হৃদয় মাঝারে পর্ব -০৩

#হৃদয়_মাঝারে [৩]
#হালিমা_চৌধুরী

মুরতাসিম আমার হাত চেপে ধরে রেখেছে যেনো রক্ত বের না হয় তাই। পাশে থাকা টি-টেবিল থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে দিয়ে বলে,

‘পানির ভিতরে হাত রাখো। ব্যাথা একটু হলেও কমবে। আমি ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসি।’

বলেই উনি চলে যান। আমি গ্লাস নিয়ে বেলকনিতে এসে আস্তে আস্তে হাতে পানি দিতেছি। এরমধ্যেই উনি বরফ নিয়ে হাজির হয়।

‘গাধা একটা! তোমাকে বলেছি গ্লাসের ভিতর আঙ্গুল ডুকিয়ে রাখতে। কমেছে তোমার হাতের ব্যাথা!’

উনার ক্ষীপ্ত মেজাজে কথা বলার ধরণ দেখে এবার আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।

‘আমার হাতে কাঁটা ফুটেছে নাকি আপনার হাতে? আপনার এই এক্সট্রা দরদ আপনার কাছেই রাখেন।’

বলেই আমি বেলকনি থেকে চলে আসি। আমার পিছন পিছন উনিও রুমে প্রবেশ করে।

‘তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী তোমার ব্যাথা লাগলে আমার কর্তব্য তা সারিয়ে তোলা।’

‘আপনি অনেক কর্তব্য পালন করেছেন মিস্টার চৌধুরী। আপনি তো বলেছেন আমি আপনাকে বিয়ে করলে আমি আমার ইচ্ছে মতো চলতে পারব। তাহলে কেনো আপনি আমাকে আপনার মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন? আমি অর্ধেক আপনাকে কেনো বিয়ে করেছি জানেন! আমি নিজের মত করে নিজের জীবন কে সাজাতে চাই। এর জন্য আমার একটা নিরাপদ বাসস্থান এর প্রয়োজন ছিলো। আপনি কি মনে করেছেন আপনি আমাকে জোর করেছেন বিয়ে করতে আর আমি আপনার ভয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম! নো মিস্টার চৌধুরী আপনার ধারণা ভুল। আমি আমার ইচ্ছে তে আপনাকে বিয়ে করেছি। এবং আপনার সাহায্য ছাড়াই নিজের পায়ে দাড়ানোর চেষ্টা করবো। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ আমাকে মেরে ফেললে ও আমি বিয়ে করতাম না। আমি আপনাকে নিজের ইচ্ছেই বিয়ে করছি।’

‘ভাষণ দেওয়া শেষ হলে এবার ঘুমাতে পারো। এতোক্ষণ তো আমাকে পাগল করে দিয়েছো ঘুমাবে বলে? তাহলে কথার মধ্যে এতো তেজ আসে কোত্থেকে?’

এতো গুলো কথা বলার পরও উনাকে স্বাভাবিক দেখে একটু অবাক তো হলামই।
চুপচাপ আমি বেডের একপাশে শুয়ে পড়লাম। উনি বেড থেকে একটা বালিশ নিয়ে বাহিরে বের হতে নিতেই আমি বলি,

‘আমি আপনাকে খাটে ঘুমানোর জন্য বারণ করিনি। চাইলে ঘুমাতে পারেন। যতই হোক বিছানা টা আপনার।’

আমার কথা শুনে উনি কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে বাহিরে বের হয়ে যায়। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। মানবতার দিকে তাকিয়ে উনাকে উনার বিছানায় ঘুমানোর জন্য বলাটা আমার দায়িত্ব ছিলো। নাহলে আমার একটুও ইচ্ছে নেই লোকটার সাথে বেড শেয়ার করার।
গোলাপের কাঁটা তো কিছুই না এটা তো ছোট্ট একটা ড্রামা ছিলো মিস্টার চৌধুরী। এখন নিত্য নতুন আপনাকে পুড়তে হবে। আমার পিছনে পড়েছেন বলে কথা!
.
.
সকালের এই মিষ্টি রোদ চোখে পড়তেই ঘুম আপনা আপনি হাওয়া হয়ে গেলে। বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে ফেলাম। কৌতুহলী হয়ে নিচে নামতেই মধ্যবয়স্ক মহিলা টি আমার দিকে তেড়ে আসে যে কিনা আমার শাশুড়ি।

‘কি করলা তুমি আমার ছেলের সাথে? প্রথম রাতটাই তো আমার ছেলের সাথে কাটাতে পারলে না!’

