বোনের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আবারও ভাঙা গলায় বললো,
–“এত ছুটতে হবে না। তোর পড়াশোনা আছে। পড়তে বস।”

তরী পুরো কথা শেষ করার আগেই সাবিয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“আমার কাছে তোমার সুস্থতা আগে জরুরি আপু। পড়ালেখার জন্যে সময় পরে আছে প্রচুর।”

তরী আর কিছু বললো না। পিছের বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো! সাবিয়াও আর কিছু বললো না। চলে গেলো ফুপিকে সাহায্য করতে। কতটুকুনি বোন তরীর। অথচ সে ব্যস্ত পায়ে বোনের জন্যে ছোটাছুটি করছে। ফুপিকে সাহায্য করছে। বোনটা তরীর ভীষণ আদরের। নীরবে কিছুক্ষণ সেভাবেই চুপ করে বসে থাকলেও পরমুহূর্তে কী ভাবে চোখ বুজেই বালিশের নিচে হাতড়ালো। হাতের নাগালে কিছু না পাওয়ায় চোখ মেলে চাইলো। আবার খুঁজতে গিয়ে খামটা আঙুলে লাগলো। তরী তখনই খামটা বের করে নিলো। আবার উলটে পালটে দেখে বুঝলো সকালে যা দেখেছে তা ভুল দেখেনি। আসলেই এই চিঠিটা তার জন্যে।

খাম থেকে চিঠিটা নিয়ে দেখলো পুরো পেজ খালি। তরী ভীষণ চমকালো। এটা কী হলো? শুধু মাঝে একটা লাইন লেখা। তাও ছোটো করে। তরী তার ঝাপসা চোখ ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে ভালোভাবে চোখ বুলালো লেখাটাতে। সেখানে লেখা,
–“নিকাব রাণী, আমার নীরব বন্ধু হবে তো?”

তরী হতভম্ভ। এইটুকু একটা লেখার জন্যে এত আয়োজনেএ কী আছে তরী বুঝলো না। অবাকের রেশও কাটলো না। বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ কার!

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১১]

সিদাত অফিসে আসতেই দেখলো এখনকার জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর জারা বসে আছে। যার ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি শর্ট ফিল্ম এবং নাটক বেরিয়েছে। কিছু সপ্তাহ আগে এক টপিকে দারুণ ভাইরালও হয়েছে জারা। সিদাতকে দেখতেই জারা উঠে দাঁড়ালো। মুখে তার অমায়িক হাসি। সিদাত কাঁধে থাকা ব্যাগের হাতল ধরে এগিয়ে এলো জারার কাছে। যেহেতু সিদাতকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে সেহেতু সিদাতের সাথেই জারা কথা বলতে আগ্রহী। সিদাত সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,
–“আরেহ, জারা আহসান! কী মনে করে? কোনো শো-এর গেস্ট হয়েছেন নাকি?”

জারা স্মিত হেসে বললো,
–“তা বলতে পারো। মিস রাজিয়ার কুইজ শো-তে গেস্ট হিসেবে এসেছি। তবে তার চাইতেও বড়ো কারণ হচ্ছে তুমি!”

সিদাত কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। তাও হেসে বললো,
–“আমি কী করে কারণ হলাম?”

জারা এবার মুখে একটু অভিমানী ভাব ফুটিয়ে বললো,
–“আমাকে না বলে সেদিন পার্টি ছেড়ে চলে এলে কেন? জানো, কতটা হার্ট হয়েছি? আমার বার্থডে পার্টি ছিলো। তুমি ছিলে স্পেশাল গেস্ট। আপ্যায়ন করার আগেই দেখি তুমি নেই। এটা কী ঠিক হলো?”

