হৃদয় এনেছি ভেজা পর্ব -১৭+১৮+১৯

#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১৭]

দিয়া তার বাবা-মায়ের সঙ্গে নীরবে বসে আছে। নাজমুল সাহেব এতে বিচলিত হয়ে পরলেন। বললেন,
–“দু’দিন যাবৎ কথা বলছিস না, কী করলাম আমরা? এভাবে বাবা-মায়ের সাথে রাগ করলে চলে?”

দিয়া মুখ তুলে চাইলো না। সেভাবেই বসে রইলো। মিনমিন গলায় বললো,
–“আমি যখন বলেছিলাম বিয়ে করবো না তখন তুমি আমার মত ছাড়া-ই কেন আরেক জায়গায় বিয়ের কথা দিয়ে দিলে? তুমি যেদিন এই অকাজ করেছো সেদিন-ই আমি সাইফকে আমার মনের কথা জানাতে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে শুনি এই কাজ করেছো। কথা বলার মতো অবস্থায় রেখেছিলে বাবা?”

নাজমুল সাহেব মুখটাকে ঘুঁচে বললো,
–“আমি আসলে ভাবিনি এমপির মতো লোক আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজের ছেলের জন্যে প্রস্তাব নিয়ে আসবে।”
–“সবাইকে এক দাড়িপাল্লায় মাপা ঠিক নয় বাবা। প্রস্তাব না আনলেও আমি এখন বিয়ে করতাম না!”

পাশ থেকে দিয়ার মা বললো,
–“থাক, এখন এত চিন্তা করতে হবে না। পাত্রপক্ষকে তোর বাবা না করে দিয়েছে।”

দিয়া তাতেও খুশি হলো না। বললো,
–“এখন তো আবার ওরা ভাববে বড়োলোক পেয়ে টাকার লোভে পরে বিয়েতে না করে দিয়েছি। এই অপবাদ আমি কিছুতেই শুনতে পারবো না বাবা!”

দিয়া চোখ তুলে তাকাতেই নাজমুল সাহেব খুব চমকে ওঠলো। দিয়ার চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। নাজমুল তৎক্ষনাৎ মেয়েকে বুকে টেনে বললো,
–“এই বোকা। কাঁদিস কেন? এরকম কিছুই হয়নি। আমি তাদের থেকে সময় নিবো বলেছিলাম। সরাসরি হ্যাঁ তো বলিনি৷ তাছাড়া আমার মেয়ের খুশি সবার আগে। তুই আমাদের কথা কত ভাবিস, আর আমরা তোর কথা ভাববো না? এতই পাষাণ লাগে তোর বাবাকে?”
দিয়ার মা নীরবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এই মেয়ে তাদের বড়োই আদরের, বড়োই সাধনার।

————–
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। বিয়ের সকল প্রকার আয়োজনের ভার সিদাত এবং সাঈদ সাহেবের ম্যানেজারের ঘাড়ে গিয়ে পরেছে। সিদাত তার অফিস সামলে যতটুকু পারে ততটুকু করছে। এর মাঝে মাকে সিদাত এবং সাইফ দুজন মিলেমিশে দেখাশোনা করছে। মেহমানদের তালিকাসহ নানান কাজে সাঈদ সাহেবও হাত লাগাচ্ছে। বিয়ে হবে আরও দশ দিন বাদেই। তাড়াহুড়োর মূল কারণ সিদাতের মা জয়া। সে অতি দ্রুত বউ দেখতে চায়। যখন শুনেছে বিয়ে আরও দুই – তিন মাস পরে হবে তখন তার নিঃশ্বাস বেড়ে যায়। সে আবারও অসুস্থ হয়ে পরলেন। সাঈদ সাহেব তখনই বুঝলেন তার স্ত্রী কী চাইছে। সঙ্গে বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন। স্ত্রীর কথা না বলতে পারার যন্ত্রণাটা সে একটু হলেও অনুভব করে।

দিয়া তার কাজিন বোনেদের সাথে বসে আছে। আজ গায়ে হলুদ। মোটামুটি অল্প করে সাজগোছ করে বসে আছে সে। তার বোনেরা, আত্নীয়’রা তো বিশ্বাস-ই করতে পারছে না এমপির বড়ো ছেলের সাথে দিয়ার বিয়ে হচ্ছে৷ তারা ভীষণ খুশি। দিয়াকে হাসি-মুখে বহু দোয়া দিচ্ছে। তবে সুযোগ বুঝে তাদের আবদারও জানাচ্ছে। তাদের সুবিধার জন্যে বেশ কিছু অভিযোগও করছে, যাতে দিয়ার শ্বশুরবাড়ির তরফ থেকে তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে দেওয়া হয়। দিয়ার বাবা-মাও নরম মনের মানুষ। তারা হাসি-মুখে সেসব গিলছে। কিন্তু দিয়া শুধু তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। খারাপ সময়ে যারা পাশে থাকেনি তারা বোধহয় আবদারের ঝুলি নিয়ে বসেছে। কিছু কিছু স্বজন তো তাদের মেয়েকে সাইফের ছোটো ভাই অর্থাৎ সিদাতের সাথেও লাগাতে চাইছে।

দিয়ার কয়েক জন বোন সিদাতের নাম্বার চেয়েছিলো। দিয়ার কাছে এমনিতেও নেই। তাই সে সোজা-সাপটা বলে দিয়েছিলো, “নেই।”
এতেই একেকজনের খোঁচানো শুরু। ঠাট্টা মশকরা, এমনকি দিয়াকে হিংসুটে বলতেও ছাড়ছে না তারা।
–“কী রে দিয়া? তুই দেবরের সাথে সেটিং করিয়ে দিতে ভয় পাচ্ছিস নাকি?”
–“ভয় পাবে না? ওর ভাগে যদি আমরা বসে যাই?”
–“আরে না। দিয়া লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়। আচ্ছা, দেবরের নাম্বার দিতেও বুঝি লজ্জা পেতে হয়?”
–“থাক সমস্যা নেই। বিয়ের দিন আমরা নিজেরাই চেয়ে নিবো!”

