হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব -০৮+৯

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৮]

তরী স্বভাবসুলভ নীরব, শান্ত, চুপচাপ। নীরব থাকতে থাকতে এখন এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মুখে বলা দরকার কথাগুলোও নিজের মধ্যে আওড়ায়। যার ফলে অপর পাশের মানুষটি তাকে নানান উপাধী দেয়। স্বল্পভাষী, ভাবওয়ালী, অহংকারী, চুপচাপ, ভদ্র অথবা কথা বলা নিয়ে কিপ্টেমি। তবে ইতিবাচকের চাইতে নেতিবাচক মন্তব্য-ই বেশি পায়।

এতে আগে মন খারাপ হলেও এখন সেরকম খারাপ লাগে না। সয়ে গেছে। তরীর এই স্বভাবের কারণে আজ পর্যন্ত তার কোনো বন্ধু জুটেনি। সঙ্গে বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা, কোনো বন্ধু বানানোর প্রয়োজন নেই।

এজন্যে মাদ্রাসা পড়াকালীন একজন বান্ধুবী হলেও কলেজ জীবনের পরপর ভার্সিটি জীবনে এসেও বন্ধু জুটেনি। তরী-ই স্বভাবগত কারণেই মিশেনি। তরী কাউকে নিজের স্বভাবের পায়নি বিধায় বন্ধুত্ব করেনি।

যেখানে তরী মেয়ে বন্ধুই তার জীবনে রাখলো না, সেখানে একজন ছেলে এসে তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। তাও, যে কী না মাঝরাতে তারই বাসায় মাতাল অবস্থায় পরেছিলো। দুঃসাহসিক কাজ। তরী প্রতিবারের মতো এবারও নিজ মনে আওড়ালো,
–“অসম্ভব, কখনোই না!”

তরী সিদাতকে এড়িয়ে ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলো। এদিকে সিদাত নাছোড়বান্দা। তরীর সাথে বন্ধুত্ব করার ভূত মাথায় ভালোভাবেই চেপেছে। সে শান্ত হয়ে বসবে না। এজন্য তরীর পিছু সেও চললো। বাস স্টেশন অবধি তরীর পিছেই এলো। তরী বাসে উঠে গিয়ে বসলো এক মহিলার পাশে।

সিদাতও বাসে উঠে তরীর পাশের সিটে বসলো। তাদের মাঝে মানুষজনের চলাচলের দূরত্ব রয়েছে। তরী বেশ বিরক্ত হলো। বিরক্তির সাথে আওড়ালো,
–“পিছু নিচ্ছেন কেন?”

সিদাত নির্বাক স্বরে বললো,
–“তুমি আমার নীরব বন্ধু তাই!”

তরী ভারী অবাক হলো। সে কখন রাজি হলো? তরী অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“কখন হলাম?”
–“যখন নীরবে চলে এলে। জানো না, নীরবতা সম্মতির লক্ষণ?”

তরী আশ্চর্য চোখে তাকালো সিদাতের দিকে। সে এখন কী বলবে বুঝতে পারলো না। নিজের মধ্যে কতক্ষণ কথা গুছিয়ে খুবই নিচু গলায় বললো,
–“আমি নীরবে চলে এসেছি মানে আপনাকে এড়িয়ে চলছি!”

–“কিন্তু নীরবতার আরেক সংজ্ঞাও আছে। আজ নাহয় আমি সেটাকেই গ্রহণ করলাম!”

তরীর ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে গেলো। বললো,
–“এখন “না” করছি। দয়া করে আমার পিছু করবেন না!”

সিদাত তরীর কথায় কান না দিয়ে আশেপাশে তাকালো। এরপর তর্জনী আঙুল সকলের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
–“এর মানে কী বাসে বসা সবাই তোমার পিছু নিচ্ছে? বাসে বসার অধিকার তাহলে কারো নেই?”

