হৃদয়হীনা পর্ব -০৩

#হৃদয়হীনা
Part–3
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

খাওয়ার টেবিলে প্রচুর হৈ-হুল্লোড় চলছে। সবার মুখে-চোখে আনন্দের ছাপ। আহনাফ-শায়েরী ডাইনিং টেবিলে এসে বসতেই শায়েরীর কাজিন বাহিনীর দল তাদের দুইজনকে ঘিরে ধরলো। আহনাফ শায়েরীর বিপরীতে বসতে চাইলেও তা আর হলো না। তার কাজিনরা বাধ্য করে তাকে শায়েরীর পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিল। পাশাপাশি বসতেই যে শায়েরী মিইয়ে গেল তা দিব্যি টের পাচ্ছে আহনাফ। মেয়েটা তার সঙ্গে বেশ আনকমফোর্ট তা বুঝে ফেলে সে। কিন্তু এতোগুলা মানুষের সামনে তো আর উঠে অন্য কোথাও বসা যায় না! বড্ড দৃষ্টিকটু দেখাবে বিষয়টা।

দুইজনের সামনেই খাবার চলে আসলো। দুপুরে আহনাফ ঠিকঠাক মতো খাওয়ার টাইম পায়নি। হুলুস্থুলের মধ্যে আরাম করে নিজের বিয়ের খাওয়াই খেতে পারেনি সে। বিরিয়ানি , রোস্ট, খাসির রেজালা, আলুর চপ, কাবাব, বোরহানি,জর্দাপোলাও, ফিরনি পরিবেশন করা হয়েছে তাদের সামনে৷ আহনাফ বেশীরভাগ সময়ই ডায়েটে থাকে।কিন্তু আজ বিয়ে উপলক্ষে ডায়েট হতে একদিনের ছুটি নিয়েছে সে।

তাদের প্লেটে খাবার তুলে দেওয়া হলে যেই না শায়েরী নিজের মুখে খাবার তুলবে ওমনি তার কাজিনরা এমন জোড়ে চিৎকার দিল যেন ঘরে আগুন লেগে গেছে। শায়েরী এক প্রকার ভড়কে গেল। তৎক্ষনাৎ তার কাজিনের দিকে তাকালে তারা আয়েশী দুষ্ট ভঙ্গিতে বলে, “বিয়ের পর নিজ হাতে নিজে খাওয়া ঘোর অপরাধ।একে অপরকে খাইয়ে দিতে হবে।” তার এক কাজিন বলে উঠে, “দুলাভাইয়ের কাছ থেকে হাত ধোয়া টাকাও আদায় করতে হবে কিন্তু।”

শায়েরীর তো নাস্তানাবুদ অবস্থা। সে মরে গেলেও সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে পারবে না। না মানে না। এটা অসম্ভব তার পক্ষে!
কিন্তু কাজিনদের জোড়াজুড়িতে সে পেরে উঠতে পারলো না। নিজেকে পরাজিত সৈনিক ভাবতে লাগে সে। অতঃপর, হাতে একটা কাঁটা চামচ তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ একটা কাবাব তুলে নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে আহনাফের মুখে পুড়ে দিল। কাজটা এতো দ্রুত ঘটলো যে আহনাফ বোকা বনে গেল। চামচ সহ কাবাব মুখে তুলে নিয়ে বসে থাকলো। কাবারের সাইজটা মোটেও ক্ষুদ্র ছিল না। ভালোই মোটাতাজা সাইজের একটা সম্পূর্ণ কাবাব মুখে পুড়ে ফেলে সে ভীষণ বিপাকে পরে যায়। মনে মনে শায়েরীকে বোকা মেয়ে বলে বকাও দিল সে।এতো বড় একটা পিস কেউ একবারে খাওয়ায়? শায়েরীর কী দানব মনে হয়? মুখের খাবার টা কোনমতে চিবিয়ে গিলে ফেলে, একঢোক পানি খেয়ে স্বস্তিবোধ করে সে।