উনার কথা শুনে আমি অসহায় চোখে উনার দিকে তাকাই। আমি জানি উনি আমাকে সহ্য করতে পারে না। না করারই কথা! তবুও আমাকে এগিয়ে যেতে হবে।

‘কি হলো চুপ করে আছো কেনো? আমার ছেলে নিজের রুম ছেড়ে কেনো গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়েছে?’

‘আহ মা তুমি চুপ করো তো। ভাইয়া কেনো অন্য রুমে গিয়ে শুয়েছে সেটা তুমি ভাইয়াকেই জিঙ্গেস করো। ফারিহা কি ইচ্ছে করে ভাইয়াকে রুমে থেকে বের করেছে নাকি!’

চাঁদনীর কথা শুনে আমি সস্তির নিশ্বাস ফেলি। মেয়েটা আমাকে আসছি থেকে হেল্প করে যাচ্ছে।

‘আমি তোদের এসবের মাঝে নেই। বাপ ছেলে, মেয়ে সবাই তো আমার অবাদ্য। আমার কথার কি কোনো মূল্য আছে নাকি! তা বউ যখন হয়েই এসেছো এই বাড়ির তো এককাপ চা ও কি জুটবে না কপালে?’

‘মা ফারিহাকে আজকে কেনো রান্নাঘরে যেতে হবে ওর তো সবে কালকে বিয়ে হয়েছে।’

‘থাক না চাঁদনী আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

বলেই আমি রান্নাঘরের দিকে চলে এলাম। পিছনে তারা এখনো তর্ক করছে আমি নাকি এসেই চাঁদনী কেও যাদু করে নিয়েছি। এসবে কান দিলে চলবে না। আমার লক্ষ্য স্থির থাকা লাগবে। এখানে আমি বউমা গিরি করতে আসি নি। তবুও আমায় একটা সম্পর্কের টানে এগুলো করতে হবে। কিছু করলে তবেই তো কিছু পাবো!
.
চা বানিয়ে আমার শশুড় আর শাশুড়িকে দিয়ে ট্রে টা রান্নাঘরে রাখতে যেতেই পিছন থেকে আমাকে মুরতাসিম ডাকে।

‘আমি কি সকাল বেলা বড়য়ের হাতে চা টাও পাবো না?’

আমি কিছু না বলে আবারও রান্নাঘরে চলে এলাম চা বানাতে। আমার সাথে চাঁদনী ও আসে।

‘ভাবি ভাইয়া কিন্তু চা খায় না কফি বানিয়ে নাও।’

চাঁদনীর মুখে ভাবি ডাক শুনে আমি চমকে ওর দিকে তাকায়। আমি আসার পর থেকেই আমাকে নাম ধরেই ডাকে এখন আবার কি হলো!

‘আরে এতো চমকালে চলবে না আমি তোমায় সব নামেই ডাকবো।’

বিনিময়ে আমি মুচকি হেসে কফি বানাতে মন দিলাম। কত কিছু সহ্য করতে হবে এই বাড়ি তে থাকতে হলে কে জানে!
.
‘তোমার গান শুনেছি আমি ফারিহা। তোমার গানের গলা অনেক সুন্দর! তাই আমি একজনের সাথে যোগাযোগ করেছি। এখন তুমি ফেসবুকে গান গাও এক সময় সব জায়গায় তোমার গান থাকবে।’

মুরতাসিমেরর কথা শুনে আমি উনার দিকে আবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। লোকটা কিভাবে জানে যে আমি ফেসবুকে গান গাই। আমি উনার হাতে কফি দিয়ে বলি,

‘কিভাবে জানলেন?’

‘আরে তোমার ফেসবুকে গিয়ে জেনেছি তুমি গান গাও এতো অবাক হওয়ার কি আছে?’

‘কিন্তু ফেসবুকে তো আমাকে দেখা যায় না শুধু একটা ব্যাকগ্রাউন্ড এ গান গেয়ে এডিট করে তারপর ফেসবুকে আপলোড করি।’

‘তোমার কন্ঠ তো আমি ছিনি ফারিহা। আর তোমার বোনও বলেছে তোমার নাকি ছোটোবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো গায়িকা হওয়ার।’

‘ওহ। কিন্তু গানের গলা সুন্দর হলেই হয় না তারা মডেলিং করার মতো সুন্দর চেহারাও চায়।’

‘আমি তোমার গান একটা ডিরেক্টর কে পাঠিয়েছি। আমার বন্ধু হয় ও। ও বলেছে যে তুমি নিশ্চিত সিলেক্ট হবে।’

উনার কথা শুনে খুশিতে আমার চোখ মুখ চকচক করে উঠে। কত শত স্বপ্ন এই গান’কে নিয়ে আমার। আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো একদিন আমি অনেক বড় গায়িকা হবো। কিন্তু অনেকের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারি নি। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেই স্বপ্ন পূরণের গুটি হিসেবে বাছাই করলাম।

‘কিন্তু আপনি আমার জন্য এতো কিছু করছেন কেনো?’