কথাগুলো দিয়ার এতটা তিক্ত লাগছে বলার মতো নয়। কোনো-রকমে হলুদের অনুষ্ঠান গেলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সাইফের কল এলো। দিয়া সাইফের কল দেখে কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে ছিলো। তার কেমন যেন লাগছে কল রিসিভ করতে। দিয়া আশেপাশে তাকালো। তার বোনেদের অনেকেই তার ঘরজুড়ে বিচরণ করছে। কেউ কেউ ঘুমোচ্ছে আবার কেউ ফোন দেখছে। দিয়া মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। রিসিভ করতেই সাইফ খুবই নরম গলায় বললো,
–“ব্যস্ত ছিলে?”

দিয়া ম্লান গলায় বললো,
–“সেরকম না। বলুন!”
–“কী বলবো? বলবে তো তুমি? এতকিছু লুকিয়ে রেখেছো, যা জানতে পেট মোঁচড়ায়!”
–“তাহলে বিয়ে কী সব জানার জন্যে করছেন? এরকম হলে এখনই “না” করে দিন। আমি বিয়ে না করেও থাকতে পারবো।”

সাইফ শুয়েই ছিলো। দিয়ার এহেম কথা শুনে সাইফ শোয়া থেকে উঠে বসলো বিস্ময়ে। থতমত খেয়ে বললো,
–“আমি তো শুধু আমার আগ্রহ জানিয়েছি। আর তুমি কী না বিয়ে ভাঙার দিকে চলে গেলে! ভয়ানক চরিত্রের মেয়ে মানুষ তো তুমি!”
–“আমি এমনই! আমি কোনো জানার বস্তু হয়ে নয়, স্ত্রী হয়ে আপনার বাড়িতে পদার্পণ করতে চাই। যদি সম্পর্কে ভালোবাসা এবং সম্মান-ই না থাকে তাহলে এই সম্পর্ক জুড়ে কী লাভ? এজন্য আগে-ভাগে সব মিটিয়ে ফেলা ভালো!”

সাইফ চাপা হাসলো। আর কিছু থাকুক বা না থাকুক, তার এই হবু বউটার কথার তেজ অনন্য। কেমন বাড়ীর বড়ো বউ হওয়ার ভাব আছে তার মধ্যে। সাইফ চাপা হেসে বললো,
–“কথার ঝংকার বলে দিচ্ছে, তুমি বড়ো বউ হওয়ার জন্যে পারফেক্ট।”
দিয়া এবার হেসে বললো,
–“প্রপোজ করার ক্ষমতা থাকলে বড়ো বউ হওয়াটা বড়ো ব্যাপার না। কারণ আমাদের মতো মেয়েদের প্রপোজ করাটাই সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার।”
–“তা বুঝলাম। কিন্তু স্বভাব অনুযায়ী তুমি কখনো ত্যাড়া কথা বলো না। আজ কী এমন হলো যে এতটা চটে আছো? এনি প্রব্লেম?”
দিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
–“এটা মধ্যবিত্তদের সমস্যা বুঝলেন। যখন পরিস্থিতির খপ্পরে পরে মানুষ চিনতে শিখলাম, তখন থেকেই এই স্বভাব আমার মধ্যে উদয় হয়েছে। তাদের ভালো-মানুষী রূপ আজকাল সহ্য হয় না!”

সাইফ অবশ্য এসব ঘাটলো না। বেশি প্রশ্ন করতে নিলে না জানি দিয়ার মনটাই বিষিয়ে যায়। এজন্য সাইফ প্রসঙ্গ বদলে বললো,
–“হাতের মেহেদী দিয়ে আমার নাম লিখেছো তো? না লিখলে এখনই লিখে ফেলো। মেহেদী আমার খুব পছন্দ। নিজের নাম দেখলে আরও ভালো লাগবে।”

পরেরদিন বিয়ের অনুষ্ঠান হলো কমিউনিটি সেন্টারে। দিয়ার বাবা মোটামুটি খরচ করার অনুমতি পেয়েছে। এছাড়া সাঈদ সাহেব আর কোনো অনুমতি দেয়নি। নাজমুল সাহেব নিজের সাধ্য অনুযায়ী মেয়ের জন্যে স্বর্ণের অলংকার এবং মেয়ে জামাইয়ের জন্যে দামী ঘড়ি উপহার দিয়েছে। কারণ সে আগে থেকেই অবগত স্বর্ণ ছেলেদের জন্যে হারাম। এই কথাটা সাইফ নিজেই তাকে জানিয়েছে। নাজমুল সাহেব চেয়েও বেশি কিছু করতে পারেনি। এই একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার কতশত স্বপ্ন। মেয়েকে সে পেয়েছে বিয়ের প্রায় নয় বছর পর। আল্লাহ্’র কাছে অনেক চাওয়ার পরপর-ই এই দম্পতি দিয়াকে পেয়েছে। তাও দিয়া শুরুর দিকে ভীষণ অসুস্থ থাকতো। দুই বছর হবার পর থেকেই ধীরে ধীরে আল্লাহ্ মুখ তুলে তাকায় তাদের দিকে। নাজমুল সাহেবের পাইকারি কাপড়ের ব্যবসা ছিলো। তাই আগে তাদের পরিবার ভালোই স্বচ্ছল ছিলো। যখন দিয়া এইচএসসি দেয় তখনই হয় বিপত্তি। আগুন ধরে তার পুরো ব্যবসা শেষ। সেই সময় তার পথে বসার মতো অবস্থাম তাও বাড়ির ভাড়া এবং দোকানের ভাড়া নিয়ে কোনোরকম দিন পার করছে। সেই থেকে নাজমুল সাহেব ঘরেই বসা। চাকরি করতে চেয়েছিলো, কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে রোগ-ব্যাধি দেহে বাঁধে। এই বিপদের দিনগুলোতে কোনো আত্নীয়-স্বজন তাদের খোঁজ নেয়নি। সবসময় দূরে দূরে থাকতো টাকা দেওয়ার ভয়ে।