এবার তার পালা, সেও শায়েরীকে এক প্রকার শায়েস্তা করার জন্য চামচে কাবাব তুলে নিল। এবার সে বুঝবে পুরা একটা কাবাব একবারে খাওয়া কতো কঠিন৷ কিন্তু তার ইচ্ছায় ভাটা দিল শায়েরীর কাজিনরা। আহনাফকে হাত দিয়ে খাইয়ে দিতে হবে।এটাই তাদের দাবী। চামচ দিয়ে না খাওয়ালে তারা হাত কীভাবে ধোয়াবে? আর হাত না ধোয়ালে হাত ধোয়া টাকাও পাবে না। সো দুলাভাইকে হাত দিয়ে পোলাও রোস্ট মেখে খাওয়াতে হবে।তাদের যুক্তি শুনে আহনাফ মিটমিট করে হেসে এক পলক শায়েরীর দিকে তাকায়। মেয়েটা লজ্জায় ইতিমধ্যে লাল হয়ে গেছে। টসটসে গাল দুটোতে লালভ আভা ফুটে উঠেছে। আহনাফ মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। কি স্নিগ্ধ চেহারা মেয়েটার। টানাটানা চোখ। নেত্রপল্লব বেশ ভারী। গাল গুলো বেশ ফোলা। মিডিয়া জগতে এমন ফোলা গাল থাকে না কারো। কিন্তু আহনাফের মধ্যে হচ্ছে ফোলা গালের মধ্যে একটা আদুরে ভাব আছে। গাল দুটোয় শুধু আদরই করতে মন চায়। সে পুনরায় মুচকি হেসে খাওয়ার প্লেটে হাত গুজলো৷ এরপর মিনিট দুই পোলাও আর রোস্ট নিয়ে যুদ্ধ করে এক লোকমা খাবার তুলে নিয়ে শায়েরীর পানে তাকাতেই তার বিরক্তির সীমা থাকলো না। মেয়েটা এতো অসমাজিক কেন? প্রতি পদে তাকে আপাদমস্তক করাই যেন তার প্রধান লক্ষ্য৷ হুহ!

শায়েরী ঘাড় সামান্য বাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরে আছে। আহনাফ হালকা কাশলো তাও তার ভাবান্তর নেই। মুখ ফিরে তার দিকে তাকালো না, কিন্তু মৃদ্যু কেঁপে উঠে। শায়েরীর এহেন বাচ্চামো কাণ্ডে তার কাজিনরাই হেসে দিল। আহনাফ হাসতে গিয়েও সৌজন্য বজায় রেখে হাসি চেপে রাখলো। এরপর নম্রতা বজায় রেখেই আস্তে করে বলে, “তাকাও এদিকে।”

শায়েরী সঙ্গে সঙ্গে তাকালো তার পানে। বেচারীর দৃষ্টি একজায়গায় স্থির নেই। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে বারংবার। যেন আহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকলে মেয়েটাকে শূলে চড়ানো হবে।সে তার মুখের সামনে খাবার আনলেও শায়েরীর খাবারটুকু মুখে তুলে নিতে বেশ জড়তা কাজ করছিল। তবুও বহু কষ্ট খাবার খাওয়ার জন্য মুখ খুলতেই আহনাফের শান্ত, সুস্থির, বাদামী দৃষ্টিজোড়ার সম্মুখীন হতে হয়৷ যার দরুন তার পুনরায় মাথা ঘোরানো বেরাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। দ্বিতীয়বার ঐ সর্বনাশা চোখ জোড়ার দিকে সে তাকালো না৷শরীর জুড়ে ক্রমশ অস্থিরতা এসে ঘূর্ণিঝড় পাকাচ্ছে যেন। নার্ভাসনেসের জন্য তার দ্বারা মস্ত বড় এক ভুল হয়ে যায়। সে ভুলে আহনাফের হাতের আঙুলে কামড় বসিয়ে দেয়৷ আহনাফ ব্যথা অনুভব করলেও সেই ব্যথা দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যায়। মুখে শব্দ করা থেকে বিরত থাকলেও তার চোখ-মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে শায়েরী বুঝে যায় সে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। শায়েরী মুখে খাবার নিয়েই নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। এদিকে উনি দ্রুত হাত সরিয়ে এনে বিড়বিড় করে বলে, “সবার সামনেই লাভবাইট দিয়ে দিয়ে হাতের আঙুলটা শেষ করে দিলে। ”

তার মুখ থেকে এমনকিছু শোনার পর শায়েরীর মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর সে সেই গর্তে মুখ লুকাক! কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি তার জন্য এটা।

একবার খাওয়ানোর পরও তার কাজিনরা ক্ষ্যান্ত হলো না। তারা হৈহৈ করে বলে, “একবার খাওয়ালে হবে না। মিনিমাম তিনবার খাইয়ে দিতে হবে।”

আহনাফ এবারে এক গাল হাসলো। এরপর শায়েরীকে উদ্দেশ্য করে লো ভয়েজে বলল, “এবারে দোহাই লাগে আর লাভবাইট দিও না। বেশি ভালোবাসা সহ্য হবে না। বদহজম হলে বিপদ!”

