হৃদয়হীনা পর্ব -০৬

#হৃদয়হীনা
Part–6
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রৌদ্রজ্বল আকাশটার দিকে একধ্যানে চেয়ে আছে আহনাফ। আকাশের ভেলায় ভেলায় মেঘের হাতছানিও আজ তাকে মুগ্ধ করতে পারছে না। চারপাশটা কেমন ঝিম ধরে আছে। এতো শোরগোলের মধ্যেও তার বুকের ভেতরটা নিস্তব্ধতায় দাউদাউ করছে৷ সিগারেট ঠোঁটে গুজে এক পলক চেয়ে থেকে সিগারেটটা ফেলে দিল।কোনদিকেই খেয়াল নেই তার। এমনই সময় ডিরেক্টর সাহেব তথা মাসুদ ভাইয়ের আগমণ ঘটে। উনি এসে আহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠে, “আহনাফ সবকিছু ঠিকঠাক? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সামথিং ইজ রঙ। আজকে শুটিংয়ে আসতে চাওনি তারপরও এলে যে?শরীর ভালো?”

আহনাফ কিছু বললো না। একদৃষ্টিতে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

উনি নিজ গরজে তাকিয়ে থেকে হতাশার শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে, “লিসেন, তোমাকে কিন্তু জোর করে এইসব সীন করানো হচ্ছেনা। স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে সবটাই তো তোমার অবগত।তারপরও এমন ব্যবহারে কিন্তু আমাকে আর আমার ইউনিটকে সূক্ষ্মভাবে ইনসাল্ট করা হচ্ছে।”

আহনাফ এবার ওনার মুখোমুখি তাকিয়ে করুন গলায় বলে, আমার হুট করে কী যেন হয়ে গেল ওইসময়। মাথায় রাগ চটে যায়। মনে হচ্ছিল ওকে ঠকাচ্ছি…..

মাসুদ ভাই পকেট থেকে দুটো’ সিগারেট বের করে একটা নিযে ধরালো এবং অন্যটা আহনাফকে দিয়ে বলে, “ইন্টারেস্টিং! নায়ক সাহেব আপনি আবার কাকে ঠকালেন?”

আহনাফ কিছুটা বিব্রতবোধ করে কোমল গলায় বলে, আসলে কালকে আমার আকদ ছিল।

— ওহ মাই গড!কান্ট বিলিভ! অভিনন্দন আহনাফ৷

— ধন্যবাদ,ভাই।ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হয়ে গেল। মিডিয়ায় এখনো জানানো হয়নি। আপনাকেই প্রথম জানালাম।

–” কে সেই ভাগ্যবতী?”

— ভাগ্যবান তো আমি। ( হালকা হেসে)

মাসুদ ভাই সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে বলে,” তুমি তো দেখছি বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো!”

আহনাফ শব্দ করে হেসে বলে, ও মনে হয় আমাকে পছন্দ করেনা। যার কারণে আমার মন-মেজাজের করুন দশা৷

মাসুদ ভাই এবার হোহো করে হেসে বলে, নাইস জোক! তোমাকে পছন্দ করেনা এইটা আমি বিশ্বাস করব?

আহনাফ জানালার নিকটে এসে দাঁড়ালো এবং স্মিত হেসে বলে, হয়তোবা এই বিয়ে ও মানতে পারছে না।নিজেকে আমার কাছ থেকে গুটিয়ে রাখছে। কারনটা কী জানি না। ওর বয়স কম এজন্য মেবি প্রস্তুত ছিল না বিয়ের জন্য।

–” তুমিও যে খুব বেশি বয়স্ক তা কিন্তু নয়! মেয়ে কী বেশি ছোট? সিক্স- সেভেনে পড়ে কিনা?

এবারে আহনাফ সত্যি হেসে বলে, আরে ধুর, এবার কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে। কিছুদিন পর বোর্ড এক্সাম। আম্মার পছন্দের মেয়ে। কোন এক অনুষ্ঠানে দেখেছিল৷ খুব নাকি পছন্দ হয় আম্মার। এরপর আর কি সব পারিবারিক ভাবেই হলো।

— আম্মার পছন্দেই বিয়ে করে ফেললে?