সারা অনুষ্ঠানে দিয়ার বোনেরা বেয়াইয়ের সাথে ভাব জমাতে চেয়েছিলো অনেকবার। কিন্তু সিদাত এবং তার কাজিনরা সেভাবে তাদের গুরত্ব দেয়নি। শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে হাসি-মুখে কথা বলেছিলো এই যা!

এর কারণ সারা পথে সাইফ তাদের ট্রেনিং দিয়ে এনেছে, যেন ওদের সাথে সেভাবে কেউ না মিশে। সাইফ গতকাল দিয়ার সাথে কথা বলে সে যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলো। দিয়া মুখ ফসকে সিদাতের কথাও বলে ফেলেছিলো। কারণ এই মেয়েগুলো স্বার্থ বুঝে টোপ ফেলছে। এই টোপ কেউ একবার গিললে সে একাই ধ্বংস হবে না। সঙ্গে পুরো পরিবারকেও শেষ করতে পারবে।

সিদাত অবশ্য একজনের মোহেই আটকে আছে। সে সচরাচর অন্য মেয়ের সাথে এতটা মিশে না। এটা তার স্বভাবে নেই। কথা বললেও কথা বলার সীমা লঙ্ঘন করে না। সে নারী জাতিকে যথেষ্ট সম্মান করে চলে।

বিয়েতে এসে অজানা কারণে তরীর কথা বড্ড মনে পরছে। গত পনেরো দিন যাবৎ তরীকে সে দেখেনি। চিঠি দেয়নি। কাজের ফাঁকে বহুবার যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু বাবার অসন্তুষ্টির ভয়ে যায়নি। অথবা এই সময়টায় অনয়ের বাসায় গিয়ে অন্তত একটি রাত থাকাটাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো৷ সিদাত আনমনেই ভাবলো,
–“আচ্ছা, এই অনুভূতিটা কী শুধুমাত্র বন্ধুত্বের? নাকি এর মাঝেও অনুভূতির বিরাট রহস্য লুকিয়ে আছে?”

এমন সময় অনয় এলো। একপ্রকার ছুটতে ছুটতে। সিদাতের কাঁধে চাপড় মেরে বললো,
–“শালা। এতক্ষণ ধরে খুঁজতেছি, দেখাই পাই না। মানে কী এসবের?”
–“দেখা তো আগেও হয়েছে। হঠাৎ এখন উত্তেজিত হওয়ার কারণ কী?” ভ্রু কুচকে বললো সিদাত।

–“আরে ধুর। জরুরি কথা আছে যা সপ্তাহখানেক ধরে বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু নানা কারণে সে-কথা ভুলে যাই। এখন বহু কষ্টে মনে রেখে তোকে বলতে আসছি!”

–“কী কথা?”

–“তরী মেয়েটা তোকে চিঠি দিতে মানা করেছে। তার তোর বন্ধুত্বের প্রস্তাবও আজীবনের মতো প্রত্যাখান করে দিয়েছে। তুই আর ওকে চিঠি দিস না। ওর বাবা-মা অলরেডি দেশে ফিরছে। কোনো ভাবে তাদের হাতে চিঠি পরলে তরী না চাইতেও ফেঁসে যাবে।”

সিদাত নীরবে শুনলো। কিছুক্ষণ অন্যমনস্কও থাকলো। পরে কী মনে করে বললো,
–“বউ করার প্রস্তাব দিলে মানবে তো?”
অনয় যেন আকাশ থেকে পরলো। চোখ জোড়াও কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সিদাতের মাথা কী গেলো নাকি? কী-সব বাজে বকছে? অনয় অস্ফুট স্বরে বললো,
–“তুই বিয়ে করবি? তাও ওকে?”

দিয়ার দুজন কাজিনবতাদের পাশ কেটে যাচ্ছিলো। ওমনি ওদের কথোপকথন শুনে দুজনেই চমকালো। আহত সুরে বললো,
–“সিদাত, তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?”

সিদাত তাদের দেখে হাসি চওড়া করলো। বললো,
–“গার্লফ্রেন্ড নয় অবশ্য। বলতে পারেন মনের মানুষ আছে!”
ব্যথিত চোখে দুজন দুজনার দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। অতঃপর অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে কোনো রকমে পাস কাটিয়ে চলে গেলো। তাদের চেহারা দেখার মতো হয়েছিলো। অনয়ের মুখ-ভঙ্গি সবচেয়ে হাস্যকর।
–“তুই সিরিয়াস ভাই? আমার মনে হচ্ছে আমার পা জোড়া কাঁপছে। মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবো ভাব। কী করে তুই এমন আতঙ্কে পা দিলি বাপ? কলিজা কাঁপলো না?”