তরী বিরক্তির সাথে নিঃশ্বাস ফেললো। কথা যেন সিদাতের জিভের ডগায় ঝুলে থাকে। বলতে সময় নেয় না। এতটা পটু। এজন্য-ই তো এই ছেলে আর-জে। এদের পটরপটর করার অভিজ্ঞতা ভালো হয়। তবে তরী সাজানো-গোছানো কথা বলতে সবসময়য়-ই অপটু। এজন্যে চুপ থাকলো। কিছু বললে যদি আবার উলটো পালটা যুক্তি দাঁড় করায় তখন সমস্যা। তর্কটাও যে তরী ভালো করে করতে জানে না।

সিদাত নীরব তরীর দিকে নীরবে চেয়ে রইলো। আর তরী দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালায় স্থির করলো। বাস চলছে তার আপন গতিতে। কন্ডাক্টর এলো ভাড়া তুলতে। তরী চুপচাপ নিজের ভাড়া দিয়ে দিলো। সিদাতও তাই করলো। সে মোটেও জোরাজুরি করলো না তরীর ভাড়া নিয়ে। কন্ডাক্টর পেছনে চলে গেলে সিদাত চোখ-মুখে দুষ্টুমি ভাব ফুটিয়ে বললো,
–“তোমার ভাড়া দেইনি বলে আমাকে কিপ্টে লাগছে তরী?”

তরী চমকে তাকালো সিদাতের দিকে। ভ্রু কুচকে খানিকটা বিরক্তির সাথে-ই বললো,
–“আমার এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় নেই!”

সিদাত হাসলো। সে জানে তরী আসলেই এসব নিয়ে ভাবেনি। কিন্তু ওইযে, তরী সবসময় তাকে ভুল-ই বুঝে। এজন্যে এবার সবটা পরিষ্কার করতে হবে। সিদাত বললো,
–“আমি তোমার বিরক্তির কারণ হতে চাইনি। কারণ ভাড়া দিলে অন্যান্য মেয়েরা খুশি হলেও তুমি খুব বিরক্ত হতে। কারণ তুমি হচ্ছো ব্যতিক্রম৷ ব্যতিক্রমধর্মীদের জন্যে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা মঙ্গল!”

তরীর বলতে ইচ্ছে করলো,
–“এমনিতেই তো কম বিরক্ত করছেন না।”

সিদাত আর কোনো কথা বললো না। আধঘন্টা যাবৎ জ্যাম। সিদাত ঘেমে-নেয়ে একাকার। বারবার রুমাল দিয়ে গাল, কপাল, গলা মুছে নিচ্ছে। একপ্রকার হা-হুতাশ অবস্থা তার। তরীর দিকে তাকালেও তার গরম লাগছে। উপরওয়ালা মেয়েদের অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়েছেন। তারা পর্দার মাঝেও কী সুন্দর গরম সহ্য করে নেয়। আর ছেলেরা খালি গায়ে থাকলেও তাদের গরমের জ্বালা-পোড়া কমে না।

সিদাতের উজ্জ্বল-শ্যাম মুখখানা লাল হয়ে গিয়েছে গরমে। বাইকে থাকলে চিপা-গলি দিয়ে জ্যাম কাটানো যায়। কিন্তু এখন যে বাজে অবস্থা। তরী আড়চোখে সিদাতকে পরখ করে আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সিদাত হঠাৎ তৃষ্ণার্ত হয়ে বললো,
–“পানি হবে? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে!”

তরী “না” করতে পারলো না। না করলে ভারী অন্যায় হয়ে যাবে। কাউকে তৃষ্ণার্ত রেখে তরী শান্তিতে বসতে পারবে না। এজন্য বিনা-বাক্যে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে সিদাতের দিকে এগিয়ে দিলো। সিদাত সেই বোতল নিয়ে কয়েক ঢোঁক পানি খেলো। এর মাঝেই জ্যাম ছুটে গেলো। সিদাত পানির বোতলটা তরীকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
–“ধন্যবাদ।”

তরী কিছু বললো না। পরমুহূর্তে-ই সিদাত আবার বললো,
–“তোমার বাবা-মা উমরাহ-তে গিয়েছে। তাদের অনুপস্থিতিতে একজন বন্ধু হিসেবে তোমাকে প্রটেক্ট করার দায়িত্ব অবশ্যই আমার! এজন্যই তোমার সঙ্গে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি!”

তরী চোখ কপালে তুলে সিদাতের দিকে চাইলো। সিদাত হাসলো। তরী হা করে চেয়ে আছে সিদাতের দিকে। তার ঘরের খবর এই লোকের কানে গেলো কী করে? পরিচয় তো বেশি দিনের নয়। তরী দুই মিনিটের জন্যে অবাক হলেও পরে স্বাভাবিক থাকলো। জানতেও পারে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাদের ভবনের সকলেই জানে দো’তলার মাদ্রাসার শিক্ষক উমরাহ-তে গিয়েছে।

তরী নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
–“আমার কোনো প্রটেকশনের দরকার নেই।আপনি আমার বন্ধুও নন, আমি মানিনি!”