আহনাফ লজ্জা পাওয়া গলায় বলে, বহু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম জীবনে আর যাই করি না কেন , আম্মার পছন্দে বউ আনব। নিজের পছন্দের উপর ট্রাস্ট নাই। আর আম্মা সবসময়ই আমার জন্য বেস্টটাই খুঁজে বের করে। আমি শায়েরীকে সাত-আট মাস ধরে চিনি। আম্মা ওর ছবি, ফেসবুক আইডি দিয়েছিল। প্রথম থেকেই ভালো লেগেছিল ওকে। এজন্য ডিরেক আকদ করে ফেললাম।কিন্তু এক মোলাকাতেই যে ওর প্রেমে এমনভাবে ঘায়েল হবো এটা জানা ছিল না।

মাসুদ ভাই বলে উঠে, তোমার উচিত ভাবীজানের সঙ্গে সময় কাটানো। আমাকে আগে জানাতে যে কালকে তোমার বাসর ছিল। আমি নিশ্চয়ই এতোটাও পাষাণ না যে বাসর থেকে উঠায় এনে শুটিং করাব?

আহনাফ একগাল হেসে বলে, রাগ করে চলে এসেছি ওর কাছ থেকে। কাল সারারাত ও জেগে ছিল কিন্তু এমন এক ভান ধরলো যেন সে ঘুমে! অভিনয় করলো আমার সাথে। কিন্তু সে তো জানে না অভিনয়ে আমি কতো বড় খেলোয়াড়!

— “আই থিংক ভাবীর টাইম দরকার। মেয়েরা এইসব ব্যাপারে একটু সেন্সিটিভ হয়। ভয় পায় অকারণে। ভয় পাচ্ছে সম্ভবত!”

— আমি তো আর আদিমযুগের বন্য মানুষ নই যে ভয় পাবে৷

— বেশ ভালোই রেগে আছো। যাইহোক বলো কী খাবে দুপুরে? আমি ট্রিট দিব।

আহনাফ সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বলে, হাঁসের মাংস আর লুচি খাব।

— ব্যবস্থা করছি। ভাবীজানের সঙ্গে কথা বলো আর এক কাজ কর, ওনার কাছে পারমিশন নাও যে অন্য কোন নায়িকার সঙ্গে রোমান্স করতে পারবা কীনা?

আহনাফ পুনরায় খুব সুন্দর করে হাসলো।

মাসুদ ভাই থেমে থেকে বলে উঠলেন, গড ব্লেস ইউ ইয়ং ম্যান!

___________

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। চারিদিকে কুয়াশা ছেয়ে গেছে। শীত শীত করছে আহনাফের। সে সঙ্গে সোয়েটার আনেনি। ইউনিটের কাউকে বলে সোয়েটারের ব্যবস্থা করতে হবে। সে পা বেরিয়ে বিছানায় এসে ঘাপটি মেরে বসে ফোনটা হাতে নিল।নিজেকে বুঝ দিল,সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকেই এগিয়ে আসতে হবে।

ফোন দিবে না দিবে না করেও ফোন লাগালো শায়েরীর নাম্বারে। চারবার রিং হতেই ওপাশ থেকে পরিচিতি আওয়াজে বলে উঠে, হ্যালো?কে বলছেন?

কণ্ঠস্বর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আহনাফের মনটা হুট করে শান্ত হয়ে গেল। সে মিস্টি হেসে বলে, আমাকে চেনো?ওই যে কালকে তোমাদের বাসায় আসলাম যে?

ওপাশ থেকে সম্ভবত শায়েরী চমকে গেল। সে কাপাটে গলায় বলে, আ-আপনি?

— যাক তাও চিনলে। ভাবলাম ভুলে গেছো।

— ভুলব কেন?

— মনেই না কেন রাখবে?

ওপাশ থেকে পিনপতন নীরবতা। আহনাফ বলে উঠে, রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল?

–হু।

— দুপুরে খেয়েছো?