সিদাত এবার স-শব্দে হেসে দিলো। বললো,
–“থাম অনয়। বেশি নাটক করিস না। আম জাস্ট কিডিং। সিরিয়াস নেওয়ার কিছু নেই।”
কিন্তু সিদাতের মনে হলো তার খাচায় বন্দি মনখানা খাচা ভেঙে মুক্তি পেয়েছে। তার স্বাধীন-চেতনা মন তার মুখের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো।

©লাবিবা ওয়াহিদ#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১৮]

দিয়া সাইফের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। বিছানা জুড়ে গোলাপের পাপড়ি। মন কাড়া ঘ্রাণ নাকে এসে বিঁধছে। ঘ্রাণের আবেশে দিয়ার তো ইচ্ছে করছে বিছানার মাঝে লেপ্টে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পরতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেই ফুলগুলোকে নষ্ট করতে মন চাচ্ছে না। এজন্য দিয়া বিছানার কোণেই পা ঝুলিয়ে বসেছে। মাঝ বরাবর গিয়ে বসার সাধ্য তার নেই।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাইফ রুমে প্রবেশ করলো। সাইফ আসতেই দিয়ার মতো মেয়ে মানুষ কেমন জড়তা, লজ্জা অনুভব করলো। সাইফের মুখ পানে চাইতেও তার সারা দেহ জুড়ে শিহরণ খেলে গেলো। এজন্যে দিয়া চোখ তুলে চাইলো না। একমনে কোলে লেহেঙ্গার ভারী ডিজাইনের দিকে চেয়ে রইলো। সাইফ দিয়ার পাশে এসে বসলো। অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বললো,
–“তুমি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছো?”

লজ্জায়, জড়তায় দিয়ার নিঃশ্বাস বেড়ে গেলেও গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরুলো না। সাইফ মুচকি হাসলো। দিয়া তাকে দীর্ঘদিন ধরে ভালোবাসে। আর সাইফের সবে দিয়া নামক মেয়েটির জন্যে মনে প্রেমের ফুল ফুটতে শুরু করেছে। তাহলে দিয়ার তো এত লজ্জা পাওয়ার কথা নয়।৷ দিয়া সেরকম মেয়েও নয়। তবে সাইফের ভীষণ ভালো লাগলো। যার ইচ্ছে হবে না তার বউকে লজ্জায় রাঙা দেখতে? সাইফের তো খুব ইচ্ছে হলো।

তবে সাইফ পরিস্থিতি জটিল করেনি। দিয়ার হাত টেনে তার হাতে একটি সুন্দর রিং পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
–“তুমি সেদিন বলেছিলে না আমি তোমার ভেতরের গল্প জানতেই বিয়ে করছি? আসলে ব্যাপারটা এরকম না। আমি চাইনি আমাকে চরম ভালোবাসা মেয়েটিকে হারাতে। কারণ যে আমাকে ভালোবাসে তাকে আমি নিশ্চিন্তে ভালোবাসতে পারবো।”

দিয়া এবার চোখ তুলে চাইলো সাইফের দিকে। সাইফের নজর তখনো তার পরানো আংটির দিকে নিবদ্ধ। দিয়া শান্ত গলায় বললো,

–“আমি ছাড়াও অনেক প্রপোজাল পেয়েছেন আপনি। তাহলে আমি-ই কেন?”
সাইফ হুট করে একটি কান্ড ঘটিয়ে বসলো। দিয়ার বাম হাতের পিঠে চুমু খেলো। বললো,

–“তুমি স্পেশাল দিয়া। স্পেশাল দেখেই আমার বউ হয়েছো। তবে তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া। আমার দুই মাকেই তুমি সমান ভাবে আগলে নিও!”

দিয়া হাসলো। বললো,
–“আমি বড়োই ভাগ্যবতী। নাহলে বিয়ের পরপর আরও দুজন মাকে পেতাম না!”

সাইফ খুব মুগ্ধ হলো দিয়ার কথা শুনে। দিয়ার মাথার দোপাট্টা আরও কিছুটা টেনে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
–“ভারী লেহেঙ্গা এবং জুয়েলারিতে বোধহয় অস্বস্থি হচ্ছে। তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো!”

——————
আকবর সাহেব এতদিন পর বাড়ি ফিরে খুব খুশি হয়েছে। আবারও তাদের অর্ধেক পরিবার পূরণ হলো। তরীর বাবা-মা আসতেই ফুপি চলে গেলো নিজের বাড়ী। আকবর সাহেব যাওয়ার আগে বলে দিয়েছে যেন একদিন সময় করে পুরো পরিবার তাদের বাড়িতে আসে। এটা আকবর সাহেবের পক্ষ থেকে দাওয়াত। ফুপি হেসে বলেছিলো আসবে।

কামরুন নাহার অর্থাৎ তরীর মা এসেই রান্নাঘরে ঢুকে পরেছে। এতদিন যেন এই রান্নাঘরকে ভীষণ মনে করছিলো। না রেঁধে টেকা যায় নাকি? তবে আকবর সাহেব আসার পর থেকেই মেয়ে দুজনকে খন্ড খন্ড করে সৌদিতে কাটানো সময় নিয়ে গল্প করে। ওখানে যা যা জেনেছে তা মেয়েদেরকে অল্প বিস্তর ব্যাখ্যা করেছে। মেয়েরাও অত্যন্ত আনন্দের সাথে মনোযোগ সহকারে শুনেছে।