সিদাত তরীর দিকে একপলক চেয়ে বলে,
–“আপাতত আমি মানলেই চলবে। তুমি নাহয় একটু দেরী করেই বন্ধু হিসেবে মেনে নিও!”

———————
অনয় সিদাতের দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে বললো,
–“তুই ভাবলি কী করে এই ধরণের মেয়ে তোকে বন্ধু করবে? ওরা পরপুরুষের সাথে একদমই মিশে না।”

সিদাত চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
–“কী জানি দোস্ত, আমার মন মানছে না। একটা অদৃশ্য আগ্রহ কাজ করে তরীর সাথে কথা বলতে। ওর সঙ্গ আমার পছন্দ!”

অনয় প্রথমে সন্দিহান নজরে তাকালো সিদাতের দিকে। অতঃপর বিদ্রুপ করে বললো,
–“মন মানছে না মানেই মন খাচা থেকে বেরিয়েছে। বন্ধু, তুমি ফেঁসে গেছো!”

সিদাত গরম চোখে অনয়ের দিকে চেয়ে সরাসরি অস্বীকার করলো। বললো,
–“আরেকবার এই কথা বললে তোকে ব্রীজ থেকে ফেলে দেবো ব’দমাইশ!”

প্রতিদিনের মতো মাকে খুশি রাখতে সিদাত আজকের পুরো ঘটনা মাকে শোনালো। সিদাতের মা জয়াও খুব আগ্রহ সহকারে সব শুনলো। সিদাত খেয়াল করে, যখন সে তরীকে নিয়ে বলতে শুরু করে তখন জয়ার কোনো দিকে খেয়াল থাকে না। তার চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে।

যেন তার ভেতরকার চাপা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চায়। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু সে বারবার ব্যর্থ হয়। সিদাত অবশ্য মায়ের খুশি দেখতেই মাকে তরীর গল্প শোনায়, তরীর সাথে কথা বলতে যায়, বন্ধুত্ব করতে চায়।

এসব মাকে খুশি করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। যদি কোনোভাবে ম্যাজিকের মতো করে আগের মা তার কাছে ফিরে আসে? সেই আধো আলো কে নিয়ে সিদাত যে রোজ স্বপ্ন দেখে।

—————-
তরী এবং সাবিয়া একসাথে বাবা-মায়ের সাথে গল্প করছে। গল্প করা শেষে ফুপি ডাক দিলে দুজনই খেতে চলে যায়। তরী জোর করে ফুপিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলে,
–“অনেক কাজ করেছো। এবার তুমি বসো, আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি!”

ফুপি অমত প্রকাশ করে বললো,
–“আরেহ। এটা হয় নাকি? দে আমাকে। তুই বস!”
তরী অবাধ্য হয়ে বললো,
–“একদম না ফুপি। আমাকে করতে দাও না!”

শেষমেষ ফুপি দমে গেলো। মুগ্ধ হয়ে দেখলো কিছুক্ষণ তরীকে। পরমুহূর্তে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইশ, আজ তার ছেলেটা বেঁচে থাকলে তরী তার ছেলের বউ থাকতো। এরপর রোজ খুনশুটি চলতো তাদের মাঝে। কিন্তু হায় আফসোস, উপরওয়ালার ইচ্ছে যে অন্য কিছুই ছিলো!

তরী ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। এরপর ঘুম থেকে উঠলো সাতটার দিকে। আড়মোড়া ভেঙে বাহিরে আসলে দেখলো আকাশ মেঘলা, খুব স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। শো শো করে শীতল হাওয়া বইছে। হঠাৎ তরীর আবহাওয়া বিলাসের অদম্য ইচ্ছে জাগলো। এজন্য তরী তার ইচ্ছেকে আর দমিয়ে রাখেনি।

ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বেরোতেই দেখতে পেলো একটা চিঠি। তরীর ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে গেলো। নানান চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সে চিঠিটা কুড়িয়ে নিলো। চিঠির খামটা উলটে পালটে দেখতে গেলে দেখলো তার নাম লেখা। “Dear Toory”.