একথায় অপরপ্রান্তের ব্যক্তি খামোশ রইল। আহনাফ খুব সুন্দর করে হাসলো এরপর বলে উঠে, আমি না সঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কার উপর রেগে আছো?আমার উপর? নাকি খাবারের উপর? হু?

এবারও ওপারের হৃদয়হীনা রমনী নিশ্চুপ। আহনাফ বলে উঠে, আমাদের ইউনিটের যে রাঁধুনী আছে উনি দুর্দান্ত শেফ। ওনার হাতের গরুর রেজালা আর কাতলা মাছ দিয়ে মটরশুঁটি সেরা! একবার এসো তোমাকে গরুর রেজালা খাওয়াব। তুমি কী মাছ খেতে পছন্দ করো?

এবারে সে মুখ খুললো এবং অপ্রস্তুতভাবে বলে, মাছ তেমন একটা পছন্দ না।

— আমি আবার মাছপ্রেমী। সব ধরনের মাছ আমার প্রিয়ের তালিকায়। মাছে-ভাতে বাঙ্গালী আমি। সবচেয়ে পছন্দ সরষে ইলিশ। যাইহোক অনেক কথা বললাম। তুমি মেবি পড়াশোনা করছিলে? ডিস্টার্ব করলাম?

শায়েরী পালটা প্রশ্ন ছুড়লো, কবে ফিরবেন আপনি?

— তুমি কবে চাও আসি?

শায়েরী যেন কিছুটা হতবিহ্বল হলো যা ফোনের এপাশ থেকে কিলোমিটার দূর থেকে আহনাফ বুঝে গেল।

সে মিনমিন গলায় বলে, আজকে আসলে ভালো হয়।

আহনাফ আর কিছু বলবে এর আগেই ফোন কেটে গেল। সে মুচকি হেসে রুম থেকে বের হলো। তার এখন ফেরা দরকার।মাসুদ ভাইকে বলে এক-দুই দিনের আর্জেন্ট লিভ নিবে। বউ ডাকলে কী না গিয়ে পারা যায়?

মাসুদ ভাইকে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। সাথে বেশ কিছু পরামর্শও দিলেন। রাত নয়টার আগেই আহনাফ গাজীপুর থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে।

★★★

শায়েরী মাত্র খেয়ে-দেয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসলো। সকাল থেকে সে একমিনিটের জন্যও ঘর থেকে বের হয়নি। বিছানায় শুয়েই ছিল। এমন কি দুপুরেও তাকে জোর করে কেউ খাওয়াতে পারেনি। কিন্তু ওনার সঙ্গে কথা হওয়ার পর সে রুমের বাইরে গেল। কাজিনদের সঙ্গে গল্প করলো।এরপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবারও টিভি দেখার জন্য ড্রয়িংরুমে এসে বসলো। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা এখনো চলে যায়নি। কাল-পরশু আস্তে আস্তে তারা বিদাই নিবে। খাওয়ার টেবিলে এখনো সবাই খাচ্ছে। তার দ্রুত খাওয়া শেষ হয়ে যায়। সোফায় গা এলিয়ে বসতেই কলিং বেল বেজে উঠল। সে বিরক্ত হলো। এই সময় আবার কে?দুটো দিন ধরে আওয়াজ শুনতে শুনতে সে প্রচুর বিরক্ত৷ মা খাওয়ার রুম থেকে বলে উঠে, শায়েরী একটু গেটটা খুল তো মা! আমরা খাচ্ছি।

খুলে দিচ্ছি বলে দরজার কাছ এসে লক খুলতেই সে পিলে চমকে উঠে। ভূত দেখলেও সে এতো অবাক হত না যতোটা সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে অবাক হলো সে।নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। উনি দাঁড়িয়ে আছেন! তার এক আহ্বানে সত্যি সত্যি কাজ ফেলে চলে এলো মানুষটা? শায়েরী আবেগে আপ্লূত হলেও তা প্রকাশ করলো না।