আজ থেকে আকবর সাহেব মাদ্রাসায় যাবে। সে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে। তবে সাবিয়ার মাদ্রাসাতে নয়। সে ইচ্ছাকৃত মেয়েকে তার চাকরিরত স্থানে ভর্তি করাননি। যাতে কেউ খোঁটা দিয়ে কখনো বলতে না পারে যে সাবিয়া তার বাবার মাধ্যমে ছলচাতুরী করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর আনছে। সে এই কাজ বড়ো মেয়ের বেলাতেও করেছে। বড্ড সৎ মানুষ সে। এজন্য মানুষদের বাজে কথা-বার্তা সে হজম করতে পারে না সেরকম।

নাস্তার টেবিলে সকলে মিলে নাস্তা করছে। তরীর ভার্সিটি যেতে দেরী হবে। কিন্তু তাও সে সবার সাথেই নাস্তা করতে বসেছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবার একসাথে নাস্তা করাটা যেন তাদের বাড়ীর অঘোষিত নিয়মের মধ্যে পরে। আকবর সাহেব খেতে খেতে টুকটাক জিজ্ঞেস করছেন মেয়েদের কোনো সমস্যা হচ্ছিলো না? ঠিকভাবে সময় কাটাতে পেরেছে কী না। বড্ড সাহস করে মেয়ে দুটোকে একা ফেলে গিয়েছিলো। ইচ্ছে ছিলো পুরো পরিবার মিলে উমরাহ করে আসবে। কিন্তু মেয়ে দুজনেরই পরীক্ষা ছিলো। এজন্যে সকলের জোরাজুরিতে তারা স্বামী-স্ত্রীই আগে উমরাহ করে এসেছে।

খাওয়া-দাওয়া শেষে সাবিয়া তৈরি হয়ে বাবার সাথে বেরিয়ে গেলো। এখন থেকে সাবিয়াকে তার বাবাই নিয়ে যাবে মাদ্রাসায়। তরী ততক্ষণে সময় কাটানোর জন্যে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে কাজে সাহায্য করতে থাকে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অনেকের সাথেই দেখা হয়ে যায়। সালাম দিয়ে সকলের সাথেই টুকিটাকি কুশল বিনিময় হয়েছে। এই ভবনের প্রায় সব ভাড়াটিয়ারাই আকবর সাহেবকে চেনে। বাড়িওয়ালার সাথেও তার ভীষণ সখ্যতা। আকবর সাহেব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। জীবনে খুব কম রেগেছেন। সে মনে করে রাগ জিনিসটা শয়তানের উস্কানি ছাড়া কিছুই নয়। এজন্যে আকবর সাহেব রাগ করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেন।

নিচে হঠাৎ সিদাতের সাথে দেখা হলো। সিদাত তড়িঘড়ি করে দরজা দিয়ে প্রবেশ করছিলো। একটুর জন্যে আকবর সাহেবের সাথে সংঘর্ষ বাঁধেনি। সিদাত এতে অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে নিচু গলায় বললো,
–“আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত আঙ্কেল। আমি বুঝতে পারিনি আপনি আসছিলেন!”

আকবর সাহেবের পেছনে দাঁড়ানো সাবিয়া আঁতকে উঠলো সিদাতকে দেখে। সিদাত যে তাদের বাড়ি এসেছিলো সেটা কী তবে সিদাত তার বাবাকে বলে দিবে? বলে দিলে তো সর্বনাশ। সাবিয়া ভয়ে রীতিমতো ঘামতে শুরু করলো। তরী বারামদায় এসেছিলো জামা-কাপড় মেলে দিতে। গেটের দিকে তাকাতেই অপ্রস্তুত হলো। তার বাবা এবং সিদাত মুখোমুখি! ভয়ে তরীর হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। সিদাত তাকে কিছু বলে দেয়নি তো?

আকবর সাহেব সিদাতের দিকে চেয়ে হাসি-মুখে বললেন,
–“এরপর থেকে সাবধানে চলাচল করবে। তাড়াহুড়ো তো মোটেও করবে না!”
–“জি আঙ্কেল। মনে রাখব!”

বলেই সিদাত তাদের পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়াতেই সাবিয়ার দিকে চোখ যায়। সাবিয়াকে চিনত্ব অসুবিধা হলো না তার। সিদাত চট করে আকবর সাহেবের মুখপানে তাকালেন। ভীষণ স্নিগ্ধ এক লোক। আকবর সাহেব মুচকি হেসে সিদাতের কাঁধে হাত রেখে মেয়েকে নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তরী এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

সিদাত কী ভেবে বারান্দায় তাকালো। তরী বারান্দার রশিতে ভেজা জামা-কাপড় মেলছে। মুখ তার ওড়না দ্বারা আবৃত। সিদাত এতে মুচকি হাসলো। কতদিন পর দেখা পেলো নিকাব রাণীর। মেয়েটাকে নিজের অজান্তেই বড্ড ভালো লাগে তার।

—————
দিয়া ভেবেছিলো বিয়ের পর প্রথমদিন শ্বশুরবাড়িতে একটু অস্বস্থি অনুভব হবে, সবকিছু কঠিন হবে তার জন্যে। এর জন্যে ভেতরে ভেতরে যেমন প্রিপারেশন নিচ্ছিলো তেমনই নার্ভাস হয়ে পরছিলো। কিন্তু যখন শ্বশুর, শ্বাশুড়ির সাথে নাস্তা করতে বসলো তখন তাদের আন্তরিকতায় দিয়া সব ভয়-ভীতি ভুলে গেলো। তার শ্বশুর খাওয়ার মাঝে তার সাথে টুকটাক কুশল বিনিময়ও করেছে।