তরীর কুচকানো ভ্রু আরও কুচকে গেলো। হঠাৎ দমকা বাতাস সিঁড়ির থাই গ্লাসে এসে লাগলো। এতে অদ্ভুত শব্দ হলো। তরীর সেই শব্দে ধ্যান ভাঙলো। সে চিঠিটা হাতে নিয়েই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। যে করেই হোক, বড়ো ঝড় হওয়ার আগে ছাদে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে।

ছাদে গিয়ে তরীর সর্বাঙ্গ জুড়ে ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেলো। তরীর ভীষণ ভালো লাগলো। পশ্চিমের দিকে আকাশ খুব কালো হয়ে আছে। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের মাঝ দিয়ে হালকা-পাতলা ঝিলিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এর মানে ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি হবে। আজ আর তার এবং সাবিয়ার মাদ্রাসা, ভার্সিটিতে যাওয়া লাগবে না। কিছুক্ষণ একা একাই ঘুরে বেড়ালো তরী।

চিঠিটা খুলতে চেয়েছিলো, কিন্তু যা বাতাস। একটু অসাবধান হলেই চিঠি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। যা তরী আপাতত চাইছে না। যখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তার গায়ে এসে পরলো তখন তরী ছাদের দরজার দিকে এগোলো।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামলো। তরী হাঁটা ছেড়ে ছুটে দরজার দিকে চলে গেলো। ভেতরে এসে আগে চিঠিটা পরখ করে নিলো। সেরকম ভিঁজেনি। তবে একটু শুকাতে হবে। এর মধ্যে তরী অনুভব করলো তার নাক কেমন সুড়সুড় করছে। তরী ভালোই বুঝতে পারলো এটা কিসের ইঙ্গিত।

সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। সেরকম না ভিঁজলেও মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পরেছে। এজন্যেই নাকটা এমন করছে। অসময়ের বৃষ্টি তরীকে ভালোই নাস্তানাবুদ করে। এজন্যে তরীর মা কখনোই তাকে বৃষ্টিতে ভিঁজতে দেয়নি।

©লাবিবা ওয়াহিদ#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [০৯]

তরীর আজ গা কাঁপিয়ে তীব্র জ্বর উঠেছে। বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পরলেই তরী অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। একে তো তরীর জ্বর তার ওপর বাহিরে ভীষণ ঝড়। সাবিয়াও মাদ্রাসা যায়নি। এদিকে তরীর এত জ্বর অথচ ওষুধ আনতে ফার্মেসী যাওয়াও হচ্ছে না। ফুপির দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পরেছে। কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছে না।

দুর্ভাগ্যবশত আজ-ই নাপা এক্সটিনের পাতা সম্পূর্ণ খালি। নয়তো জরুরি, দরকার হতে পারে এই ভেবে আকবর সাহেব সবসময় ঘরে নাপা, নাপা এক্সটিনের পাতা এনে রাখতেন। এখন তো আকবর সাহেব নেই৷ এজন্য ওষুধ বিষয়ক ঘাটাঘাটিও কেউ করে না। তবে এখন ওষুধ ছাড়াও চলছে না। ফুপি বারবার ছোটাছুটি করছে। সে ফার্মেসী চিনে না, ঝড় বৃষ্টি দিয়ে খোঁজাও সম্ভব না। ঘরেও পুরুষ মানুষ নেই, যে ছুটে গিয়ে ওষুধ এনে দিবে।

সাবিয়া বোনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে নামাজে দাঁড়িয়েছে। সাবিয়া যখন খুব বেশি ভয় পেয়ে যায় অথবা বেশি বিপদে পরে তখন নামাজ পড়া তার অভ্যাস। তরী জ্বরের ঘোরে বিড়বিড়ালো,
–“সাবিয়া, তুই ঠিকাছিস তো? এই ঝড়-বৃষ্টি দিয়ে মাদ্রাসায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রাস্তা-ঘাটে রিকশা, গাড়ি কিছুই পাবি না। ঘরে থাক, আমি হুজুরকে কল করে জানিয়ে দিবো।”

এখন বেলা বারোটা বাজে। তীক্ষ্ণ রোদে পুরো শহর চকচক করে, সেই সময়টায় সন্ধ্যার ক্ষীণ আঁধারী অবস্থা। যেন এখনই সন্ধ্যা নামবে। এতটাই ঝড় হচ্ছে। অথচ টিভি ছাড়লে আবহাওয়া খবর শুনলে বুঝবে দক্ষিণ দিকে ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়েছে। এজন্যে দেশের সব জায়গায় কম-বেশি এরকম ঝড়-বৃষ্টি চলছে।

ফুপি একপ্রকার অশান্ত হয়ে বসা ছেড়ে উঠে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসলে চলবে না। পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটার থেকে সাহায্য চাইতে হবে। সে-ই নাহয় এনে দিবে ওষুধ!”