সিদাত অত্যন্ত দুঃখিত গলায় বললো,
–“সো স্যরি! সেদিন কিছু ইন্সিডেন্ট ঘটে গিয়েছিলো এজন্যে আপনাকে না বলেই চলে আসতে হয়েছিলো। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”

সিদাতের মুখে “স্যরি” শুনতে পেয়ে জারার মুখ জুড়ে অমায়িক হাসি ফুটে ওঠে। সিদাত জারার দিকে না তাকিয়ে এদিক সেদিক এলোমেলো নজর ফেলছে। জারা সিদাতের সাথে আরও কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করে চলে গেলো। সহজে যেত না, কিন্তু শো-এর সময় প্রায় হয়ে আসায় তাকে মেকাপ রুমে যেতে হবে।

জারা যেতেই সিদাত চেপে রাখা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে সিদাত তার ডেস্কে চলে গেলো। সিদাত বসতেই তার কলিগ রাতুল হেসে হেসে বললো,
–“জারা আহসানের দেখছি বেশ ইন্টারেস্ট তোমাকে নিয়ে!”

সিদাত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তাতে চুমুক দিয়ে বললো,
–“আমার তো মনে হয় না!”

রাতুল আজকের স্ক্রিপ্টের ফাইল সিদাতের সামনে রেখে মুচকি হেসে বললো,
–“জারার বার্থডেতে যেতে তোমাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছিলো। নিজে এসে ইনভাইট করেছে। আবার পার্টিতে তুমি কোনো কারণে মিসিং হওয়াতেও কিছুটা অস্থির ছিলো। তাহলে এগুলার মানে কী আর-জে সিদাত?”

সিদাত আড়চোখে রাতুলের দিকে চেয়ে পরমুহূর্তে স্ক্রিপ্টে নজর বুলিয়ে বললো,
–“এজ এ ফ্রেন্ড, এগুলা ন্যাচারাল। তোমার এসব না ভাবলেও চলবে রাতুল। তুমি এডিটিং-এ ফোকাস করো!”
রাতুল এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
–“তা তো দিবোই। তবে সিদাত, পারলে মেয়েদের সাথে একটু চিপকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলিও। আজকালকার মেয়েরা তিন আঙুল দূরে থাকা কোনো ছেলের সাথে ছবি তুলে না।”

সিদাত এ-কথায় হাসতে বাধ্য হলো। রাতুলও হাসতে হাসতে তার ডেস্কে চলে গেলো। রাতুল চলে গেলে সিদাত স্ক্রিপ্টের ফাইলে চোখ বুলালো। হঠাৎ মস্তিষ্কে নাড়া দিলো তরীর ব্যাপারটা। সিদাত ফোস করে নিঃশ্বাস ফেললো। পরমুহূর্তে কী ভেবে সিদাত আপনমনে হেসে দিলো। মিনমিন করে বললো,
–“অভদ্র মেয়ের সংকট থাকলে এই দুনিয়া চলতো না রাতুল। এখনো কিছু ভদ্র মেয়ে আছে, যারা বাসে নিজের পাশের সিটেও পরপুরুষ সহ্য করতে পারে না! চেহারা তো কখনোই দেখায় না!”

সিদাত তার শো শেষ করে বেরিয়ে আসতেই দেখলো সাইফ দাঁড়িয়ে। চুল এলোমেলো, মুখটাও কেমন শুকনো! সিদার অপ্রস্তুত হলো। উৎকন্ঠা হয়ে বললো,
–“কী ব্যাপার ভাইয়া? আজ হঠাৎ অফিসে এসে হাজির?”

মুহূর্তে-ই সাইফের মুখখানা লাল হয়ে গেলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
–“অনুগ্রহপূর্বক আপনার ফোনটা চেক করুন ছোটো ভাইয়া!”

সিদাত বেশ স্বাভাবিক ভাবেই পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো সাইফের প্রায় তেরোটা মিসড কল। সিদাত ফোন আবার পকেটে পুরে বললো,
–“শো-তে থাকলে আমার ফোন সাইলেন্ট থাকে ভাইয়া। জানো না?”

সাইফ জানলেও আজ একটু আবেগী হয়েছিলো। সিদাতকে কলে না পেয়েই মূলত সিদাতের অফিসে চলে এসেছে। এসে জানতে পারে সিদাতের শো চলছে। সিদাত ভ্রু কুচকে বললো,
–“কী লাগবে বলো?”

–“তোর ছুটি। আয় আমার সাথে। দুঃখবিলাস করবো!”