শায়েরী লজ্জায় নতজানু হয়ে পড়ে। ছুট লাগিয়ে পালিয়ে যেতে মন চাচ্ছে।তাকে খাইয়ে দেওয়ার পর, আহনাফকে পাঁচ হাজার টাকা হাত ধোওয়ানোর জন্য পকেট থেকে বের করতে হলো।

খাওয়ার পর্ব সমাপ্ত হলে তাদের দুজনকে ড্রয়িংরুমে এনে বসিয়ে দেওয়া হলো। এসময় আশেপাশে তার কাজিনদের পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা শায়েরীর রুমটা সাজানোতে ভীষণ ব্যস্ত। দুইজন পাশাপাশি অবস্থান করলেও কারো মুখে বাক নেই। দুইজনই চুপ। চারপাশে পিনপতন নীরবতা।শায়েরীর হাত বারবার ঘেমে ভিজে উঠছে।

আহনাফ ফোন চালাচ্ছিল। প্রায় আধঘন্টা পর সে বলে উঠে, আমি জানতাম মেয়েরা দুই মিনিট কথা না বলে থাকতে পারে না, বাট তুমি আমার ধারণা পাল্টে দিলে।

–” আমি আর দশটা মেয়ের মতো নই। আমি সাধারণ হলেও আমার মধ্যে কিছু অসাধারণ ব্যাপার আছে।”

— যেমন?

উদাহরণস্বরুপ যে কোনো কিছু বলবে সেই উদাহরণ শায়েরীর মাথায় আসলো না। আসলে তার মধ্যে কোন অসাধারণ গুণ নেই। না সে গান পারে, না আবৃত্তি! বরং সামনে থাকা মানুষটার পা থেকে চুল সবটাই বুঝি অসাধারণ! কথাও কি সুন্দরভাবে বলে সে!

শায়েরী মুখ ভার করে বললো, আসলে আমার মধ্যে কোন অসাধারণ গুণ নেই। আমি একটা বেগুণ।

তার কথা শুনে আহনাফ মুখ ঘুরিয়ে হালকা হাসল।

শায়েরী বলে উঠে, “তবে আমার একটা বিশেষ স্বপ্ন আছে। সবাই যেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য ছুটছে সেখানে আমি আকাশে উড়তে চাই।বাংলার আকাশে প্লেন চালাতে চাই। ”

— মানে?

— “এয়ারফোর্স অফিসার হতে চাই।”

আহনাফ প্রথমদিকে তার কথাগুলোকে আমলে না নিলেও শেষ বাক্যটা কর্ণপাত করার সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটাকে বেশ সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করতে লাগলো। এবং তার কাছে মনে হলো, মেয়েটা আসলে বড্ড অসাধারণ!

শায়েরীকে উদ্দেশ্য করে সে বলে উঠে, “তোমার এইম ইন লাইফটা খুবই চমৎকার, শায়েরী।”

এই প্রথম শায়েরী নামটা জোড়ে শব্দ করে উচ্চারণ করলো সে। কেমন ভালোলাগা ছেয়ে গেল তার মন জুড়ে। সে থেমে থেকে বলল, তবে লক্ষ্য পৌঁছাতে হলে ডিটারমাইন্ড থাকতে হবে কিন্তু!

শায়েরী নিভে যাওয়া গলায় বলে,” ডিটারমাইন্ড তো আছি।”

— বেশ তাহলে! বেস্ট অফ লাক।

শায়েরী তার দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে তাকালো। তার কাছে মনে হলো, সে বড়সড় কোন অপরাধ করে ফেলেছে। কিন্তু কী অপরাধ করেছে তা অজানা।

শায়েরী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আপনার জন্য আমার স্বপ্নটা কাঁচের মতো ভেঙে গুড়গুড় হয়ে গেল।”

— আমি, মানে আমি কি করলাম? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

শায়েরী আর দাঁড়ালো না। চোখ ভিজে উঠলো তার। সদ্য স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার আঘাতটা ফের মনের দরজায় করঘাত করা শুরু করতেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে গটগট করে হাঁটা দেয় অন্যদিকে। মাত্র যার প্রতিটা কাজে সে মুগ্ধ হচ্ছিল এখন তাকেই শায়েরীর বিরক্তির কারন মনে হচ্ছে। ঘৃণা করতে ইচ্ছা করছে তাকে।

আহনাফ তার চোখে জল দেখে চকিত দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে এবং বিড়বিড় করে বলে, “ভারী অদ্ভুত তো তুমি!”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here