‘তোমার স্বপ্ন পুরণে তোমার পাশে থাকতে চাই। আমার ইচ্ছে আমার বউ একদিন অনেক বড় কিছু হয়ে আমার মুখ উজ্জল করবে।’

‘কিন্তু আমি কারো সাহায্য চাই না তো!’

‘সাহায্য করছি না তোমাকে আমি। আমি তো আমার বন্ধুকে একজন ভালো কন্ঠশিল্পী খুজে দিয়ে ওকে হেল্প করছি।’

‘ওহ আচ্ছাহ। তা আমি যদি কখনো সেলিব্রটি হয়ে যাই তখন যদি আপনাকে ভুলে যাই তখন?’

আমি জানি উনি আমাকে হেল্প করছেন। আমাকে হয়তো সেটা বুঝতে দেয়নি। তবুও আমি বুঝতে ফেরেছি। উনি হয়তো জানেন যে আমি উনার করা সাহায্য নিবো না তাই বলেন নি। আমি ও বুঝেও না বুঝার ভান ধরে আছি। আমার এখন এতো বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত না। সবকিছু বুঝেও আমার চোখে বিন্দুমাত্র কৃতঙ্গতার চাপ নেই।

‘তখন তুমি আমাকে পাত্তা না দিলে সেটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু আমার মন বলছে তুমি আমাকে ঠকাবে না।’

‘ওহ।’

‘আর হ্যা ওদের আমি তোমার নাম্বার দিয়েছি ওরা তোমাকে ফোন দিবে বলেছে।’

‘আচ্ছাহ ঠিকাছে।’
.
ফোনের ক্রিংক্রিং শব্দে বেলকনি থেকে রুমে এসে দেখি একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ফোন রিসিভ করতেই ফোনের অপর পাশ হতে একজন অচেনা ব্যাক্তির কন্ঠ বেসে আসে।

‘হ্যালো, আপনি কি মুরতাসিমেরর ওয়াইফ বলছেন?’

লোকটির প্রশ্ন শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। তারপর ও ভদ্যতা বজায় রেখে বলি,

‘জ্বী। আপনি কে?’

‘আমি তূর্য শিকাদার। টিভি চ্যানেল ডিরেক্টর এবং মুরতাসিমেরর বন্ধু। আপনাকে একটা দরকারে ফোন করলাম মিসেস মুরতাসিম!’

‘আমার নাম ফারিহা। নাম ধরেই ডাকতে পারেন। আর কি দরকার?’

‘আপনার গান আমি শুনেছি। আমাদের একটা অনুষ্ঠান আছে সেখানে যদি আপনি গান গাইতে চান তবে আমাকে বলবেন। হয়তো সেই অনুষ্ঠান থেকে আমরা আপনার সরাসরি প্রতিভা দেখতে পাবো। যদি আপনি সেখানো ভালো ভাবে গান তো আপনাকে আমরা আমদের একটা মুভির গানের জন্য সিলেক্ট করবো।’

ডিরেক্টরেরর কথা শুনে অতটা খুশি হতে পারলাম না। এখন নাকি আমাকে আমার প্রতিভা একটা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে দেখাতে হবে। তারপরও নিজেকে দাতস্থ করে বলি,

‘অনুষ্ঠান টা কবে?’

‘কালকে।’

‘আচ্ছাহ আমি রাজি কালকে আমি ওই অনুষ্ঠানে গান গাইবো। আপনি লোকেশন পাঠিয়ে দিবেন।’

‘লোকেশন পাঠানোর দরকার নেই মুরতাসিম ও এই অনুষ্ঠানে আসবে। আপনি ওর সাথেই চলে আসবেন ভাবি।’

‘ওকে স্যার।’

‘বেস্ট অব লাক।’

তূর্য শিকদার ফোন কাটলেন। আমি গিয়ে চাঁদনী কে খবর টা দিলাম। ও খুশি হয়ে বললো,

‘আমিও যাবো তোমাদের সাথে।’

‘আচ্ছাহ।’

‘তুমি ভাইয়াকে গিয়ে খবর টা দিয়ে আসো।’

বলেই চাঁদনী চলে যায়। আমি ও রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই।

চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃ্ষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here