তরীর কানে ফুপির কথাগুলো ভালোভাবেই প্রবেশ করলো। অবচেতন মস্তিষ্কে সিদাতের চেহারা ভেসে উঠলো। ফুপিকে বারণ করে দিতে চাইলো। মিনমিনিয়ে বললো,
–“না, ফুপি। প্রয়োজন নেই। তুমি যেও না। আমি ঠিক আছি!”

আফসোস, ফুপি তার কথা শুনতে পেলো না। সে আগেই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো। তরীর হঠাৎ গা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। জোরে চার-পাঁচবার হাঁভি দিয়ে ওঠলো। সাবিয়া সালাম ফিরিয়ে জলদি বোনের কাছে এলো। তরীর কপালে, গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা চেক করতে করতে বললো,
–“খারাপ লাগছে আপু? কেমন লাগছে আমাকে বলো!”

তরী বহু কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বললো। সাবিয়া তার কান তরীর কাছে আনলো। তরী আটকে গলায় বললো,
–“খুব শীত করছে!”

সাবিয়া সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ঘরে গিয়ে আলমারি খুললো। আলমারি থেকে দুটো মোটা কম্বল টেনে আনলো তাদের ঘরে। অতঃপর সেগুলো তরীর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে থার্মোমিটার আনলো। এতক্ষণ খেয়ালে আসেনি থার্মোমিটারের কথা।

থার্মোমিটার এনে সেটা তরীর মুখে দিয়ে রাখলো। ওদিকে ফুপি ব্যস্ত হয়ে অনয়ের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কাচ্ছে। সিদাত হাই তুলতে তুলতে দরজার দিকে এগুচ্ছে। চোখ জোড়ায় এখনো ঘুম লেপ্টে আছে৷ অনয় সেই সকালেই অফিস চলে গেছে।

সিদাত সকাল সকাল তরীর জন্যে চিঠি লিখে সেটা তাদের ঘরের সামনে রেখে কতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো তরীর জন্যে। যখন টের পায় তরীদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলেছে তখন সিদাত দরজা আলতো ফাঁক করে দেখতে পায় তরী তার লেখা চিঠিটা কুড়িয়ে নিচ্ছে। দরজা আগেই খুলে রেখেছিলো বিধায় তরী দরজা খোলার শব্দ পায়নি। তরীকে দেখে সিদাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভেবেছিলো, যাক ঠিক মানুষের হাতেই চিঠিটা পরেছে। এরপর খুব সাবধানে দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গিয়েছে। অনয় তখনো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলো।

সিদাত দরজা খুলতেই তরীর ফুপিকে দেখতে পেলো। তবে তাকে সিদাত চিনতে পারেনি৷ ঘুমটাকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক গলায় বললো,
–“জি, কিছু দরকার?”

ফুপি দ্রুত করে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। অতঃপর ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“আমি পাশের ফ্ল্যাট থেকে এসেছি বাবা। আমার বড়ো মেয়েটা খুব অসুস্থ। জ্বরে কাবু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় বাসায় ওষুধ-পত্র নেই। ফার্মেসী থেকেও যে আনবো সেই পরিস্থিতিও নেই। তুমি একটু সাহায্য করো বাবা।”

ফুপির কথা শুনে সিদাতের ঘুম উবে গেছে। সিদাত চোখ কপালে তুলে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“সে কী! এমন হলো কী করে? দাঁড়ান, আমি দেখি বাসাতে ওষুধ আছে কী না!”

বলেই সিদাত উলটোদিক ফিরে লম্বা লম্বা কদম ফেলে ভেতরে চলে গেলো। ফুপির কথা শুনে সিদাতের বুঝতে বাকি নেই তার নিকাব রাণী-ই কঠিন জ্বরে কাবু। এজন্যে ভেতর থেকে চাপা অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা কাজ করছে। কপালে ভাঁজ পরেছে নিজের অজান্তেই। সিদাত তন্ন-তন্ন করে ওষুধের বক্স খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। সিদাতের খুব রাগ হলো অনয়ের উপর। কোনো রকমে রাগ সামলে আবার দরজার সামনে আসলো। ফুপি এখনো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সিদাতের মনে পরলো, সে তো এই বড়ো মানুষটাকে ভেতরে এসে বসতে বললো না। নিজের বোকামীতে নিজেই বিরক্ত এবং লজ্জিত হলো।

ফুপির উদ্দেশ্যে খুবই ম্লান গলায় বললো,
–“দুঃখিত আপনাকে ভেতরে আসতে বলিনি। আপনি এক কাজ করুন, ওনাকে কিছু খাওয়ান আগে। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি!”