খাওয়া শেষে দিয়াকে নিয়ে সাইফ তার মায়ের ঘরে এলো। জয়া চোখ বুজে ছিলো। কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ মেলে চেয়েছিলো সে। দিয়া তার সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটায়। এখনো সে জানে না জয়া কী কারণে এমন অসুস্থ হয়ে পরেছে। তবে তাকে শয্যাশায়ী দেখে দিয়ার ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। মুখ বুজে নিয়তিকে মেনে নিতেই হবে।

ভরদুপুরে কলিংবেল বেজে ওঠে। তরী দরজা খোলার আগে দরজার দূরবীন দিয়ে পরখ করে নিলো। কিন্তু কেউ নেই। নির্ঘাত ওই ছোটো বাচ্চাটা মজা নিচ্ছে। ভেতর থেকে কামরুন নাহার উচ্চ স্বরে তরীর উদ্দেশ্যে বললো,
–“কে এসেছে তরী?”

তরী ভেতরে যেতে যেতে বললো,
–“এক দুষ্টু ছেলে বোধহয় আম্মা। কলিংবেল বাজিয়ে পালিয়ে গেছে।”

কামরুন নাহার কিছু বললেন না। কাঁথা সেলাইয়ে মনোযোগ দিলেন। তরী মায়ের সাথে বসে বসেই দেখতে লাগলো।

বিকালে ছাদে এলো তরী। তাদের উপরতলার কম বয়সী গৃহিনীর সাথে। ছাদে সচরাচর তেমন কেউ আসে না। এজন্যই তরীর ছাদ ভীষণ ভালো লাগে। তার মুখের ওড়নাটা আলগা হয়। প্রাণভরে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে। সেই মহিলার ছোটো বাচ্চা ছাদে ঘুরে ঘুরে খেলছে। তরী ছেলেটাকে ভীষণ পছন্দ করে। ছেলেটা বড্ড মায়াবী। যার তার মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তখনই সিদাত কলে কথা বলতে বলতে ছাদে এলো। অসাবধান বশত সিদাত এবং তরীর চোখা-চোখি হয়ে যায়। তরী তড়িঘড়ি করে তার মুখে ওড়না জড়ালো। সিদাত নিজেও অপ্রস্তুত হয় এই ঘটনায়। তরী তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে ফিরে যায়। আর সিদাত দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে ছাদের ওপাশে চলে যায়। ওপাশের থেকে ছাদের এপার দেখা যায় না। সিদাতকে দেখে তরীর পাশের মেয়েটিও অপ্রস্তুত হয়। তরীর সাথে বলতে শুরু করে,
–“এটা তো আরজে। কী যে দারুণ কথা বলে ছেলেটা। আমার খুব ভালো লাগে ওকে। আগেও একবার বোধহয় সিঁড়িতে দেখেছিলাম। কিন্তু তখন বিশ্বাস হয়নি ও আমার সামনে। কিন্তু আজ বিশ্বাস হয়ে গেলো।”

মেয়েটির বলা কথা গুলো তরীর এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সাবিয়ার কাছে শুনেছে সকালে সিদাত বড্ড স্বাভাবিক আচরণ করেছে। কিন্তু সিদাতকে দিয়ে তরী কোনো রকম ভরসা পাচ্ছে না। বারবার কেন ছেলেটা চোখের সামনে এসে পরছে? পৃথিবী গোল বলে এই নয় যে দিনে তিন বেলা চোখের সামনে এসে পরবে। মাবুদের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই ধারণা করতে পারছে না তরী।

–“ছাদে এসেই মুখোমুখি হয়ে গেছি দোস্ত। কী করবো?” সিদাতের কন্ঠ ব্যাকুল শোনালো।

অনয় ফোনের অপরপ্রান্তে হাসলো। হেসে বললো,
–“বলেছিলাম না বন্ধু? খাঁচায় মন বন্দী করা মুশকিল। সে একদিন না একদিন তোমায় বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে খাঁচা ভেঙে পালাবেই? মিললো তো আমার কথা?”

সিদাত কিছু সময়ের জন্যে চুপসে গেলো। বড্ড অস্থির লাগছে তার। কী ভেবে বললো,

–“বন্ধুত্ব করতে গিয়ে এই কান্ড ঘটিয়ে ফেলবো তা তো জানতাম না রে অনয়। কীভাবে নিজেকে বুঝ দিই? ওর সামনে দাঁড়ালেও আমার হাঁটু কাঁপে, আবার ওর চোখ জোড়ার অতলেও ডুবতে ইচ্ছে করে।”

–“এত টেনশন নিস না বন্ধু। তোর না অফিস আছে? অফিসের দিকে ফোকাস কর। ছাদ থেকে বাসায় গিয়ে রেডি হ। আর যদি তোর তরীর বাবাকে শ্বশুর বানানোর ইচ্ছে থাকে তবে আমার বাসাতে তোর না আসাই ভালো। আর আঙ্কেলের চোখের সামনে তো ভুলেও পরিস না। নয়তো তোকে লোফার নিকনেম দিতে পারে। আড্ডাবাজি ছাড়াও তুই কিছুই বুঝিস না!”