সাইফ লম্বা লম্বা পা ফেলে যেতে থাকে। সিদাতের ব্যাগটা সাইফের হাতে। এর মানে সাইফ নিজ দায়িত্বেই সিদাতের সব গুছিয়ে দিয়েছে। সিদাত সাইফের পেছনে যেতে যেতে বললো,
–“আমার তো কোনো দুঃখ নেই ভাইয়া। আমি দুঃখবিলাস করে কী করবো?”

সাইফ কোনো উত্তর দিলো না। শুধু ঠোঁট কামড়ে রাখলো। ভাইয়ের রসিকতা সে ঠিকই ধরতে পেরেছে।

সিদাত বাইরে এসে সাইফের হাতে গাড়ির চাবিটা দিতে চাইলো। কিন্তু সাইফ সিদাতকে অগ্রাহ্য করে ফন্ট সিটে গিয়ে বসলো। সিদাত কিছু না বলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। পাশে চাইতেই দেখলো সাইফ চোখ বুজে সিটে মাথা এলিয়ে রেখেছে। সিদাতের একটু খারাপ লাগলো। গত দু’দিন সাইফের গাড়ি সিদাতের কাছেই ছিলো। নির্ঘাত সাইফের চলা-ফেরায় খুব সমশা হয়েছে? সিদাত ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গত বছরেই সিদাত ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে। এজন্যে বাইক এবং গাড়ি দুটোই নির্ভয়ে চালাতে পারে সে।

সিদাত ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিয়ে বললো,
–“এত অস্থিরতার কারণ কী ভাইয়া?”

সাইফ সরাসরি উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করেই রইলো। সিদাতও সাইফকে সময় দিলো। সাইফ হঠাৎ সটান মেরে বসে বেশ আফসোসের সুরে বললো,
–“দুনিয়াতে এমন কোনো মেয়ে নেই যে আমার মতো ফ্রেশ? কেন বারবার নিরাশ হচ্ছি বল তো?”

সিদাত সাইফের কথা শুনে বললো,
–“সবেমাত্র মেয়ে দেখা হলো তিনটা। তুমিএত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? বিয়ে করার জন্যে এত উতলা?”

সিদাতের শেষ কথা শুনে সাইফ কিছুক্ষণ থমকে বললো,
–“ক..কই? না-তো! একদমই তাড়া নেই বিয়ের!”

–“তাহলে ব্যস্ত হওয়ারও দরকার নেই। উপরওয়ালা যাকে তোমার জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছে তাকেই পাবা!”

সাইফ গালে হাত দিয়ে বললো,
–“সেই নির্ধারিত নারী যে কবে আসবে জীবনে।”

সিদাত একগাল হাসলো। সাইফ দুই মিনিট নীরবতা পালন করে তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে আলাপ শুরু করে দিলো। সাইফ তার পরিবারের কাছে যতই বাচ্চামো করুক না কেন বাহিরের জগতে সে অত্যন্ত কঠোর থাকার চেষ্টা করে। ভালোবাসা একমাত্র তার পরিবারের জন্যেই নির্ধারিত। বাহিরের মানুষ এই নরম ভালোবাসার মূল্য কখনোই দিবে না। কারণ, নরম মানুষের ওপরই শক্ত আঘাত বেশি হয়!

তরী পরেরদিন-ই ভার্সিটি যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগলো। ফুপি এবং সাবিয়া অসংখ্যবার তাকে বারণ করেছে। কিন্তু তরীর যাওয়াটা জরুরি। ফুপি কেঁদে দিবে ভাব। একা মেয়ে মানুষ, জ্বর এখনো সারেনি। তার ওপর এই জ্বরে মেয়েটার শরীর ভেঙে গিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করে না। একদিনেই কী সুস্থ হওয়া যায়? ফুপি পরেছে মহা মুশকিলে।

ফুপির মুখ-জুড়ে কাঁদো কাঁদো ভাব থাকলেও সাবিয়ার চোখের কোণ চিকচিক করছে অশ্রুতে। তরী মুখ গোমড়া করে তাদের অবস্থা দেখেও না দেখার ভান করছে। তরীর ভাষ্যমতে, রোগমুক্ত হতে হলে পরিশ্রম করতে হবে, বাহিরের আলো-বাতাস না পেলে শরীর সুস্থ হবে কী করে? কিন্তু এসব কেউ কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না।