এতক্ষণে যেন আশার আলো দেখতে পেলেন ফুপি। তার এখানে আসার সিদ্ধান্তটা বিফলে যায়নি। ফুপি শুকনো হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“সমস্যা নেই। তুমি ওষুধটা তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো বাবা। দুঃখিত, তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি!”

সিদাত সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে কন্ঠস্বর কিছুটা উঁচিয়ে বললো,
–“আরে নাহ। এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না আন্টি। আমরা আমরাই!”

ফুপি চলে গেলেন। ফুপি যেতেই সিদাত ভেতরে এসে অনয়কে কল লাগালো। কিন্তু এই মুহূর্তে এসে অনয়ের ফোন বন্ধ। সিদাত রাগে, ক্ষোভে নিজের অজান্তেই অনয়কে কঠিন গা*লি দিয়ে বসলো। এরপর মিনমিন করে বললো,
–“শালা! দরকারের সময় এরে পাওয়া যায় না!”

সিদাত উপায় না পেয়ে গায়ে রেইনকোর্টটা জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। কাছাকাছি এক ফার্মেসীতে গেলো ওষুধ আনতে। বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে ফার্মেসীর শাটার অর্ধেক নামিয়ে রাখা হয়েছে। সিদাত জ্বর, ঠান্ডার মেডিসিন নিয়ে আবার ফিরে এলো। অনয় এই রেইনকোর্টটা ঘরে রেখে ভালো একটা কাজ করেছে। ছাতা টানার ঝামেলা পোহাতে হলো না।

সিদাত বিষণ্ণ চিত্তে ওষুধের প্যাকেটটা নিয়ে তরীদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে সকালেও সুস্থ-সবল দেখেছিলো। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এমন কী হলো যে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পরে গেলো? বাই এনি চান্স, বৃষ্টিতে ভিঁজেছিলো? সিদাত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা নক করলো। দরজা খুলে দিলো ছোটো, অল্প বয়সী একটা মেয়ে। সাবিয়া সিদাতকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সে হয়তো ভেবেছিলো সিদাত নয়, অনয় থাকবে। কিন্তু এ যে দেখছি সিদাত। দ্বিতীয়বারের মতো তাদের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে আজ স্ব-জ্ঞানে।

সাবিয়াকে দেখে সিদাত অনুমান করলো, এটাই তরীর ছোটো বোন। তাই তার দিকেই ওষুধের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“ওষুধের পেছনে লেখা আছে, কোনটা কয় বেলা খেতে হবে।”

সাবিয়া মাথা নিচু করে ওষুধের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বললো,
–“ঠিকাছে। ধন্যবাদ।”

সাবিয়া দরজা লাগিয়ে দিবে, এমন পর্যায়ে সিদাত প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“তরী এখন কেমন আছে?”

সাবিয়া ভারী অবাক হলো সিদাতের মুখে তরীর নাম শুনে। সে নিজের বিস্ময় চেপে বললো,
–“সেরকম ভালো না। তাপমাত্রা ১০২ ডিগ্রী! দোয়ায় রাখবেন আপুকে।”

সিদাত চোখে-মুখে বেদনা ফুটিয়ে আপনমনেই বিড়বিড়ালো,
–“ফি-আমানিল্লাহ্। নিকাব রাণী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও!”

সাবিয়া দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেলো। সিদাত কিছুক্ষণ সেভাবেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। অতঃপর অনয়ের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রেইনকোর্টটা প্রথমে খুললো। রেইনকোর্ট চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির পানি পরছে। সিদাত রেইনকোর্ট খুলে অনয়ের ফ্ল্যাটের তালা খুলতেই যাবে ওমনি ফুপি দরজা খুলে বললো,
–“সাবিয়া বুঝি মুখের ওপর দরজা লাগিয়েছে? ওর কাজে আমি সত্যি লজ্জিত। তুমি ভেতরে এসো, চা খেয়ে যাও! এত কষ্ট করলে!”

সিদাত পিছে ফিরে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বললো,
–“আরে না, না। এত ব্যস্ততার প্রয়োজন নেই। আপনি রোগীর খেয়াল রাখুন!”

ফুপি শুকনো হেসে বললো,
–“তুমি আসো তো। আমার ভালো লাগবে। “না” করো না, অনুরোধ।”

সিদাত অনুরোধ ফেলতে পারলো না। বললো,
–“ঠিকাছে।”

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here