সিদাত অনয়ের কথামতো নিচে চলে গেলো। যাওয়ার আগে একপলক তরীকে দেখতে ভুললো না।
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [১৯]

আকবর সাহেব তরীর বানানো চা খেয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। তরী হাতে ট্রে ধরে অধরে অধর চেপে বাবার দিকে উৎসুক নজরে চেয়ে আছে। চাপা অস্থিরতা তাকে চেপে ধরেছে। আকবর সাহেব বললেন,

–“আগের থেকে চা-টা উন্নত হয়েছে। সত্যি-ই ভালো হয়েছে মা। এশারের পরপর আরেক কাপ বানিয়ে খাওয়াবে কিন্তু!”

তরীর অধর প্রসারিত হলো আকবর সাহেবের মুখে প্রশংসা শুনতে পেরে। মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“অবশ্যই বাবা!”

তরী খালি চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘরে গেলো। রান্নাঘরের একটি চেয়ারে বসে কামরুন নাহারও তরীর বানানো চা পান করছে। সে আগেই প্রশংসা করে ফেলেছে। তরী মুচকি হেসে বললো,

–“এশারের পরপর আরেক কাপ খেও আম্মা!”

–“না, না। একবারই যথেষ্ট। নয়তো দেখা যাবে রাতে ঘুমানো মুশকিল হয়ে পরবে। তুমি যাও, গিয়ে পড়তে বসো। রান্নাঘর আমি সামলাচ্ছি।”

তরী মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। সাবিয়া পড়ার টেবিলেই অমনোযোগী হয়ে বসে আছে। তরী সাবিয়ার দিকে চেয়ে টেবিল থেকে তার নির্ধারিত বই নিলো। অতঃপর বললো,
–“কিসের এত চিন্তা করছিস পড়তে বসে?”

সাবিয়া চমকে উঠে বোনের কথা শুনে। আমতা আমতা করে বললো,
–“কিছু না তো!”
–“কিন্তু তোর অভিব্যক্তি আমাকে অন্যকিছু বলছে। সত্যি করে বল সাবিয়া। আমার থেকে কী লুকাচ্ছিস?”

সাবিয়া ঘাবড়ে গেলো। প্রথমে বলতে চাইলো না। কিন্তু তরীর চোখ রাঙানো দেখে বলতে বাধ্য হয়। বললো,
–“আব্বার সাথে আজ একজন লোক দেখা করেছে। আমার সামনেই। খুব সম্ভবত উনি রফিক চাচা। আব্বার কোনো এক বন্ধু। উনি আব্বাকে জিজ্ঞেস করে বলে বড়ো মেয়েকে বিয়ে কবে দিবেন? বয়স পেরিয়ে যেতে দিচ্ছেন কেন? এটা তো অনুচিত! আব্বা তখন তাকে হেসে জানিয়েছিলো মাবুদ যখন হুকুম করবেন তখনই বিয়ে দিবে। তবে তার আগে সুপাত্র তো পেতে হবে!”

সাবিয়া থামে। তরী ভ্রু কুচকে চেয়ে আছে সাবিয়ার পানে। এই ব্যাপারটা তো পড়ার টেবিলে বসে চিন্তা করার কথা নয়। তরী লহু কন্ঠে বললো,
–“কত মানুষ তো কত কথাই আব্বাকে বলে। তুই এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছিস কেন?”

–“এই লোক মোটেও সুবিধার নয় আপু। না জানি কবে কী বলে আমাদের আব্বার কান ভারী করে ফেলে। আমার খুব ভয় হয় আপু। আমি চাই না তোমার বিয়ে হোক।”

তরী ফিক করে হেসে দেয়। কিছুদিন পর এসএসসি পরীক্ষা অথচ এই মেয়ে তরীর বিয়ে নিয়ে পরে আছে। তাও তরী সাবিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

–“আব্বা আগেই বলেছে আমার পড়াশোনা শেষে বিয়ের চিন্তা করবে। তুই এত উতলা হোস না। তোকে ছেড়ে আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। পাগলী বোন আমার!”

————-
সিদাত চোখ-মুখ কুচকে তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে। সিদাতের মায়ের চোখ যেন হাসছে। এটাই সিদাত সহ্য করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে মা তাকে ব্যঙ্গ করছে, উপহাস করছে। সিদাত অভিমানী গলায় বললো,

–“এটা একদম ঠিক হচ্ছে না মা। তুমি আর অনয় মিলে আমার দুর্দিনে শুধু হেসেই যাচ্ছো। আমি কী জেনে বুঝে পরেছি নাকি? মনটা হঠাৎ খাঁচা খুলে পালালো। সেই মন পালিয়ে অন্য কোথাও না গিয়ে তরীর কাছেই কেন গেলো?”

জয়া পলক ফেললো। অর্থাৎ এটাই হওয়ার ছিলো। তার চোখ-মুখ অন্য দিনের তুলনায় চিকচিক করছে বেশি। এদিকে সিদাতের অস্থির লাগছে। মায়ের মজা নেওয়া একদম সহ্য হচ্ছে না তার। সিদাত উঠে দাঁড়িয়ে কিছুটা জেদ করে বললো,
–“আমি আমার মন ঠিকই ফিরিয়ে আনবো মা। দেখে নিও! এখন আমি অফিস যাচ্ছি।”

বলেই সিদাত হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। জয়া তখনো ছাদের দিকে শূন্য নজরে আছে। তার চোখ-মুখ জুড়ে তৃপ্তি। ছোটো ছেলেটাকে যেন উপরওয়ালা দারুণ কাউকে মিলিয়ে দিলেন। সিদাতের জন্যে চিন্তা কিছুটা কমে এলো তার। ভালো লাগছে, শান্তি লাগছে তার।

দিয়া আজ ক্লাসে যেতে ইচ্ছুক। এজন্যে একমনে টেবিলে বিচরণ করা তার বই সমূহের দিকে চেয়ে আছে সে। সাইফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। আড়চোখে স্ত্রীকেও খেয়াল করছে। এখন জরুরি এক মিটিং আছে তার। সে তাড়াহুড়ো না করে বরঞ্চ ধীরে সুস্থে রেডি হচ্ছে। সাইফ পারফিউম দিতে দিতে বললো,

–“কী ব্যাপার দিয়া? এভাবে বসে আছো যে?”