তরীও নিরুপায়। আজ চারুকলা বিভাগে সুন্দর প্রতিযোগিতা আছে। তরী তাদের রঙিন, সুন্দর ছবি দেখার জন্যে ব্যাকুল, তৃষ্ণার্ত। গত দুই বছরে একবারও এই প্রতিযোগিতা মিস করেনি। এবার জ্বরের কাছে হার মেনে কিছুতেই প্রতিযোগিতা মিস দিতে চায় না। তাই শত কষ্ট হলেও চোখ এবং মনের শান্তির জন্যে হলেও তাকে যেতেই হবে।

তরী আসল সত্যটা সাবিয়া বা ফুপিকে খোলাশা করে বলেনি। শুধু এটুকুই বলেছে যাওয়াটা অত্যন্তি জরুরি। তরী তৈরি হয়ে সদর দরজা খুলে বেরুলো। তরীর পিছু পিছু সাবিয়া এবং ফুপিও এসেছে। তরী কোনো দিকে না তাকিয়ে দুই সিঁড়ি নামতেই মনে হলো তার পাশ কাটিয়ে কেউ একজন উঠছে। হঠাৎ পুরুষালি নরম কন্ঠ কানে আসতেই তরী থমকে দাঁড়ালো। কেউ যেন চাপা স্বরে ডাকলো,
–“নিকাব রাণী!”

তরী চট করে পিছে ফিরে তাকালো। পুরুষ অবয়বের মুখপানে চাইতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। ফুপি সিদাতকে দেখে বেশ আকুল গলায় বললো,
–“অবস্থা দেখো বাবা। মেয়েটার জ্বর এখনো সারেনি। তাও কী না এই অবস্থায় দেড় ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে ভার্সিটি যাবে। এসবের কোনো মানে হয় বলো তো? কত করে বললাম শুনলোই না!”

তরীর চিন্তায় অস্থির হয়ে ফুপি কাকে কী বললো বুঝতে-ই পারলো না। যেন সে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছে। অথবা সিদাতকে বেশি আপন ভেবে ফেলেছে। সিদাতের সামনে ফুপির মুখে এসব কথা শুনে তরী লজ্জায় জর্জরিত হয়ে পরলো। জড়তায় মাথা নিচু হয়ে গেলো তার। পরপুরুষের সামনে ফুপি তাকে নিয়ে এভাবে অভিযোগ করছে। তরীর ভেতরটা কেমন গুলিয়ে আসছে। এই কারণে তরী আর ভার্সিটিতে যাওয়ার সাহস করলো না। ফুপির এই ধরণের কথাবার্তায় সিদাতের পালটা কোনো কথা তরী হজম করতে পারবে না। অথচ সিদাত কিছুই বললো না। নীরবে চেয়ে রইলো তরীর দিকে। আপাতত তার মন জানতে চাইছে তরীর সুস্থতার ব্যাপারে। তরীর শরীর কেমন জানার জন্যে সিদাতের রাতে ঠিকমতো ঘুমও হয়নি। এজন্যে তরীর উপস্থিতির মাধ্যমেই সে তরীর সুস্থতা/অসুস্থতা পরিমাপ করতে ব্যাকুল হয়ে পরেছিলো।

তরী বিনা-বাক্যে ধপাধপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। খুব দ্রুত। যেন সিদাতের সামনে দাঁড়ানোটাই অসম্ভব ব্যাপার।

তরীকে ভেতরে আসতে দেখে ফুপি এবং সাবিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, মত বদলিয়েছে তাহলে। ফুপি মুচকি হেসে সিদাতকে বিদায় দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। সিদাত সেখানেই কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা ভ্রু কুচকালো। এতক্ষণে মস্তিষ্কে নাড়া দেয় ফুপির বলা কথাগুলো। এই অসুস্থতা দিয়ে ভার্সিটি যাওয়ার তো এত তাড়া থাকার তো কথা না। এছাড়াও সিদাতের যতটুকু মনে পরে, আজ সরকারি ছুটি। তাহলে তরীর তাড়া কিসে বুঝলো না। যাওয়ার জন্যে জেদ করলো আবার মিনিটের মধ্যে মতও পালটে গেলো? অদ্ভুত তো!

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here