ততোক্ষণে চাচী এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। ওনাকে দেখা মাত্র জামাই আদর দিয়ে ঘরে ঢোকালেন। এরপর তাকে নিয়ে সবার হৈচৈ পড়ে গেল। সবার একটাই প্রশ্ন সকালে উনি কেনই বা গেলেন আর এতোরাতেই বা কেন ফিরে এলেন? উনি মুখ কাচুমাচু করে বলে উঠে,” একটা জরুরি কাজ পরে গিয়েছিল।”

ওনার কথায় চাচীসহ সবাই ঠোঁট টিপে মিটমিট করে হাসলেন। শ্রুতি বলে উঠে, ভাইয়া জানো না তো! তুমি চলে গেছো জন্য আপু আজ দুপুরে খাবারই খায়নি। এমনকি মেহেদীও পড়লো না।

শায়েরী বোনের কথায় টাস্কি খেল। শ্রুতি একদিনের মাথায় তাকে আপনি থেকে তুমি বলে ডাকছে। আবার উনি এখন বাবার সঙ্গে হাত নেড়ে কথা বলছে। একদিনেই তার পরিবারের সঙ্গে এতো দ্রুত মিশে গেলেন কীভাবে?

আহনাফ শ্রুতির কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে দারুণ সুন্দর করে হাসলো। উফ! এই হাসির দিকে তাকিয়ে থেকেই শায়েরীর বুকে কম্পন ধরে গেল। চোখে পানি এসে গেল। সে সাবধানে চোখের পানি আড়াল করল।

আজকে আহনাফ বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে সত্যিই ঘুমিয়ে গেল। এরমাঝে শায়েরী তাকে নিজ হাতে শরবত বানিয়ে এনে খাওয়ালো। শরবত খেয়ে শরীরে ঘুমটা ঝেঁকে ধরল৷ ক্লান্তিতে মাখা শরীরটা এলিয়ে দিতেই সে ঘুমে জল। শায়েরী কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে সন্তপর্ণে বিছানায় এসে তার পাশে চুপিসারে শুয়ে পড়ে।

পরদিন আহনাফ সকাল এগারোটায় উঠে। উঠেই কিছুটা ব্যস্ত হয়ে সে ওয়াশরুমে ছুটে গেল। ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে যেতেই শায়েরীর দেখা মিলল৷ শায়েরী তাকে দেখামাত্র নাস্তা সাজানো শুরু করে। তার পরনে সেইদিনকার ওই গোলাপি শাড়ি৷

আহনাফ বিড়বিড় করে বলে, “উফ এই শাড়িটা কেন পড়লে? তুমি কী জানো না! এই শাড়িতে তোমাকে মারাত্মক লাগে। এই লুকে তোমাকে দেখলে মনে হয় হৃদপিণ্ডটা কেউ খামচে ধরেছে৷”

সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে খেতে বসলো। আহনাফ জিজ্ঞেস করে, ” শ্রুতি কই?”

— ও স্কুলে গেছে।

— ওহ। আজকে কী বার যেন?

— বুধবার।

–তুমি কলেজে গেলে না?

শায়েরী এ প্রশ্নে থেমে গেল। ক্ষণেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলে,” প্রয়োজন নেই যাওয়ার।”

আহনাফ নাস্তা মুখে দিয়ে বলে উঠে, এক্সামের আগে আগে মিস না দেয়াই ভালো।লাস্টের দিকে টিচাররা সাজেশন দেয় যা কাজে আসে।

— আমি তো এ বছর এক্সাম দিচ্ছি না।

তার কথা শুনে আহনাফ আকাশ থেকে পড়লো। সে থমথমে গলায় বলে, কিন্তু কেন?

–” সেটা আপনি ভালো জানেন।”

— আশ্চর্য! তুমি কেন এক্সাম দিবে না এটা আমি কীভাবে জানব? বোর্ড এক্সাম না দেওয়ার মানে এক বছর লস!

শায়েরী কিছুটা শান্ত হয়ে বলে, চায়ে চিনি খান?

আহনাফ এবারে কিছু রেগে গিয়ে বলে, এক্সাম কেন দিবে না? এটার উত্তর দাও। কোন সমস্যা আছে তোমার?

শায়েরী তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। আহনাফ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here