দিয়া ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
–“আমি আবার ক্লাসে যাওয়া শুরু করতে চাইছি!”

–“তো যাবে। সমস্যা নেই তো। আজকে গেলে রেডি হয়ে নাও!”

দিয়া খুব খুশি হলো সাইফের কথা শুনে। দিয়া একটি চওড়া হাসি দিয়ে বললো,
–“আচ্ছা।”

সাইফ দিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“এখন থেকে বাইরে গেলে তুমি বোরকা পরার অভ্যাস করবে দিয়া। আলমারিতে কয়েকটা আনিয়ে রেখেছি। যেটা ইচ্ছে পরতে পারো। আমার কথা মানতে কী কোনো অসুবিধা হবে?”

সাইফ ঘুরে তাকালো দিয়ার উত্তরের অপেক্ষায়। দিয়া কিছু না বলে আলমারি খুলে একটি বোরকা হাতে নিলো। সাইফ দিয়ার নীরব সম্মতি বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। বিছানায় গা এলিয়ে বসে সাইফ বললো,
–“রেডি হও। আমি অপেক্ষা করছি।”

—————
আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আকাশ জুড়ে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ ভাসমান। অন্যান্য দিনের চাইতে আজ গরমের উত্তাপ কিছুটা কম। মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দিয়ে তার সোনালী নরম রোদ ছড়াচ্ছে আজ। যেন বৃষ্টি নামবে ভাব। এই এত সুন্দর একটি দিনে তরীর মামা রাজিব এসে হাজির হন। হাতে তার বিয়ের কার্ড। অধর জুড়ে চওড়া হাসি।

আকবর সাহেব পত্রিকা ছেড়ে রাজিবের সাথে কথা-বার্তা বলছেন। কামরুন নাহার ব্যস্ত হাতে রান্না করছে ভাইয়ের জন্যে। অনেক জোরাজুরির পর ভাইকে অন্তত দুপুরে খাওয়ার জন্যে রাজি করিয়েছে। তরী টুকটাক সাহায্য করছে মাকে। মামার সাথে একটু আগেই তরী দেখা করে, কথা বলে এসেছে।

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসলো। মামা খেতে খেতে জানালো মৌসুমীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে ঢাকাতেই থাকে। ভালো চাকরি-বাকরি আছে। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ এবং ওয়ারীতে নাকি একটি করে বাড়ী আছে। পরিবারও ভালো, ভদ্র। এক কাছের জনের মাধ্যমেই এই পাত্রের সন্ধান পায় সে। আকবর সাহেব সব শুনে খুশি হলেন। এ নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা চললো।

সাবিয়া তো ভেতরে ভেতরে খুব খুশি। মৌসুমীর বিয়ে হবে। এর মানে হচ্ছে শহুরে পরিবেশ ছেড়ে সুদূর জামালপুরের গ্রামাঞ্চলে যাবে। শান্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। তার ওপর তো বিয়ে বাড়ির মজাই আলাদা। নিজে আনন্দ করতে না পারলেও অন্যদের আনন্দ দেখে তো অন্তত শান্তি পাবে, তাই না? যা হয়েছে ভালোই হলো। রাজিব সকলকে অত্যন্ত অনুরোধ করে বললো যাতে সোমবারের মধ্যেই তারা চলে আসে জামালপুর। এতে রাজিব সহ তাদের সবার খুব ভালো লাগবে। একসাথে বিয়ের আয়োজন করবে সবাই। আকবর সাহেব হাসি-মুখে বলেছে সে চেষ্টা করবে।

——-
–“স্যার। আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। বললো আপনার পরিচিত। আমি বললাম আপনি ব্যস্ত কিন্তু সেও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই সেখান থেকে সরবে না। ঠিকই ঘন্টাখানেক গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে কল দিলাম!”

সাইদ সাহেব নীরবে সব শুনে বললো,
–“নাম তো জিজ্ঞেস করেছ নিশ্চয়ই?”
দারোয়াম জিভে কামড় দিয়ে বললো,

–“স্যরি স্যার। এত কিছু বললাম অথচ নামটাই বলিনি। লোকটির নাম রাজিব। বললো জামালপুর থেকে এসেছে। হাতে বিয়ের কার্ডও আছে বোধহয়!”

অদ্ভুত ভাবে সাঈদ সাহেব যেন তাকে চিনতে পারলো। বললো,
–“তাকে ভেতরে আসতে দাও। এবং বাগানে বসতে বলো।”

দারোয়ান থতমত খেয়ে বললো, “জি, আচ্ছা স্যার।”
দারোয়ান বুঝতেই পারছে না সুদূর জামালপুরের লোকের সাথে সাঈদ সাহেবের কী সম্পর্ক? তাকে তো কোনোক্রমেই সাঈদ সাহেবের নিকটাত্মীয় লাগছে না। তাহলে? দারোয়ান ব্যাপারটাকে বেশি না ঘেটে গেটের দিকে পা বাড়ালো।

©লাবিবা ওয়াহিদ
~[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here